স্মৃতির ভেলায় ভেসে বেড়াই (পর্ব-২)
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ১৫ আগস্ট, ২০১৪, ০৭:১৭:১৯ সকাল
খাবার আনতে গিয়ে ভাইটি ধরা পড়ায় সেদিন খাওয়ার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যায়। রাত বাড়ছে, রিমান্ড ভয়ে ঘুম হারাম। মাঝে মধ্যে পুলিশ এসে হাকডাক দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ করে হুমকী দেয়, " খুব নেতা হয়েছিস, কিছু পরেই বুঝবা মজা! ইলেকট্রিক শক! গরম ডিম থেরাপি, বাপ-মায়ের নাম ভুলায়ে দিমু!" সিরিয়াল ধরে নাম ডাকছে। প্রথম দশজনে আমার নাম নেই। আবার আসে, বলে যায় এই সিরিয়াল হবেনা। নতুন সিরিয়াল করা হচ্ছে। এইবার দশজনের ভিতরে আমার নাম! দুহাতে হ্যান্ডকাপ পরায়। তারপর হাত দুটি পেছনের দিকে নিয়ে কোমরে মোটা রশি বাঁধে। একই রশিতে সবাইকে বেঁধে গাড়িতে উঠায়। ভয়ে ভয়ে পুলিশকে জিজ্ঞেস করি, আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। " মিন্টো রোড, ডিবি অফিসে," জবাব দেয়। একজন পুলিশের কাধে ব্যাগ। ব্যাগ কেন, জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় আমাদের সবার মোবাইল। ডিবি অফিসে নিয়ে চেক করা হবে। শুনে গলা শুকিয়ে কাঠ।
থানায় দুই একটা পাতলা কম্বল থালকে ডিবি অফিসে থাকার জায়গায় তাও ছিলনা। চরম ভুতুরে পরিবেশ। এক কক্ষে অনেক লোক গাদাগাদি করে পড়ে আছে। আমাদেরকে ঠেলে দেয়া হয় ভিতরে। কক্ষের চারদিকে পানির খালি বোতলের ছড়াছড়ি। তা দিয়ে চলছে বালিশের কাজ। ক্লান্ত শরীরটাকে ফ্লোরের উপর এলিয়ে দিলাম। মাথা রাখলাম বোতলের উপর। ক্ষাণিক পরে কারও পায়ের শব্দ। "এই নতুন এসেছিস কারা, হাত তোল, একে একে নাম বল। এই তাদের কিছু খাইতে দে। তারপর দেবনি কঠিন ধোলাই"। বলল ডিবি পুলিশের একজন। খাবার আনা হল। ভাত, মাছ ও ডাল। মারের ভয়ে ক্ষুধা চলে গেছে। তবুও খাওয়ার জন্যই খেয়ে নিলাম। গলাধঃকরণ! কখন ডাক পড়ে কখন ডাক পড়ে, অযাচিত অপেক্ষার মধ্যেই রাত বারোটায় ডাক পড়ে।
জিজ্ঞাসাবাদ শুরু----- "মিছিল আসলি কেন, গাড়িতে আগুন দিলি কেন? বলল ডিবির একজন। টেলিভিশনের দিকে ইশারা করে বলে, "দেখ কিভাবে পুলিশের উপর হামলা করেছিস? পুলিশকে রক্তাক্ত করলি কেন"? "স্যার, আমি মিছিলে যাইনি, গাড়িতে আগুন দেইনি, আর পুলিশকেও আক্রমণ করিনি"। জবাব দেই। "তাহলে 'স্পটে' আসলি কেন"? প্রশ্ন করে। "স্যার 'এই পথ' দিয়ে সবসময় যাতায়াত করি। আজও বাসে করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাসটি থেমে যায়। সামনে গোলযোগ বেঁধে গেছে। দ্রুত বাস থেমে নেমে পাশেই এক মসজিদে ঢুকে পড়ি। তখন আসর নামাজের ওয়াক্ত। তাই নামাজ পড়েই বের হই। ঠিক তখনই সন্দেহের বশে পুলিশ আটক করে। কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে থানায় নিয়ে খুব মারদোর করে"। আমি একটানে বলে যাই।
"বুঝলাম মিছিলে আসছনাই, এখন বল কোথায় পড়িস, কি করিস? রাজনীতি করিস?"। " আমি বাংলাদেশের সেরা বিদ্যাপীঠ ......... বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, হলে থাকি, সাধারণ ছাত্র, পড়াশোনা ঘুম খাওয়া দাওয়া এই আমার কাজ, রাজনীতি করিনা, কিন্তু ছাত্রলীগের ভাইয়েরা ডাকলে মাঝে মধ্যে মিছিল মিটিংয়ে যাই, কারণ হল হল সেক্রেটারি আমাকে বর্তমান রুমটি দিয়েছে, কৃতজ্ঞতাস্বরুপ তাদের ডাকে সাড়া দেই"। বুঝতে পারলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শোনে তার মধ্যে কিছুটা নমনীয়ভাব কাজ করল। "আচ্ছা তুইত বললি, সাধারণ ছাত্র, তাহলে তোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুরা আন্দোলন করছেনা কেন?" " যদি তারা শোনত ঠিকি আন্দোলন করত, কিন্তু তারা কেন, দুদিন হল এখনো পর্যন্ত গ্রেপ্তারের বিষয়টি বাড়িতে জানাতে পারিনি"। "মোবাইল কোথায়? বের কর, দেখি কোন কোন নেতার সাথে কল আর মেসেজ আদান প্রদান করেছিস।" মনে ভয় তবু সাহসের সাথেই বললাম, "মোবাইলতো আপনাদের কাছে তবু চেক করে নিতে পারেন"। তোর কথা শুনে হচ্ছে সত্য বলতেছিস, তোর রুম মেইটদের নাম্বার দে কথা বলি।" "নামবার মুখস্ত নেই"। অন্য এক অফিসার কে লক্ষ করে "ভাই, তার কথা সত্য মনে হচ্ছে কি করব?" হা কচু বলছে সত্য! ওরে কঠিন ধোলাই দিতে হবে, রুম্মেইটদের নাম্বার মনে নাই! উল্লেখ্য যে, কথা বলার সময় আমার পেটে বেশ কয়েকবার খুব জোরে চিমটি কেটেছে আর কান মলে লাল করে দিয়েছে।
এইবার অন্যদের পালা। শশ্রুমন্ডিত একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। সাথে চলছে লাথি, চর-থাপ্পর, ঘুসি, কান মলা, দাঁড়ি ধরে হেস্কা টান। মুখে অহংকার নিয়ে, " আমি লীগের গুন্ডা। মানুষ মেরে হাতের মাশল শক্ত করেছি। ভালই ভাল সব বলে দে, নয়ত আমার আসল রূপ দেখতে পাবি," বলল জিজ্ঞাসাবাদকারী। প্রথম বারে আমাদের পাঁচ জনকে ডাকে। আমি ছাড়া বাকী সবাইকে নানান ভাবে নির্যাতন করে। তারপর আমাদেরকে আগের সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। 'যেকোন সময় আবার ডাকতে পারি', ভয় ধরিয়ে দিয়ে যায় একজন। কক্ষে যাওয়ার সাথে সাথে বাকীরা উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চায়, কি জিজ্ঞেস করেছে? মেরেছে খুব? মারবেনা বলে আশ্বস্ত করি তাদের। সেদিন মনে হয় ডিবির রহম হয়েছে। বাকী পাঁচ জনকে তেমন নির্যাতন করেনি। কিন্তু কখন আবার ডাকবে! ভয়ে জড়সড়! ঘুম কি আসে! এক আধটু তন্দ্রা এসে পরক্ষণেই সজাগ হয়ে পড়ি। বোতলের মরমর শব্দ তো আছেই। বহুদিন ধরে সেখানে আটকে থাকা ক'জন আসামী শোনায় তাদের উপর অত্যাচারের কাহিনী। যা শুনে আমাদের ভয় বহুগুণ বেড়ে যায়।
"ভাইরে, গত চার মাস ধরে বিনা বিচারে পড়ে আছি। আদালতে তুলেনা। দিক যাবজ্জীবন অথবা ফাঁসি। বিনা বিচারে পচতে চাইনা। এখন যদিও ডাকেনা, মাইর ধর করেনা। কি দিন, কিবা রাত অথবা গভীর রাত। যখন তখন ডেকে নিয়ে দফায় দফায় নির্যাতন চালাত। রশিতে ঝুলিয়ে মারত। পশ্চাৎদেশে গরম ডিম দিত বার কয়েক। পায়ের পাতায় এতো জোরে মারত যে শরীরে বিদ্যুত প্রবাহ খেলে যেত। দিত গরম পানি থেরাপী। এসব করত চোখ বেঁধে। মাঝে মাঝে শূন্যে তুলে বলত, 'তোকে পানিতে ডুবিয়ে মারব'। ইলেক্ট্রিক শকে শেষ বিন্দু পানিটুকু যেন শুকিয়ে যেত। একদফা শেষ করে ঘা শোকানোর আগেই শুরু হতো আরেক দফা নির্যাতন। নিত্য নতুন কৌশলে অত্যাচার-নির্যাতন। গলা ফাটা চিৎকার, মার থেকে বাঁচার কতশত কাকুতি মিনতি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাদের দেখে বুঝেছি মানুষ মারায় আনন্দ আছে। মরেইত গিয়েছিলাম প্রায়। এখনও বেঁচে আছি, এ যে বিস্ময়! কখনও আরাম করে ঘুমাতে পারিনা। কখন ডাক পড়ে, চালায় নিষ্ঠুর নির্যাতন।
সেই রাতে আর ডাকেনি। নির্ঘুম কাটিয়েছি পুরো রাত। পরের দিন সকালে আরও দশজন আসামীকে থানা থেকে ডিবি অফিসে নিয়ে আসে। আমাদের চেহারায় কিছু বুঝে নেয়। চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে, মেরেছে কি? "খুব একটা মারেনি," তাদের আশ্বস্ত করি। 'ভয় পাবেন না, সাহস রাখুন বুকে,' আবারও তাদের সাহস দেই। পরে থানায় নিয়ে আসা হয়। বাকীদের যখন আনা হয়, দেখি কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা। হাঁ
খুড়িয়ে খুড়িয়ে পুলিশের কাধে ভর হাটছে।
দু'একজন বলেই ফেলে, "তোরা না বলেছিস কিছু করবেনা। শুধু মেরে ফেলাই বাকী ছিল। কয়েকবার করে মেরেছে!" পরের বার শেষ বাকী দশজন কে নিয়ে গেল। তাদেরকে খুব একটা টর্চার করেনি। তবে থানায় বারবার ডেকে নিয়ে নানাভাবে নাজেহাল করেছে। বুকে নেইম প্লেট লাগিয়ে 'আমি মিছিলকারী' 'গাড়ি ভাংচুরকারী' লিখে ফটো সেশন করে পত্রিকায় ছেড়ে দেয়। প্রথম দফার তিন দিন রিমান্ড শেষ হল।
আগামী পর্বে থাকবে, আসামী ধরে অভিভাবক কে ভয়ভীতি দেখিয়ে, হয়রানী করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিশদ বর্ণনা, আশা করি সঙ্গেই থাকবেন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৬৪ বার পঠিত, ৩৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনিও ভাল থাকবেন, আর হা, সম্ভবত আমি আপনার ছোট হব, অনার্স ফাইনাল ইয়ার লাস্ট সেমিস্টার চলছে, তাই ছোট হয়ে থাকলে তুমি করে বলার অনুরোধ রইল।
আমার কম্নেট বক্সে আপনার আগমণ বাড়তি ভাললাগার কারণ হয়ে থাকবে। অশেষ ধন্যবাদ।
জাযাকাল্লাহ খাইর।
জাযাকাল্লহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন