হিজাব শুধু মাথার উপর এক টুকরো কাপড় নয়, জীবনাচরণের পদ্ধতিও
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ০৩ আগস্ট, ২০১৬, ০৫:৩১:৩৯ বিকাল
মূল: আসমা বিনতে শামীম
অনুবাদ: গাজী সালাউদ্দিন
হিজাব শুধু মাথার উপর এক টুকরো কাপড় নয়, জীবনাচরণের পদ্ধতিও
কিছু বোন মাথা ঢেকেই মনে করে হিজাব পূর্ণ হয়ে গেছে। তারা উপলব্দি করেনা, হিজাবের পরিপূর্ণতা শুধু মাথা ঢাকার চাইতে বেশি কিছু। আল্লাহ্ বলেন:
“ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও”। (সূরা আন নূ: ৩১)
আমার মাথা ঢাকা, এর বেশি কি করতে হবে?
যদি আপনি এই আয়াতটি ভালো করে দেখেন, স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে, মাথার কাপড় ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত টেনে দেওয়া উচিৎ। খুমুর আরবি শব্দ ‘খিমার’ এর বহুবচন। যার অর্থ মাথা ঢেকে রাখা। তবুও কিছু বোন শুধু মাথা ঢেকে রেখেই ভাবে হিজাবের কাজ পূর্ণ করে ফেলেছে, অথচ তাদের চুল বা শরীর দেখা যায়, অথবা সমস্ত ঘাড় এবং বুকের উপরের অংশ অনাবৃত থাকে।
প্রকৃতপক্ষে এমনটি জাহিলি যুগের নারীদের রীতি। আল কুরতুবী বলেন: “তখনকার দিনে (জাহেলী যুগে) নারীরা ‘খিমার’ দ্বারা নিজেদের মাথা ঢেকে নিত, আর এর প্রান্ত পিঠে ছেড়ে দিতো। এতে করে তাদের কানসহ ঘাড় এবং বুকের উপরের অংশ খোলা থাকতো। তারপর আল্লাহ্ নির্দেশ দিলেন, তারা যেন ‘খিমার’ দ্বারা উক্ত অংশগুলো ঢেকে নেয়”। সুতরাং মুখের চারিপাশে স্কার্ফটি উত্তমরূপে বেঁধে নিন, সাথে ঘাড় এবং বুক ঢেকে নিন।
দুঃখিত, টাইট জিন্স এবং শর্ট শার্ট পরিহার করুন
মাথাকে এক টুকরো কাপড় দিয়ে ঢেকে টাইট জিন্স আর শর্ট শার্ট পরে বলতে পারেন না এটা হিজাব। শরীরের গঠন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এমন টাইট কিছু পরা যাবেনা, যদিও তা লম্বা হয়। আমাদের নবী (সা) বলেছেন: ‘দুই প্রকারের জাহান্নামী আমি এখনো দেখিনি। একপ্রকার হলো, ওই সম্প্রদায় যাদের হাতে গরুর লেজ সদৃশ চাবুক থাকবে। তারা এসব চাবুক দ্বারা (অন্যায়ভাবে) লোকদেরকে প্রহার করতে থাকবে। আর আরেক প্রকার সেসব নারী যারা কাপড় পরিধান করার পরেও উলঙ্গ থাকবে। তারা (পুরুষদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও (পুরুষদের দিকে) আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা হবে সম্মুখে ঝুঁকে পড়া উটের কুঁজের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না; এমনকি তারা জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ অনেক অনেক দূর থেকেও পাওয়া যাবে’ (মুসলিম)।
রঙ চড়ানো বা কারুকার্যখচিত কাপড় এড়িয়ে চলা উচিৎ
মাথা অথবা শরীর ঢাকার জন্য রঙ চড়ানো বা কারুকার্যখচিত কাপড় পরিহার করা উচিৎ। গায়ের চামড়া দৃশ্যমান হবেনা, এমন কাপড় পরিধান করুন।
আল্লাহ্র রাসূল (সা) একবার উপহার হিসেবে একটি মোটা কাপড় পেলেন। তিনি তা উসামা এবনে জায়েদকে (রা) দিয়ে দিলেন। জায়েদ (রা) দিয়ে দিলেন তাঁর স্ত্রীকে। রাসূল তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তিনি তা পরেন নি? উসামা ইঙ্গিত দিলেন তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে দিয়েছেন। তারপর রাসূল (সা) উসামাকে (রা) বললেন: “তুমি তাকে এর নিচে একটি গোহালা পরতে বলবে। আমার ভয় হয়, এই কাপড়টি পরলে তার শরীরের হাড়ের সাইজ দেখা যাবে”.। (আবু দাউদ) আরবি গোহালা শব্দের মানে শরীরের গঠনকে প্রকাশ না করতে জামার নিচে পরা একটি মোটা কাপড়।
আকর্ষণ করার জন্য হিজাব নয়
কাপড় এমন হওয়া উচিত নয় যা পুরুষকে নারী সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ করে। আল্লাহ পরিষ্কারভাবে বলেছেন: “তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে”।
তবুও কিছু বোন এমনভাবে হিজাব পরে, যার ফলে তাদের এতোটা আকর্ষণীয় লাগে, হিজাব না পরলে এতোটা আকর্ষণীয় লাগতোনা। আকর্ষণীয় ডিজাইনে করা হিজাবে জিনা কমেনা, বৈ বাড়ে, এবং হিজাবের উদ্দেশ্যকে ভ্রূকুটি করে।
আল্লাহ্ বলেন: “এবং তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান কর, আর জাহিলি যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করোনা”। (আল আহযাব: ৩২)
সাজ সজ্জা এবং সুগন্ধি
সাজ সজ্জা দূষণীয় নয়, তবে তা নন মাহরামদের নিকট প্রদর্শন করা জিনার অংশ। কেননা আল্লাহ্ সাজ সজ্জা প্রদর্শনী করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। সুতরাং মাথা এবং শরীর উত্তমরূপে ঢেকে স্কার্ফে উজ্জ্বল লাল ক্লিপ আর চোখ কসমেটিক দ্বারা রঙ্গিন করে বাহারি সাজে বের হওয়া হিজাব নয়। সুগন্ধি ব্যবহার শুধু স্বামীর জন্য, পর পুরুষের জন্য নয়।
আল্লাহ্র রাসূল বলেছেন: “কোনো নারী সুগন্ধি ব্যবহার করল, তারপর পুরুষের পাশ দিয়ে গেল, যাতে তারা তার সুগন্ধি পায়, সে একজন ব্যভিচারিণী”। (আন নাসায়ী, তিরমীজি)
স্বর্ণ গয়নার টুংটাং এবং ব্রেসলেটের ঝনঝন শব্দ
স্বর্ণ গয়না, ব্রেসলেট, হাই হিল জুতা, কাপড়ে ছোট্ট ঘটি ইত্যাদি যদি টুংটাং ঝন ঝন শব্দ করে, তা হিজাবের পরিপন্থী। কারণ এগুলো মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
নন মাহরামের সাথে হাসি, ঠাট্টা, একত্রে উঠবস করা যাবেনা
কিছু বোন মনে করে যে, তারা যেহেতু শরীর ভালোভাবে ঢেকেছে, তাই নন মাহরাম পুরুষের সাথে বসা, কথা বলা, হাসাহাসি ঠাট্টা ইত্যাদি করাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু না, এটা ঠিক নয়, যদিও সে শায়েখ হয়।
আল্লাহ্ বলেন: “... তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলোনা...”। তবে নির্দিষ্ট প্রয়োজনে (বিধিসম্মত) থাকে, তাহলে তাদের সাথে কথা বলা যাবে, আর তা কর্কশ ভাষায় হবে না, হবে ভদ্র ভাষায় কিন্তু কোমলতা না দেখিয়ে।
যা পুরুষের চোখে পড়ার মত, তা হিজাব নয়
উপরের আয়াতে আল্লাহ্ দৃষ্টিকে অবনত রাখতে বলেছেন। কেন? কেননা, একটি সিঙ্গেল দৃষ্টি হাজারটা কথার চেয়ে বেশি কিছু বুঝিয়ে দেয়। সুতরাং, যদিও আপনি ভালোভাবে শরীর ঢেকে রেখেছেন, তবুও দৃষ্টিকে অবনত রাখতে হবে, লজ্জাকে জলাঞ্জলি দেওয়া যাবেনা, আর ফিতনা থেকে দূরে থাকতে হবে।
হিজাব করে ইন্টারনেটে চ্যাটিং অথবা ফোনালাপ নয়
‘আমরা শুধুই ফ্রেন্ড’, এই কথা বলার সুযোগ নাই। নন মাহরামের সাথে কথা বলা, যদিও তা ইন্টারনেট অথবা মোবাইলের মাধ্যমে হয়, তা সঠিক নয়। অবৈধ সম্পর্ক, ব্যাভিচার, সংসার ভাঙ্গন, বিবাহ বহির্ভূত প্রেম ইত্যাদি তো চলছেই। এই কারণেই ইসলামে যেসব জিনিস হারাম কাজে উদবুদ্ধ করে, তাও হারাম।
আল্লাহ বলেন: “আর ব্যাভিচারের কাছেও যেওনা, নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ”। (সূরা বনী ইসরাইল: ৩২)
চলার পথে সতর্ক থাকুন
মনে রাখবেন, আপনি মডেল নন যে, নতুন নতুন ফ্যাশন দেখিয়ে হাঁটবেন। লজ্জা এবং শালীনতার সাথে হাঁটুন, তাতে করে আপনি সম্মানিত হবেন। রাসূল (সা) বলেন: “দুই প্রকারের জাহান্নামী আমি এখনো দেখিনি…... যারা কাপড় পরিধান করার পরেও উলঙ্গ থাকে...” (মুসলিম)
নন মাহরামের সাথে হেন্ডশেইক বৈধ নয়
ইসলামে নন মাহরামের সাথে হেন্ডশেইকের অনুমোদন নেই, কারণ রাসূল (সা) বলেছেন: “তোমাদের কারো মাথায় ছুরিকাঘাত অনেক ভালো একজন নারীকে স্পর্শ করার চেয়ে, যাকে কিনা স্পর্শ করার অনুমতি নেই”।
তবে নন মাহরামের সাথে হেন্ডশেইকের প্রস্তাব রুক্ষভাবে প্রত্যাখান করা উচিত নয়, বরং ভদ্রভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যে, আপনার ধর্মে বিষয়টা বৈধ নয়।
পুরুষের সমাগম থেকে দূরে থাকুন
প্রায় দেখা যায়, অনেক বোন পুরুষের প্রবেশ পথ দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করে। তা ঠিক নয়। এমন জায়গায় দাঁড়ানো ঠিন নয়, যেখানে পুরুষের সাথে মিক্সিং এর সম্ভাবনা থাকে।
অপর বোনের কোনো বিষয় রাখাও হিজাব
যদিও অনেক বোন নিজেরাই হিজাব পরে, অথচ তারা ভুলে যায়, তারা অন্য বোন এবং তার সৌন্দর্য সম্পর্কে নিজেদের স্বামী, ভাইদের নিকট বর্ণনা করা যাবেনা। মনে রাখা দরকার, অপর বোনের কোনো কিছু গোপন করাও হিজাবের অংশ। রাসূল (সা) বলেছেন: ‘কোনো নারী যেন তার অনাবৃত শরীর অন্য কোনো নারীর অনাবৃত শরীরের সাথে না লাগায় এবং সে যেন তার (অপর নারীর) - শারীরিক সৌন্দর্য নিজের স্বামীর নিকট এমনভাবে বর্ণনা না করে, যেন সে তাকে সচক্ষে দেখছে।’ [বুখারি ও মুসলিম]
আল্লাহ্ আমাদের বোনদেরকে উক্ত বিষয়গুলো যথাযথভাবে উপলব্দি করে আমল করার তাওফীক দিন।
মূল লিংক
Click this link
বিষয়: বিবিধ
২১০৯ বার পঠিত, ২৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালোলাগা অব্যাহত রাখুন
আপনাকেও ধন্যবাদ
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
আপনার ধন্যবাদ স্বানন্দে গ্রহণ করলাম।
জাযাকাল্লাহু খাইর
বেশি নয়, একজনও যদি মেনে চলে, তাই বা কম কিসে। ঠিকি বলছেন, পুরুষ পর্দা মেনটেইন না করলে নারীকে দিয়ে করানো কঠিন।
আপনাকে ধন্যবাদ ব্রাদার
ওমর সিরিজের ৩০ পর্বের মধ্যে ৯ ও ১০ এর অনুবাদ আমি করে দিয়েছি, এখন করছি সর্বশেষ দুই পর্ব ২৯ ও ৩০ এর।
জাযাকাল্লাহু খাইরান
খুশী লাগছে!
আরও অনেক দূর এগিয়ে যান।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
শুকরিয়া শুকরিয়া
ইনশাআল্লাহ্। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাবো। আপনাদের সঙ্গ বাড়তি প্রেরণা দেবে নিশ্চয়।
জাযাকাল্লাহু খাইরান
খুব দেরি হয়ে গেল রিপ্লাই দিতে। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি.
আপনাকেও ধন্যবাদ শেখ ভাই
আল্লাহ্ আমাদের বোনদেরকে উক্ত বিষয়গুলো যথাযথভাবে উপলব্দি করে আমল করার তাওফীক দিন। ছুম্মা আমিন
আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমিও খুশি হলাম।
খুব দেরি হয়ে গেল রিপ্লাই দিতে। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি.
আপনার দোয়ার সাথে আমীন
আপনার দোয়ায় আমীন
খুব দেরি হয়ে গেল রিপ্লাই দিতে। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি.
হারিয়ে যাইনি যাওয়ার ইচ্ছাও নেই বুবু।
নানান কারণে সময় হয়ে ওঠেনা সবসময়।
খুব চেষ্টা থাকবে নিয়মিত হওয়ার। দোয়া করবেন বুবু।
খুব দেরি হয়ে গেল রিপ্লাই দিতে। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি.
মন্তব্য করতে লগইন করুন