স্মৃতির ভেলায় ভেসে বেড়াই ( পর্ব-৬)
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১০:২২:০০ সকাল
আবু গারিব, গুয়ান্তানামো বে, ট্যাডমোর কারাগার, গিতারামা কারাগার, লা সান্তে, কান সি নম্বর ২২ কারাগার, লুজিয়ানা পেনিটেনশিয়ারি, দিয়াররাকিবসহ পৃথিবীর বিখ্যাত যত কারাগার সম্পর্কে জেনেছি, এও জেনেছি কারাগার পৃথিবীর সবচেয়ে সংকীর্ণ জায়গা।মদ খোর গাজাখোর টপটেরর, সমকামী, যৌন নির্যাতনকারীদের দৌড়াত্ব! তবে মনে হয়না, পৃথিবীর কোন কারাগারে ঢাকা কারাগারের মত এতোটা জঘন্যভাবে ঘেষাঘেষি করে থাকতে হয়। বারান্দায় দরজার কানা কাঞ্চিতে তিল ধারনের ঠাই নেই, লোকে লোকারন্য। আমার শোয়ার ব্যবস্থা হল বারান্দায় সপ্তাহে ১৫০০টাকার বিনিময়ে। বিড়ির ধোয়ায় চোখ জ্বালা করছিল। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহটাকে বিছানায় এলিয়ে দেই, নিয়ম দশটায় ঘুমিয়ে পড়তে হবে। তারপর আমার পাশেই দুই সমকামীর লীলাখেলা শুরু, ও আল্লাহ আরো কত কি দেখতে হবে, কে জানে!!!!
ফজরের সময়ে টয়লেটে অজুখানায় বিশাল সিরিয়াল।টয়লেট আছে দরজা নেই, অজুখানা আছে পানি নেই, কেও কেও এমন আয়েশি হালতে টয়লেট ব্যবহার করে আসে, দ্বিতীয় কারও যাওয়ার উপায় ছিলনা। বন্যাকবলিত দেশ বাংলাদেশ, পানির অভাব মনে করিয়ে দিবে মোশাররফের কারবালার পান্তরে একফোটা পানির জন্য হাহাকারের সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য। বিশেষ প্রয়োজনে গোসল করার কথাতো ভাবাই যেতোনা। সিরিয়াল মেইন্টেইন করে যদি পানি থাকত তা দিয়ে অজু, নয়ত তায়াম্মুম ছিল একমাত্র ভরসা। নামাজ শেষে সবাইকে ফাইল করে বসিয়ে কারারক্ষীরা এসে গুনে যেত।
জলপরীর সাথে সাক্ষাত কারাগারেই প্রথম। দিতীয়বার হূমায়ূন আহমেদের নুহাশ পল্লীতে। জল্পরী মেয়ে হয়, কিন্তু কারাগারের জলপরী ছেলে। যার কাজ ওয়ার্ডের সবার জন্য রান্না ঘর থেকে খাবার নিয়ে আসা। প্লেট বাটি মগ, কম্বল ইত্যাদি সংরক্ষণ করা ও সবাইকে একটা করে সরবরাহ করা। কোন কারণে তাকে জলপরী বলা হয় আমার কাছে বোধগম্য নয়। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, জলপরীরা বিয়ে সংসার করে। অবাক হচ্ছেন , সেখানে আবার মেয়ে আসল কোথা থেকে! মহিলা পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা বিল্ডিং, কেও কার ছায়াও দেখতে পায়না। আসলে জলপরীরা মেয়ে নয় ছেলদেরকেই বিয়ে করে। খুব অদ্ভূত তাইনা। হা এটাই সত্য! ছেলেটি বউয়ের মতই সকল সেবাযত্ন রান্না বান্না অতঃপর শারীরিক সম্পর্ক করে থাকে। কারাকর্তিপক্ষ এইসব নোংরামির কথা ভাল করেই জানে, তাদের নীরবতা সম্মতিরই লক্ষণ।
পরের দিন গোসল করতে গিয়ে পানির জন্য কাড়াকাড়ি দেখে পিছু হটতে বাধ্য হই। হাউজে পানি দেয়ার দুই তিন মিনিটের মধ্যে শেষ, পরে শুধু বালতি বোল জগের টূন টান আওয়াজ শোনা যায়। পাশেই খোলা টয়লেট। প্রয়োজন যখন যেতেই হবে। এক পা সামনে আগাইতো তিন পা পিছনে যাই, দূর্গন্ধে টেকা বড় দায়। সেখান থেকেও ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসি। ওয়ার্ডে আসলে ডাক পড়ে আমার লোকজন আমাকে দেখতে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই ভাই। উনারা কি বলে বুঝিনা না, আমি কি বলি উনারাও বুঝেন না, শুধু পাখির কিচিরমিরিরে কান জ্বালাপালা, তবু সিস্টেমে কথা বলা যায়, প্রথমে সে সিস্টেম আমার জানা ছিলনা, উনাদের ও ছিলনা, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাপকহারে গ্রেপ্তার আমাদের কেই দিয়ে শুরু হয়, অভিজ্ঞহতার যথেষ্ঠ ঘাটতি ছিল। এখন কাওকে দেখতে গেলে ভালভাবেই কথা বলতে পারি।সেদিন বলতে পারিনি।
তারা আমার জন্য কিছু শুকনা খাবার আর জামা কাপড় কিনে দিলেন, যা আমার কাছে আসে সন্ধায়। তাও সংসারের কর্তার হাত ধরে। কিছু দেয় আর কিছু নিজেরা রেখে দেয়। বললাম, এই লুঙ্গিটা আমার জন্য বাহির থেকে পাঠাইছে তাইনা, সরাসরি অস্বীকার। না! সংসারে নতুন এসেছিস বলে গিপ্ট করলাম। ওলে ওলে ওলে গিপ্টওয়ালা, খেতে পায়না, হুডামি ঠিকি আছে! তাও আমার জিনিস দিয়ে আমাকেই এ্যাপায়ন! রাতে বেলা নতুন স্যান্ডেল, আর আমার ছোট জামাটা হাওয়া। হাসব নাকি কাদঁব! স্যান্ডেল, বিস্কিট, চানাটচুর নিলি, সবি মেনে নিচ্ছি, তা তোদের কাজে লাগবে, আমার ছোট জিনিস টা কি কাজে লাগবে! যা কিনা একজনেরটা অন্যোজন ব্যাবহার করা যায়না। আজব বটে! রুচী কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! কর্তাকে বলি, এইভাবে চুরি হতে থাকলে যে বস্রহীন থাকতে হবে আমাজনের লোকদের মত! বলে, কিছু করার নাই, খেয়াল রাখিস তাহলে চুরি হবেনা।
পরের দিন ১৫০০ টাকার জন্য তাগিদ দেয়। কিভাবে দেব, দেখতে আসা লোকদের সাথে ভাল করে কথাই বলতে পারিনি। ডেডলাইন দেয়, আগামী কালকের মধ্যেই টাকা পরিশোধ করতে হবে, ভাবখানা এমন আমাকে টাকা ধার দিয়েছে। নয়ত ফাইলে নামিয়ে দিবে অরথাত মাঝখানে ঢলাঢলি করেই ঘুমাতে হবে। সমকামীদের একজন( সারাগায়ে ব্লেড চুরি দিয়ে হাজারো কাটা দাগ) আমাকে কুপ্রাস্তাব দেয়, যদি রাজি থাকি ১৫০০টাকা মউকুপ করে দিবে। কেমন লাগে বলেন!!!! ছোটলোকের বাচ্ছা বলে কি! বললাম, মানুষ চিনে কথা বলবেন, আপনাদের টাকার দরকার টাকা পেয়ে যাবেন, যদি না পারি দিতে ফাইলেই ঘুমাব, তবু এই ধরনের নোংরা প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে আসবেন না। উল্লেখ্য যে, গাঞ্জার আসরে তুলনামূলকভাবে আমি ছিলাম দেখতে শোনতে সুন্দর নরম শরীর, তাই কুনজরটা আমার উপরেই বেশি পড়ে।
একে একে চারদিন চলে গেল। সকাল সন্ধ্যা হুমকীর উপরেই রাখত। দিনের বেলা ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে সবার সাথে দেখা হলে কষ্টের কথা বলতাম,তাদেরো কিছু করার ছিলনা, স্বান্তনা দেয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকত।গোসল করতে পারতাম্না, খেতাম কম টয়লেটে যেতে হবে বলে, পানি খেতাম কম পেশাবের বেগ হবে বলে। কিন্তু কতদিন এমন করে থাকা যায়! চারদিনের মাথায় নাকে মুখে গামছা বেধে পা রাখার অযোগ্য খোলা টয়লেটে প্রকৃতির কর্ম সম্পন্ন করলাম।চারদিন পরে গোসল ও করতে সমর্থ হইলাম।
চতুর্থ দিন রাতে সংসারের কর্তা ভীষণ ক্ষেপে যায়। “ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িস বলে গায়ে হাত তুললাম না, কিন্তু আর সহ্য করবনা, আজ থেকে সংসারে খাওয়া দাওয়া বন্ধ, ফাইলে ঘুমাবি” ।অনেক করে বললাম, টাকাটা দিয়েই দেব, , তবু সংসারে রাখেন। না কিছুতেই রাজি নয়। সংসারের একজন কর্তাকে বলে কয়ে আমাকে খাওয়াইতে বসাল, ভাতের লোকমা মুখে তুলব,তখনি, “ লজ্জা করেনা তোর! টাকা দিতে পারিস না, ঠিকি খেতে পারিস! মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ, কষ্ট দিবা যখন সহ্য করার ক্ষমতা দাওনা কেন! কি খাব ভাত, টপ টপ করে পানি পড়ছে প্লেটের উপর। গলায় ভাত যেন পাথরের মত মনে হচ্ছিল। এতো লজ্জা অপমান কেমন করে সহ্য করি, বেহায়া হয়ে জন্ম নিলে হয়ত সয়ে যেতো। খাওয়ার সময় কারও বকা সত্য হজম অযোগ্য। খাওয়ার পর শুইতে দিবেনা, সাফ সাফ জানিয়ে দিল। ফাইলেও নামিয়ে দিল।
না, এইবারো পারলাম না। ঠেলাঠেলি করে শোয়ার জায়গা করা আদোউ সম্ভব হলনা।দুনিয়ার যত খারাপ লোকদের সাথে শোয়া নিয়ে আমার মত দূর্বল্প্রায় ছেলেটির অসহায় ঠেলাগুতা খেয়ে হেনস্থা হওয়ার দৃশ্য দেখে অনেকেই চোখের পানি আটকে রাখতে পারেন নি। অনেক অনুনয় বিনয় করে আরেকটা রাত সুযোগ দিতে বললে রাজী হয়। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ পাক বান্দার সহ্য সীমা বুঝেন। সকাল বেলা খবর আসে আমাদের কাশিমপুর কারাগারে চালান করবে আজ। জানতাম না কাশিমপুর সম্পর্কে, তবু বুক থেকে অনেক বড় বোঝা যেন নেমে পড়ল। অন্তত দুনিয়ার এই নরক থেকে মুক্তি মিলবে।
মাত্র চারটা দিন, অথচ মনে হল কয়েক যুগ ধরে পড়ে আছি। এক মুরুব্বী সান্ত্বনা দেয়, “ঢাকা কারাগার কে আমাদের পান্তা ভাত মনে করতে হবে”। বললাম, বললাম, করতে কি আর অসুবিধা, কিন্তু সত্যি তা যদি পান্তা না হয়ে উত্তপ্ত গরম ভাত হয়, পান্তা মনে করে খেলে গলা পুড়ে আগ্নেয়গীরির লাভায় পরিণত হবে। আমার মত নাকানী চুবানী খাওয়া লোকদের সান্ত্বনার বাণী বড়োই তেতো লাগে। তবু সান্ত্বনাই যখন কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘবের একমাত্র উপায় হয় তবে সান্ত্বনাই শুনে যাই।
আগামী পর্বে থাকবে কাশিমপুর রওয়ানা হওয়ার সময় জেল গেইটে মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর দুর্লভ সাক্ষাত, সান্ত্বনার বাণী, কাশিমপুর গমন, জেল গেইটে অভাবনীয় ভদ্রোচিত ব্যববার, যেন কনের বাড়িতে বর পক্ষের আগমন এই নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা। সঙ্গেই থাকবেন আশা করি।
বিষয়: বিবিধ
২৭১৬ বার পঠিত, ৩৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দুবাইয়ের জেল খানাকে দুবাই সরকার নাম দিয়েছে সংশোধন কেন্দ্র হিসেবে। তারা চরম অপরাধীর সাথেও খারাপ ব্যবহার করেনা। খেলাধুলা সহ লাইব্রেরীর ব্যবস্থা আছে। কোরআন শিক্ষার সুযোগ আছে, চরিত্র গঠনরে সুযোগ রাখা আছে। যার ভাল চরিত্রের পরিচয় দেয় তাদের সাজা কমানো হয়। যারা কোরআনের শেষ পারা মুখস্ত করতে পারে তাকে বড় ধরনের ক্ষমা দেখায়। তিন পারা মুখস্থ করতে পারলে দীর্ঘ মেয়াদের সাজাও মওকুপ করা হয়।
জেল খানার সুনাম করছিনা, আপনার দুরাবস্থার কথা মনে গেল তাই এই ঘটনাটি তুলে আনলাম। জেল এবং রিমান্ড জীবনের সব কথা লজ্জা ভুলে লিখতে থাকুন, অনেকের উপকারে আসবে। যারা বাহিরে আছে তারা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা করতে শিখবে। অনেক ধন্যবাদ
অনেক কষ্ট অনেক যন্ত্রনা পেরিয়ে এসেছেন । আল্লাহ আপনার ভাল করুন দুনিয়া ও আখিরাতে ।আমীন ।
ধন্যবাদ। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীকে এত কঠিন বাস্তবতা পার হতে দেখে খুব কষ্ট লাগল। আল্লাহ আপনার মত সব কযেদী ভাইকে সহ্য করার তৌফিক দান করুন।
আপ্নাকেও অনেক ধন্যবাদ আপনার অতি মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমার লিখা পড়েছেন বলে।
আসলে কারাগারের সাইন বোর্ডটি (রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ) একটি মিথ্যা, ধোকাবাজী, প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন