প্রেম, সর্বনাশের অপর নাম
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ২৩ আগস্ট, ২০১৪, ০৬:৫৫:৫৩ সকাল
বাস্তব সত্য অবলম্বনে লিখা, দয়া করে কেও এড়িয়ে যাবেন না
ঘুষি মেরে নাক ফাটানো, খরের স্তুপেআগুন, ঘরে আগুন, বান্দরের শলা(একজাতীয় গাছের পাতা, গায়ে লাগালে চুল্কাতেই থাকে)লাগানো, কাকার আদুরে ডাকের বিপরিতে তার মাকে গালি গালাজ, ২৪ ঘন্টা ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি, মায়ে বিরক্ত হয়ে শলার মোঠা দিয়ে আচ্ছামত মাইর, মুরুব্বী টাইফের কারো জামা ধরে টানাটানি, বউ জামাই খেলা, মোহরানা ছাড়াই দশ বিশটা বিয়ে করা, স্কুল পালাতে গিয়ে স্যারের হাতে বেদম মাইর, আট দশ বছর বয়সেও বিছানায় ঘুমে পেশাব করে দেওয়া এই ছিল সায়েমের ছোটবেলা।
কিছু পজেটিভ দিকঃ ৬/৭ বছর বয়সে তার বাবা বিদেশ পাড়ি জমায় উপার্জনের জন্য। মাই তাদের দেখাশোনা করে। খুব ছোট বয়স থেকে নামাজ রোজায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে মায়ের দেখাদেখি। চাচা ছিলেন খুব ধার্মিক, চাচাকে অনুসরণ করে টূক্টূক করে মসজিদে জামাতে পড়ত। এক্টাও রোজাও ভাংতনা। শুধু তাই নয়, রাতে উঠে প্রায় তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ত। ছিল ভোর রাতে উঠে পড়ার অভ্যাস।মা সবসময় বলত, কারো সাথে ঝগড়া করবেনা, কেও শালা বলে গালি দিলে চুপ করে চলে আসবে। সে তাই করত। কখনও কারো সাথে ঝগড়া করে আসলে মা নিজের ছেলেকেই শাসন করত, অন্যের ছেলেকে নয়। তখন রাগ পেলেও এখন সে বুঝে মা তার ভালর জন্যই করেছেন।
সায়েমের মায়ের পড়াশোনা এক ক্লাস পর্যন্ত। তবু কাজের ফাকে কোরআন হাদিস আর ইসলামী বই নিয়ে বসে থাকত, এক অক্ষর দুই অক্ষর করে পড়ার চেষ্টা করত। বাবা বিয়ে পাস, মা ওয়ান পাস, মায়ের কাঁপা কাঁপা হাতে এবড়ো থেবড়ো লাইনে লিখা চিঠি পড়ে বাবা নিশ্চয় অনেক খুশি হতেন, পারুক বা না পারুক, বেচারী চেষ্টা করছে নিজের অনুভূতিগুলো নিজেই লিখতে অন্য কাওকে দিয়ে লিখিয়ে নয়।
সায়েমের মা ধর্মকারী। জায়নামাজে বসে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কেঁদে কঁদে বলত, “ ইয়া আল্লাহ, আমাকে পূত্র সন্তান দান কর, তাদের মাদ্রাসায় পড়াবো, মাওলানা বানাবো”। আল্লাহ কবুল করলেন, দুইটি পূত্র সন্তান দিলেন। উল্লেখ্য যে, চার মেয়ে জন্ম হওয়ার পর দুই পুত্র সন্তান হয়। সময়মত মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন।আলেমে দ্বীন হওয়ার সব সম্ভাবনাই তার মধ্যে ছিল এবং খুব ছোট বেলা থেকে প্রকাশ পেতে থাকল। যখন তখন ওয়াজের ক্যাসেট ইসলামী সঙ্গীতের ক্যাসেট বাজিয়ে শিখে ফেলত, আর সারাক্ষণ গাইত। এইসব দেখে মায়ের খুশি ধরেনা, ছেলে মাওলানা হবে, আল্লাহর প্রিয়ভাজন হবে, কিয়ামতের দিন আলেমে দ্বীনের মা হওয়ার গর্বে গৌরবান্বিত হবে।
ক্লাস থ্রীতে লাস্ট বয়, ফোরে এক লাফে রোল দুই, স্কুল পালানো বন্ধ। কঠোর অধ্যাবসায়। এইভাবে চলছিল ক্লাস সেভেনের মাঝামাঝি পর্যন্ত। হঠাত ভয়ংকর (১৩ থেকে ১৯) বয়সের দোষে আক্রান্ত। ক্লাসের এক মেয়েকে ভাল লেগে যায়। চেয়ে থাকতে, হাসি দেখতে, অনুভব করতে ভালই লাগছিল। বুঝতে পারছিলনা এই ভাললাগার হেতু কি? পড়ায় মন বসেনা, ক্লাসে মনোযোগ আসেনা, ভাই এগারোটা পর্যন্ত আর সে শুয়ে শুয়ে ভাবে শায়লা নামের কিশোরির কথা। ক্লাসে বাজে পারপরমেন্স, উদাসীনতা শিক্ষকদের বিস্মিত করে, ছেলেটার হল কি! শিক্ষক ক্লাস করায় আর সে শায়লার দিকে তাকিয়ে অমীয় সুধা আহরণ করে। শায়লার ও কেমন যেনো ভাল লাগে সায়েমের তাকিয়ে থাকা, মুচকি হেসে কিছু একটা জানান দেয়।
অস্থির মন , প্রতিদিন প্রেক্টিস করে আসে, আজ কথাটা বলেই ফেলবে সাহস করে। কিন্তু বলা হয়না, শায়লা সামনে আস্লেই হাটু ঠক ঠক কাঁপতে থাকে। এই শোন, একটা কথা বলার ছিল, এই পর্যনতই, আমতা মাতা করে, লাজুক হাসি উপহার দিয়ে শায়লা চলে যায়। ক্লাস সেভেনের শেষের দিকে, এক বন্ধুর মাধ্যমে চিঠি দিতে সক্ষম হয়, অনেক জল্পনা কল্পনা, বুকের ধরপরানির অবসান ঘটিয়ে উত্তর আসে এক সপ্তাহ পর। চুমুতে চুমুতে মুখের লালা দিয়ে চিঠি ভিজে যায়, খুশিতে পানি ঝাপ দিবে নাকি আগুনে আত্মাহুতি দিবে কোন দিশ পায়না। সেদিন, মায়ের ছেলেকে মাওলানা বানানোর স্বপ্ন দুঃস্বপনে পরিনত হয়।
পড়াশোনায় চরম অধঃপতন। সারাক্ষণ চিন্তা বিভোর, চিঠি পত্র আদান প্রদান, শায়লার বাড়ির পাশে উকি ঝুকি, ভাইয়ের কথা না শোনা, মায়ের অবাধ্য হওয়া, বোনদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যায়। কিন্তু শায়লা দুইটাই, পড়াশোনা + প্রেম দুইটাই সমানতালে চালিয়ে যায়। তবে প্রেম দেয়ার নেয়ার ক্ষেত্রে দুজনই সমানে সমান!
শিক্ষকরা চিন্তায় পড়ে যান, এমন সম্ভাবনাময় ছেলে নষ্ট হবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব! ক্লাস এইটের মাঝামাঝি সময়ে এক রাতে আমার ছোটবেলার গৃহশিক্ষক আমাদের বাসায় আসেন, রাত ব্যাপী আমাকে বুঝান, প্রেম ভাল জিনিস নয়, প্রেসার ক্রিয়েট করেন এই বলে, “ তোমাদের প্রেমের বিষয়টি মাদ্রাসার সবাই জেনে গেছেন, যেকোন সময় তোমাদের পিটিয়ে লজ্জাজনকভাবে বের করে দিতে পারে, তাছারা মেয়ে তোমার দেয়া চিঠিগুলো মারদাসয় দিয়ে দিয়েছে, তার গুলো কেন তোমার কাছে রেখে দিবে, তুমিও দিয়ে দাও, যাতে প্রমাণ করা যায়, চিঠি শুধু ছেলে একা লিখেনি, মেয়েও লিখেছে।“
পরের দিন আমার সেই গৃহশিক্ষক শায়লাকে মেয়দের কমন রুমে ডেকে নেয়, ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে আমার সাথে প্রেম করে কিনা, সে বারবার অস্বীকার যাচ্ছিল, অতঃপর যখন আমার কাছে তার দেয়া চিঠিগুলো তাকে দেখায়, সে স্বীকার করে এবং ক্লাসে এসেই রাগে ক্ষোভে চলে যায়, আর আসেনি, অন্য মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। বিচ্ছেদে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল, এক সময় তিব্রতা কমে আসে। সব ভুলে গিয়ে আবারো কঠোর অধ্যাবসায়, চমক! রোলা আট থেকে এক লাফে এক! অভাবনীয় সাফল্যে মাদ্রাসায় সারা পড়ে যায়।
চিরায়ত অভ্যাস, কারো অতিরিক্ত কড়াকড়িতে ক্ষেপে যাওয়া। ক্লাস নাইনে ম্যাডামের সাথে চরম বেয়াদবি করে ফেলে। ম্যাদাম পড়া নিচ্ছিলেন, সবসময় পড়া ভালই বলতে পারে, আজ পড়া না পারার কারণে বেশ ক জন কে বেত্রাঘাত করে, তারপর সায়েমের পালা, আমিও কিছুটা ভুল করি, আর তাতেই হাতে লাগালেন বেতের বারি, ক্ষেপে যায়, “ ম্যাডাম আর একটা বারি দিলে আপনাকে চরম মূল্য দিতে হবে”। ম্যাদাম ভরকে গেলেন। এর পরে বেশ কয়েক মাস আমার পড়া ধরেন নি, আমাকে মারতেও আসেন নি। ক্লাস নাইনে একটি আদর্শবাদী সংস্পর্শে আসি, নিজের মধ্যে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসি। আচার আচরণ চলন বলন সবকিছুতে পরিবর্তন নিয়ে আসি। সেই ম্যাডাম, একদিন ডেকে বলে, “ তোমাকে বাজে ছেলে ভেবেছিলাম, কিন্তু না, আমার বুঝায় ভুল ছিল, দেরি করে হলেও বুঝলাম, তোমার মত এতো ভদ্র মার্জিত স্বভাবের ছেলে দ্বিতীয়টি চোখে পড়েনা।মন থেকে দোয়া করি, অনেক বড় হও”।
দশম শ্রেণীতে আবারো ছন্দপতন! ফাইনল পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে আবারো শায়লার দেখা, মোমের মত গলে যাওয়া কিংবা গলিয়ে দেওয়া। পুরনো প্রেম আবার জেগে উঠল পুরোদমে। আমার টানে আবারো আগের মাদ্রাসায় আগমণ, ছুটিয়ে প্রেম। আদর্শের জলাঞ্জলি। ভাইদের ডাকে সারা দেইনি বরং অবজ্ঞাই হচ্ছি করেছি। মা আক্ষেপ করে বলতেন, “মাদ্রাসায় পড়ালাম মাওলানা বানানোর জন্য, এইওসব করার জন্য নয়।“ মায়ের আক্ষেপ সায়েমের কানে যায়না, কান চোখ মুখ সব যে শায়লার দখলে! বাবাকে বলি বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব, রাজী হয়না, বহু কষ্ট করে রাজি করায়, কোচিং করে প্রথম স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ব্যার্থ হয়, ঠাই হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের বারের চেষ্টায় স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়।
হলে গণরুম দিয়ে শুরু। নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াইতে গিয়ে নিজস্ব স্বকীয়তা শেষ। খারপ চলন বলন, খারাপের মেশা, খারাপ পথে গমণ, নামাজ কালামের খোজ নেই। আশ্চ্ররজনক হলেও সত্য, ছেলেবালায় আজান হলেই নামাজে যাবার জন্য ছটপট শুরু হয়ে যেতো, আর হলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান কখন হল, তারও খবর থাকেনা। অসুস্থ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, মিছিল মিটিংইয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি অস্থির করে তুলছিল লাইফটাকে। শায়লাকে কে আর আগের মত মনে পড়েনা, একদিন সম্পর্কে ইতি টানে, না টেনেও উপায় ছিলনা, একদিন সায়েমের মা নির্জনে ডেকে নিয়ে তাকে বলে, “তুমি যার সাথে প্রেম কর, তাকে ত্যাগ কর। ঐ খারাপ মেয়েকে আমি ঘরের বউ করে আনতে পারবনা। তোমার সামনে দুইটা রাস্তা খোলা, এক, মেয়েকে বিয়ে করলে আমাকে পরিত্যাগ করতে হবে দুই, আমাকে মা হিসেবে দেখতে চাইলে তাকে পরিত্যাগ করতে হবে। আর যদি না পার এই নাও দা, এটা দিয়ে আমাকে জবাই করে তবেই ওই মেয়েকে বিয়ে কর” । সম্পর্কের ইতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই বছর সায়েমের জন্য ছিল জঘন্য, ঘৃন্য, নোংরা, বাজে কূতসিত। বিবেক তাকে প্রায় ধংসন করত, সে কি ছিল আর এখন কি হয়ে গেল, অধঃপতন। উপলব্দি করল, সে চরম বিশৃংখল জীবন যাপন করছেন, যাতে নেই শান্তি, মানুষিক তুষ্টি, শুধুই অস্থিরতা।২য় বর্ষের আড্ডা কমিয়ে দেয়, নিওমিত পড়তে বসে, মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ে, কোরআন হাদিস পড়ে। সত্যের পথে আলোর দিশারী ভাইদের বিষয়টি চোখ এড়ায়নি। তারা এগিয়ে আসে , সুশৃংখল জীবনে প্রদার্পন। দশম শ্রণীতে ছেড়ে আসা আদর্শকে আবারো জড়ীয়ে ধরে, সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করে।
দুবছরের হল লাইফে সামান্য কোন বিপদে পড়তে হয়নি, আর আদর্শের ছায়াতলে আসার এক সপ্তাহ পর চরম বিপদে আসে, মানবেতর জীবন যাপন করে মোটামোটি দীর্ঘ একটা সময় পর মুক্তি মেলে। তবু সায়েম অনেক হ্যাপি, প্রত্যাবর্তন হয়েছে ধংসস্তুপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগেই।
উক্ত গল্প থেকে শিক্ষাঃ
ছেলেবেলায় বাচ্ছারা যে বিষয় নিয়ে বেশি অনুশীলন করে, পরে তা থাকে বিচ্যুত হয়ে গেলেও জীবনের কোন না কোন সময় পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে। যেমন সায়েম আদর্শকে ধারণ করে নবম শ্রেণীতে, পরে আবারো একি জায়গায়।
কিশোর অথবা যৌবনের প্রারম্ভে কোন ছেলে বা মেয়ে ভুল করলে অভিভাবকদের জোরজবরদস্থি নয়, বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলের সাথে হস্তক্ষেপে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এই সময়টাতে অভিভাবিকদের সন্তানের উপর সতর্ক দৃষ্টি অইতীব প্রয়োজন।
প্রেমে ভাল কিছু নেই, সবি মোহ মায়া। নষ্ট করে শুধু। সায়েমের পড়ালেখার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল!
বিশ্ববিদ্যালয় এমন এক জায়গা, যেখানে কেও চাইলে ধংসের অতল গহবরে নিক্ষেপ করতে পারে আবার কেও চাইলে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে, সব উপায় উপকরণ এখানে বিদ্যমান।
------ গাজী সালাউদ্দিন
বিষয়: বিবিধ
১৬৫০ বার পঠিত, ৩৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো, অনেক ধন্যবাদ
আচ্ছা একটু বলবেন কি শায়লা এখন কোথায় কি করে ? তার বিবাহ হয়েছে ? আর আপনিও কি বিবাহ করেছেন ? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে শায়লাকে নাকি অন্য কাউকে ?
এ ঘাট পেরুনোর পরে সবাই বোঝে,
কিন্তু আগে সাবধানবানী মানতে চায়না-
শত্রু ভাবে, এমনকো মা-বাবাকেও
সবই বয়সের দোষ
মন্তব্য করতে লগইন করুন