আশুরার ইতিহাস। করনীয় ও বর্জনীয়?
লিখেছেন লিখেছেন মুজাহিদ হোসাইন সজিব ১২ অক্টোবর, ২০১৬, ০৬:৩৯:০৬ সন্ধ্যা
আশুরার ইতিহাস ও করনীয়:
আশুরা হলো ইসলামের একটি ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস। এটি প্রতি হিজরী চান্দ্রবর্ষের মহররম মাসের ১০ তারিখে পালিত হয়। ‘আশুরা’ শব্দটি আরবি। ‘আশারা’ শব্দমূল থেকে নির্গত। এর অর্থ ১০। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মহররমের দশম দিবসকে ‘আশুরা’ বলে অভিহিত করা হয়। হিজরি বর্ষের সূচনা হয় এ মহররম মাসের মাধ্যমেই। ‘মহররম’ শব্দের অর্থ পবিত্রতম ও মর্যাদাপূর্ণ। ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে এ মাসকে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের চোখে দেখা হতো। এর পবিত্রতা ও মর্যাদার কথা বিবেচনা করেই যুদ্ধপ্রিয় আরবরা এ মাসে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকত। তাই এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘মহররম’ বা ‘মর্যাদাপূর্ণ’ বলে। এ মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, হাদিস শরিফে এ মাসকে ‘আল্লাহর মাস’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এ মাস সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২টি। এর মধ্যে ৪টি নিষিদ্ধ ও সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এসব মাসে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করো না’ (সুরা : তাওবা-৩৬)।
মহররমের ৯ তারিখের দিবাগত রাত থেকে আশুরা উদযাপন শুরু হয়। ইসলামের ইতিহাসে এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত। কারণ বহু ঐতিহাসিক ঘটনা এই তারিখে সংঘটিত হয়েছে। শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে এ দিনটি বিশেষ মর্যাদাময়। কেননা এই দিনে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রাঃ) ইসলামের তৎকালীন শাসনকর্তা এজিদের সৈন্য বাহিনীর হাতে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসের অসংখ্য কালজয়ী ঘটনার জ্বলন্ত সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে পুণ্যময় এ মাস। আর কারবালার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিও আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। রচিত হয়েছে শোকাভিভূত এক নতুন অধ্যায়।
কারবালার ঘটনা আশুরা সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ৬১ হিজরীর আশুরাতে কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইনকে (রাঃ) সপরিবারে শাহাদাত লাভের ঘটনার জন্য। ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম শুক্রবার আশুরার দিনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নাতী হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) হক ও ইনসাফ চলমান রাখার লক্ষ্যে কারবালা প্রান্তরে ত্যাগের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যুগ যুগ ধরে যা মানুষকে ন্যায় ও সত্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা যুগিয়ে যাবে। সেদিন ইমাম হোসাইন (রাঃ) ও তার ৭২ জন সঙ্গী-সাথীকে কারবালার প্রান্তরে এজিদের বাহিনী অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ করেছিল। এজন্য এই দিনটি মুসলিম মিল্লাতের নিকট যেমন বেদনার বার্তা বহন করে আনে, ঠিক তেমনি সত্যাশ্রয়ী জীবনযাত্রার আশার আলোও সঞ্চারিত করে।
আশুরার দিনের আরো কিছু ঘটনাঃ মুহররমের ১০ তারিখে আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে রয়েছে আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছিল ১০ মুহররম। ১০ মহররম আদম (আঃ) কে বেহেশতে প্রবেশ করানো হয়েছে। আশুরাতেই আদম (আঃ) কে বেহেশত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছিল। আদম (আঃ) এ তওবা কবুল করা হয়েছিল এই আশুরাতেই।
মা হাওয়া (আঃ) এর সাথে আদম (আঃ) পুনরায় সাক্ষাত হয়েছিল এই ১০ মুহররম। আসমান জমিন সৃষ্টি করা হয়েছিল মুহররম মাসেই। আরবের জাহেলরাও মহররম মাসটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিত। চাঁদ-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, সাগর মহাসাগর সৃষ্টি করা হয় এই মহররম মাসেই। আশুরাতেই জন্ম গ্রহণ করেন ইব্রাহীম (আঃ)। আশুরাতেই হযরত মূসা (আঃ) এবং আল্লাহপাকের মধ্যে কথোপকথোন হয়েছিল। হযরত মূসা (আঃ) এর উপর তাওরাত কিতাব নাজিল হয়েছিল এই আশুরাতেই। আশুরাতেই মূসা (আঃ) তার সাথীদের নিয়ে নীল নদ পার হন এবং ফেরাউন বাহিনী পানিতে ডুবে মরে।
হযরত আইয়ুব (আঃ) দীর্ঘ ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগের পর সুস্থ হয়ে উঠেন এই আশুরাতেই। হযরত সোলায়মান (আঃ) পুনঃবাদশাহী লাভ করেন আশুরাতেই। আশুরাতেই দাউদ (আঃ) এর তওবা কবুল করা হয়। হযরত ইউছুফ (আঃ) তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর সাথে মিলিত হন এই আশুরাতেই। হযরত ইসা (আঃ) জন্ম গ্রহণ করেন আশুরাতেই।
হযরত ইসা (আঃ) কে আল্লাহপাক সশরীরে আসমানে তুলে নেন এই আশুরাতে। আশুরাতে আল্লাহপাক হযরত ইদ্রিস (আঃ) কে জীবিত করেন এবং তাকে জান্নাতে উঠিয়ে নেয়া হয়। হযরত নূহ (আঃ) এর জাহাজ চল্লিশ দিন পর পাহাড়ের কিনারে ভিড়ে আশুরাতে। আশুরাতেই হযরত নূহ (আঃ) জমিনে অবতরণ করেন। আশুরাতে উম্মতে মুহাম্মদীর গুনাহ মাফ হয়। জিব্রাইল (আঃ) আশুরাতে দুনিয়াতে আগমন করেন। আল্লাহপাক দুনিয়াতে প্রথমবার রহমত নাজিল করেন ও রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন আশুরাতেই। হযরত ইউনুস (আঃ) মাছের পেট থেকে বের হয়ে আসেন আশুরাতে।
আশুরার দিবসে করণীয়ঃ প্রতিটি ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার অন্যতম দুটি শর্ত রয়েছে।
এক. আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত করা।
দুই. ওই ইবাদত রাসুল (সাঃ)-এর আনীত শরিয়ত এবং বর্ণিত পথ ও পন্থা অনুসারে হওয়া। আশুরার দিবসে রোজা রাখা ছাড়া অন্য কোনো রীতিনীতি, সংস্কৃতি ও ইবাদত ইসলাম অনুমোদন করে না। তাই কেবল রোজা রাখার মাধ্যমেই দিনটিকে পালন করতে হবে। আশুরা হল সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাতিলের সাথে সত্য-মিথ্যার লড়াই। আশুরার শিক্ষা হল- সব মিথ্যার সাথে লড়াই করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আশুরার নিষিদ্ধ কার্যাবলী: আশুরার সুমহান মর্যাদা ও তাৎপর্যকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে কিছু নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড ও কুসংস্কারের প্রচলন হয়ে গেছে। সেসব থেকে বেঁচে থাকা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। নিষিদ্ধ কার্যাবলী উপস্থাপন করা হলো, মহররম আসার সঙ্গে সঙ্গে হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ওপর মাতম-বিলাপ শুরু করা ও নিজ দেহে ছুরিকাঘাত করা গর্হিত অপরাধ। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘শোকে বিহ্বল হয়ে যে ব্যক্তি গাল চাপড়ায়, কাপড় ছিঁড়ে ও জাহেলি যুগের মতো আচরণ করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (বুখারি : ১২৯৭)
কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে ট্রাজেডি হয়েছিল, মুসলিম বিশ্বে তা আজও স্মরণীয়। তবে কিছু অতি উৎসাহী মুসলিম তাজিয়া মিছিলের নাম করে ইসলাম বর্হিভূত কাজ করে থাকে। যেমন শরীর নগ্ন করে শরীরে আঘাত করে। শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করা, নানা রকম মাতম করা। যা ইসলামী শরীয়তের কোন ভিত্তি নেই। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও শিয়াদের সর্বোচ্চ আলেম আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছেন, ফতোয়া অনুযায়ী মহররম ও আশুরার শোক পালনের নামে শরীর রক্তাক্ত করা হারাম। এমনকি গোপনে এ কাজ করতেও নিষেধ করেছেন খামেনি। তিনি বলেন, এ ধরনের কাজ শোক-প্রকাশ নয় বরং শোক-প্রকাশের ধ্বংস সাধন। পোশাক খুলে উদাম গায়ে শোক প্রকাশ করাও হারাম। বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে আশুরা
ও মহররমের শোক প্রকাশের নামে অনেকেই নানা পন্থায় শরীরকে রক্তাক্ত করেন। বিষয়টি মহররমের পবিত্রতা ও শোক-প্রকাশকারীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করছে অনেকের মধ্যেই। এছাড়াও ইরানের শীর্ষস্থানীয় অনেক আলেম মনে করেন, এ ধরনের শোক পালনের নামে অপতৎপরতায় ইসলাম বিদ্বেষীরা এই মহান ধর্ম সম্পর্কে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানোর সুযোগ নিচ্ছে। তাই তারা শোক-প্রকাশের ক্ষেত্রে এসব বাড়াবাড়ি পরিহার করতে মুসলমানদের সতর্ক করে আসছেন।
পরিশেষে বলা যায়, আশুরার এই ঐতিহাসিক ঘটনার মূল চেতনা হচ্ছে- ক্ষমতার লোভ, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য চক্রান্ত ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। বর্তমান বিশ্বে আশুরার এই শিক্ষা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান ও ত্যাগের যে শিক্ষা কারবালার ঘটনা মানবজাতিকে দিয়েছে, তা আজকের দুনিয়ার অন্যায় ও অবিচার দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। কারবালার ত্যাগের মহিমায় সবার অন্তর আলোকিত ও শুদ্ধ হোক।
১০ মহররমের গুরুত্ব শুধুমাত্র কারবালার কারনে নয়!
রাসুল (সাঃ) এর হাদীসে বর্ণিত ফযীলতের কারনেই মহররম এত গুরুত্বপূর্ণ। আশুরার সম্পর্ক শুধু কারবালার সাথে নয়, আশুরার সম্পর্ক হাদীসে বর্ণিত নির্দিষ্ট ‘ইবাদতের’ সাথে। কারবালা একটা, আশুরা আরেকটা। মহররম মাসের দশ তারিখে যদি হোসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের জন্য শোক পালন করতে হয়, তাহলে হযরত উমর (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ), হযরত আবুবকর (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ) এর শাহাদাতসহ অসংখ্য সাহাবীর শাহাদাতে আরো বেশি শোক পালন করতে হয়। মহররমের তাৎপর্যকে ভিন্নদিকে পরিচালনা করা শিয়াদের অন্যতম সফলতা। বাদশাহ হুমায়ুনের হাত ধরে মোঘল রাজ-পরিবারে শিয়াদের অনুপ্রবেশ এসব ভ্রান্তির বড় একটা কারণ।
এছাড়া নবাব আলিবর্দী খাঁ ও নাতি সিরাজদ্দৌলার শিয়া পরিবারও মহররমকে এই বাংলায় ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার অন্যতম অনুঘটক। পাকিস্তান আমলে পাক সরকারে শিয়দের প্রভাবও অনেকাংশে দায়ী। নৃশংস শিয়ারা রক্তপিপাসু নাদের শাহের দিল্লি আক্রমণের পর থেকেই শিয়ারা মূলত বেশি করে ভারতীয় উপমহাদেশে শেকড় গাড়তে শুরু করে। যাক, বর্তমানের ইরানপ্রিয় সব শিয়ারা ভিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত। তাদের প্রবর্তিত রুসুম-রেওয়াজও এজন্য বর্জনীয়। দূর্গপূজার কুফুরি বোঝা যায়, কিন্তু মহররমে হোসাইন (রাঃ) এর জন্যে কুফুরি তরীকায় কান্নার বিপদজনক কুফুরি বোঝা দুস্কর! কারণ এটা নেক সুরতে আসে।
বিষয়: বিবিধ
২২৮২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন