আজ অধঃপতিত,উপেক্ষিত এবং অবহেলিত মুসলিমদের রেঁনেসার কবি ফররুখ আহমেদ এর মৃত্যূবার্ষিকী ।
লিখেছেন লিখেছেন মুজাহিদ হোসাইন সজিব ১৯ অক্টোবর, ২০১৬, ০৫:৩৯:০৫ বিকাল
ফররুখ আহমেদকে মুসলিম রেঁনেসার কবি বলে চিহ্নিত করা হয়। কোন সন্দেহ নেই অধঃপতিত,উপেক্ষিত এবং অবহেলিত মুসলিমদের জাগাবার জন্য তিনি মসীযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
রেঁনেসা বলতে কি বুঝি, সুপ্রকাশ রায় তার ‘পরিভাষা কোষ’এ এভাবে সংজ্ঞা দিয়েছেন 'এই আন্দোলন কেবল সাহিত্য বা কলাশিল্প বা কোন বিশেষ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। ইহা জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে চিন্তা, সামাজিক,অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাহিত্য,কলাশিল্প প্রভৃতির ক্ষেত্রে পরিব্যপ্ত হয়ে সভ্যতার এক নতুন স্তরে উন্নীত করে। তবে নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদের মতে- 'প্রাচীনকে ধ্বংস না করে,সে ঐতিহ্য,সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস না করে,পুরানা ঐতিহ্যের উপর ভিত্তির উপর নতুন আদর্শ সৃষ্টি করে,পুরনো ঐতিহ্যের সাথে নতুন ও পরিবর্তনশীল সামাজিক অবস্থার সামঞ্জস্য বিধান করা। ইসলামই বিশ্বে প্রথম রেঁনেসার উদগাতা। কারণ বিজ্ঞানের অনেক মূল সূত্রের আবিস্কারের গৌরব মুসলিম বিজ্ঞানীদের। যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের কার্যাবলীর বিষয়ে বিশেষ অজ্ঞতাবশত অনেক সময় বা বিদ্বেষবশত তাদের প্রাপ্য আসন তাদেরকে দেয়া হয়নি। যুদ্ধবিদ্যায়, বন্দুক বা কামানের প্রযুক্তি সর্বপ্রথম ব্যবহার মুসলিমরাই করেন। যার উদাহরণ,ভারতের পানিপথের যুদ্ধে বাবরের বিজয়ী হওয়ার পেছনে ছিল গোলন্দাজ বাহিনী। ইতিহাস বলে,এই যুদ্ধে বাবর কামান ও অন্যান্য উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। বিজ্ঞানচর্চায় আত্মনিবেদিত মুসলিমরা মারাযার মানমন্দিরকে বিজ্ঞানসম্মত যন্ত্রপাতি দিয়ে সুসজ্জিত করেছিলেন। মানচিত্র অংকন বিদ্যাতেও মুসলিমরা বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। গণিত,জ্যামিতি,পদার্থ বিদ্যা ও রসায়নের বিভিন্ন শাখায় মুসলিম বিজ্ঞানীরা অসামান্য আবিস্কার সাধন করেন।
আরব মুসলিমরা নৌ-বিদ্যায় ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। তাই বলা যায় মানব মুক্তি,মানব স্বাধীনতা মুক্তি,মানব চিন্তা নিপীড়ন মুক্তি যদি রেঁনেসার নামে অভিহিত হয় তবে ইসলামই সেই রেনেঁসার প্রথম উদ্ভাবক। মধুসূদনের সাথে ফররুখের পার্থক্য হল,মধুসূদন ছিলেন সাহিত্য ও কাব্যে আত্মসমর্পিত। সেজন্য খ্রিষ্টান হয়েও হিন্দু সাহিত্যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন নন। কিন্তু ফররুখ শুধু তার ধর্মের প্রতিই অনুরক্ত নন সেই ধর্মের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে তার শিল্প,সাহিত্য ও কাব্যের সঙ্গে অবিমিশ্র ভালবাসা সম্পৃক্ত। কাব্যকে ভালবাসতে গিয়ে তার ধর্মবন্ধন ছিন্ন করার প্রয়োজন হয়নি। নজরুল একটি হিন্দু-মুসলিম এক বলয়ে রেখে একটি অসম্ভবকে সম্ভব করতে চেয়েছিলেন। ফররুখ ইকবালের মত ভেবেছিলেন এটি বাস্তবতঃ অসম্ভব। অতএব সময়ের ও বাস্তবতার দাবি মনে রেখ ফররুখ পাকিস্তান আন্দোলনকে স্বাগত জানান উপমহাদেশের সকল মুসলিম এর মত। জাগ্রত সেই অস্তিত্ব রায় মুসলীম স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা রূপায়িত হয়ে উঠেছিল ফররুখ কাব্যে। সে জন্য ফররুখকে মুসলিম রেঁনেসার কবি বলে চিহ্নিত করা অযৌক্তিক হবে না। ‘সাতসাগরের মাঝি’ কবিতায় ফররুখ যখন বলেন,‘কতনা আধার পর্দা পারায়ে ভোর হলো জানিনা তা’ তখন তার ভিতর থেকে শুধু একজন মানুষের নয় একটি জাতির হৃদয়ের কান্না বিচ্ছুরিত হতে থাকে। তখন সে কান্নার মধ্য দিয়ে কারবালার কান্না, বাগদাদ, স্পেন পতনের কান্না,পলাশী যুদ্ধের পরাজয়ের,সিপাহী বিপ্লবের বিফলতার, ফিলিস্তিনের অবুঝ শিশুদের উতথাল মিছিলের, কান্দাহারের মাটিতে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ে থাকা কালিমার পতাকার, কিংবা গুজরাটের মাটিতে ছাই হয়ে মিশে যাওয়া মুসলমানদের কান্না ঝরে পড়তে দেখা যায়।
