স্মৃতির ভেলায় ভেসে বেড়াই (পর্ব -০১ )
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ১১ আগস্ট, ২০১৪, ০৮:১৪:৫৩ রাত
স্মৃতির ভেলায় ভেসে বেড়াই (পর্ব -০১ )
নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হতেই দু'জন পুলিশ এসে হাত চেপে ধরে। ঘাবড়ে যাই। হাত ধরলেন কেন? প্রশ্ন করি।
পুলিশ: থানায় চলেন।
আমি: কেন থানায় যাব?
পুলিশ: আগে চলেন, যা বলার সেখানে গিয়ে বলবেন। আমরা স্যারের হুকুম পালন করছি মাত্র।
অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে। এ কোন ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছি। অগত্যা হেঁটে চলি থানার দিকে।
গরু বা ছাগল যেমন হাঁটতে না চাইলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়, ঠিক তেমনই আমাকেও নিয়ে চলে। আর আমিও মন্ত্র মুগ্ধের মত হেঁটে চলি তাদের সঙ্গে সঙ্গে।
থানার কাছাকাছি যেতেই একজন চিৎকার করে বলে, "ঐ শালারে মেরে হারগুড় ভেঙ্গে দে, হারামির বাচ্চা কোথাকার"!
থানায় ঢুকিয়ে ধপাস করে চেয়ারে বসায়। মুহুর্তের মধ্যে বাহির থেকে একজন এসে গায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে। যেন আমাকে নয়, তুলার বস্তার উপর লাঠি চালাচ্ছে! চোখ বন্ধ করে মার খেয়ে যাচ্ছি, প্রতিটি লাঠির আঘাতের সাথে সাথে লোকটার মুখ থেকে গর গর শব্দ বের হচ্ছিল। সব রাগ আমার উপর ঝেরে তবেই ক্ষান্ত হয়।
উত্তম-মধ্যম দেওয়ার পর একে একে সবাইকে ১৪ শিকের ভিতরে ঢুকায় গরুর মত হট হট করে...। কারও পিছনে লাথি, কারও পিঠে ঘুষি চলছে অবিরাম। আর মুখ দিয়ে যেসব বাংলা বুলি অনর্গল বের হয়, তা লেখায় আসার যোগ্যতা রাখেনা। পকেট হাতিয়ে টাকা-পয়সা, মোবাইল, যা পেয়েছে, নিয়ে গেছে, ওসব আর কখনোই ফিরে পাওয়া যায়নি।
পিছন থেকে একের একের পর কমান্ড...কোমর থেকে বেল্ট খুল, বলতে না বলতেই সজোরে লাথি। জোতা খুল, আবারও লাথি। টাকা-পয়সা আছে কিনা দেখি? দেখে, নিয়ে যায়। আর কখনোই ফিরে পাইনি।
ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়। হয়ে যাই খাঁচায় বন্দী। মুক্তির প্রতীক্ষায় প্রহর গোণা শুরু..................
যে ঘরটিতে ঠেলে দেয়া হয়, আয়তনে নেহায়েৎ ছোট নয়, তিন চার জন থাকার জন্য যথেষ্ঠ। যা হবার হবে, এইবার একটু জিরিয়ে নেই। ঘরটির চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেই। বলার মতো তেমন কিছুই নাই। তবে মাথার উপর ঝুলছে ২০০ পাওয়ারের লাইট, এক পাশে টয়লেট, দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় কলার ছাল, আপেলের কিয়দংশ। দেয়ালে কিছু লেখালেখি।
হঠাৎ চোখ পড়ে হাতের ডান পাশে। টয়লেটের অবস্থা ভয়ানক। এটির দেয়াল কোমর পর্যন্ত। দেয়ালের দিকে সামনের দিক কিন্তু দরজা নেই। পেশাবের পানি সরে যেতে না পেরে আমাদের শোয়া-বসার স্থান ছুঁয়ে যায়। নিরুপায়। আমরা তো আসামী।
এরই মাঝে আবার হৈ চৈ, চিল্লা বাল্লা। একের পর এক লোক ঢুকাচ্ছে। কারও গায়ে রক্তমাখা শার্ট, ভিজে চোপ চোপ করছে। কারও কপাল ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বুটের আঘাতে কারও গাল ফুলে বীভৎস আকার ধারণ করেছে, তিন চার জন থেকে সংখ্যাটা ক্রমে বেড়েই চলতে লাগল......
ঘণ্টা পাচেকের মধ্যে রুমটা ভরে যায়। লোক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ থেকে ২৫ জন। কোন রকমে চেপে চোপে বসবার ব্যবস্থা করতে পারি। সময় যাচ্ছে, দুশ্চিন্তা বাড়ছে। আহত মানুষগুলোর চিকিৎসার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরেই যাচ্ছে, বন্ধ করার কোন উপকরণ আমাদের হাতে ছিলনা। বার বার পুলিশকে ডেকে কাকুতি-মিনতি করার পরও তাদের দিক থেকে আশাব্যঞ্জক কোন উদ্যোগ নেয়া হয়না। দায়িত্ববোধ থেকে কিছু করার তাগিদ অনুভব করলেও অসহায়ত্বের কথা মনে করে নির্বাক অশ্রু বিসর্জন দিয়ে সমবেদনা জ্ঞাপন করি। অবশেষে মধ্যরাতে আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, ততক্ষণে রক্ত স্রোতের গতিধারা শ্লথ হয়ে আসে। অশ্রু সিক্ত নয়নে দ্রুত আরোগ্য কামনা করে বিদায় দেই......
এত লোক, জায়গা সংকুলান হয়না। ধানের বস্তায় যেমন ক্যাযানি দিয়ে বেশি ধান রাখা হয়, ঠিক তেমনি আমাদের মাখামাখি করে দেয়। মধ্য রাতের দিকে তাদের দয়া হয়। আমিসহ আমাদের কিছু লোককে পাশের একটি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। হাত দু'টি পিছনে নিয়ে হ্যান্ড কাপ পরিয়ে, কোমরে মোটা রশি লাগিয়ে একজনের সাথে অন্যজনকে বেঁধে নিয়ে চলে। গাড়ির কাছে আসতেই টিভি ক্যমেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে ক্যাপচার শুরু হয়ে যায়। লজ্জায় তখন মাথা হেট হয়ে যায়, এ কোন ফাঁপড়ে পড়লাম!
সেখানে রুমটা তুলনায় বেশ কিছুটা ফাঁকা। কিন্তু তাতে যোগ হয় নতুন বিপত্তি। ফ্লোরে বিছানোর মত কিছু ছিলনা। জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে। ঠাণ্ডায় শরীর জমে যাওয়ার মত অবস্থা। চিন্তায় পড়ে যাই, ঘুমাব কিভাবে! পেটে নেই ভাত, ক্ষুধার যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়ছে। আমাদের করুণ অবস্থা দেখে দায়িত্বরত একজন পুলিশ কিছু পুরনো পত্রিকা দিয়ে যায় কোনো রকম রাতটা পার করা যায়।
শুয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করি। পেটের ক্ষুধায় ঘুমও আসছেনা। বুঝে উঠতে পারিনা, না খাইয়ে মেরে ফেলবে নাকি! খাবার-দাবার কিছুই দেয়না, কেউ জিজ্ঞেসও করেনা খেয়েছি কিনা! একজন পুলিশ ভাইকে জিজ্ঞেস করি, আমাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে যাবে কিনা? তিনি জানান, নিয়ে যেতে পারে। মারদর করবেনা, শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তিনি আশ্বস্ত করেন। ঘুমাবার চেষ্টা......
সারারাত গলাকাটা মুরগীর মত ছটপট করে অবশেষে ভোরে মুয়াজ্জিমের সুমধুর কন্ঠে আযানের সুর কানে ভেসে আসতেই অযু করে নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে যাই। অনেক করে কেঁদে কেঁদে প্রভুর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করি। সময় যাচ্ছে, দুশ্চিন্তা বেড়েই চলছে। অজানা ভয়-আতঙ্কে হৃদয় কেঁপে কেঁপে ওঠে। মনের ভিতর নানা চিন্তা মাথাটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কি হতে যাচ্ছে আমার জীবনে!
সকালেও কোন খাবার দেয়নি। কারও কারও আত্মীয়-স্বজন এসে কিছু খাবার দিয়ে যায়, তাও ছিল যৎসামান্য। এই সামান্য খাবার পেটে যাওয়াতে পেটের চাহিদা আরও বহু গুন বেড়ে যায়। সকাল এগারোটার দিকে ডাক পড়ে। আবার হ্যান্ডকাপ, কোমরে মোটা রশি বেঁধে অফিস রুমে নিয়ে গেলে সেখানে কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ, পারিবারিক ব্যকগ্রাউন্ড সম্পর্কে তথ্য আদায় করা হয়। হুমকি ধমকিতো আছেই।
দুপুর দুইটার দিকে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান হয়। একে একে সবাই গাড়িতে উঠি। তিল ধারণের ঠাই নাই, নাই বসার ব্যবস্থা। পেটের ক্ষুধায় নড়া চড়া করার শক্তিও হারিয়ে গেছে। কোমর থেকে বেল্ট আগেই খুলে নেয়া হয়। এক হ্যান্ডকাপ দিয়ে দু'জনের হাত বাঁধা, না পারছি গাড়ির হেন্ডেল ধরতে, না পারছি কোমরের প্যান্ট ধরতে, যা বার বার পড়ে যাচ্ছে। একটু নড়া চড়া করতেই হাতের হাড্ডি যেন ভেঙ্গে যাবে। গাড়ি এসে আদালত প্রাঙ্গনে দাঁড়ায়। বিপুল পরিমাণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের দুপাশে দাঁড়ায়। আর তাদের একজন উচ্চ গলায় বলতে থাকে, কেউ পালাবার চেষ্টা করবিনা......
কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে আদালতের কাঠগড়ায় দাড়ঁ করানো হয়। জীবনে প্রথম আদালতে আসা, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। আদালত তো নয়, যেন মাছ বাজার। আর কাঠগড়া যেন ঢাকা শহরের গাবতলি আট নম্বর বাস। বিচারক এসে আয়েশ করে চেয়ারে বসেন। বিবাদি পক্ষের উকিল বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলেন, আজ এখানে যাদের দেখছেন, তাদের বেশিরভাগই ছাত্র। ঘটনার সাথে তারা যুক্ত নয়। যাকে যেখানে পেয়েছে, ধরে নিয়ে এসেছে। তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করছি।
বিচারক কিছু সময় ভাবেন। দেখে মনে হয়, কি আদেশ দিবে, তা আগে থেকেই প্রস্তুত করা। আদেশ: আমি তাদের মুক্তি দিতে পারছিনা, তবে বাদী পক্ষ (পুলিশ) ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে, সেখান থেকে চার দিন কমিয়ে আমি তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলাম। এই আদেশ শুনে সবাই ভড়কে যাই। কারও মুখে রা শব্দটি পর্যন্ত নেই। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক, শেষ পর্যন্ত রিমান্ড!
আবার গাড়িতে উঠানো হয়। আর দাঁড়াতে পারছিনা। যেহেতু এক হ্যান্ডকাপ দিয়ে দু'জনকে বাঁধা, বসতেও পারছিনা। সাথের জনকে অনুরোধ করে গাড়ির কাদা মাখা মেঝেতে বসে পড়ি। হাত পা শরীর সব অসাড়, ঘার মাথা সোজা থেকে নুয়ে আসে। গরম ডিম, গরম পানি থেরাপি, ঝুলিয়ে মারা, প্লাস দিয়ে নখ তুলে নেওয়া, ইলেকট্রিক শক দেয়া, এই সবইত রিমান্ড! কেমন করে সহ্য করব! না না আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব! আল্লাহ তুমি রক্ষা কর......
রাতে একজন একজন করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় অফিস রুমে। বুক ধুরু ধুরু করে, কখন আমার ডাক পড়ে। একজনকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বিকট চিৎকারের শব্দ শোনা যায়। কান খাড়া হয়ে ওঠে। মাগো বাবাগো বলে অনবরত চিৎকার আসতে থাকে, এ যেন থামবার নয়! তার সারা শরীরে আঘাত করেই যাচ্ছে। দু'জন মিলে উপর করে শুইয়ে বুট জোতা দিয়ে হাত পায়ের উপর ইচ্ছেমত পিষতে থাকে, গম যেমন করে পিষে। মার সহ্য করতে না পেরে সে যত জোরে সম্ভব চিৎকার করে যায়, কিন্তু তাতে তাদের এতটুকু দয়ার উদ্রেক হয়না, যাকে বলে সীমার! তার অপরাধ তার বাবা একটি রাজনৈতিক দলের জেলা বা থানা পর্যায়ের সক্রিয় রাজনীতিবিদ। তার মুখ থেকে এই কথাটুকু স্বীকার করানোর জন্যই বর্বর অত্যাচার চালানো হয়।
শরীর হিম শীতল হয়ে আসে। পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি। ভাবি, একটু পরেই আমার পালা, কি কঠিন বাঁশ ডলা না জানি অপেক্ষা করছে! টয়লেটের দুর্গন্ধ তাড়া করে বেড়ায়, নাকে টিস্যু গুজে দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করি। দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে পানি পড়ে মেঝে ভিজে ফ্লোর বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তার উপর পাশের রুমে ধরে নিয়ে অত্যাচারের স্ট্রীম রোলার চলে, কানে হাত দিয়ে ‘তোরা যা কিছু করার কর, আমি কিছু শুনিনা’ এই ভাবে ঝিম ধরে পড়ে থাকি।
সেদিন খুব দুঃখ পেয়েছি। একজন ভাই আমাদের জন্য অনেক ঝুঁকি নিয়ে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসে। খাবার দিয়ে চলে যাবেন, এমন সময় থানার ওসি উনাকে ধরে ফেলে এবং সাথে সাথে মামলাও দিয়ে দেয়। কি আজব! যিনি একটু আগে বাহিরে ছিলেন, তাকেও আমাদের মাঝে লকআপে ঠেলে দেয়া হল। এই ঘটনায় আমরা বাক রুদ্ধ হয়ে গেলাম। যতবার ভাইটির দিকে তাকালাম, খুব কান্না পেল, নিজেদেরকে বড় অপরাধি মনে হল। মনকে বুঝ দিতে পারছিলামনা। আমাদের এই দুর্দিনে খাওয়াতে গিয়ে উনার এমন অবস্থা হল। একটা মহৎ কাজ করতে গিয়ে ধরা খেলেন, কে জানে ছাড়া পাবে কবে!
লজ্জায় উনার সাথে ঠিক মত কথা বলতে পারছিলামনা, আমাদের জন্য কিনা জেল খাটতে হবে। বিষয়টা আরও বেদনাদায়ক ছিল এই জন্য যে, মাত্র পনের দিন আগে দীর্ঘ তিন মাস জেল খেটে মুক্তি পাওয়ার পর আবারও গ্রেফতার হলেন। ব্যপারটা এখানেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। উনাকে অফিস রুমে ডেকে নিয়ে উনার উপর অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চালালো হয়। উনার অপরাধ ছিল, উনি খাবার নিয়ে আসলেন, আসামীদেরকে খাওয়ালেন। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছু হতে পারেনা, আর ‘তাদের’ দৃষ্টিতে এটাই অপরাধ! 'মার শালারে, তোর কি খেয়ে ধেয়ে কাজ নেই, আসামির জন্য খাবার আনতে গেলি, এখন বুঝবি চৌদ্দ শিকের ভিতর কেমন মজা!
চলবে...
-----সালাউদ্দিন
বিষয়: বিবিধ
১৬৯০ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পুলিশ নামক জানোয়ারগুলো খেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে ইসলামের বিজয়ের বিকল্প নেই।
বলার কিছু নাই৷ জোর যার মুলুক তার৷
আমার বাড়ি আমার ঘর
আমারে কয় সইরা পড়।
কোথায় রাখব এই দুঃখ?
ধন্যবাদ ভাই, পড়তে থাকুন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন