মূদ্রাদোষ
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ০৩ নভেম্বর, ২০১৫, ০৬:৫১:৫৮ সন্ধ্যা
একই বাচনভঙ্গি বা স্বভাবগত অঙ্গভঙ্গি বারে বারে করার কুঅভ্যাসের নামই মূদ্রাদোষ। অভ্যাসটি যদিও গুরুতর নয় কিন্তু লোকের কাছে খুবই বিরক্তিকর। মূদ্রাদোষে আক্রান্তদের অধিকাংশই জানে না দোষটি তাদের মধ্যে বিদ্যমান, কেননা তা ঘটে ব্যক্তির অবচেতনে। হলে থাকাকালে একরাতে আমার ক্লাসমেইটের সাথে রুমমেইট বেড শেয়ার করে। সকালে রুমমেইট মুখ কালো করে বলে, “তোর দোস্ত একটা বন্য, হাত পা ছুঁড়ে, চেপে চুপে আমাকে ঘুমাতেতো দেইইনি, শরীর ব্যাথা করে ফেলেছে”!
মুদ্রাদোষ আমাদের সবার দ্বারা কম বেশি সঙ্ঘটিত হয়, অনেক সময় আমরা নিজে বুঝতে পারি কিন্তু অবচেতন মনে হয় বলে তাতে নিয়ন্ত্রণ থাকে না, আবার কখনো নিজেও বুঝতে পারি না যতক্ষণ না অন্য কেও দোষটা ধরিয়ে দেয়। এই দোষগুলোর জন্য নানা জায়গায় হেনস্থার শিকার হতে হয়। অপমানিত হওয়ার আগে অভ্যাসগুলো ত্যাগ করতে প্রচেষ্টা চালানো উচিত। চলুন তাহলে দেখে নিন আপনার মধ্যে দোষটি আছে কিনা, থাকলে এখনি শুরু করুন নিজেকে বদলাতে।
টয়লেটে গিয়ে দরজা ভালমতন বন্ধ না করেই কাজ সারতে বসে যাওয়া। এটাকেও মূদ্রাদোষ বলার কারণ অনেককেই এইরকম বেহুঁশ মার্কা কর্মকান্ড বারবার করতে দেখে নিজেই লজ্জা পেয়েছি। একবার প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য টয়লেটের কাছে গিয়ে গলা খাকর দেয়ার পরেও সারা শব্দ না পেয়ে দরজা টান মারি, আচমকা ভূত দেখার মত তিন পা লাফিয়ে পেছনে আসি, ধমক দিয়ে বলি আওয়াজ করা যায় না? আমারে জবাব দেয়, “টয়লেটে বসে আমি জিকির করব নামি”!!!!
ভাতের লোকমা মুখে নিয়ে ছপছপ আওয়াজ করা। ঝাল লাগলে মুখ দিয়ে ও হু ও হু শব্দ করা। ভাতের লোকমা মুখে নিলে অর্ধেক ঢুকে গালে, বাকি অর্ধেক পড়ে প্লেটে। যেখানে আঙ্গুলের দুই কড়ার উপর ভাত বা ঝোল ওঠার কথা নয় সেখানে কবজি পর্যন্ত উঠে যায় আর এইসব দেখে আশে পাশের লোকজনের ঘেন্না পায়, খাওয়াই বন্ধ হয়ে যায়।
বগলের ঘামের গন্ধ নাকের কাছে নিয়ে শোঁকা। হয়তো আপনি অস্বীকার করবেন, কিন্তু এই দোষটা কমন। কারো সামনে এমন করলে এবং কাজটা অন্যের দৃষ্টিগোচর হলে উভয়ের জন্যই বিব্রতকর। কাউকে এমন করতে দেখলে আলাদাভাবে ডেকে বুঝিয়ে বলা উচিত, “কাজটা খুবি দৃষ্টিকটু, এমন না করাই উত্তম”।
মানুষের সামনে খালি গায়ে থাকলে এবং মাথা চুলকাতে বা অন্য কোন কাকে হাত তুললে অন্য কোন দিকে না গিয়ে চোখ আটকে যায় বগলের এসে। মানুষ চায় না এমন হোক, কিন্তু হয়ে যায়, তবে চোখকে সংযত রাখা এবং খালি গায়ে না থাকাই বাঞ্ছনীয়।
যেখানে সেখানে নাক পরিষ্কার এবং বাম হাতের পরিবর্তে ডান হাতে নাক পরিষ্কার করা। নাকের পানি অথবা থুতু ফেলতে সবার সামনে থাকতেই খক খক, হু চ হু চ শব্দ করতে করতে তারপর সাইডে গিয়ে পরিষ্কার করা। নাকের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কারে সর্বক্ষনই হাত দুটিকে ব্যস্ত রাখা। আবার নাক দিয়ে সারাক্ষণ খু খু শব্দ করা। কার কেমন লাগে জানিনা, এমন দেখলে আমার ঘেন্না ধরে যায়!
ব্লেড বা নেইল কাটার থাকতে দাঁত দিয়ে নখ কাটা এবং নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে অন্য হাতের নখের ময়লা পরিষ্কার করা। গলা পরিষ্কার না মানুষের সাথে গড় গড় করে কথা বলা।
রাতে ঘুমালে নিয়ন্ত্রণহীন হাত পা দিয়ে পাশের জনের উপর তান্ডব চালানো। এক রাতে কারাগারে আমরা দুই আসামী পাশাপাশি শুয়ে ঘুমাচ্ছি, ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ গালে এসে লাগে সজোরে এক ঘুষি, থতমত খেয়ে উঠে বসি, আমিতো পুরাই ভ্যাবাচ্যাকা, শরীর কাঁপছিল, আরেক জনকে ডেকে তুলি, “ভাই দেখেন, আমারে ঘুসি মেরে এখন কেমন আরাম করে ঘুমাচ্ছে, জ্বিনে পেল নাকি”। সকালে যখন জিজ্ঞেস করি, ভাই রাতে ঘুসি মারলেন কোন অপরাধে? বলে, কই নাতো, আমিতো এমন কিছুই করিনি!
কারো সাথে কথা বলার সময় তার বুকের বুতামগুলো বারবার খোলা আর লাগানো, যেন বোতাম ঠিক করার কারিগর! কথা বলতে গিয়ে বিড়ালের মত গায়ের সাথে ঘেষাঘেষি করা অথবা সামনে উপবিষ্ট ব্যক্তির গালে টোকা মারা, কিল ঘুসি দেয়া বা চিমটি কাটা। আবার কথা বলার সময় মুখ থেকে যে পরিমাণে থুতু থুতু বের হয়, সামনে দাঁড়ানো লোকের তাতে গোসল হয়ে যায়।
গা পরিষ্কার করবে গোসলের সময় অথচ অন্য সময়ে লোকের সামনে খুঁটে খুঁটে বা হাত দিয়ে ডলে ডলে ময়লা পরিষ্কার করা।
পা চুলকাতে গিয়ে পরনের কাপড় উরু পর্যন্ত উঠিয়ে ফেলা। কারাগারে কম বেশি সবারই চুলকানির ব্যারাম হয়, আলহামদুলিল্লাহ্ আমাকে রক্ষা করেছেন। এক লোক খচর খচর করে এমন আরামচে চুলকাতো যে লুঙ্গি উপরের দিকে উঠতেই থাকত, উনার খবর থাকত না! আর বেটা মানুষের তো এটা কমন স্বভাব, যার তার সামনে জায়গা অজায়গায় চুলকাতে থাকা।
অসুখ বিসুখ হলে ব্যথার তাড়নায় বিশেষ রকমের আওয়াজ বের হবেই কিন্তু অল্পসল্প অসুখে আহ, ওহ করে সারা বাড়ির লোক জড়ো করা, এটা কি! মহিলাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি লক্ষণীয়।
লুঙ্গি থাকলেও গামছা পরে গোসল করা এবং তা পরা অবস্থায় বাথরুম থেকে বের হয়ে আসা!
কথোপকথনের সময় “কেমন আছেন, ভালো আছেন তাহলে?”, কথা খুঁজে না পেলে অযথাই এই কথাটার পুনরাবৃত্তি করা।
কতিপয় বেটা চাওয়ালদের অন্তর্বাস না পরেই দিব্যি প্যান্ট ট্রাউজার পরে ঘুরে বেড়ানো। একজনতো আমাকে জিজ্ঞেস করে, “সালাউদ্দিন, তুমি কি এইসব পর, এগুলো পরলে নামাজ হয় না, তাই না?” আমি শুনেতো হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম!
কান্না শুনে সহানুভূতি জাগে না এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে। কিন্তু সে কান্না যদি টিপ না দিতেই চোখ থেকে ঝর ঝর করে পড়া শুরু করে, যাকে বলে ছিঁচকাঁদুনে স্বভাব, তাহলে কানের নিচে ঠাডায়ে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। মেয়েরাই বেশি এই স্বভাব দোষে দুষ্ট।
হাসি মন আনন্দিত হওয়ার বহিঃপ্রকাশ, তাও যখন তখন অকারণ হওয়া উচিত না। হাসির কথা বললে ভেটকি মারে, আবার রাগের কথা বললেও ভেটকি মারে, তখন হয় রাগের জায়গায় বোকার মত হেসে ফেলে নয়ত রাগ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। যাই হোক, এমন মানুষ কিন্তু মহাবিরক্তিকর!
শ্রোতার মন মানুসিকতার দিকে খেয়াল না রেখে হাটতে বসতে নীতি বাক্য শোনাতে যাওয়া। এমন লোকদের কাছে মানুষ হেদায়েত হতেতো আসেই না বরং তাদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়।
তর্কের বেলায় নিজের কাছে যা সঠিক মনে হয়, এক সের চাউল দিয়ে হলেও তার কথাটাকে অন্যের কথার উপর রাখার চেষ্টা করা।
আমার বর্তমান শিক্ষক, মানুষটাকে খুব শ্রদ্ধা করি এবং বিশেষ একটা কারণে উনার জন্য খুব মায়া হয়। উনার লেকচারের ধরণটা এমনঃ “Attention please, ok, you know, ok, say for example, ok, conflict transformation, ok, means, ok, it is a, say for example, enduring process, ok, of, say for example, change, I hope, ok, you have, say for example, understood…… “. সেকেন্ড অন্তর অন্তর ‘ওকে’ এবং ‘সে ফর এক্সাম্পল’ টার্ম দুটির ব্যবহার মুহুর্মুহু ব্যবহারে ক্লাসের সবাই কোনভাবেই হাসি চেপে রাখতে পারে না, যার জন্য তিনি সবার কাছে লাফিং গ্যাস নামে খ্যাতি পেয়েছেন। আমরা জানি এটা উনার বার্ধক্যজনিত সমস্যা হতে পারে, তবুও হাসির হলে না হেসে থাকা বেজায় কঠিন।
উপরোক্ত দোষগুলো কারো মধ্যে বিদ্যমান থাকলে তাকে কেউ মাথায় লাঠি মারবে না, এসবের জন্য যাবতীয় কাজ থেমে থাকবে না, এমন কি এইসব সফলতার প্রতিবন্ধকও নয়, তবে ছোটখাটো অপমান থেকে বাঁচতে, অযাচিত বিড়ম্বণা এড়াতে, অন্যের কাছে বিরক্তির না হতে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা যে উপভোগের বিষয় তা উপলব্দি করতে অবশ্যই সেগুলো পরিহার করা উচিত।
চলুন, নিজের বাচন ভঙ্গি পরিবর্তন করি, কুঅভ্যাসগুলোকে সুঅভ্যাসে পরিণত করি এবং অন্যকের মাঝে পরিবর্তন আনতে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাই।
বিষয়: বিবিধ
১৭৪১ বার পঠিত, ২৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তারা এমন করতেই থাকবে, আবার আপনি বলতে গেলে অনেক ক্ষেপেও যাবে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ভাই
চলুন, নিজের বাচন ভঙ্গি পরিবর্তন করি, কুঅভ্যাসগুলোকে সুঅভ্যাসে পরিণত করি এবং অন্যকের মাঝে পরিবর্তন আনতে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাই।
দশ কথার এক কথা। খুব ভালো লাগলো। শুকরিয়া।
মূল্যায়নের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার আশে পাশের কেউ এমন করলে তাকে শোধরাবেন, এমনটাই কামনা।
জান্নাতের বাবা, আপনাকে ধন্যবাদ।
তবে আমার সালাম দেয়াটা কিন্তু মুদ্রাদোষ নয়!!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
হাহাহা, আমার রুমমেইট একজন বলে, সেও ব্লগিং করে, লোকজন ব্লগে এতো সালাম দেয় কেন! নাহ, সাইফের বাবা, কোন কাজের পুনুরাবৃত্তি করা মানেই কিন্তু মূদ্রাদোষ নয়, আমরা প্রতিদিন কোরআন অধ্যয়ন করি অথবা নামাজে একি রকম সূরা বারবার পড়ি, তা কিন্তু মূদ্রাদোষের পর্যায়ে পড়ে না, মূদ্রাদোষ তাই যা অন্যের কাছে বিকরিকর, অস্বস্তিকর।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
আপনি যখন বুঝতে পেরেছেন এটা দোষ, এবং এটার জন্য বাবার কাছে বকাও খেয়েছেন, তাহলেতো ছেড়ে দেওয়াই উচিত, তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। আপনার খাবার আপনি খাবেন, যেমনে খুশি তেমনি করে, তাতে কার বাবার কি আসে যায়!
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ব্রাদার।
কিতাবী ভাষায় উর্দুতে একে 'তাকিয়া কালাম' বলা হয়!
আচার-আচরণ,কথায় মুদ্রাদোষ অনেক বিরক্ত সৃষ্টি করে!
আমার এক আত্মীয়ের কথায় কথায় 'আপনার' শব্দ ব্যবহার অনেক অর্থই যেন বদলে দেয়!
দারুণ উপস্হাপনায় অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহ!
হা হা হা, কাছে ডেকে কানে কানে চুপি চুপি বলে দেবেন, এটা দোষ, যেন বদলে ফেলে।
আপনার মূল্যায়ন কি কম দারুণ, সবসময়ই প্রেরণা দেয়।
আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।
প্রয়োজনীয় বিষয়ে লিখেছেন। সুখপঠ্য ছিল।
কিছু মনে না করলে বলতে পারি,
নারীর প্রতি পিন্চিং গুলো মুদ্রাদোষ না তো?
যাইহোক সুন্দর লিখাটির জন্য ধন্যবাদ।
সুন্দর মূল্যায়নের জন্য ধন্যবাদ নেবেন। মানব অস্তিত্বের অর্ধেক যদি হয় পুরুষ, তাহলে বাকি অর্ধেক নারী, তাকে বাদ দিয়ে লিখলে এক পেশে হয়ে যাবে না? পুরা লিখার অধিকাংশ জায়গাতে পুরুষের দোষগুলো তুলে আনা হয়েছে, নারী প্রসঙ্গ খুব সামান্য, তবুও তা পিন মারা হয়ে গেলো, এবং প্রশ্ন করেছেন তা মূদ্রাদষের মধ্যে পরে কিনা? তাহলে আপনিই বিচার করুন না।
অনেক ধন্যবাদ
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ কবি সাহেব।
ব্রাদার আপানাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই এবং দোয়া করছি বেশ ভালো থাকুন।
প্লিজ, কারো দিকে আর তাকিয়ে থাকা নয়, কেউ আসুক অথবা নাই আসুক, আপনি আসছেন, লিখছেন, ভালো কিছু উপহার দেয়ার চেষ্টা করছেন, এটাই নিশ্চিত করুন!
অনেক বিষয় উঠে এসেছে। আপনাকে ধন্যবাদ। তবে কয়েকটি কথা নারীদের বিরুদ্ধে গেছে।।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ অনেক সময় ব্যয় করে মনোযোগসহকারে লিখাটি পরার জন্য।
মানব অস্তিত্বের অর্ধেক যদি হয় পুরুষ, তাহলে বাকি অর্ধেক নারী, তাকে বাদ দিয়ে লিখলে এক পেশে হয়ে যাবে না? পুরা লিখার অধিকাংশ জায়গাতে পুরুষের দোষগুলো তুলে আনা হয়েছে, নারী প্রসঙ্গ খুব সামান্য, তবুও তা পিন মারা হয়ে গেলো, এবং প্রশ্ন করেছেন তা মূদ্রাদষের মধ্যে পরে কিনা? তাহলে আপনিই বিচার করুন না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন