বাবা রিক্সাচালক, ছেলে পড়ে মেডিকেলে
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ০২ নভেম্বর, ২০১৫, ০৬:৫৭:৩২ সন্ধ্যা
রেজিস্টার ভবন থেকে নেমে রিক্সাচালককে বললাম, চাচা, ছাপড়া মসজিদ যাবেন? কেমন খুশি হয়ে উঠলেন, মনে হল যাত্রীর জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করছেন। উত্তরে বললেন, "হ্যাঁ চলেন যাই”। “ভাড়া কত দিতে হবে”? "চল্লিশ টাকা দিয়েন"। আমি বললাম, চল্লিশ টাকা নয়, আপনাকে ২৫ টাকা দেব। হঠাৎ কানের কাছে মুখ এনে চুপিসারে বলল, "শুনেন, আমি দুইদিন হল ঢাকা এসেছি, আমার ছেলেটা বরিশাল মেডিকেলে পড়ে, বড় মেয়েটাও অনার্স করছে বরিশাল কলেজে, আমাকে সাহায্য না করলে কাকে করবেন! আচ্ছা আপনি ত্রিশ টাকাই দেন"।
ড্রাইভার নয়, পাশের যাত্রী হিসেবে উনার সাথে গল্প শুরু করি। শুরুতেই উনার ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার খোঁজ খবর নেই। ছেলেটা এস এস সিতে গোল্ডেন প্লাস পেয়ে ভর্তি হয় ঢাকা নটরডেম কলেজে, সেখানেও এইচ এস সিতে কৃত্বের সাথে গোল্ডেন এ প্লাস পায়, এখন বরিশাল শেরা বাংলা মেডিকেল কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। বড় মেয়েটা এস এস সি ও এইস এস সিতে এ প্লাস পেয়ে এখন বরিশাল কলেজে বিএ অনার্স করছে, ছোট ছেলে-মেয়েগুলোও স্কুলে পড়ছে।
তারপর একে একে বেরিয়ে আসে উনার অসহায়ত্বের নানা কথা। এক সময় কাজ করতেন আদমজী জুট মিলে, বেশ চলছিল সংসার। তারপর মিলটা বন্ধ হয়ে গেলে স্ত্রী সন্তান নিয়ে পড়েন মহা বিপদে। ছেলেটা এখন নিজের খরচ নিজে চালালেও প্রথম দিকে ভর্তিসহ যাবতীয় খরচ উনাকেই বহন করতে হয়েছিল। অন্যদিকে মেয়েগুলোর পড়ার খরচ, বুড়ির মুখে দুই লোকমা ভাত তুলে দিতে এবং পেটের দায়ে চলে আসেন ঢাকায়। বয়স ৬৫ অথবা ৭০এর কাছাকাছি হবে। এই বয়সে যখন বিশ্রাম আর নাতী নাতনীর হুইহুল্লোর নিয়ে বেশ থাকার কথা তখন তিনি রিক্সার শক্ত হ্যান্ডল চেপে যাত্রী টেনে চলছেন।
কথার ফাঁকে ফাঁকে বলতেছিলেন, “আপনি অনেক ভালো লোক, আপনার জন্য দোয়া করি জীবনে ভালো কিছু করেন এবং আপনার মা-বাবা, ভাই-বোনের জন্যও দোয়া করি, তারাও ভালো থাকুক, শান্তিতে থাকুক। উনার সাথে কথা বলতে ভালই লাগছিল, তাই জিজ্ঞেস করি, নামায পড়েন? জবাবে, “সবসময় চেষ্টা করি জামাতের সাথে পড়তে”। “বৃদ্ধার চলার জন্য একটা টাকাও দিয়ে আসতে পারিনি, মনটা বেজায় খারাপ, গত দুই দিনে যা আয় হয়েছে তার থেকে কিছু বিকাশে নাকি পাঠিয়ে দেব, নয়ত বেচারী না খেয়ে মরবে”।
জিজ্ঞেস করি, “আচ্ছা আপনারতো বয়স হয়েছে অনেক, শরীরে কোন অসুখ বিসুখ নেইতো”? উনার উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে পারলাম না, "না বাবা, আমি সদা আল্লাহর উপর ভরসা করি, আমার বয়সী খুব কম লোক আছে যারা কিনা রিক্সা চালায়। যখন বের হই, আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং হালাল রুজি কামাই করার নিয়তেই বের হই, আলহামদুলিল্লাহ্, আপাতত আমার অসুখ নেই, রিক্সা চালাতেও খুব কষ্ট হচ্ছে না। শুধু এই বুড়া মানুষটার দোয়া করবেন”।
গল্পে গল্পে পথ শেষ হয়ে যায়, আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে উনার জন্য খুব করে দোয়া করে আমার গন্তব্যে পা বাড়ালাম। আমার দিকে তাকিয়ে উনার হাসিটা এখনো চোখে ভাসছে। কিছু মানুষ ক্ষণিকের আলাপে কত আপন হয়ে যায়, হয়তো আর কোনদিনই দেখা হবে না, কিন্তু স্মৃতির পাতায় ঝাপসা হয়ে দেখা মিলবে কখনো কখনো, মনের ক্যানভাসে স্নেহমাখা হাসিটা রয়ে যাবে অনেক অনেক দিন।
যে বাবারা বার্ধক্যে পৌঁছেও নিজের আরাম আয়েশের চিন্তা বাদ দিয়ে ছেলে মেয়ের পড়ার খরচ জোগায়, ভারী ভারী সব কাজ করে নিজে খেয়ে না খেয়ে সন্তানকে টাকায় পাঠায় ভালোমন্দ কিনে খেতে, একসাথে খেতে বসলে মাছের বড় পিচটা, মুরগীর রান, গো মাংস সন্তানের প্লেটে তুলে দেয়, সন্তানের টেনশনে বিনিদ্রা যাপন করে, মঙ্গলকামনায় মোনাজাতে অশ্রু ঝরায়, তাদের থাকার জায়গা হবে কি সন্তানের বানানো বিলাসবহুল বাড়িতে, চড়তে পারবে কি লাক্সারিয়াস গাড়িতে, নাকি কবরে এক পা চলে গেলেও টেনে চলবে রিক্সা অথবা হেন্ডল চালানোর ক্ষমতা হারিয়ে জায়গা হবে বৃদ্ধাশ্রমে?
বাবার স্মরণে মানিক ভাইয়ের গানটি গাইতে ভালই লাগছে-
বিমূর্ত ছবিগুলো, এ্যালবাম জুড়ে আছে
একজন মানুষের ইতিহাস
চশমার ফ্রেমখানি, ঘড়ি ছড়ি পাঞ্জাবী
সব আছে তবু দীর্ঘশ্বাস
শুধু বাবা নেই
মায়া মাখা শাসনের ছায়া নেই......
বিষয়: বিবিধ
১৪৩০ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কোন কাজেই লজ্জার কিছু নেই আর তা প্রকাশেও বাধা নেই৷ বাবা মা সব সময়েই সন্তানদের সুখের চিন্তা করে,তাদের ভবিষ্যতের চিন্তা করে৷ ধন্যবাদ৷
কিন্তু আমাদের সমস্যা হল আমরা খ্যাতির বিড়ম্বনায় ভুগি, তাই না খেয়ে পড়ে থাকলেও অধিকাংশ কাজ করতে আমাদের আত্মসম্মানে বাধে। বাবারা কেন এম হয়, সন্তান হলে নিজের চিন্তা বলে আর কিছুই যেন থাকে না, সব চিন্তা তখন সন্তানকে ঘিরে থাকে।
আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।
মূল্যায়নের জন্য ধন্যবাদ। @ জুলফিকার আলী
ধন্যবাদ আপনাকে সবার মাঝে এই রকম একটা লিখা শেয়ার করার জন্য।
এটা বাংলাদেশে বেদনায়ক বাস্তবতা।
ভাই মামুন, আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
দোয়া করবেন যেন সেই পরিশ্রমি মানুষের কাতারে আমরাও শামিল হতে পারি
আল্লাহ ভদ্রলোককে সুস্থ্য রাখুন।
এবং ওনাকে আমাদের সংশোধনের জন্য উসিলা করে দিন।
শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমিন, ছুম্মা আমিন।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ লিখাটি পড়ার জন্য।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ লিখাটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন