স্মৃতির ভেলায় ভেসে বেড়াই (পর্ব-৫)
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ২৭ আগস্ট, ২০১৪, ০৯:১৫:২১ রাত
আমাদানি সেলের ব্যবস্থাপক নূরানী চেহারাধারী মৌলভী সাহেব রাজকীয় হালতে থাকার বেশ কিছু প্যাকেজ অফার করলেন। প্যাকেজগুলোঃ ১নং প্যাকেজ ৭হাজার টাকা- দুইতিন জন সেবক থাকেব যাদের কাজ আপনার গোসল, গোসলে গা ঢলা, খাওয়া, ঘুম, গা টিপা, পান বানানো, চুল টেনে দেওয়া।বেহেশ্তি খাবার চাওয়া মাত্র মুখে হাজির, আপনি শুধু ঘুমাবেন আর খাবেন। ২নং প্যাকেজ ৫ হাজার টাকা- সপ্তাহে ৪দিন গোমাংস, বিলাসবহুল্ভাবে থাকার ব্যবস্থা। ৩নং প্যাকেজ ৩হাজার টাকা- সপ্তাহে ২ দুইন দিন বইশেষভাবে রান্না করা গোমাংস, মুরগী, বাকি সেবা ১নং ও ২নং এর মতই।যারা প্যাকেজ নিতে ইচ্ছুক তারা খাতায় নাম এন্ট্রি করেন, যারা ইচ্ছুক নন, তাদের কথায় আসি।
প্যাকেজ না নিলে চরম পস্তাবেন, কেন? শোনেন- কারাগারে ধারন ক্ষমতা ২৭০০জনের, বরতমানে আসামী আছে ১০হাজার! শোনেই মাথা মাছির মত ভন ভন করছে তাইনা, কিভাবে সম্ভব! উপায় আছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে জন্য ৩টা সারি থাকে, যারা প্যাকেজ নিবে তাদের দুই পাশের সারি, যারা নিবেনা তাদের জন্য মাঝখানের সারি বরাদ্দ। মাঝখানের লোকদের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। মাঝখানের সারি ব্যাবহৃত হয় দুই পাশের লোকদের যাতায়াতের রাস্তা হিসেবে, যার কারণে রাত দশটার আগে ঘুমানোর কোন সুযোগ নেই, এমন কি বিছানা পর্যন্ত বিছানোর সুযোগ নেই।
রাতে ঘুমিয়েও শান্তি নেই, বুকের উপর দিয়ে দুই পাশের লোকজন অজু টয়লেট ব্যাবহারে আসা যাওয়া করবে, তাতে কারো মুখে বুকে পায়ে লাথি লাগ্লেও কিছু বলা যাবেনা, মুখ বুঝে সহ্য করতে হবে। মাঝখানে খেতেও পারবেনা, জামাকাপড় ও রাখতে পারবেনা, পাশের লোকদের হাতে পায়ে ধরে তাদের সাথে খাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে যদি তারা রাজি হয়। আসবাবপত্র কিছু চুরি গেলে কেও দায়ী থাকবেনা। পরস্পরের সাথে এমনভাবে ঘেষাঘেষি করে শোয়ানো হবে, দুজনার মাঝে ইঞ্চি পরিমান জায়গা খালি থাকবেনা। এতো কিছুর পরেও যদি কেও আমাদের প্যাকেজে নিজেকে অন্ত্ররভূক্ত না করে তবে খুব পস্তাবে।
কেও বুঝে কেও না বুঝে খাতায় নাম এন্ট্রি করি। এইবার শোয়ার পালা, আমাদের সবাই ছাত্র, শিক্ষক, চাকুরীজীবি ছিলেন বিধায় আমাদের জন্য আমদানিতে পাশের দুই সারিতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আমাদেরতো ব্যবস্থা, প্যাকজবিহীন বাকি আসামীদের মাঝখানে শোয়াবে। দায়িত্ব পড়ল মোটা সোটা কুস্তিগীর টাইপের কয়েকজন ইয়ং কয়েদীর উপর যারা বিশাল পানি ভর্তি ড্রাম কাধে করে হাউজ ভরছিল। শুরু হল লাথি গুতা কিল থাপ্পর। অবাক করা ব্যাপার, দুইজনের জায়গায় ৬ জন। কাত করে শোয়ায়ে পিছনে আরেকজন চেপে ধরে লাগা;আগি করে শোয়ানোর পর দেখে দুজনার কিঞ্চিত মাঝে ফাকা জায়গা আছে কিনা, যদি থাকে, আরেকজন কে মাঝে, প্রথমে হাত দিয়ে চেপে শোয়ানোচেষ্টা, না ঢূকলে পা দিয়ে চেপে চেপে তৃতীয়জন কে শোয়াবে, মাথার নিচে হাত রাখতে পারবেনা, এইভাবে শোয়াকে বলে ঈলিশ ফাইল।বর্বরীয় কায়দায় এইসব চাপাচাপি দেখে কলিজা আমার পানি শূন্য প্রায়, কাল কি আমারো একি পরিণতি হবে!
প্রায় ২০০ লোকের জন্য ৩টা টয়লেট, বিরম্বনার কি শেষ আছে! খুব ভোরেই সবাই, কে মাঠে বসাল সারিবদ্ধ করে, নাম পরিচয় এন্ট্রি করে উজন উচ্চতা মেপে নিল। ফর্মালিটি শেষ করতে করতে ৯টা বেজে যায়। তারপর আবার আমদানিতে, এক পিচ করে আটার রুটি, একটি চিমটি গুর, কাওকে আঙ্গুলের আগায় করে পুটি মাছের আধার ডাল বিতরণ করা হল। রুটিতো নয় যেন গরুর শুকনা চামড়া চিবুচ্ছিলাম। বিভিন্য ওয়ার্ড থেকে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা আসতে থাকল, সবাই যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী, জেলেই যাদের রাজত্ব।
প্যাকজের অন্ত্ররভূক্তদের নিয়ে দরকষাকষি ভাগবাটোয়ারা শুরু, কাকে কোন ওয়ার্ডে দেয়া হবে। আর যারা প্যাকেজ নেয়নি তাদের তুলাধুনা করে ছাড়ল। রাতে নাম এন্ট্রি করার পর লোক মারপতে জানতে পারি, প্যাকজের নামে তারা আদম ব্যাবসা শুরু করে দিয়েছে, তাই সকালে প্যাকেজ নিতে অপারগতা জানালে আমাদের উপর খরগ নেমে আসে, কয়েকজন কে গলা টিপে ধরে, কেন নাম লিখিয়ে এখন প্যাকেজ নিচ্ছিনা, অনেক বাক বিতন্ডার পর আমাদের থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতে না পেরে হতাশ হয়ে আমদের ছেড়ে দেয়।
বিকেলের দিকে বিভিন্য ওয়ার্ডে ভাগ করে দেয়া হয়। আমার ভাগ্য এতো খারাপ ছিল, প্রত্যেক ওয়ার্ডে আমাদের চার পাঁচ জন একসাথে পড়লেও আমি পড়ে যাই একা এক ওয়ার্ডে। এমন কি ঐ ওয়ার্ডে প্রায় ৩০০ লোকের মধ্যে আমাদের সমমনা আগের কেও ছিলনা যে আমাকে হেল্প করতে পারে।সব গুন্ডা পাণডা মদ গাজাখোর, টপ টেররের সাথেই থাকতে হবে! কপালে এই ছিল আমার! দশবারো জন করে এক একটা সংসার প্রতিটি ওয়ার্ডে। আমাকেও একটা সংসারে নিয়ে নিল।
সংসারে মেইন কর্তা( বড় বড় চুল, খালি গা, লিক লিকে শরীর, সারাগায়ে গাজা খেয়ে মাতাল হয়ে ব্লেড দিয়ে কাটাকাটির বীভতস দাগ!) আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। রাগ পায়, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, আমাদের ভয়ে লোকজন তঠস্ত হয়ে থাকত, আর একটা গাঞ্জাখোরের কাছে কিনা আমাকে হুকুমের গোলাম হয়ে থাকতে হবে! তবু ভাগ্যকেই মেনে নিলাম। নাম পরিচয় পর্ব শেষ করে আমাকে তাদের সংসারে থাকার কথা, বিনিময় সপ্তাহে ৩ হাজার টাকা। থাকা হাওয়ার ভার তাদের উপর। লোভনীয় প্রস্তাব বটে। কিন্তু রাজি হইনি। অনেক চেষ্টা করেইয়ে রাজি করাতে পারেনি, ভয় দেখায়, বলে, তুই পড়াশোনা করিস, নরম শরীর, এইসব গাঞ্জাখোরের সাথে মাঝখানে চাপাচাপি করে ঘুমাতে পারবিনা, ঠেলে উঠিয়ে দেবে।তবু রাজি হয়নি, বলি, অন্যরা মাঝখানে কষ্ট করে থাকতে পারলে আমিও পারব।
শোয়ার সময় হল, মাঝের সবাই বসে গেল পাশাপাশি, কোথাও জায়গা নেই বসার, তাদের বলি আমি এইখানে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব অথবা বসে। বলে না, ক্কোথাও জাউগা থাকবেনা, এইখানেই ঠেলাঠেলি করে শুইতে হবে। একজনে মাথা চেপে ধরে, এইখানে বস, দুজনের কটিদেশের উপর ধপাস করে পড়লাম, দুইদিক থেকেই ধমক লাগালো, আমিতো মহা বিব্রত। কোমর নাড়ালাম বসার জন্য, ফ্লোর খুজে পেলাম না, তাদের কটিদেশের উপর চাপ দিলাম, এইবার তারাও দুই পাশ থেকে সজোরে নিতম্ব দিয়ে ঠেস মারে, ঠেলা সামলাতে না পেরে পিছনে ছিটকে পড়লাম, আর তারা খিল খিল করে নির্লজ্জভাবে হাসতে থাকল, লজ্জায় চোখে জল এসে যায়। এইরকম শোয়াকে বলে ‘ক্যাচকি ফাইল’ উঠে পড়ি, বলে কই যাও, এইখানে বস, কিভাবে জায়গা করবে আমরা জানিনা, এইখানেই থাকতে হবে। পরপর তিনবার চেষ্টা করলাম, তিনবারি ওদের নিতম্বের শক্তির কাছে হার মেনে দুঃখে ক্ষোভে টয়লেটের দিকে হাটা ধরলাম, পিছন থেকে একজন কটাক্ষ করে বলে, বলছিনা, তুই পারবিনা, এখন বুঝ মজা, বেশি বুঝে, ইস, তিনহাজার টাকা দিতে পারবেনা! কোথায় তিল ধারণের ঠাই নেই, তাই টয়লেটের সামনে গিয়ে দাড়াকাম, না সেখানেও দাড়াতে দিবেনা।
আবার দরকষাকষি, আচ্ছা তুই ১৫০০ টাকা দিস, আয় তোকে জায়গা করে দেই, আরামচে ঘুমা। রাজি না হলে বলে, তুই এইখানেও দাড়াতে পারবিনা, বাথরুমের ভিতরে যা, সমান্তরাল জায়গায় দাড়াবিনা, যতক্ষণ না টাকা দিতে রাজি হবি, ততক্ষণ উচু জায়গাটার উপর দাঁড়িয়ে থাকবি, খবরদার, ফ্লোরে পা ফেলবিনা। তাই করলাম। চোখ দিয়ে বন্যা বয়ে যাচ্ছে, টানা দুঘন্টা দাড়িয়েছিলাম, পা দুটো টলমল করতেছিল, পা ফ্লোরে পড়ে গেলেই মাইর নিশ্চিত। সেদিন চোখের জল কোনভাবেই থামাতে পারিনি, অঝোর ধারায় অশ্রু জরছিল। কাদছিলাম ফুফিয়ে ফুফিয়ে, পা ব্যাথা হয়ে গেল, কষ্টে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল, তবু তাদের পাষাণ হৃদয় গলেনি! পা টলমল করছিল, আর পারলাম না, পড়েই যাচ্ছিলাম, অবশেষে ১৫০০ টাকার বিনিময়ে পাশের সারিতে শোয়ার ব্যবস্থা করে নিলাম।
আগামী পর্বে থাকবে গোসল টয়লেট নিয়ে চরম বিরম্বনা, সাত দিন গোসল না করে থাকা, আরো কিছু নিকৃষ্ট অভিজ্ঞতা। সঙ্গেই থাকবেন আশা করি।
বিষয়: বিবিধ
১৫৩৭ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন