রোগ ছড়ানোর ভয়ে সবাই পালিয়ে বেড়ালে রোগীকে সারিয়ে তুলবে কে?
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৫:৪৪:৪০ বিকাল
'নন্দর ভাই কলেরায় মরে, দেখিবে তাহারে কেবা!
সকলে বলিল, যাও না নন্দ, কর না ভায়ের সেবা'।
নন্দ বলিল, ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দেই
না হয় দিলাম, কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি?'
আমার সহপাঠী বন্ধু, বেশ কয়েক মাস আগে টিভি বা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়, রোগের প্রকাশ অনবরত কাশির মাধ্যমে নয়, বরং বুকের এক পাশটায় টিউমারের মত ফুলে যায়। যার দ্বারা রোগীর পাশে থাকা লোকজনের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। হলের রুমে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর রুমের পরিবেশটাই বদলে যায়, চেনা মানুষগুলোকে বড়ই অচেনা লাগে তার। একসাথে খেতে চাইলে অন্যরা উঠে দূরে সরে যায়। তার বিছানায় কেউ বসে না, বসলেও দূরত্ব বজায়ে রাখে, এই বুঝি গায়ে লেগে গেল রোগের ছোঁয়া। রমজানে তার ইফতারের ব্যবস্থা আলাদা, এমন কি দা, ছুরিও তার ব্যবহার নিষেধ। রুম থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলেই যেন সবাই বাঁচে!
রুমমেইট, বন্ধুবান্ধবদের নাক ছিটকানো, ঘেন্না ভাব, আলাদা করে দেখা, সহযোগিতা-সহমর্মিতার বদলে একাকী অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দেওয়া সহ্য করতে না পেরে দ্রুতই ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। আলহামদুলিল্লাহ্, সফল অস্রপাচার হওয়ার পর এখন হাসপাতালে পুরোপুরি আরোগ্য লাভের অপেক্ষায়। অপারেশন হওয়ার পর অনেকটাই অচল, বারবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, ড্রেসিং করানো, ঔষধ পত্র কেনা, খাবার আনা, গোসল করানো, এইসব করানোর জন্য একজন মানুষ তার পাশে সার্বক্ষণিক থাকা প্রয়োজন। অথচ অনেক ব্যস্ততা সত্ত্বেও থাকার মধ্যে তার ভাই, একজন চাচা, এবং দুএকজন বন্ধু দেখভাল করে, যদিও ক্যাম্পাসে আছে তার একটা বড় ফ্রেন্ডসার্কেল। তাদের সঙ্গ আজ বড় দুর্লভ মনে হয়।
বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। এই ছোট্ট কথার মর্মার্থ আপনি তখনি বুঝবেন, যখন বিপদ আপনাকে ঝেঁকে বসবে, একটু সহযোগিতা পাবার আশে দহরম মহরম বন্ধুদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এক বুক হতাশায় দুমড়ে মুচড়ে যাবেন। ‘বুন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল’ কথাটি বড্ড পরিহাস মনে হবে। শিল্পীর ভাষায় শুধু প্রশ্নই করে যাবেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না? ও বন্ধু!’
আমার বন্ধু, আজ দুঃখ করে বলে, “আজ আমায় যারা দূরে ঠেলে দিচ্ছে, আল্লাহ চাহেতো সুস্থ হওয়ার পর তাদের রোগে শোকে সেবাযত্নে নিজেকে উজার করে দেব”। বন্ধুদের কাছে সবসময় সহযোগিতাই কাম্য, কিন্তু তার সম্পূর্ণ উল্টো আচরণ পেয়ে কবির ভাষায় আপনার সান্ত্বনা এই-
‘আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
...কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর-
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।‘
আমি মানছি, ছোঁয়াচে রোগীর সাহচর্য আপনাকেও আক্রান্ত করে তুলতে পারে। তাই আপনি রোগীর থেকে দুরত্ব বজায়ে থাকছেন। শোয়া, বসা, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া সবকিছু থেকে রোগীকে একপাশে ঠেলে দিচ্ছেন। সবাই রোগী হয়ে গেলে কে কার সেবা করবে, তাইতো? যৌক্তিক অবস্থান বটে। সতর্কতা অবলম্বন করে, ছোঁয়াচে প্রতিরোধক ব্যবহার করেওতো রোগীর সেবা করা যায়। তাছাড়া রোগের মধ্যে ক্রিয়া করার নিজস্ব ক্ষমতা নেই। তাই আল্লাহ চাইলে রোগাক্রান্ত হবে নতুবা হবে না। এজন্যই দেখা যায়, সংস্পর্শে যাওয়ার পরও অনেকে রোগাক্রান্ত হয় না। সবাই সুস্থ থাকতে গিয়ে, মানুষ নয়, একটা রোগিকে সেবা যত্নবিহীন ঘৃণাভরে দূরে ঠেলে দেয়া কতটা মানবিক অথবা যৌক্তিক?
সবাই সেবা করে রোগাগ্রস্ত হয়ে পড়লে কেউ কারো সেবা করতে পারবে না, এটা যেমন যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত কথা, এটাও কি বাস্তবসম্মত নয়, কেউ সেবায় এগিয়ে না আসলে রোগী মারা পড়বে? খুন বা হত্যা করা কি শুধু পেটে ছুরি মারলে, বুকে গুলি ছুড়লেই হয়, আপনাদের সবার অযত্ন, অবহেলা, অচ্ছুত মানুসিকতার কারণে রোগীর মরে যাওয়া নিশ্চয় খুন, আর তার খুনি আপনারা! ভায়ের সেবা না করে নন্দলালের দেশদরদে গৃহকোণে ‘স্বার্থনিজ’ হয়ে চুপটি মেরে থাকা খুনেরই নামান্তর! যদি আপনি সত্যকার মানুষ হয়ে থাকেন, নন্দর ভূমিকা আপনার জন্য বেমানান।
আপনার ভূমিকা হবে জাতীয় কবির মতই- “দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে”। কবি বলেছেন, ‘সকলের তরে আমরা সকলে, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’।
আপনি হয়তো বলবেন, “আমি সেবা করার দরকার কি, হাসপাতালে নার্স আছে, রোগীর পরিবারের লোকজন আছে, তারা সেবা করলেই হল”! আচ্ছা, যে রোগ আপনার শরীরে ছড়ানোর ভয়ে রোগীর কাছে ঘেঁষতে পারছেন না, সে রোগ কি নার্স অথবা রোগীর স্বজনদের শরীরে ছড়াতে পারে না? নাকি তাদের শরীর মাটি ভিন্ন অন্য কোন ধাতু দিয়ে গড়া? আমার বন্ধুটির ভাই দিনরাত ভাইয়ের জন্য অক্লান্ত সেবা করে যাচ্ছে, অথচ উনিও আক্রান্ত হতে পারেন। একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে জঙ্গল ভাল’। কিন্তু আপনার সমস্ত সত্ত্বাজুড়ে ঘৃণা প্রমাণ করে, ‘পর কখনো আপন হয় না’।
পরের জন্য যদি ভালবাসা নাই সৃষ্টি হবে, তবে মেকি ভালবাসা দেখানো কেন? দেখা হলেই মিষ্টি হেসে জানের দোস্ত বলে পারলে বুকের সাথে চেপে ধরে হারগুড় ভেঙ্গে ফেলে, অথচ বন্ধু বিপদে পড়লে ‘যখন তোমার কেউ ছিল না, তখন ছিলাম আমি, এখন তোমার সব হয়েছে, পর হয়েছি আমি’ ভূমিকা কেন? এমন ভন্ডামির চেয়ে বন্ধুর গালে দুটা চড় মেরে বুঝিয়ে দিন, “তোকে আমার পছন্দ নয়, যারে দেখতে নাড়ি, তার চলন বাঁকা, তুইও আমার কাছে তাই’। তবুও তা ভাল, অন্তত মিথ্যে ভালবাসার অভিনয়ের চেয়ে! মনে শয়তানী, বাহিরে সদা হাস্যময় সদালাপী। কবি যথার্থই বলেছেন, মাকাল ফলটা দেখতে বড়ই চমৎকার, কিন্তু ভিতরটা খুব জঘন্য।
অনেক কথা হল, আচ্ছা বলুন তো, অসুস্থতার সময় সবাই আপনার পাশে থাকে সুস্থ থাকাকালীন সময়গুলোর তুলনায় অনেক বেশি, তবুও কি আপনার মনে হয় না, আপনি খুব একা? সবাই থাকলেও অসুস্থতার সময় একা মনে হওয়া অতি স্বাভাবিক ব্যপার, অথচ এই স্বাভাবিক বিষয়টাও মেনে নিতে পারছেন না। মনে ক্ষোভ জন্মায়, যতটুকু সেবা পাওয়ার কথা ঠিক ততটা পাচ্ছেন না, সবসময় সেটা ঠিক নয়, সেবা পেলেও অভিমানে ঠোঁট দুটি ফুলে ওঠে।
আপনার জায়গা থেকে একটু বিচার করুন না! সবাইকে পাশে পেয়েও যখন খুব একা লাগে, তাহলে কখনো কোন ছোঁয়াচে রোগে আপনি আক্রান্ত হলে, আশ পাশের মানুষগুলো ঘেন্নায় দূরে সরে গেলে, কতটা অসহায় মনে হবে? ‘অপরাহ্নের’ গল্প আওড়ায়ে সময় কাটাতে হবে! অযত্ন অবহেলায় দুঃখে ভারাক্রান্ত মনের কথাগুলোও যখন বলার মত লোক খুঁজে পাবেন না, তখন কেমন বোধ করবেন? নাকি আমৃত্যু সকল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সার্টিফিকেট পেয়ে গেছেন, কোন রোগই আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না?
নিশ্চয় এটা সম্ভবও নয়। তাহলে আপন পর নির্বিশেষে সকলের সেবায় এগিয়ে আসুন। মানবিক প্রয়োজন উপলব্দি করুন সকল মানবের বেলায়, শুধু নিজের কষ্টের বেলায় নয়।
বিষয়: বিবিধ
১৬৮২ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জীবনের একটি কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন!! জাযাকাল্লাহ...
সতর্কতা অবলম্বন করে, ছোঁয়াচে প্রতিরোধক ব্যবহার করেওতো রোগীর সেবা করা যায়। তাছাড়া রোগের মধ্যে ক্রিয়া করার নিজস্ব ক্ষমতা নেই। তাই আল্লাহ চাইলে রোগাক্রান্ত হবে, নতুবা হবে না।
প্রথম মন্তব্যে আপনাকে অভিনন্দন। অনেক দিন পর আমার পাড়ায় আপনার আগমন, খুবই ভাল লাগল।
হাদীসটা আমার জানা ছিল না, আপনি উল্লেখ করাতে লেখাটির গুরুত্ব কিছুটা বেড়ে গেল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
অনেক অনেক ধন্যবাদ উপস্থিতি এবং সুন্দর মন্তব্যটি করার জন্য।
আমাদের সমস্যা আমরা অন্যের ক্ষতির চেয়ে নিজের ক্ষতিটাকেই বড় করে দেখি।
ধন্যবাদ, সংক্ষিপ্ত অথচ গুরুত্ববহ মন্তব্যটি করার জন্য।
আলহামদুল্লিলাহ।অনেক যুক্তিসংগত লেখা লেখেছেন।
আপনার উপস্থিতি এবং সুন্দর মূল্যায়নের জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
'
মানুষ মানুষের জন্য কথাটি দিন দিন যেন মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লিখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ মা-শা আল্লাহ জাযাকাল্লাহ খাইর
আপনার সাথে সম্পূর্ণ সহমত জান্নাতের বাবা।
কেমন আছেন?সবমিলিয়ে বিশের বাড়ি কেমন যাচ্ছে। ব্যস্ততার কারণে আপনাদের সাথে আড্ডাবাজি হয়ে উঠছে না, তবুও নিশ্চুপ মুখরতা আনন্দ দিচ্ছে বৈ কি!
আমার লিখাটিকে সুন্দর বলে মূল্যায়ন করার জন্য আপনাকেও খুব করে ধন্যবাদ দিলাম। আপনারা সবাই অনেক অনেক ভাল থাকুন এই কামনা।
আলহামদু লিল্লাহ ভালই আছি, দোয়া করবেন যেন তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাইতে পারি।
বন্ধুরা একজন আরেকজনের জন্য খুব করার চেষ্টা করে । বিশেষ করে কারও রক্তের দরকার হলে ।
কিন্তু সেই বন্ধুকে নিজেদের কাছে রেখে সেবা বন্ধুরা কেন , আপনজনেরাই তো করে না !
বাসায় কেউ একজন অসুস্থ হলে আপনজনদের মধ্যে একটা হুলস্থুল পড়ে যায় । ছোঁয়াচে হেল তো আপনজনেরাই পাশে থাকবে । বন্ধুদের উচিত এসময় তাদের অসুস্থ বন্ধুকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেওয়া ।
কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয়ের আশে পাশে হাসপাতাল এখন আছেই।
অসুস্থতাকালীন বন্ধু বা আপনজনদের এমন অদ্ভূত আচরণ রোগীকে খুব পীড়া দেয় তাতে সন্দেহ নেই। অথচ ছোঁয়াচে রোগ যদি শতভাগ ছোয়াচে হত তাহলে রাস্তা ঘাট, বাজার, হাসপাতালে রোগীর আশেপাশেরসবাই আক্রান্ত হত।
মন্তব্যের জবাব দিতে দেরি করায় ক্ষমা করবেন।
আপনাকে ধন্যবাদ মূল্যবান মন্তব্যটি করার জন্য।
আল্লাহ আপনাকে নিশ্চয় উত্তম প্রতিদানে ধন্য করবেন। আমার লেখাটি বাড়তি গুরুত্ব পাবে আপনার বন্ধুর পাশে সাহস নিয়ে সেবা যত্ন করার সহজ স্বীকারোক্তিটি।
মনুষ্যত্ববোধ যার সম্পূর্ণ হারিয়ে গিয়েছে তার থেকেই এমন ব্যাবহার আশা করা যায়।
আপনার কথার সাথে সহমত।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ নেবেন।
যথার্থই বলেছেন, মানুষের কাজই এই।
আপ্নাকেও ধন্যবাদ মামুন ভাই।
আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ ভালই রেখেছেন বলতে হয়। দেরি করে আসছেন নাকি ত্বরা করে আসছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আপনার আসাটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
এমন সুন্দর মূল্যায়ন, সত্যিই আমাকে দারুণ অনুপ্রেরণা দেয়।
অনলাইনে গলাবাজি করার সাথে সাথে তা বাস্তবরুপদান করাতে না পারলে তা যে বড্ড স্ববিরোধী হয়ে যায়। ভার্চুয়াল জগতে তার জন্য বাহ বাহ পেলেও সত্যিকার বাহ বাহা পাওয়ার মত কাজ না করলে যে অতৃপ্তির বেদনা কুঁড়ে খাবে।
আপনার কথাগুলো খুবই ভাল লেগেছে। ভালবাসা অব্যাহত রাখার জন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ।
আপনার সুন্দর মূল্যায়ন আমার জন্য প্রেরণা।
আপনার পোস্টের অপেক্ষায় থাকলাম।
আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। বড়দি সবর করছি!
আপনার দোয়ায় আমাকে সবসময়ই রাখবেন আশা করি।
সকল তো রোগ আর ছোয়াঁচে না, আর টিবি বা যক্ষ্মা রোগ ছোয়াঁচে নয়। আসলে আমরা নিজেদের যতই পরের জন্য মনে করি না কেন? বাস্তবতার মুখোমুখি হলে তখন বুঝা যায় কে কতটা মানব দরদী!
লিখতে থাকুন. ভাল মন্তব্য করতে না পারলেও ভাল পাঠক কিন্তু। ধন্যবাদ..
কে বলেছে ভালো মন্তব্য করতে পারেন না, অবশ্যই পারেন।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ ব্রাদার
মন্তব্য করতে লগইন করুন