সুশান্ত পালে অশান্ত হাওয়াঃ তাঁর তিন তালাকের গল্প
লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল রাহাত ২৮ অক্টোবর, ২০১৬, ০৫:৫১:০০ বিকাল
গনজাগরণ মঞ্চ ইমরান এইচ সরকার নামক এক আইকন সৃষ্টি করেছিল। হঠাৎ বিশাল নেতা হয়ে ওঠে ছিলেন তিনি। তাঁর পিছনে যারা পঙ্গপালের মত ছুটছিল তাদের নিয়ে ভেবে ছিলেন ভিন্ন ধারার একটা রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করবেন। কিন্তু তাঁর সেই রাজনৈতিক উচ্চবিলাস পুরণ হয়নি। গণজাগরণ মঞ্চে ইসলাম অবমাননা, ইসলাম ও রাসুল(সঃ) চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটনাকারী নাস্তিক ব্লগারদের অতিতোষণের প্রতিবাদে হেফাজত ইসলামের ধাক্কায় অল্প কয়দিনে ঝিমিয়ে যায় সেই আলোচিত সমালোচিত মঞ্চ। এই মঞ্চের প্রধান চরিত্র ইমরান এইচ সরকারের রঙ-বেরঙ্গের পাঞ্জাবি পরিধান নজর কেড়েছিল ফেইসবুক ও টকশো ওয়ালাদের এবং সমালোচিত হয়েছিলেন নিত্য নতুন পাঞ্জাবির কারণে। অনেকের ধারনা ছিল গণজাগরণ মঞ্চের নামে তুলা চাঁদার টাকায় তিনি বিলাসী পোশাক পরিধান করতেন যা তাঁর পতনের একটি কারণ বলা যায়। অবশ্যই তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাবিলাস দেখে সরকারও তাকে নিয়ন্ত্রিত সমর্থন দিতে থাকে। আজকাল তিনি নানা ইস্যুতে সরকারেরও সমালোচনা করছেন । প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় সরকার তাকে দুই তালাক দিয়ে রেখেছে, যেন আগামীতে প্রয়োজন হলে ফিরিয়ে নেওয়া যায়।
Sushanta Paul নামের আরেকজন বিসিএস ক্যারিয়ার সেলিব্রেটি তৈরি হল। চুয়েট থেকে কম্পিউটার সাইন্সে বিএসসি করা সুশান্ত পাল ৩০তম বিসিএসে প্রথম হয়ে বিসিএস প্রেমীদের কাছে ধীরে ধীরে বিসিএস দেবতা হয়ে উঠলেন। প্রতিবারই কেউ না কেউ প্রথম হন, কিন্তু তাদের কথা কেউ মনে রাখেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বিসিএসে পর পর দুইবার প্রথম হয়েও বিসিএস প্রেমীদের কাছে স্বরনীয় হয়ে থাকতে পারেননি। কিন্তু সুশান্ত পাল বিসিএসে প্রথম হয়ে কতক লোকের কাছে কিংবদন্তী হয়ে গেলেন। মনে হয় ২.৭৮ সিজিপিএ নিয়ে যে বিসিএসে প্রথম হওয়া যায় তা ছিল বেশ আকর্ষনীয় , আবার তা চুয়েট থেকে যা সাধারনত কেউ ভাবে না। তবে ফেইসবুকে তাঁর বিসিএস ক্যারিয়ার বিষয়ে নানা পরামর্শ দিয়ে পোষ্ট করা নোটগুলো তাঁর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। ফেইসবুকে ধীরে ধীরে তাঁর ভক্ত মুরিদ বাড়তে লাগল। লক্ষনীয় যে, তাঁর নোটগুলো ইম্প্রেসিভ হলেও ভক্তকুলের কমেন্টে করা প্রশ্নের রিপ্লাই ছিল ডোন্ট কেয়ার টাইপের যা তাঁর অহমিকা বলে মনে করেন অনেকেই। এক কর্মজীবী মহিলা ফেইসবুকে তাঁকে কয় ঘন্টা করে বিসিএস এর জন্য পড়া দরকার জানতে চাইলে তিনি জানান ২৩.৫৯.৫৯।
ক্যারিয়ার আড্ডা নামে নতুন ধাঁচের আড্ডা শুরু হল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সেই আড্ডায় সুশান্ত পাল মটিভেটেড বক্তা হিসাবে সুখ্যাতি পেতে শুরু করল। তাঁর কিছু মুরিদের বিশ্বাস হল সুশান্ত পাল মাঝে মধ্যে জন্মায়! অসাধারণ মেধাবী! মহা জ্ঞানী! তিনিও নিজেকে মহা জ্ঞানী ভাবতে শুরু করলেন। তাঁর বক্তব্যে পান্ডিত্যের জাহির সহজে অনুমেয়। মহা পন্ডিত ভাবা এই বক্তার মনে যে কুস্যিৎ একটা পান্ডিত্য লুকায়িত ছিল তা কেউ কেউ বুঝতে পারলেও অধিকাংশ জনই তা আঁচ করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর এই পাণ্ডিত্য তিনি নিজেই ফাঁস করে দিয়েছেন ফেইসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে। এরপর সুন্দরী মেয়েদের সাথে তাঁর কুরুচিপূর্ণ ফেইসবুক চ্যাটের স্কীন শট প্রকাশ পায়।
কিছুদিন আগে তিনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অর্ধসত্য তথ্য দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে কুরুচিপূর্ণ ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেন যেখানে ঢাবির ছাত্রীদের "কুত্তি" বলে সম্মোধন করেন। এতেই বহু মুরিদের ক্যারিয়ার গুরু সুশান্ত পালে অশান্ত হাওয়া শুরু হল। চায়ের কাপে বীর্যের ঝড় তুলার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠে ফেইসবুকে। তাঁর মুরিদরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ব্যাপক সমালোচনার মূখে স্ট্যাটাস মুছে দেওয়া সহ ক্ষমা চাইলেন তিনি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মুরিদ নাছোড়বান্দা। তাঁরা তাকে "সাইজ" করতে চায়। ঠুকে দিল মামলা, সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে করা হল ওএসডি। যিনি এতদিন অন্যের বিসিএস ক্যারিয়ার গড়া নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন, এখন নিজের ক্যারিয়ার রক্ষা নিয়ে চিন্তিত। যেহেতু তিনি ক্ষমা চেয়েছেন , ব্যাপক সমালোচনার স্বীকার হচ্ছেন সরকারী কর্মকর্তা হওয়ায় মামলা পর্যন্ত না গড়ালে পারত। র্যাগিং যে হয় না তা কিন্তু না! নানা বিব্রতকর অমানবিক র্যাগিংও হয় তা সত্য।
তাঁর তিন তালাকের গল্প ত বলা হল না। তিনি তাঁর এক ক্যারিয়ার আড্ডায় বলেছিলেন, তিনি ভালবাসেন সাহিত্য , কিন্তু পিতা-মাতার স্বপ্ন পুরণের জন্য চুয়েটে সিএসসিতে ভর্তি হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হলেন। যেহেতু সিএসসি তাঁর পছন্দনীয় বিষয় নয় তাই তিনি সিএসসিকে তিন তালাক দিয়ে ঢাবি আইবিএ এর এমবিএতে ভর্তি হন। এখানে কান্ত হলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু এই খ্যাতি পাওয়া মটিভেটর তাঁর মুরিদদের মধ্যে যারা পছন্দের বিষয়ে পড়ছে না তাদেরকেও অনার্সের বিষয়কে তিন তালাক দেওয়ার উপদেশ দিলেন। আমরা জানি প্রতিযোগিতামূলক এই দেশে পছন্দের বিষয়ে পড়তে পারে অল্প কিছু শিক্ষার্থী। সুশান্ত পালের এই উপদেশ গ্রহণ করলে দেশের ৯০% শিক্ষার্থীর নিজ নিজ অনার্সের বিষয়কে তিন তালাক দিতে হবে। চার বছর পর যারা নিজ নিজ বিষয়কে তিন তালাক দেওয়ার মনস্তির করবে তারা বেশ যন্ত্রনায় চার থেকে সাত বছর পর কোন মতে পাশ করে বের হওয়ার চেষ্টা করবে। যার উদাহরণ তিনি নিজেই যার বিএসসি কমপ্লিট করতে বেশী সময় লেগেছিল। আর সুশান্ত পালের মত বিসিএসে প্রথম হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকবে। অথচ প্রতি বছর বের হওয়া স্রাতকদের মধ্যে মাত্র ০.৫% এরও কম বিসিএস ক্যাড়ার হতে পারেন।
সবাই নজরুল , রবিন্দ্রনাথের মত কবি কিংবা সুশান্ত পালের মত বিসিএসে প্রথম হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে, কিন্তু তা পূর্ণ করতে পারবে না। এই যেন সাঁতার না জানা মুরিদদের সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে আহবান।
সুশান্ত পালরা প্রতি বিসিএস শেষে জন্মায়। কিন্তু মার্ক জাকারবার্গ জন্মায় না, বিল গেটস জন্মায় না কিংবা স্টিভ জবস । আমাদের দরকার একজন মাহাথির , একজন বিল গেটস, একজন মার্ক জাকারবার্গ।
তিন তালাকের তত্ত্ব শুনিয়ে এই বিসিএস ক্যারিয়ার বিশেষজ্ঞ তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের অজ্ঞতার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। সাব্জেক্টিভ নলেজ বাদ দিয়ে কবি সাহিত্যিকের জন্ম-মৃত্যু সাল মুখস্থের দিকে উদ্বুদ্ধ করছেন মনের অজান্তে। প্রকারান্তে উচ্চ শিক্ষার বারোটা বেঁজে যাবে এতে। যেখানে দেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে সর্বত্র। বিশ্ব রেঙ্কিং ১০০০ এর মধ্যেও বাংলাদশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। অথচ সিঙ্গাপুর কিংবা হংকং এর মত ছোট শহরের কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০-২০০ এর মধ্যে রয়েছে।
যখন ছাত্রছাত্রীরা মুরিদের মত তাঁর কথা গিলছে তখন তিনি সাইন্টিস্ট হওয়ার কথা বলছেন না । ভাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা বলছেন না। ভাল উদ্যোগক্তা হওয়ার কথা বলছেন না। ভাল রাজনীতিবিদ হওয়ার কথা বলছেন না। তিনি মটিভেট করছেন না আমাদের একজন মার্ক জাকারবার্গ বড্ড প্রয়োজন। তিনি বলছেন না দেশের সৎ চরিত্রবান নীতিবান সরকারী কর্মচারী দরকার। তিনি জানাচ্ছেন কিভাবে বিসিএস ক্যাডার হওয়া যায়। এক ক্যারিয়ার আড্ডায় তিনি কিভাবে মিথ্যা তথ্য( কবিতা, কবির নাম ইত্যাদি) লিখে নিরীক্ষককে ফাঁকি দেওয়া যায় তা হেসে খেলে বলে দিচ্ছেন যা ছাত্র-ছাত্রীদের দূর্নীতিপরায়ণ করবে, প্রতারক বানাবে।
আশ্চর্যের বিষয় হল, এক ক্যারিয়ার আড্ডায় তিনি যখন জিজ্ঞাস করলেন, আপনাদের মাঝে কতজন ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট আছে হাত তুল, দেখা গেল তাঁর বিসিএস ক্যারিয়ার আড্ডায় ৫০% শ্রোতাই ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট। তিনি আপ্রিসিয়েট করলেন। অথচ এটা জাতির ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত। এত ইঞ্জিনিয়ার সরকারের ক্যারানি হলে দেশের শিল্প-কারখানা কে চালাবে? সুশান্ত পালের এন্টেনায় এই অশনি সংকেত ধরা পড়ল না। তাকে কেমনে বলি মহাজ্ঞানী?
তাঁর এই বিসিএস ক্যারিয়ার আড্ডা কি দূর্নীতি মুছে দিতে পারবে? দারিদ্রতা দূর করে দিতে পারবে? প্রযুক্তি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দিতে পারবে? তাঁর পিছনে ছুটছে লক্ষ জন , বিসিএস ক্যাডার হবে ২ হাজার জন। বাকিদের তিনি বিকল্প কি স্বপ্ন দেখাচ্ছেন? এইসব যদি না পারেন তাকে কিংবদন্তী ভাবার কি আছে? হ্যাঁ তিনি তাঁর ভাক্তকুলদের সাহিত্যের আনন্দ দিতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে সৎ থাকলে জাতির কিছুটা উপকার করতে পারেন।
বিষয়: বিবিধ
৪৯০৮ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লিথাটা যখন পরেছি তখন ব্লগে লগইন ছিলাম তাই তখন কমেন্ট করি নাই , এখন না পরে শুধু কমেন্ট করলাম ।
আবার ও ধন্যবাদ ভাইয়া ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন