মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কবে দলীয় রাজনীতির রাহু মুক্ত হবে?
লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল রাহাত ৩০ মার্চ, ২০১৭, ০৯:১০:৩৯ রাত
মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহারের ফলে ইতিহাসের নির্মোহ চর্চা সম্ভব হচ্ছে না। নিছক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গায়েল করতে কেউ ইতিহাসের অপব্যখ্যা করে ইতিহাস বিকৃত করছে। আবার কেউ দূর্বলতা ঢাকতে আইন করে ইতিহাস চর্চার পথ রুদ্ধ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। ইতিহাসের এমন বিকৃতি ও অপব্যবহার অব্যাহত থাকলে ইতিহাস পাঠ করে ইতিহাস থেকে সঠিক শিক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। তাই বঙ্গবন্ধুর নানা কর্মের সমালোচনা করতে গিয়ে তাঁর মর্যাদা ক্ষুন্ন করা যেমন উচিত নয়, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে বড় করতে ইতিহাসকে বিকৃত করা বা অন্যের অবদানকে খাটো করে দেখাও কাম্য নয়। কেননা বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাঙ্গালি জাতি আত্মপরিচয়সম্পন্ন জাতি হিসাবে ঠিকে থাকতে পারে না, আবার সব কৃতিত্ব একজনকে দিয়ে দেওয়াও বাস্তবতাবিবর্জিত। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব বাংলার অভিসংবাদিত নেতা হিসাবে সমীহ করতেন, এখন বিএনপিরও উচিত বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার স্থপতি হিসাবে কথা ও কর্মে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নেওয়া। তবে এমনটা তখনই সম্ভব হবে যখন মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির স্বার্থে অযাচিত ব্যবহার বন্ধ করা হবে। আমাদের একথা উপলব্ধি করতে হবে যে, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কোন দলের সম্পত্তি হয়ে থাকতে পারে না।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় বাঙ্গালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড সৃষ্টির লক্ষ্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এই তিন মূলনীতির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন মেজর জিয়াউর রহমান। কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষনা নিয়ে নানা অযথা বিতর্ক করা হচ্ছে নিছক রাজনীতির স্বার্থে। শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানাতে ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার দাবি করছেন কেউ কেউ। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে ৭ মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিক ভূমিকা থাকলেও এটি ছিল তাঁর রাজনৈতিক ভাষণ। যেখানে স্বাধীনতার প্রচ্ছন্ন হুংকার থাকলেও আবুল মনসুর আহমদ, আহমদ ছফা, বদরুদ্দীন উমর, ও অলি আহাদের মত প্রথিতযশা ব্যক্তিরা তাদের বইয়ে দাবি করেছেন বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষে “জিয়ে পাকিস্তান” বলেছিলেন। যদিও জিয়ে পাকিস্তান বলা না বলা নিয়ে বিতর্কের মীমাংসা এখনো হয়নি। এছাড়া ৭ মার্চ ভাষণে যদি স্বাধীনতার চুড়ান্ত ঘোষণা দিতেন তাহলে তিনি ১৬ মার্চ থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে দরকষাকষি করতেন না এবং ২৭ মার্চ সমগ্র দেশব্যাপী সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে হরতালের ডাক দিতেন না। সস্প্রতি তাজউদ্দিন আহমদের কন্যার প্রকাশিত বই অনুসারে বলা যায় তাজউদ্দিন আহমদ যখন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাক্ষর নিতে গেলেন সবকিছু চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু সাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানান, কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন “এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে, এর জন্য পাকিস্তানিরা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের বিচার করতে পারবে”। কিন্তু বঙ্গবন্ধু্র সাক্ষর করতে অস্বীকার করার অর্থএই নয় যে, তিনি স্বাধীনতা চাচ্ছিলেন না। মূলত বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি মনে করেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয় সম্ভব নয়। তাই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জাতিকে বিচ্ছিন্নবাদের দিকে ঠেলে দিয়ে কাশ্মীরী অথবা ফিলিস্তিনীদের ভাগ্যবরণ করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন সময় নিয়ে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে ছয়দফার ভিত্তিতে আলোচনার মাধ্যমে দেশকে রক্তপাতহীনভাবে স্বাধীনতা করা। নির্বাচনে জয়লাভের পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করার কারণে আলোচনার মাধ্যমে স্বায়াত্তশাসনের দাবি আদায় করা অসম্ভব ছিল না। তাই আবেগতাড়িত না হয়ে তিনি বরং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতারই প্রমাণ দিয়েছিলেন। এছাড়া ইন্দো-সোভিয়েত অক্ষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা না করলে চীন-আমেরিকা অক্ষের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আমরা কবে স্বাধীন হতে পারতাম তা অনুমান করাও কঠিন ছিল।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর নামে দেওয়া হয়েছিল, তাতে বুঝা যায় তাঁকে ছাড়া মুক্তির সংগ্রামে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নামে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার কারণেই তিনি জাতির জনক ও স্বাধীনতার স্থপতির মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। পাক হানাদার বাহিনীও মুক্তিকামী জনতাকে “মুজিবের সৈনিক” হিসাবে জানতেন। আসলে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতা ঘোষণা দিতে পারা জিয়াউর রহমানের জন্য গৌরবময় সৌভাগ্য ছিল। এই ঐতিহাসিক কারণে স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে জিয়াউর রহমান ও শেখ মুজিবুর রহমানকে পরস্পর থেকে আলাদা করা যায় না। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে এদেশের মানুষের মনে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন বলেই পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর এদেশের মানুষ জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বকে আকুন্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন। এমন দুইজন জনপ্রিয় নেতাকে নিয়ে অপরাজনীতির পরিনিতি জাতির জন্য শুভ হবে না। ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ যে জিয়াউর রহমানকে মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছেন তাঁর প্রতি ঈষার্ন্বিত হয়ে স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার করে নেওয়া ও জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম পরিবর্তন কোন সুস্থ রাজনীতির লক্ষণ নয়। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বঙ্গবন্ধুও অনুরূপ অপরাজনীতির স্বীকার হবেন না এমনটা হলফ করে বলা যায় না।
দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার দিকে জাতিকে পরিচালিত করে যিনি স্বাধীনতা স্থপতি ও জাতির জনকের মর্যাদা পেলেন, মৃত্যুর ৪১ বছর পর তাঁকে দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণ পরিমন্ডল থেকে মুক্ত করা সময়ের দাবি। এমনটা হলে তিনি সবার বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে পারবেন। ১৫ আগস্ট দল মত নির্বিশেষে সবাই শোকাহত হবেন। মওলামা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, জাতীয় চার নেতা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা হয়েও তাঁরা এখন সবার কাছে জাতীয় নেতা হিসাবে স্বীকৃত। রাজনৈতিক ও দলীয় আদর্শের উর্ধ্বে ওঠে দেশের ডান-বাম সবাই বিশিষ্ট এই নেতাদের ঐতিহাসিক অবদানকে এক বাক্যে স্বীকার করেন। কিন্তু যার অবদান সবচেয়ে বেশী তিনি এখনো দল-মত নির্বিশেষে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এখনো কটাক্ষ করা হয় রাজনৈতিক কারণে। আর এই কটাক্ষ বন্ধ করতে আইন করে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনার জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এর ফলে মানুষের মনে আরো বেশী মন্দ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
পৃথিবীর কোন মহৎ নেতাই ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন না, উপমহাদেশের মহাত্মা গান্ধী থেকে কয়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, চীনের মাও সেতুং, তুরষ্কের কামাল পাশা, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের জোসেফ স্ট্যালিন থেকে কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো কেউ না। কিন্তু উনারা সবাই নানা ত্রুটি বিচ্যুতি চাপিয়ে নিজ নিজ জাতির কাছে পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। কামাল পাশা আধুনিক তুরষ্ক প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিমা ভাবধারা প্রসারে ইসলামের নানা বিধানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন এবং দেশের ধার্মিক সম্প্রদায়ের উপর অবর্ননীয় নির্যাতন চালায়, এরপরও তুর্কিদের কাছে কামাল পাশা এখনো অত্যন্ত জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র, যদিও তাঁর দলের জনপ্রিয়তা আগের মত নেই।
বৃহৎ ও মহৎ কোন অবদানের জন্য একজন জাতীয় নেতা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও জায়গা করে নিতে পারেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মহাত্মা গান্ধী বা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশ্ব নেতার স্থান লাভ করে নিতে পারেননি। অথচ বাঙ্গালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ফিলিস্তিনের ইয়াসিন আরাফতের চেয়ে কম নয়। তরুণ প্রজন্মের মাঝে কয়জন জানে বঙ্গবন্ধু ৫৫ বছরের হায়াতের ১৪ টি বছর জেলে কেটেছিলেন! ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বাঙ্গালিদের অধিকার আদায়ের জন্য জীবনের চারভাগের একভাগ যিনি জেলে কাটিয়েছিলেন তাঁকে দলমত নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হিসাবে মেনে নিতে আপত্তি থাকবার কথা নয়। স্বাধীনতার আগের ভূমিকার জন্য বঙ্গবন্ধুর সমালোচনার সুযোগই তো নেই। ইতিহাসের এই পর্যায়ে এসে ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জন্য তিনি জাতির সামনে কালো হয়ে থাকতে পারেন না। প্রকৃত অর্থে শেখ মুজিবুর রহমানের এই সংক্ষিপ্ত শাসনকাল নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এই সময় তাঁর কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল যেগুলো তার মত সাহসী ও অভিসংবাদিত নেতা ছাড়া গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। এরমধ্যে অন্যতম ছিল ভারত ও দলের বিরোধিতা উপেক্ষা করে ওইসি সম্মেলনে যোগ দিতে পাকিস্তান যাওয়া। স্বাধীনতার বিরোধিতা করা স্বর্থেও মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন। কমনওয়েলথ, ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) এবং জোটনিরপেক্ষ সংস্থার সদস্যপদ লাভ, দেশের ভিতর নতুন করে বিদ্রোহ যাতে সৃষ্টি না হয় সেই জন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমা করে দেওয়া। প্রিয় ভুখণ্ডটি যখন শিয়ালের মুখ থেকে হায়েনার মুখে পড়ে যাচ্ছিল তখন লুটতরাজে রত ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে ফেরত পাঠানো তাঁর অগ্রগণ্য অর্জন। সকলের সাথে বন্ধুত্ব এবং কারো সাথে শত্রুতা নয় এই মূলনীতি বঙ্গবন্ধুই প্রনয়ন করেন যা এখনো বাংলাদেশের পররাষ্টনীতির মূলস্তম্ভ। এছাড়া ভারতে আশ্রয় নেয়া এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন, ১৯৭৩ সালে সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠান, ভারতের বিরোধীতা স্বর্থেও স্বাধীন প্রতিরক্ষা বাহিনীর পুনর্গঠন, শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য কুদরত-ই-খুদা কমিশন গঠন, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাশ (১৯৭৩), ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্তি ও বৈদেশিক সাহায্য লাভ, ভারতের সাথে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি এগুলোও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অর্জন যা একটি দেশকে পূর্ণগঠনে অপরিহার্য ছিল।
যিনি সারা জীবন গনতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন তিনি হঠাৎ করে কেন অগতান্ত্রিক হয়ে বালশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা রীতিমত গবেষণার বিষয়। কারা তাঁকে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই খল নায়কদের মুখোশ উম্মোচন করাও প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শাসনভার গ্রহণের প্রথম থেকেই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে কয়টা বড় ভুল করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান না করা, সেনা বাহিনীর উপর রক্ষীবাহিনীকে প্রাধান্য দেওয়া, সংবিধানে ইসলামকে উপেক্ষা করা অন্যতম। ৭৩ নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও দলীয় নেতা-কর্মীদের নানা অপকর্মের লাগাম টেনে ধরতে না পারা তাঁর রাজনৈতিক ব্যর্থতা ছিল। এতে রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট হয়। জাসদ গণবাহিনী গঠন করে সরকারের বিরুদ্ধে স্বশন্ত্র যুদ্ধ করে, এতে আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতা-কর্মীসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। এর ফলে দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয় তা নিয়ন্ত্রণে অনেকে বঙ্গবন্ধুকে একনায়কতন্ত্র কায়েমের পরামর্শ দিয়েছিলেন। অবশ্যই তিনি সেই সময় বিশ্বরাজনীতিতে শক্ত ভিত থাকা একদলীয় শাসনে শাসিত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে পারেন।
বঙ্গবন্ধু যদি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গনমূখী সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে যে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা তাঁর ছিল তাতে বাকশাল গঠন করে একদলীয় শাসন কায়েক করার কোন প্রয়োজন পড়ত না। তিনি এমনিতে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। জাসদকে রাজনৈতিকভাবে কন্টেইন না করে তাদের বিরুদ্ধে রক্ষীবাহিনী লেলিয়ে দেওয়াও তার প্রতি গনমানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছু গনবিরোধী সিদ্ধান্তের কারণে তাঁকে ব্যবহার করে ভারত বাংলাদেশকে দখল করে নিতে পারে এমন আশঙ্কা জনগণের মাঝে সৃষ্টি করতে পেরেছিল তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরা। একদলীয় শাসন কায়েমের ফলে সেই আশঙ্কা আরো প্রকট আকার ধারণ করে।
এই সব দূর্বলতা স্বর্থেও মানুষের অধিকারের জন্য তাঁর দীর্ঘ সংগ্রাম, পররাষ্টনীতি, ও রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো গঠনে তিনি যে সফলতা দেখিয়েছিলেন সেই জন্য তিনি দলমত নির্বিশেষে সঠিকভাবে মূল্যায়িত হওয়ার কথা। এর জন্য প্রধান অন্তরায় হল মৃত্যুর ৪১ বছর পরও তাঁকে দলীয় রাজনীতির স্বার্থে অপব্যবহার। বদরুলের মত বখাটেরা ঘৃণ্য অপরাধ করে যখন দম্বভরে বলে “আমি বন্ধবন্ধুর সৈনিক” তখন তাতে বঙ্গবন্ধুর অপমান হয় এবং সেই সাথে স্বাধীনতার স্থপতি সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মের কাছে ভূল বার্তা যায়। সবকিছুতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন টেনে আনা তোষামোদী ছাড়া আর কিছু নয়। আজকাল জোর করে বা আইন করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা আদায় করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ যেকোন কিছুর নামকরণে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করা হচ্ছে যেন বাংলাদেশে আর কোন নেতাই নেই, স্বাধীনতা অর্জনে আর কারো অবদান নেই। এখন তাজউদ্দিন আহমেদ ও মওলানা ভাসানী মত নেতারা আওয়ামী লীগের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।সিরাজুল ইসলাম খানের কথা নাই বললাম যাকে বঙ্গবন্ধুর মস্তিষ্ক বলা হয়। ফিদেল ক্যাস্ট্রো মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছেন তার নামে যেন কোন কিছুর নামকরণ করা না হয়। এর ফলে কি ফিদেল ক্যাস্ট্রো হারিয়ে যাবেন? মানুষের অন্তরে যে স্থান করে নিতে পারে তাকে মূর্তি বানিয়ে কিংবা তাঁর নামে স্থাপনার নামকরণ করে স্বরনীয় করে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। ইতিহাস পাঠ করলে তাকে পাওয়া যায়।
বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো বঙ্গবন্ধুর প্রতি যতটা আবেগ দেখায় তার ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব থেকে শিক্ষা নিতে ততটা উদাসীন। মূলত নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য অস্ত্র হিসাবে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ইমেজকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে তারা। আর এই সব কারণে পনের আগস্ট আওয়ামী লীগের আমলে জাতীয় শোক দিবস হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হলেও বিএনপির আমলে তা আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসুচিতে পরিনত হয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজনীতি না করলে খালেদা জিয়া পনের আগস্ট জন্মদিন পালন করতেন বলে মনে হয় না। বিএনপি মনস্তাত্ত্বিকভাবে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে গ্রহণ করলেও রাজনৈতিক কারণে এখন দুষ-ত্রুটি খোঁজায় ব্যস্ত। মূল কথা হল, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার বন্ধ হলেই কেবল সর্বমহলে বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবে মূল্যায়িত হবে।
বিষয়: রাজনীতি
১১৩১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তাই, আওয়ামী লীগ = বঙ্গবন্ধু = মুক্তিযুদ্ধ
মন্তব্য করতে লগইন করুন