ফেলানীরা ফেলনাই থেকে যায়
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ০৭ জানুয়ারি, ২০১৬, ০১:৫৫:০২ দুপুর
ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি খুন নিত্য দিনের ঘটনা। নিয়মিত হয় বলে হত্যাগুলো বাংলাদেশের মানুষ কিংবা সরকারের কাছে খুব একটা গুরুত্ব বহন করেনা, দেখা হয় আর দশটা ঘটনার মত করেই। এইসব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মিছিল মিটিং ও খুব একটা দেখা যায়না, কেননা তারা সাধারণ মানুষ, পেটের দায়ে গরু ব্যবসায়ী অথবা ভারতে কাজ পাওয়ার আশায় অবৈধ অনুপ্রবেশ কারী। তাই সীমান্ত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকেও কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ে না।
কিন্তু বিএসএফের বর্বতার শিকার, গুলি খেয়ে পাখির মত তারকাটায় ঝুলে থাকা ফেলানীর নির্মম পৈশাচিক মৃত্যু বিশ্ববিবেক কে প্রশ্ন বিদ্ধ করেছিল। সেই ফেলানীর মরে গিয়ে ঝুলে থাকার ৫ বছর হল আজ। ফেলানীতো চলে গেল না ফেরার দেশে, পরিবার পেয়েছে কি সঠিক বিচার?
বিচারের বাণী নিরবে কাঁদে, এ কথাটি ফেলানীর মত খড়কূটেদের জন্য একটু বেশিই প্রযোজ্য। ফেলানী মরেছে, বিশ্বও অবাক বিস্ময়ে দেখেছে, সহানুভূতিতে হৃদয় বিগলিত হয়েছে, টিভিগুলো ব্রেকিং প্রতিযোগিতায় মত্ত থেকে দর্শপ্রিয়তা পেয়েছে, তাজা খবর ছাপিয়ে স্পেশাল প্রতিবেদন করে প্রিন্ট পত্রিকাগুলোর বিক্রি বেড়েছে, অনলাইন মিডিয়াগুলোর এলেক্সা র্যাং কিং চূড়ায় উঠেছে, কিন্তু বলার মত কি করতে পেরেছে ফেলানীর জন্য? তার দরিদ্র বাবা মা কি পেয়েছে ন্যায় বিচার, যা সন্তান হারা বুকে অসীম শূন্যতার মাঝে দিতে পারে একটু খানি সান্ত্বনা? পারেনি!
ফেলানী বিচার পাবেনা, এটা অনুমিতই ছিল এবং হয়েছেও তাই। ফেলানী হত্যার রায়ের মূল অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে নির্দোষ বলে রায় দিয়েছে আদালত। প্রশ্ন হল, অমিয় ঘোষ যদি নির্দোষ হয় প্রকৃত দোষী কে? ফেলানী কি বজ্রপাতে মারা গেছে অথবা কোন অদৃশ্য শক্তি এসে মেরে তাকে ঝুলিয়ে গেছে? নাকি ভারতীয় সীমানায় অনুপ্রবেশ করলেই গুলি করে মারার বৈধতা রয়েছে? ফেলানীর ছোট্ট শরীরটা এতোই দানবাকৃতিতে উপস্থিত হয়েছিল বি এস এফ সদস্যের সামনে যাকে গুলি করে থামানো ছাড়া কোন উপায় ছিলনা? তাকে ধরে শাস্তি দেয়া যেত কিন্তু মারল কেন?????
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফুলবাড়ীর অনন্তপুর সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় বিএসএফ জওয়ান অমিয় ঘোষের গুলিতে নিহত হয় বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী।
২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে খালাস দেন বিশেষ আদালত। ২০১৫ সালে মামলার পুনর্বিচারেও একই রায় বহাল রাখেন আদালত। ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারের বিএসএফের বিশেষ আদালতে ফেলানী হত্যার বিচারকাজ শুরু হয়।
দীর্ঘদিন মুলতবির পর বিজিবি-বিএসএফের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্তে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ফেলানী হত্যা মামলার পুনর্বিচার কার্যক্রম শুরু করেন বিএসএফের বিশেষ আদালত। এরপর এ বছরের ৩০ জুন বিএসএফের বিশেষ আদালতে পুনর্বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। কঠোর গোপনীয়তায় তিনদিন বিচারিক কার্যক্রম চলার পর এ রায় ঘোষণা করা হয়।
অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে ভারতীয় দন্দবিধির ৩০৪ ধারায় (অনিচ্ছাকৃত) খুন এবং বিএসএফ আইনের ১৪৬ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ কারাডন্ড এবং সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু কোন শাস্তি না পেয়েই খালাস!
অমিয় ঘোষ দোষ স্বীকার করে বলেছে, হত্যাটি অনিচ্ছাকৃতভাবেই হয়েছে। এমন প্রশিক্ষিত একটি বাহিনীর অনিচ্ছাকৃত ভুলে একটি নিষ্পাপ মেয়ের মৃত্যু কিভাবে মেনে নেয়া যায়? তাও বিনা বিচারে ছাড়া পেয়ে যায় ঘাতক! আবার বিচার হল কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে, কিন্তু কেন? প্রকাশ্যে হলে কি হত? সত্যকার অপরাধী ধরা পড়ে যেত, তাই এতো গোপনীয়তা।
সব দোষ, ফেলানীর বাবার, অমিয় ঘোষ নির্দোষ। তাহলে গুলি কেন বাবার গায়ে না পড়ে মেয়ের গায়ে পড়ল? ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম বলেন, “অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার অপরাধে আমাকে আইনের মাধ্যমে শাস্তি দিতে পারতো। কিন্তু আমার নিষ্পাপ মেয়ে ফেলানীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করতে পারে না”। যৌক্তিক বলেছেন হতভাগ্য বাবা।
অনুপ্রবেশ করাই যদি ফেলানীর দোষ হয়ে থাকে, তাহলে তাকে ধরে বিচারের আওতায় আনা যেত। তা না করে গুলি করে হত্যা নিঃসন্দেহে খুনের অপরাধে অপরাধী। তার বিচার ভারত করেনি, অথচ তারা নাকি বিশ্বের সবচাইতে বড় গণতান্ত্রিক দেশ!
পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ মাসুম বলেছে, এই রায় ভারতের সংবিধান ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। আমরাও তাই মনে করি। বড় কথা, ফেলানী যে বিএসএফের গুলিতেই নিহত হয়েছিল, তা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
ভারতের সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, ভারতীয় ভূখণ্ডে যারাই থাকবেন, তাদের সবারই অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ফেলানীর হত্যাকারীকে নির্দোষ ঘোষণা করায় এই অধিকার স্বীকৃত হয়েছে, যে কেউ ভারতীয় সীমানায় অবৈধভাবে প্রবেশ করবে, তাকেই গুলি করে হত্যার অধিকার রাখে বিএসএফ।
ভারতের জাতীয় কমিশনের তরফে বলা হয়েছিল, নির্মম ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য ফেলানীর পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক। আদালত বলেছে অমিয় ঘোষ নির্দোষ অথচ ভারতের জাতীয় কমিশন ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছে। প্রশ্ন হল, যদি অপরাধ নাই করে থাকে তাহলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা আসল কেন? যার মানে হল, অপরাধ করে ক্ষতিপূরণ গিয়ে দায়মুক্তি পাওয়া যায়! আর ক্ষতিপূরণ দিয়েতো তখনি দায়মুক্তি পাওয়া যায় যখন নিহত অথবা আহতের পরিবার উক্ত ক্ষতিপূরণ পেয়ে সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল, ফেলানীর পরিবার ক্ষতিপূরণের বিষয়ে সন্তুষ্ট ছিলনা।
ক্ষতিপূরণ দিলেও ফেলানীকেতো ফিরে পাবেনা কখনই। তা না পাক, ঘাতকের উপযুক্ত শাস্তি হতে দেখে বাবা মায়ের ভগ্ন হৃদয়ে কিছুটা হলেও সান্ত্বনা আসবে। সঠিক বিচার না করে করুণা করার এক ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করল বাংলাদেশের বন্ধু প্রতীম রাষ্ট্রটি!
বাংলাদেশ সরকার ফেলানীর হত্যা নিয়ে চিন্তিত নয়, তারা চিন্তিত দেশের নিরাপত্তা নিয়ে। বিদেশ বিভূঁইয়ে কেউ মারা গেলে কিই বা করার থাকে সরকারের! সৈয়দ আশরাফ খারাপ খারাপ বলেননি, সত্য যা তাই বলেছেন,
“সীমান্তে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। দুই দেশের পক্ষ থেকেই চোরাকারবারি, মাদক পাচার ও গরু চুরি হচ্ছে। এসব ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। শুধু আজই নয়, অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে বিচারযোগ্য বিষয় নয়। এ নিয়ে রাষ্ট্র খুব বেশি চিন্তিত নয়। আর সব কাজ ফেলে রেখে শুধু এদিকে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন আছে বলেও আমরা মনে করি না। তিনি আরও বলেছেন, সীমান্ত হত্যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এটা আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। রাষ্ট্র এতে উদ্বিগ্ন নয়”।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমি ক্ষমতা চাইনা, জণগণকে আমি ভালবাসি, জণগণের সেবা করাই আমার একমাত্র দায়িত্ব’। ফেলানীরা কি মানুষ অথবা জনগণের ক্যাটাগরিতে মধ্যে পড়ে না? হয়ত পড়েনা, তাই বাংলাদেশ জনগণ নিয়ে ভাবিত, ফেলানী অথবা তার পরিবারকে নিয়ে নয়!
বুঝলাম, ফেলানীরা জনমভর ফেলনাই থেকে যাবে। মরেও স্বজনদের ঘাড়ে চেপে যাবে দঃসহ গ্লানি! তবে বন্ধুত্ব থাকুক অটুট, ফেলানীদের বিচার গোল্লায় যাক!
বিষয়: বিবিধ
১৩০৫ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সে যদি তার ওপর অর্পিত দ্বায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে তাহলে সে সব অনাকাঙ্খিত মানুষেরা হয়ত বাড়ির মালিকের ঘরে ঢুকে প্রভূত ক্ষতি সাধন করতে পারে । তখন তো দারোয়ানকেই আগে বেঁধে ফেলতে বলবে বাড়ির মালিক ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন