আমি বর্ণবাদী
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ২৩ অক্টোবর, ২০১৪, ০৬:০২:০৯ সন্ধ্যা
“বিয়ের জন্য সবচাইতে সুদর্শনা, অমাবশ্যায় চেরাগবাতির প্রয়োজন পড়বেনা, এমন আমার চাই”, মা কে সাফ জানিয়ে দেই। মায়ের সাথে প্রায় তর্ক হত, যার বাহির কালো, ভিতরটাও কালো। “দেখুন না, সুন্দর মেয়েরা ঝগড়া করলেও মুখ লাল হয়, তাতে কি যে সুন্দর দেখায়!!! আর কালোরা, এমনিতেও দেখতে ভাল নয়, আবার ঝগড়াতেও মুখ লাল হয়ে লাল ও কুচ কুচে কালোর মিশেলে ভয়ংকর কুতসিত আকার ধারণ করে, সুতরাং কালো মেয়ে আমার থেকে লক্ষ কোটি মাইল নিরাপদ দুরত্বে থাকাই বেটার”।
মামাতো ভাই, সিনেমার হিরোদের চেয়ে দেখতে কম সুন্দর নয়, তবু ভাগ্যে মিলে কালো শ্য্যামলা মতন একটা মেয়ে। এই নিয়ে ছিল চরম অসুন্তুষ্টির।মামা দেখেই পছন্দ করে নিলেন, মামাতো ভাইকে সেখানে কিছুই বলতে দেন নি।বিয়ের রাতেই মামাতো ভাই হাক ডাক শুরু করে, বউ পছন্দ হয়নি, বেশ কয়েকবার বেহুশ হয়ে পড়েন, ওদিকে নতুন ভাবীতো পুরাই বেবাচেকা খেয়ে বেকুব বনে যাবার মত অবস্থা। ছেলের করুণ অবস্থা দেখে আমার মামাও বিছানায় ঢোলে পড়েন উনি। এইহা এক এলাহি কান্ড।ভাই আরেক বিয়ে করবেন বলেই মধ্যরাতে ঘোষণা দিয়ে বসেন। সবাই শান্ত করার চেষ্টা করলেন। উনিও কপালের লিখন বলে মেনে নিলেন। এই নিয়েও মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি হত। “ আমার জন্য পাত্রী দেখতে পারবেন এক শর্তে, মামাতো ভাইয়ের পরিণতি যেন না হয়, কালী বুচকি বাচকি মেয়ে নয় বরং রুপবতী পিলে চমকে উঠা ললনাকেই পছন্দ করবেন, যদি না পারেন, তবে পছন্দ আমিই করব”।
কালো আমার কাছে মহা বিরক্তিকর। আমি, তুম্ সে কেও পছন্দ করেনা কালোদের, বিশেষ করে বিয়ের ক্ষেত্রে, কালোরা ও চায়, ফর্সাদের বিয়ে করতে, তবু খোদা তাআলা কেন যে মানুষ কে কালো বানিয়েছেন, তার হিসেব মেলাতে পারতাম না।আশে পাশে যত কালো মানুষ কে দেখেছি, সবাইকে ঝগড়াটে, অশিষনুই মনে হত। যার চোখে চোখ রেখে মনে হবেনা, হরীনীর চোখ, হবেনা চক্ষু শীতল, বিরক্তিই প্রকাশ পাবে। যার গালে ছোট্ট ছোট্ট কালো তিলক, ফর্সা মুখে যা বাড়তি সৌন্দর্যের প্রতীক, কালোয় আধারে পড়ে খুঁজে পাওয়া ভার, যে রক্তিম ঠোঁট ফর্সা মুখে কামনার ঝর তুলে, কালোতে তা মেলেনা। কালো কেশ সরিয়ে ফর্সা ঘারের অপরুপ লাবন্য, কালো ঘারে পাওয়া যাবেনা। খাইতে সুন্দর নয়, বরং দেখতে সুন্দর। যার সব কিছুই কালো, দেখতে যে বিশ্রী, তার সাথে বসবাস! মরণ আর কি!!!!
একদা এক সময়, চরম বর্ণবাদী ছিলাম চিন্তা চেতনায় ঠিক এমনি। আজ রুচিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এখন বলি, ‘ কালো আমার গলার মালা, সুন্দর আমার পায়ের তলা’। কালো আলাদা কোন সত্তা নয়, আর সবার মত মানুষই। ন্যালসন ম্যান্ডেলা অথবা মার্টিন লুথার কিং বর্ণবাদ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন জীবনভর, কারাভোগ করেছেন জীবনের অধিকাংশ সময়, দেরি হলেও সফলতা তাদের ধরা দিয়েছে। বর্ণবাদ প্রথার মত ঘৃন্য প্রথার অবসান হয়েছে। বর্ণবাদ প্রথার ভয়াবহতা রাস্ট্রিয়ভাবে অথবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে, কিন্তু মানুষের চিন্তা চেতনা জগত থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। সে জন্যই মারিও বালেতুল্লি, এভরার মত বিশ্বকাপানো ফুটবল তারকাদের নিগ্রো বলে গালি শোনতে হয়। বিশ্বে প্রতিবছর মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা হয়, যার মানেই হল সুন্দরীতমাদের রমরমা গরম গরম শরীরিয় প্রদর্শনী। দেখেছেন কখনো কালোরা মিস ওয়ার্ল্ড হতে? হয়ত দেখে থাকবেন দু একজন কে, তাও খুব বিরল ঘটনা। কালোরাও সুন্দরী হতে পারে এটা বুঝানোর জন্য নয় বরং দুএক্টা ধরে সুন্দরী তকমা দিয়ে পাগল বুঝ দেয়া আর কি!
আমার এক বাল্য বন্ধু, গায়ের বর্ণ অনেকটাই কালো, বহু বছর পরে দেখে বললাম, “তুমি তো আগের চাইতে অনেক সুন্দরী হয়েছ”। কি বল, “আমিতো কালো, সুন্দর কখন হলাম”। “আচ্ছা তোমার গায়ের রঙ কালো বলে তুমি কি অসন্তুষ্ট? “না, নেই”। তবে মানুষ যখন মুখের সামনেই কালো বলে ব্যঙ্গ করে, তখন খুব কষ্ট হয়”। বাংলাদেশে বর্ণবাদ প্রথা নেই, কিন্তু বিয়ের বাজারে দেখা যায়, কালো মেয়েটি পাত্রস্থ করতে মেয়ের বাবা জায়গা জমি বিক্রি করে নগদ টাকা মোটর সাইকেল টিভি ফ্রিজ নিয়ে বসে থাকে। এতো কিছু নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার পরেও কালো নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকদের খোচা খুচি মুখ বুঝে হজম করতে হয়।যদিও তা কেও দেখেনা, বুঝেনা, স্বামী বেচারাও না, তবে সাক্ষী হয়ে থাকে বোবা চার দেয়াল, চোখের জলে ভিজে যাওয়া বালিশের কভার।
আর সিনেমা জগতে কালোদের অংশগ্রহণ চিন্তাই করা যায়না। মোশাররফ করিমদের মত দুএকজন যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে ব্যতিক্রমি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারলেও কালোরা সাধারণত যাবার সাহসই করেনা নিগ্রহের ভয়ে। তারপর বিমান, নৌবাহীনিতে সুদর্শনদেরকেই পছন্দের প্রথম কাতারে রাখা হয়। পরোক্ষভাবে কালোদের সবচেয়ে বেশি অপমান করা হয় সুন্দরী প্রতিযোগীতার নামে। বিশ্বে প্রতিবছর মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স হয় অবশ্য এর পরিণাম কি হয়, জাকিয়া বারী মম’র সাক্ষাতকার থেকে বোধগম্য হয়। সুন্দরী তকমা গায়ে লাগাতে কলাকৌশুলিদের মনোরঞ্জন সামগ্রী হতে দ্বিধাবোধ করেনা। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, কালোরা এই নোংরামী থেকে নিরাপদ অবস্থানেই থাকে।
আমার বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রথম বছরেই বিয়ে করে। বউ দেখতে সেইরকম কালো, অথচ সে খুব সুদর্শন একটা ছেলে। বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের যুগল ছবি ফেসবুকে আপ্লোড করে, কি হাসি খেল তামাশা, দেখলে গা জলে, কালোকে নিয়ে এতো আধিখ্যেতা দেখানোর কি আছে! একদিন, প্রশ্ন করি, “ তুই দেখতে কত্তো সুন্দর, এইডা কি বিয়ে করলি!, ভাবীকে একদম মানাচ্ছেনা তোর সাথে!”। সে বলে, “তার গায়ের রঙ কালো তা সত্য, মন কিন্তু কালো নয়, এমন কি আমার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ, ভক্তি ভালবাসা এতো তীব্র যে, শুধু এই জিনিসটাই আর সবকিছর প্রাধান্য বিস্তার করে যাচ্ছে, কখনো মনেই হয়না, সে কালো, কারণ আমি যে তাকে দেখি মনের চোখ দিয়ে, চর্ম চক্ষু দিয়ে নয়”।
আমার আরেক বন্ধু, একসাথে কোচিং করতাম, দেখতে মোটাসোটা, এক্কেবারে কালো, প্রথম তাকে সহ্য করতে পারতাম না, বোধ হয় তার কালো এবং মোটা হওয়াটাই বেশি রাগের কারণ ছিল, ছোটখাট দোষ পেলেই মাঝে মাঝে গায়ে হাত তুলতাম। ঐ যে বলেনা, ‘যারে দেখতে নাড়ি, তার চলন বাকা’। অথচ সেই অফুরন্ত ভালবাসা দিয়ে আমার মন জয় করে নিয়েছে, আমার ভালমন্দে সবসময় ততপর থেকেছে, বিপদে অভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। আজ ভাল করেই উপলব্দি করছি, তার মত ভাল মানুষ জগতে খুব কমি হয়। যতদিন বাঁচব, শ্রদ্ধাভরেই স্মরণ করব তাকে।
আরেক বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস্মেইট। প্রথমবর্ষে একদিন তার সামনেই মোবাইলে এক মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছি, কিছুটা বিব্রত বোধ করলে সে বলে, “না, কথা বল, সমস্যা নেই”। কথা শেষ হলে বলে, “ কত মেয়ে তোকে কল দেয়, আমাকে কোন মেয়ে কখনো ফোন করেনি, হয়ত গায়ের রঙ কালো বলে, তাই এই দিক থেকে আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ, তোর কিন্তু গোল্লায় যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, হা হা হা হা”। সেদিন তার কথাটা আমার দারুণ লাগে। আসলেও অনেকটা সেরকমই। সে বন্ধুটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এতো উপকার করেছে যে বলে শেষ করা যাবেনা। কালো মানুষগুলো এতো ভাল হয় কেন!!!!! একবার খুব বড় ধরণের বিপদে পড়ি, অর্থাৎ কারাগারে পরীক্ষার দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহর কৃপায় আমার সহায়তায় তার ছোটাছুটি অবাক করে, মনে মনে বলি, এতো ভাল কেন সে! নামাজ পড়ে জায়নামাজে অনেক দোয়া করেছি তার জন্য। এখনো মাঝে মাঝে ক্লাসে না গেলে ফোন করে জিজ্ঞেস করে কেন আসিনি, আসব কিনা।
একটা কথা না বললেই নয়, আমাদের সবার প্রিয় ধর্ম ইসলামই শিক্ষা দিয়েছে, সাদা কালোতে মানুষের পার্থক্য হয়না, পার্থক্য হয় কর্মে, যোগ্যতায়, গুনে। ইসলামের শিক্ষা, হাবশী গোলামও যদি নেতৃত্বের যোগ্য হয়, তবে তাকেই যেন নেতা বানানো হয়। যার উতকৃষ্ট উদাহরণ হযরত বেলাল (রাঃ)। বিয়ের ক্ষেত্রে যে চারটি জিনিস দেখতে বলা হয়েছে, তাতেও সবিশেষ গুরুত্বারুপ করা হয়েছে তাকওয়া বা পরহেজগারিতার উপর, যাতে সাদা কালোর ভেদাভেদ নেই, যে কেও তার আমল আখলাক দিয়ে আল্লাহর নিকট পরহেজগার হতে পারে। চারটার মধ্যে বাকী তিনটা না পাওয়া গেলেও পরহেজগারিতা যদি পাওয়া যায়, তাকেই অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে, যদিও দেখতে কালো হয়। আমিও আলহামদুলিল্লাহ, চিন্তায় পরিবর্তন এনেছি। পরহেজগারিতা পাওয়া গেলে তার মাঝে আর সব কিছু না থাকলেও, তাকেই সানন্দে গ্রহণ করব। আল্লাহ চাহেতো, এমন একজন কে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। ইনশা আল্লাহ।
পরিশেষে এই কথাই বলব, ভালবাসায় কালো রঙ কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, যদি অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখতে পারা যায়। মনের কালিমা দূর করে ভালবাসতে জানলে কালো কিংবা ফর্সা নয়, সুন্দর মনের মানুষটি প্রধান হয়ে উঠে, কল্যাণ তাতেই নিহীত থাকে।
মনোমগজ থেকে বর্ণবাদী চিন্তা চেতনা দূর হোক, ভালবাসার জয় হোক। সাদা কালোতে ভেদাভেদ নেই, ভালবাসার জয় হবে হবেই।
বিষয়: বিবিধ
১৫৫০ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার আরো আরো অনুভূতির অপেক্ষায় রইলাম শ্রদ্ধেয় মামুন ভাই।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ও হা টোকা দিয়ে দেখবকথা দিলাম। খুব পাকা লোক!!!!
তবে কালো ফর্সা বড় কথা নয় আমল আখলাকই আসল ।
তবে আফরা মেয়েটি কিন্তু বেজায় ভাল।
জী ঠিক বলেছেন, আমলই আসল কথা।
ধন্যোবাদ আপনাকে আফরা।
মনোমগজ থেকে বর্ণবাদী চিন্তা চেতনা দূর হোক, ভালবাসার জয় হোক। সাদা কালোতে ভেদাভেদ নেই, ভালবাসার জয় হবে হবেই।" - এই কথার উপরে আর কিছুই হতে পারে না। আমার মন্তব্যও করার কিছু নেই। বাসায় এসে পুরো লিখাটি পড়লাম।
মুগ্ধ হলাম।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার মুগ্ধতাই আমার জন্য প্রেরণা। অনেক অনেক শুভকামনা রইল। জাজাকাল্লাহু খাইর।
অসাধারণ লেখনীতে অভিভূত আমি, অবর্ণনীয় বর্ণময়তায় উপলব্ধি কে নতুন মোড় নিতে বাধ্য করলো নান্দনিক এই উপস্হাপনা।
অভিনন্দিত হাজারো শুভেচ্ছা আপনাকে!!!
আপ্নাকেও হাজারো শুভেচ্ছা ও ভালবাসা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার অভিনন্দ আমাকে সঠিক পথে চলতে অনুপ্রাণিত করবে। ইনশা আল্লহ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন