স্মৃতির ভেলায় ভেসে বেড়াই ( পর্ব-৩)
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ১৭ আগস্ট, ২০১৪, ১০:০১:০৯ সকাল
আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করব, পাঠকের আগ্রহ সৃষ্টিতে দরকার সুন্দর নজরকাড়া উপস্থাপনা, কিন্তু আমি চেষ্টা করেও পারিনা, তাই সাদামাটাভাবেই লিখলাম, পড়ে বিরক্ত হলে ক্ষমা করবেন!
স্মৃতির ভেলায় ভেসে বেড়াই (পর্ব-২)
কেও দেখতে আসেনাঃ
রিমান্ড শেষ, ৩দিন হয়ে গেল, কেও দেখতে এলোনা। সবার আত্মীয় স্বজন আসে, কাঁদে কাঁদায় স্বান্ত্বনা দিয়ে যায়, আমার কেও আসেনা। বাড়িতে জানাইনি বা জানাতে পারিনি এই জন্য যে, আমাদের খুব সামান্যই ফসলি জমি আর ভিটে মাটি আছে, একবার বাবা থানায় আসলে ফতুর হয়ে বাড়ি যাওয়া লাগবে। তবে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুকে মোবাইলে মেসেজ 'বন্ধু গ্রেপ্তার অয়ে গেছি' লিখেই ডিলেট করে ফেলি তখনি টান দিয়ে মোবাইলটা নিয়ে নেয় পুলিশ, খুঁজতে থাকে গোপন কিছু পাওয়ার আশায়, ততক্ষণে ডিলেট! ধারণা ছিল, বন্ধুটি আমার বাড়িতে জানিয়ে দিবে। ঢাকায় আত্মীয় স্বজন কেও ছিলনা, বন্ধুরা আসতে পারত, তবে তাদের ও শতভাগ গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তাই ভয়ে কেও আসেনি। আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল। কত জনের কত তদবির করছে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য, আমার তো কেও নেই কি হবে!!!! 'এই পথে' নতুন আসা, তাই ইমানের জোর এতো বেশি ছিলনা যে ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করব।
পুলিশের সেরা সময়, কাড়ি কাড়ি টাকাঃ
একসাথে ৩৯ জন গ্রেপ্তার, পুলিশের চোখে মুখে আনন্দ ধরেনা। আগামী একটা বছর পরিবার পরিজন নিয়ে মহা সুখে থাকা যাবে। উপরি পয়সা আয়ের এমন সুযোগ তো বারবার আসেনা, তাই আনন্দের ঠেলায় টালমাটাল অবস্থা। এক বন্ধু আমার সাথে গ্রেপ্তার হয়, তার বাড়ি ঢাকার পাশে একটা জেলায় বিধায় আত্মীয় স্বজনদের পুলিশের কাছে দৌড়ঝাপ শুরু , দিতে দিতে ৪০ হাজার টাকার উপরে দেয়া হয়ে গেছে, তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবি নাজুক তবু ছেলেকে মুক্ত করার আশায় কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালল। লাভের লাভ কিছু হয়নি, উলটো পুলিশের পেট তাজা হল। আরেক জন ঢাকার স্থানীয়, গার্ডিয়ান চালাক চতুর, তারাও পুলিশের টাকা কামায়ের ধান্ধায় নাস্তানুবাদ হল, ২০ হাজার টাকা খোয়া গেল, অন্য একজনের ১৫হাজার, বাকীদের গার্ডিয়ানের কাছ থেকেও ইচ্ছেমত টাকা আদায় করল। কিন্তু কাওকে ছাড়েনি।
অবশেষে ভাইয়ের আগমণঃ
তিন দিনের মাথায় ভাই আসে, আমি তখন ১৪ শিকের পাশে একটা বোতল মাথায় দিয়ে খালি ফ্লোরে জীর্ণ শীর্ন দূর্বল শরীরে পড়ে আছি। বাহির থেকে আওয়াজ আসে, "ঠিক দুই মিনিট, এর বেশি নয়, এই সময়ের মাঝেই কথা শেষ করে নিতে হবে," বুঝলাম, কারো আত্মীয় আসল, কিছু পরেই মাথার কাছে আসতে করে নাম ধরে ডাক, শোনেই উঠে বসি, দেখি ভাই, ধক করে উঠল বুকটা, হারিয়ে যাওয়া হাসি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে এক চিলতে হাসি হেসে কুশল বিনিময় করলাম। চোখে চোখ পড়াতে আবেগে আপ্লুত, কান্না রোধ করার চেষ্টা, ভাইয়ের চোখে পানি টলমল করছে, দেড় বছরের বড় ছোট আমরা, কখনও তার চোখে পানি দেখিনি, আজ আমার জন্য...... আমার এই নিথর পড়ে থাকা দেখে ভাইয়ের কষ্টে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে উপলব্দি করতেই চোখে পানি এসে গেল, লোকানোর চেষ্টা করলাম। ঐ দিকে হাক ডাক শুরু, সময় শেষ চলে যান। তারাতারি বাবা মার কথা জিজ্ঞেস করে নিলাম।
গ্রেপ্তারে দেশের বাড়িতে প্রতিক্রিয়াঃ
তারপর ভাই অফিসারের রুমে গেলেন, আমাকেও সেখানে ডেকে ভাইয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিল। আমার গ্রেপ্তারের বিষয়ে বাড়িতে প্রতিক্রিয়া ভাইয়ের মুখেঃ " তুই গ্রেপ্তার হয়েছিস তিন দিন হল কিন্তু বাড়িতে জানেনা, সবাই ধরে নিয়েছে 'গুম' করা হয়েছে। মা পাগলের মত হয়ে আছে, নাওয়া খাওয়া একদম ছেড়ে দিয়েছে, শুধু একটাই কথা, যেখান থেকে পার, আমার ছেলেকে এনে দাও। ছোটবোন কেঁদে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলছে, গ্রামের সবাই এসে স্বান্ত্বনা দিচ্ছে মাকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছেনা। আর কেও কেও এসে নানান কথা বলে যাচ্ছে, তোকে মেরে ফেলেছে, গুম করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তোকে ফোনে না পেয়ে আমার, বিশ্ববিদ্যালয় হলে তোর বন্ধুদের ফোন দিয়েও যখন তোর কোন খোঁজ পেলনা, সবাই ধরেই নিয়েছে, তুই গুম হয়ে গেছিস, সবাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করে কিন্তু কেন? যে ছেলে কারো সাথে ঝগড়া করেনি, গ্রামের সহজ সরল একটা ছেলে কেন গুম হবে, ঢাকা শহরে গিয়ে কি বড় অপরাধী হয়ে গেল, কিন্তু তার আচার আচরণে তো তার প্রকাশ পাবে! তাওতো দেখছিনা। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকে। খেতে বসলেই দেখি ভাত মাংসের প্লেট হাতে সবার চোখে পানি, কারণ ঈদের দুইদিন পর চলে আসলি, এতো গোশত তোকে ছাড়া কেমন করে খাবে! ভাতের প্লেট রেখে দিয়ে বলে, আমরা কত কি খাচ্ছি, আমাদের ভাইটা কি বেঁচে না মরে গেছে, এই বলেই সবাই একযোগে কান্না!"।
টাকা দিয়ে কি মক্তি মিলবেঃ
ভাইয়ের বিদায় নেবার পালা, ভাইকে উদ্দেশ্য করে পুলিশ, তোর ভাইকে দেখে মনে হয় সে 'এইসব' করেনা, ট্র্যাকে পড়ে গেছে, মামলা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে, এখন আর কিছু করার নেই। তবে এক কাজ কর, আজ দেশের বাড়ি চলে যা, তোদের থানায় গিয়ে তোর ভাই এলাকায় ভাল ছিল খারাপ ছিল তার উপর একটা রিপোর্ট নিয়ে আসবি, টাকা বেশি লাগবেনা, মাত্র ৪/৫ হাজার। আমি দেখি কিছু করার যায় কিনা। এই কথা শোনে ভাইয়ের সাথে যে বন্ধুটি আসছে, সে বলে আচ্ছা আমরা কি তার সাথে একটু আলাদা কথা বলতে পারি? অনুমতি দেয়া হল।
" আচ্ছা তুমি কি বল, থানায় টাকা পয়সা দিলে কোন কাজ হবে? যদি ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যাবস্থা করা যায়"। না , একদম টাকা দিবেন না। তবে এলাকায় থানায় চাইলে সেটা বিবেচনা করতে পারেন তবে ১ হাজারের বেশি দিবেন না। যাবার সময় ভাই আবারো জিজ্ঞেস করে নিল, সত্যি করে বল, তোর উপর টর্চার করেছে?। না, তবে প্রথমে ধরেই কিছুটা মেরেছে। পরে জানলাম থানায় ৫ হাজার টাকা দিতে হল, পুলিশ বাড়িতে ইনকোয়ারি করতে সেখানেও বাবা কে ভয় ভীতি দেখিয়ে ৪/৫ হাজার টাকা নিয়ে যায়। যা পুলিশের চিরায়ত খাছলত।
থানা পুলিশ যখন পাওয়ারলেসঃ
কাওকে ধরে থানায় মামলা দিতে পুলিশ সময় নেয় ১ থেকে দেড় ঘন্টা। অভিভাবকদের দেন দরবার যা করার এই সময়ের ভিতরেই করতে হয়। টাকা পয়সা হাত জোর করে অনুনয় বিনয়, বড় বড় মামু খালুদের ফোন সবি ঐ এক দেড় ঘন্টার মধ্যেই। তারপর শুধুই টাকা খাবে, পুলিশের বাপের ক্ষমতা নেই ছেড়ে দেয়ার। তখন সব হয়ে যায় আদালতের এখতিয়ার। অভিভাবকরা ব্যাকুল হয়ে আসবে, যেকোন কিছুর বিনিময়ে ছাড়িয়ে নিতে চাইবে, তাদের এই দূর্বলতা পুলিশ ভালভাবেই কাজে লাগাবে, বলবে, আপনার ছেলে বোম সহ ধরা পড়েছে, আমাদের কাছে সব রেকর্ড আছে, ভিডিও ফুটেজ আছে, তার ছারা পাবার কোন সম্ভাবনা নেই, যাবজীবন নয়ত ফাঁসি!
^^ভূঁড়ি মাটি ছুঁই ছুঁইঃ ^^
শোনেই বেহুশ হওয়ার মত অবস্থা, তারপর পুলিশের হাতে পায়ে ধরে, " প্লিজ এমন নিষ্ঠুর কথা বলবেন না, একটা কিছু করেন, আমার ছেলেকে বাঁচান'। খুব ভাবের সঙ্গেই পুলিশ বলবে, আমার কিছু করার নেই, তার অপরাধ অনেক বড়, তবু যখন এতো করে অনুরোধ করছেন, আমরাওতো মানুষ, আপনাদের দুঃখ বুঝি, ছেলে মেয়ে আমাদেরো আছে, তাহলে কিছু টাকা খরচ করতে হবে, তারপর টাকা নিয়ে দরকষাকষি, টাকার অংক যত বড় হোক না কেন, ছেলের বাবা দিতে রাজি হবে, তবু ছেলেকে যদি বাচানো যায়। তবে হা, পুলিশ একটা কাজ করতে পারে, টাকা পয়সা খেয়ে হালকা কোন মামলা দিলে একদিনে জামিন হয়ে যেতে পারে, তবে এতো হালকা মামলা শুধু চিঁচকে চোর, পকেট মারদের দিতে দেখেছি, আমাদের মত লোকদের থেকে টাকা খেয়েও শক্ত মামলাই দিয়েছে। থানায় ক দিন থেকে চরম একটা অভিজ্ঞতা হল, মিথ্যা কথা আর ঝারি দেয়াতে পারদর্শি হতে পারলে জীবনে চরম উন্নতি করা সম্ভব, যার উতকৃষ্ট উদাহরণ পুলিশ, চাকুরীতে জয়েন করার সময় পেট থাকে পিঠ ছুঁই ছুঁই, কদিন পরেই ভূঁড়ি মাটি ছুঁই ছুঁই......
পরের পর্বে থাকবে জেল গেইটে প্রকাশ্যে ছেলে বুড়োর একসাথে জায়গায় অজায়গায় হাত দিয়ে জামাকাপড় টেনে টুনে তল্লাসীর নামে বেহায়াপনার মহাউতসব বর্ণনা। আশা করি সঙ্গেই থাকবেন। কষ্ট করে পরেছেন বলে অশেষ ধন্যবাদ।
বিষয়: বিবিধ
১৪১৩ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাযাকাল্লাহ খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন