হাবা গোবারা বিরক্তিকর বটে, অনিষ্টকারী নয়। একটু বুঝে নিতে পারলে তারাই হয় পরম বন্ধু।
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:৫৮:৪৪ সকাল
প্রতিপক্ষ মনে করেই যদি কারো সাথে আলোচনায় বসি, তাহলে তার কোন কথা, অভিযোগ, কারণ দর্শানো, যুক্তি তর্ক আমার কাছে গুরুত্ব পাবে না নিশ্চিত করেই বলা যায়, এখানে বন্ধু ভাবাপন্ন পরিবেশ বিরাজ করবে না এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানেও পৌঁছা যাবে না খুব স্বাভাবিক ব্যপার।
কেউ ভুলের উর্ধ্বে নয়,মানুষ হিসেবে ভুল করা স্বাভাবিক, না করাটাই বরং চরম অস্বাভাবিকতা এবং অসম্ভবও বটে। তাই ভুলকারী ব্যক্তির ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা না করে অথবা চেষ্টা করেও শোধরাতে না পেরে তাকে হেয়প্রতিপন্ন করা অথবা বারবার ভুল ধরা, দোষ খোঁজা খুবই অমানবিক কাজ। তাতে করে ব্যক্তির মধ্যে সংশোধনতো আসবেই না, বারংবার ভুলগুলোরই পুনরাবৃত্তি হবে এবং অপমান অপদস্থ হতেই থাকবে।
পড়াশোনা, চাকুরী বাকরি করার জন্য আমাদের গ্রামগঞ্জ ছেড়ে থাকতে হয় হোটেল মেচ বাড়িতে। সামান্য কিছুকাল একসাথে থাকার পর আবার আমরা ফিরে যাই আমাদের পরিবার পরিজনের কাছে। সারাজীবনের জন্য দ্বিতীয়বারের মত দেখা সাক্ষাত নাও হতে পারে। এই কিছুকাল একসাথে থাকাকালীন আমাদের যাবতীয় কাজকর্মের কিছুই মনে থাকবে না, যা মনে থাকবে তা হল পারস্পরিক আচার ব্যবহার।
ব্যবহার বা আচরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা অধিকাংশ সময় মুখের দ্বারাই হয়ে থাকে। আমরা সবাই জানি, মুখ থেকে যা একবার বের হয়ে যায়, তা কখনোই ফিরিয়ে নেয়া যায় না। লাঠির ঘা শুকালেও কথার ঘা শুকায় না। তাই কথাবার্তায় সাবধানতা অবলম্বন অতীব জরুরী। আল্লাহর হক আল্লাহ ক্ষমা করে দেন বান্দার প্রতি দয়া পরশ হয়ে, কিন্তু বান্দার হক আল্লাহ ক্ষমা করেন না যতক্ষণ না বান্দা ক্ষমা করে।
সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে অথবা অবচেতন মনে আমরা কাউকে কষ্ট দিয়ে ফেললে আল্লাহর কাছে উক্ত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়ার পূর্বে যাকে কষ্ট দেয়া হয়েছে তার কাছেই ক্ষমা চাইতে হবে, এটা অত্যাবশ্যকীয়! যে বাবা-মা সন্তানকে রক্ত পানি করে বড় করেছেন, যে ভাই-বোন একই বাবা-মায়ের রক্ত দিয়ে গড়া, তারাওতো কখনো কখনো একে অপরের মাতায় লাঠি চালায়, তাহলে হোস্টেল বা মেচে ঝগড়া-ঝাটি হবে না এটা কি করে হয়। অথচ এখানে কেউ রক্ত সম্পর্কীয় নয়, একেক জনের বাড়ি একেক জেলায়, মতপার্থক্য,মনোমালিন্য তো হবেই।
একসাথে চলতে গেলে ঠুকাঠুকিতো হবেই। মানিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ছোট ছোট কিছু কাজ ঠেলাঠেলি না করে নিজে করে নেওয়াই উত্তম যেমন, নিয়মিত ঘর ঝাড়ু দেয়া,ধোয়া মোচা করা, শুধু ঘরের নিজের অংশটাই নয় বরং পুরো রুমটা পরিষ্কার করা, টয়লেট পরিষ্কার করা, পানি গরম করা, পানি সংগ্রহ করে নিজে খাওয়া এবং অন্যকেও খেতে দেওয়া ইত্যাদি। এইসব কাজে কারো কোমর ভেঙ্গে যাবে না, তাই ঠেলাঠেলিও পরিত্যাজ্য।
আবার কিছু বিষয়ে ত্যাগ স্বীকার করলে কোটি টাকার ক্ষতি হবে না যেমন, রাত এগারোটা বারোটার দিকে নিজের ব্যক্তিগত লাইট ব্যবহার করে আর সবার জন্য ঘুমের পরিবেশ সৃষ্টি করা, সকালে লাইটের আলোতে ঘুমের অভ্যাস করে অপর ভাইকে পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়া, বই খাতাগুলোকে পিঞ্জিরায় লুকিয়ে না রেখে যেসব ভাই টাকা পয়সার জন্য বেশি বই কেনার সামর্থ রাখে না তাদের পড়তে দেওয়া, কোন ভাই যখন এসে দেখে তার জন্য বরাদ্দকৃত খাবারটা নেই তখন যে ভাই খাচ্ছে তার থেকে শেয়ার করা ইত্যাদি।
কিছুদিন আগে ঢাকায় এক বন্ধু অপর বন্ধুকে গলা টিপে হত্যা করেছে রাতে লাইট অফ অন করা নিয়ে। এমন ঘটনা সত্যি দুঃখজনক। আমার মনে পড়ে, একদিন খুব রাত্তিতে বাহির থেকে হোস্টেলে আসার পর অভুক্ত চারজন মানুষ একজনের সমপরিমাণ খাবার খেয়েই পরিতৃপ্ত হয়েছি। অল্পতে সতুষ্ট থাকা মানিবিক গুনাবলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
তাই আক্রান্ত যিনি, তিনি বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেবে, ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আক্রমণকারীও রাগ, ঘৃণাকে জিইয়ে না রেখে ক্ষমা চেয়ে নেবে, সর্বোপরি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করবে এটাইতো প্রত্যাশিত।
আজ একজন ভাইয়ের চোখের জল আমার হৃদয়কে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। তার কিছু অনিচ্ছাকৃত নিয়মিত ভুল, সহজাত বিরক্তিকর স্বভাবের জন্য চারদিক থেকে কঠিন জবাবদিহিতামূলক বাক্যবাণে বিদ্ধ করা হয়েছে, যার আঘাত হয়ত সইতে পারেন নি। একজন মানুষ কতটা আঘাত পেলে শিশুদের মত কাঁদতে পারে, তা ভাবতে গেলে চোখের কোণায় জল টলমল করে। পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে, যারা কখনোই ইচ্ছাকৃতভাবে কারো অনিষ্ট করে না, করতে পারেও না, এটা তাদের অক্ষমতা, কিন্তু কিছু শিশুসুলভ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য জীবনভর মানুষের কাছে অপমান অপদস্থ হতে হয়। তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে না এমনটা নয়, ভুলের সাথে পেরে উঠে না, সহজাতভাবেই হয়ে যায়।
তারা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে যায়, আশাপাশের মানুষগুলোর পাহাড়সম ভুল হতে দেখেও নিজের ভুলের কথা চিন্তা করে প্রতিবাদ করে না, অথচ তারও অধিকার আছে প্রতিবাদ করার। এটাকে আমরা তার দূর্বলতা ভেবে তাকে আরো থেকে আরো মানুষিক পীড়ণ দেই কিন্তু কখনো বুঝিনা, বুঝার চেষ্টাও করি না, দেখিনা দেখার চেষ্টাও করিনা, অনেক ভাল মানুসিকতাও তার মধ্যে বিদ্যমান। সেই ভালমানুসিকতার জন্যই তার আর সবকিছু ক্ষমার যোগ্য হওয়া উচিত।
এমনসব মানুষ সবসময়ই ইতিবাচক চিন্তা করে, মনের মধ্যে থাকে না কুটিলতা। তাদের এই সারল্যই কুটিল মানুষদের কাছে গরলের মত ঠেকে। যেমন, সে ভাবে, 'আমি কখনো ভালমন্দ কিছু কিনে নিয়ে আসলে সবাইকে নিয়ে খেতে না পারলে গলা দিয়ে নামে না, অথচ আমাকে কেউ খেতে দাকে না'!
'আমার ব্যক্তিগত জিনিস পত্র যেকোন সময় যেকোন কেউ বলে, না বলে ব্যবহার করলেও কখনোই রা শব্দটি করি না, তাহলে মানুষ কেন এতো রিজার্ভ হয়! কষ্টদায়ক অথবা ভাল, সব রকম কথা আচরণে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন করি, রাগ হয়ে তির্যক বাক্য বাণে পালটা প্রতিক্রিয়া দেখাই না, মানুষ কেন কথায় কথায় ছ্যাঁত করে উঠে, বর্বর আচরণ করে'!
তারা সবকিছুই সরলভাবে চিন্তা করে, হয় অনেক বেশি মানবিক, অন্যদের কাছেও তেমনি প্রত্যাশা করে যেমনটি সে। অথচ এটা ভাবে না যে, সে কারো কাছে কিছু চাইল, সে জিনিসটা থাকা সত্ত্বেও তাকে দেওয়াটা মানবিক দিক বিবেচনায় বেমানান, ভদ্রতার পরিচায়ক নয় কিন্তু উক্ত ব্যক্তি দিতে বাধ্যও নয়। পৃথীবীর কোনো আদালতে গিয়ে বলতে পারবে না, "অমুক ব্যক্তির কাছে আমি কিছু চাইলাম, থাকা সত্ত্বেও আমাকে দিল না, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাকে জিনিসটা দেয়া উচিত"। তারা এটা ভাবে না, মানবিক দিক বিবেচনায় জিনিসটা তাকে দেওয়া উচিত বটে কিন্তু না দিলে কিছু মনে করা যাবে না বা কিছু বলা যাবে না কেননা দিবে কি দিবে না, তা ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত অধিকার।
সব মিলিয়ে এই মানুষগুলো যথেষ্টই ভাল, বুক যাদের ভালবাসায় পূর্ণ, মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কিন্ত সরল চিন্তা, কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল, আগ পিছ না ভেবে কথা বলা বা মন্তব্য, ইচ্ছাকৃত নয় বরং উপস্থিত বুদ্ধির অভাবে সম্মিলিত কাজগুলোতে শামিল হতে না পারা তাদের সব ভাল দিকগুলোকে ম্লান করে দেয়। তাদেরকে একটু বুঝে নিতে পারলে তারা হয়ে উঠবে আমাদের কাছে অনুকরণীয়। প্রতিপক্ষের বদলে পরিণত হবে চরম ও পরম বন্ধুতে।
আসুন, আমরা সেসব সহজ-সরল মানুষগুলোকে বুঝার চেষ্টা করি, যেহেতু ভুলগুলো অনিচ্ছাকৃতই, সেহেতু ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতেই দেখি। আমি হলফ করে বলতে পারি, আপনার বিপদে এই মানুষগুলোই দিন রাত খেটে মরবে যতক্ষণ না বিপদ কেটে যায়। একটু ভালবাসা পেলে আপনার জন্য সর্বোচ্চ উজার করে দিতে পারে। আমার দ্বারা শেষের কথাগুলো পরীক্ষিত, আপনিও একটু মানিয়ে নিন না!
উৎসর্গঃ ডিপার্টমেন্টের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই এবং রুমমেইট
আহমেদ শিব্বির
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিষয়: বিবিধ
১৫২৫ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এক সাথে বসবাস করতে গেলেই মনমালিন্য ভুলবোঝাবুঝির সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা থাকে। একা পথে হাটলে কথাবার্তা বলার যেমন কেউ নেই ঠিক ভুলবোঝাবুঝি হবার প্রশ্নও নেই।
বর্তমান সমাজে অসয্যের প্রবনতা মানুষে শিরা উপশিরায় দৃঢ়তার সাথে গেড়ে বসেছে! অথচ সয্য ও ধৈর্য্য মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম, আজকের সমস্যাটা ধৈর্যের সাথে সমাধান করলেই আগামীকাল সমস্যা তৈরি হবার আগেই সমাধানের পথ উম্মুক্ত হবে।
আজকের সমস্যা নিয়ে যদি তিক্তভাষী হয়ে অপমান করে বসি তবেই প্রতিপক্ষের মন প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠবে। ফলশ্রুতিতে সমস্যা স্রোতের মত আবহমান হয়।
সুন্দর লেখাটি পড়ে খুবই ভালো লাগলো ধন্যবাদ।
দিনকে দিন মানুষের সহ্য ক্ষমতা কমে আসছে
যথার্থই বলেছেন। বাড়ি যাচ্ছি, নিরাপদ যাত্রায় দোয়া কামনা করছি।
আপ্নাকেও অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকেও অভিনন্দন।
একসময় যানবাহনে লিখা থাকতো "ব্যাবহারে বংশের পরিচয়" - জানি না এখনো আছে কিনা! তবে ব্যক্তি কেমন এটা যে তার খুব কাছ এথাকে সেই সঠিক বলতে পারে। রুম মেট, প্রতিবেশী এরা এক অর্থে আয়নার মতোন!
সব মানুষ এক রকম হয় না। বুদ্ধিমত্তা আর যোগ্যতাতে থাকে অনেক পার্থ্যক্য। সবার কাছে তাই একই রকম আচরণ পাওয়া ও সম্ভব নয়! অপরপক্ষ যদি একটু খানি দুর্বল- কমবুঝের হয় একটু খানি সহযোগিতার হাত বাড়ানোই তার প্রতি ইহসান করা হয়! এখানে কৃপনতা করা ছোটমনের পরিচয়!
আল্লাহ আমাদের সবার চরিত্রকে উত্তম আদর্শের দ্বারা সমুন্নত করুণ! দুর্বলদের প্র কখনোই যেনো আমরা হেয় প্রতিপন্ন না করি!
চমৎকার পোস্টের জন্য আন্তরিক শুকরিয়া!
আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যে মূদ্রাদোষে ভরা, আমার মিশন হাতে নিয়েছে তার যাবতীয় দোষগুলো অনুশীলনের মাধ্যমে সারিয়ে তোলার, এবং পড়াশোনার দিকটাও সল্ভ করছি। আলহামদুলিল্লাহ্ আমার সহযোগিতায় সে ধীরে ধীরে শোধরাচ্ছে।
আপনার মন্তব্যটি পড়ে খুব খুব ভালো লেগেছে।
লেখাটির যথাযথ মূল্যায়ন করার জন্য শুকরিয়া।
চমৎকার কিছু আহবান করেছেন।ধন্যবাদ
দেরিতে মন্তব্যের জন্য আন্তরিকভাবে দু:খিত..
অনেক ধন্যবাদ
আমিও দেরিতে জবাব দেয়ার জন্য আন্তরিকভাবে দু:খিতো/
মন্তব্য করতে লগইন করুন