ফররুখ যে সামান্য কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘ইকবাল প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধটি অন্যতম। তিনি তার মধ্যে ইকবাল প্রসঙ্গে বলেছেন, “নিখিল মানব সমাজের জন্য যে পুরুষ ও প্রকৃত মুসলিমের অভ্যূদয় ইকবালের মানসকে আমরা দেখেছি সেই পুরুষরূপে। সেই পুরুষের আদর্শেই ইকবাল গড়তে চেয়েছেন বর্তমান সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে। মধুসূদনের ভাষায় ও ছন্দের কাসিক রীতি ফররুখকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু ধর্মচিন্তা,সংস্কৃতি চিন্তা ঐতিহ্য ও শিল্প চিন্তার ক্ষেত্রে ফররুখ মধুসূদনের গোত্রের কবি নন। ভারতীয় হিন্দুরা ভারতীয় মুসলমানদেরকে কখনও মার চোখে দেখেনি,মা করেনি এবং ভবিষ্যতেও মা করবে না। নজরুলের চিন্তাদর্শে যত মহত্বই থাকুক সে মহত্বের অনুসরণ করে মুসলমানদের স্বার্থ রা সম্পূর্ণ অসম্ভব ভেবেছিলেন ইকবাল ও ইকবাল শিষ্য ফররুখ।
বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ১৩৫০ সালের দুর্ভিক্ষে অন্তত ৫০ লাখ লোক মারা যায় কিন্তু বাংলা সাহিত্যের কোথাও তার যথাযথ চিত্র পাওয়া যায় না একমাত্র ফররুখ আহমেদের কবিতাগুলো ছাড়া। শিল্পী জয়নুল আবেদিন তার বিখ্যাত তুলিতে এই দূর্ভিক্ষের পরিনতির কিছু হৃদয়বিদারক কিছু ছবি,বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘অসনি সঙ্কেত’ উপন্যাসে এর করুণ কাহিনী,সত্যজিৎ রায়ের ছায়াছবিতে কিছু করুণ চিত্র এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কিছু কবিতায় এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব লক্ষ করা যায়।
এক নজরে ইসলামী রেনেসাঁর করি ফররুখ আহমদ
জাতীয়তাঃ বাংলাদেশি
নাগরিকত্বঃ ব্রিটিশ ভারতীয় (১৯১৮-১৯৪৭), পাকিস্তানি (১৯৪৭-১৯৭১), বাংলাদেশী (১৯৭১-১৯৭৪)
উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহঃ সাত সাগরের মাঝি, সিরাজাম মুনীরা নৌফেল ও হাতেম, মুহূর্তের কবিতা
উল্লেখযোগ্য পুরস্কারঃ বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬০), একুশে পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা পদক (১৯৮০) ১৯৬০ সালে ফররুখ আহমদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। কবি ফররুখ আহমদ ১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট পদক "প্রাইড অব পারফরমেন্স" এবং ১৯৬৬ সালে পান আদমজী পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তাঁকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়।
ফররুখ আহমদ (জন্ম : জুন ১০, ১৯১৮ - মৃত্যু : অক্টোবর ১৯, ১৯৭৪) একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী কবি। এই বাঙালি কবি 'মুসলিম রেনেসাঁর কবি' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তাঁর কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামী ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তাঁর কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট।
দাম্পত্যসঙ্গীঃ সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)
শিক্ষাজীবনঃ ফররুখ আহমদ খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পাস করেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। তবে চল্লিশ-এর দশকে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। তিনি ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন।
জন্ম ও পরিবারঃ
ফররুখ আহমদের জন্ম ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে (তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত) মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে। তার বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ফররুখ আহমদের মায়ের নাম রওশন আখতার।
১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখ আহমদের বিয়ে হয়।তাঁর নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ 'উপহার' নামে একটি কবিতা লেখেন যা 'সওগাত' পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।
ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন। তাঁরা হলেন : সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহল মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহেল মাসুদ, সৈয়দ মনজুরে এলাহি, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান [আহমদ আখতার], সৈয়দ মুহম্মদ ওয়হিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান ও সৈয়দ মুহম্মদ আবদুহু।
কর্মজীবনঃ ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় কোলকাতায়। ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন তিনি। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক 'মোহাম্মদী'-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। এখানেই প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ফররুখ আহমদ মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর, সন্ধেবেলা ঢাকায়। রচনাশৈলী সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় 'কবি'। ফররুখ আহমদ সনেট রচনারও করেছেন। তাঁর রচনায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দেখা যায়। এছাড়া আরবি ও ফার্সি শব্দের প্রাচুর্য তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলামী ডানপন্থার প্রতি সমর্থন থাকায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন না। তবে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার সমর্থন করতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই কবি ফররুখ আহমদ আশ্বিন ১৩৫৪ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৪৭) সংখ্যা মাসিক সওগাত-এ পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য নিবন্ধে লেখেন : "গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।"
কাব্যগ্রন্থ সাত সাগরের মাঝি (ডিসেম্বর, ১৯৪৪) সিরাজাম মুনীরা (সেপ্টেম্বর, ১৯৫২) নৌফেল ও হাতেম (জুন, ১৯৬১)-কাব্যনাট্য মুহূর্তের কবিতা (সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩) ধোলাই কাব্য (জানুয়ারি, ১৯৬৩) হাতেম তায়ী (মে, ১৯৬৬)-কাহিনীকাব্য, নতুন লেখা (১৯৬৯) কাফেলা (অগাস্ট, ১৯৮০) হাবিদা মরুর কাহিনী (সেপ্টেম্বর, ১৯৮১) সিন্দাবাদ (অক্টোবর, ১৯৮৩) দিলরুবা (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪) শিশুতোষ গ্রন্থ পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৭০), চাঁদের আসর (১৯৭০), ছড়ার আসর (১৯৭০) ফুলের জলসা (ডিসেম্বর, ১৯৮৫)
সংগৃহীত
বিষয়: বিবিধ
২০৪৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আজকে কোন মিডিয়াতেই খবর নেই বাংলাভাষার এই শ্রেষ্ঠ একজন কবিকে নিয়ে।
সুন্দর সংগ্রহ মাশাআল্লাহ।
জাজাকাল্লাহু খাইরান ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন