স্মৃতির ভেলায় ভেসে বেড়াই (পর্ব-৪)
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ২১ আগস্ট, ২০১৪, ১২:১৮:২৪ রাত
জয়নাব আল গাজ্জালীর কারাগারে রাতদিন বইটি পড়ে কারাগারের ভয়াবহতা সম্পর্কে আগেই সম্যক ধারণা পেয়েছি, একবার তাঁকে উপরের দিকে পা তুলে মাথা নিচু করে ঝুলিয়ে মারবে দেখে তিনি বললেন, “মারার আগে আমাকে একটা ছেলেদের প্যান্ট দেয়া হোক”, যাতে করে মারার সময় আমার লজ্জাস্থান নিবারণ করতে পারি”।কুকুর ছেড়ে দিয়ে নির্যাতন চালাতো। গোন্তানামো বে কারাগার থেকে আসা কিছু মর্দে মুজাহিদের বিভীষীকাময় স্মৃতিচারণ শোনে কারাগার সম্পর্কে ধারণা লাভ করি।তাদের অন্ধকার ঘরে নগ্ন করে পাগলা কুকুর লেলিয়ে দিত, পানির নিচে মাথা চেপে ধরে রাখত, যখনি শ্বাস আটকে যাবে তখন ছেড়ে দিত, থেকে থেকে এইভাবে পানিতে চুবাতো, আর যোন হয়রানী ছিল নিয়মতি ব্যাপার। তাই থানায় বসে এমন দুএকজন কে কারাগার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি যারা আগেও জেল খেটেছে।
জেলখানা দেখতে কেমন, ঘর কি অন্ধকার হয়? মোটা মোটা রুটি খেতে দেয়? সাদা পোষাক পড়িয়ে ভারী ভারী কাজ করায়? যখন তখন অত্যাচার করে? জল্লাদ আর সাধারণ আসামী কি একসাথে থাকে? আচ্ছা বাহিরের কারো সাথে দেখা করা যায়? কিভাবে? এইরকম একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকি। তারা অভয় দেয় জেল খানা এতো কঠিন কিছু নয়। তুমি দেখবে সেখানে তোমাকে দেখার জন্য লোকজন হাজির। চতুর্থ দিনে আবার কোর্টে তুলে, আবার রিমান্ড চায়, কিন্তু মঞ্জুর হয়না, খালাসও দেয়না, সোজা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। জেল জীবনের শুরু হতে যাচ্ছে। একে একে সবাইকে প্রিজন ভ্যানে তুলে, এতো বেশি গাদাগাদি, নড়াচড়ার সুযোগ নেই, মদখোর, গাজাখোর, ছিন্তাকারী, বিড়িখোর, দাগী খুনি সব এক গাড়িতে। এদের সাথে থাকতে হবে! বাংলার গোয়ান্তামোতেই যাচ্ছি মনে হল।
গাড়ি এসে থামল ডাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে। সাথে সাথে অসংখ্য পুলিশ এসে গাড়ির চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে গেইটের ভিতরে ঢুকলাম। নাম এন্ট্রি মালামাল জমা দেয়ার পর( পকেটে থাকা সিম, মেমোরি ভেঙ্গে দিল) সারিবদ্ধভাবে বসানো হল তল্লাসী করার জন্য। তল্লাসী শুরুঃ তল্লাসী কখনো এতো জঘন্য হয় কল্পনাতেও ভাবিনি। শোনেছি, পাসপোর্ট করার সময় নাকি উলঙ্গ করে চেক করা হয় কোন খুত আছে কিনা দেখতে, তা কিন্তু বিশেষ রুমে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে যা হল, সেদিন লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসল।
প্রকাশ্যে সবার সামনে সবাইকে চেক করতেছিল, এমনভাবে জায়গা অজায়গা চিপা চাপায় হাত দিচ্ছিল, কাপড় সামলাবো নাকি তাদের হন্য হয়ে খুজে বেড়ানো হাত সামলাবো, দিশ মিশ পাচ্ছিলাম না, সবচেয়ে বেশি বিচ্ছিরি লাগে চেক করার সময় যখন লজ্জাস্থানের দিকে তাকায়, মুরুব্বীরা, ছোটরা সবাই সামনে, লজ্জায় মাথা তুলা যাচ্ছিলনা। আবার মুরুব্বীদেরকেও যখন এইভাবে চেক করছিল চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। কেও কেও কাতুকুতু লাগে দেখে হেসে দিচ্ছিল, আর কেওবা লজ্জায় লা জবাব।তাদের পক্ষে এটা অসম্ভব নয় যে, প্রত্যেককে আলাদা করে রুমে ডেকে নিয়ে( প্রয়োজনে উলঙ্গ করে) তল্লাসী করা। কিন্তু যাদের তামাশা বেহায়াপনা দেখতে ভাল লাগে তারাতো এইভাবেই চেক করবে!!!!!
এখন সময় জেলের ভিতরে ঢুকানোর।সিরিয়ালে সবাইকে ঢুকালো। কিছুটা দূরে আরেকটা গেইটের সামনে লিখা, ‘ রাখিব নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’।মনে মনে ভাবি, নিরাপদ রাখবে নাকি বাশঁ ঢলা দিবে কে জানে, কিন্তু আলোর পথ দেখাবে মানি কি, আলোর পথে থাকার কারনেইতো কারাগার নছিবে জুটল। সবাইকে লাইনে বসিয়ে কিছু পুরনো আসামী, তাদের হম্বি তম্বি দেখেই গায়ে জ্বর আসার মত অবস্থা, চেহারা যেমন ভয়ানক, কথা বার্তাও ভয়ানক স্টাইলের, যেন নতুন আসামীদের ভয় দেখানোর জন্য এই লোক গুলোকেই বাছাই করে আনা হয়েছে জেল গেইটে, নানান চবক দিতে থাকল, তারপর নিয়ে আসল ‘আমদানী সেলের( কারাগারের প্রথম রাত এই খানে থাকতে হয়, পরের ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্টন করা হয়) সামনে, থানায় থাকতে বারবার বুঝার চেষ্টা করেছি আমদানী সেল কি? বুঝিনি। আবারো লাইনে বসানো হল। আবার কিছু চবক, গলাবাজি, কড়া আদেশ নিষেধ, উপদেশের ঝুলিয়ে মাথায় ধরিয়ে সেলের ভিতরে ঢুকালো।
ঘরটা হলরুমের মত লম্বা, সামনে এক কোণায় চাদর দিয়ে চারপাশ ঘেরা বিশেষ কারো খানকা মনে হল, নিচে দিয়ে দেখা যায়, কেও উনার পা টিপে দিচ্ছেন। আবারো সারিবদ্ধভাবে বসানো হল, নাম এন্ট্রি করে নিচ্ছে, এইবার সামনে এলেন এমন এক ব্যক্তি যাকে দেখে যে কারো শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করবে। মাথায় টুপি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবী, গালে মেহেদী মাখা দাঁড়ি, মুখে পান চিবুচ্ছেন, সবাইকে ভাল মন্দ জিজ্ঞেস করছেন, কথা গুলো খুব গুছিয়ে বলছেন,এতো সুন্দর ব্যবহার জেলখানায়! স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল। কিন্তু এতো ভাল মানুষ, জেলখানায় কেন?
আমাদের উদ্দেশ্যে উনিঃ আপ্নারা নতুন এসেছেন, অনেক কিছুই দেখবেন, বুঝবেন, জেলখানা বাড়ি ঘর নয়, জেল খানা অনেক খারাপ জায়গা, গত বিশ বছর ধরে আমি এখানে আছি, অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু সয়েছি, সবার অবস্থা যেন আমার মত না হয় তাই আপনাদের সামনে হাজির হওয়া আমার অভিজ্ঞতার ঝোলা থেকে কিছু শেয়ার করা। আপনাদের এইখানে অনেক কষ্ট হবে, অনেক কষ্ট দিবে।তবে গত বিশ ধরে আছি বলে বিশেষ কিছু পাওয়ার আমাদের আছে, তাই আমি থাকতে আপনাদের কষ্ট রাখতে পারিনা, মানুষ হয়ে মানুষের বিপদে পাশে দাড়াঁতে না পারলে আমার মানব জন্ম বৃথা! আপনাদের সঙ্গেই আছি, চিন্তার কোন কার নেই। আচ্ছা আপ্নারাতো কিছু খাননি, জেল কর্তিপক্ষ আপনাদের জন্য খিছুরীর ব্যবস্থা করেছেন, খেয়ে নিন, তারপর আবার কথা হবে।“
জেল খানায় এতো ভাল মানুষ থাকে!!!! খেতে বসলাম এক প্লেটে দুজন করে, খিছুরীর শ্রী দেখে অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেছে। পেটেও ভীষণ ক্ষুধা, দেরি না করে প্লেটে হাত চালাই, মুখে তুলতেই কড় কড় শব্দ, একি পাথরে ভরা! থেমে নেই, জানি এইসব খেয়েই থাকতে হবে, অনুশীলনটা এখান থেকেই শুরু করা যাক, তাই না চাবিয়ে গিলে ফেলতে থাকি, চোখের কোণে জল আসে, বাধ দিয়ে রাখি, পাশের একজনতো ভেউ ভেউ করে কান্না জুরে দিল ,মায়ের কথা মনে করে, বলে, তার মা যদি জানে ছেলে এইসব খাবার খায় নির্ঘাত মারা যাবে। খাওয়া শেষ করে হাত ধুইতে গিয়ে দেখি হাউজ থেকে কেও পানি নিয়ে অজু করছে, কেও টয়লেটের পানি নিচ্ছে, কেও পানি নিয়ে পাশেই গোসল করছে, পানির ছিটকা গিয়ে পড়ছে হাউজের উপর, আবার সেই পানিই বাটিতে করে নিয়ে সবাই খাচ্ছে, কি আর করা সবার অনুসরণ করলাম।
এইবার অবাক হবার পালা, সেই মহান মানুষটি, দাঁড়িওয়ালা দমদমা হুজুরের আসল রুপ চেনা গেল, তিনি আসলে একটা ভদ্র বেশি মিষ্টি ভাষী শয়তান!!!!! ঐ যে বলেনা, লঘ্যুর কথা সুন্দর, হাডা( বেটা) ছাগল ছানার আন্ডা সুন্দর! ঠিক তেমনি মিষ্টিভাষী হুজুর।অন্তরে বিষ! খাওয়ার পর আবার বসলেন আমাদের নিয়ে, আমাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিক্রি করবেন, তিন হাজার ৫হাজার সাত হাজারের অফার তুলে ধরলেন, যাতে থাকবে জেল খানার মত জায়গায় রাজকীয় হালতে থাকার মনোরম সুব্যবস্থা………
পরের পর্বে থাকবে, মনোলোভা অফারে রাজী না হওয়ার যত বিরম্বনা! আশা করি সঙ্গেই থাকবেন।
বিষয়: বিবিধ
১৬২২ বার পঠিত, ২৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমাদের দুর্ভাগ্য দেশের অনেক মন্ত্রিই একসময় জেলে কাটিয়েছেন। জেলের এই সব অমানবিক নিয়মকানুন সম্পর্কে অভিজ্ঞ। কিন্তু তারা এর পরিবর্তন এর কোন চেষ্টাই করেননা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন