রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু ভাবনা
লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহ আল রাহাত ২৬ মার্চ, ২০১৬, ১১:৫০:৪৬ সকাল
সংবিধানে ইসলাম থাকা জরুরী কেন?
ইসলাম নিছক একটি গতানুগতিক ধর্ম নয় যা মসজিদে আবদ্ধ রাখা যায়, যদিও বিশ্বের অপরাপর ধর্মগুলোকে উপসানালয়ে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে সফলভাবে। এই সফলতার কারণ এই সব ধর্মের নানা বিকৃতির ফলে ধর্মগুলোর জীবনীশক্তি হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু ইসলামের ঐশীগ্রন্থ আল-কুরআন রয়েছে অবিকৃত। ইসলামের ইতিহাস ঐতিহ্য এখনো মুসলিমদের মাঝে সচেতনভাবে আলেমরা ধরে রেখেছেন। তাই ইসলাম নিয়ে ছিনিমিনি খেললে তা মোকাবেলার জন্য মুসলিম উম্মাহর প্রাণশক্তি এখনো বিদ্যমান। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে হলেও আল্লাহর একমাত্র মনোনিত জীবনবিধান ইসলামের মর্যাদা রক্ষায় ইসলামপ্রিয় মুসলিম জনতা সদা প্রস্তুত।
শরিয়া অনুযায়ী ইসলামের আমল কাল-পাত্র ভেদে পরিবর্তনের সুযোগ নেই। মসজিদে যা করণীয় তার বেশীর ভাগ মসজিদের বাহিরে সমাজ ও রাষ্ট্রের পরতে পরতে করণীয়। মুসলিম রাষ্ট্রের আইন ইসলাম বিরোধী হতে পারে না। একজন মুসলিম বিচারক আল্লাহ এর বিধান ছাড়া অন্য বিধান দিয়ে বিচার ফয়সালা করতে পারে না। বিচারব্যবস্থা রাষ্ট্রের অংশ। আল্লাহর বিধান দিয়ে যারা ফয়সালা করে না তারা ইসলামে কাফির সাব্যস্ত হয়।
“হুকুম বা বিধান দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ” [সুরা ইউসুফঃ আয়াতঃ ১২:৬৭]।
“যারা আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুসারে ফায়সালা করেনা তারা কাফির, যালিম ও ফাসিক” [সুরা মায়েদাহঃ আয়াতঃ ৫:৪৪, ৪৫ এবং ৪৭]।
ইসলাম মুসলিমের জীবনের প্রতিটি স্তর নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ইসলামে মুসলিমের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কিছু বিধি-বিধান রয়েছে যেমন নামাজ, রোজা, পর্দা, বিবাহ ইত্যাদি। যেহেতু সংবিধান নাগরিকের জন্য অলংঘনীয় বিধি-বিধান সেহেতু এই সব ফরজ আমল পালনের ক্ষেত্রে কেউ যেন প্রতিবন্ধক হতে না পারে তার জন্য ইসলামের সংবিধানিক স্বীকৃতির দরকার আছে।
একটি মুসলিম রাষ্ট্রে একমাত্র ইসলামই সর্বোচ্চ মর্যাদা ও স্বীকৃতি পাবে। এটা যেমন মুসলিমদের গণতান্ত্রিক অধিকার তেমনি আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন এমন নির্দেশনা।
“তিনিই আপন রাসুল কে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহ পাটিয়েছেন, যাতে করে তিনি সমগ্র দ্বীনের ওপর তাকে বিজয়ী করে তুলতে পারেন”। -( সূরা আত তাওবাঃ ৩৩)।
যদি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম না থাকে তাহলে মুসলিমদের জন্য শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরজ হয়ে যায়। যে শাসক আল্লাহর আইন দ্বারা শাসন করে না, ইসলাম মানে না সে শাসকের শাসনকে মুসলিম শাসন বলা যাবে না। কাফিরের শাসন হিসাবে সাব্যস্ত হবে। মুসলিমের জন্য কাফের শাসকের আনুগত্য বাধ্যতামূলক নয়।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কি অমুসলিমের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে ?
ইসলামের ভিতরের অন্য ধর্মের মর্যাদা ও অধিকার সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত আছে। মুসলিম রাষ্ট্রে শাসককে অমুসলিমদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং সুখ-সমৃদ্ধিও সমভাবে নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। পার্থিব বিষয়ে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের অধিকার সমান।এই ক্ষেত্রে মুসলিমদের অমুসলিমদের উপর কোন অগ্রাধিকার নেই।
“তোমার ধর্মের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেনি, তোমার বসতি থেকে তোমাকে উচ্ছেদ করেনি, তাদের প্রতি তোমার দয়ালু হওয়া উচিত এবং তাদের সঙ্গে ন্যায়ানুগ আচরণ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায় ভালোবাসেন” [৬০:৮] ।
আল্লাহ তায়ালা অমুসলিমদের সাথে সদাচার ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে তাগাদা দিয়েছেন।
“আল্লাহ নিষেধ করেন না ওই লোকদের সঙ্গে সদাচার ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে যারা তোমাদের সঙ্গে ধর্মকেন্দ্রিক যুদ্ধ করে নি এবং তোমাদের আবাসভূমি হতে তোমাদের বের করে দেয় নি। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন” [সূরা আল-মুমতাহিনা, আয়াত : ৮]
ইসলামে অমুসলিম উপসানালয়ে হামলা ও মুর্তি-প্রতিমাকে অশ্রদ্ধা বা গালমন্দ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
‘তারা আল্লাহ তা‘আলার বদলে যাদের ডাকে, তাদের তোমরা কখনো গালি দিয়ো না, নইলে তারাও শত্রুতার কারণে না জেনে আল্লাহ তা‘আলাকেও গালি দেবে, [সূরা আল আন‘আম, আয়াত : ১০৮]
ইসলামে অমুসলিম নাগরিকদের মানবাধিকারের বিষয়ে জোর তাগদা দেওয়া হয়েছে।
“সাবধান! যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তার অধিকার খর্ব করে, তার ক্ষমতার বাইরে কষ্ট দেয় এবং তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক নিয়ে যায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করব” [আবূ দাঊদ : ৩০৫২]
‘যে মুসলিম কর্তৃক নিরাপত্তা প্রাপ্ত কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ তার ঘ্রাণ পাওয়া যায় চল্লিশ বছরের পথের দূরত্ব থেকে’। [বুখারী : ৩১৬৬]
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম না থাকলে কি হবে?
ধরুণ, রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে যদি ইসলাম না থাকে তাহলে কেউ কোন প্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রে সালাত পড়তে বাধা দেয় তাহলে মুসলিমরা তা মোকাবেলার জন্য সাংবিধানিক ভিত্তি পাবে না।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পড়া, দাঁড়ি রাখা, পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তা মোকাবেলার আইনি কোন ভিত্তি থাকবে না।
ইসলামকে হেয় ও গুরুত্বহীন করা
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংবিধানে নাগরিকের জীবনের করণীয় ও বর্জনীয় প্রায় সবকিছু বর্ণনা করা থাকে। এই সংবিধানের বাহিরের বিষয়াদি ঐচ্ছিক ও কম গুরুত্ব বহন করে। আর সংবিধান এর বিরোধিতা করা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। সংবিধান লঙ্ঘন এর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তাহলে সংবিধানে যদি ইসলাম না থাকে ইসলামের ফরজ আমলগুলো পালন ও অন্য মুসলিম ভাই-বোনকে তা পালনে বাধ্য করা যাবে না। ইসলামের নানা বিধিবিধান নিয়ে ইসলাম বিদ্বেষীদের কটুক্তি আরো বেড়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে তারা সংবিধানকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করবে। পিতা-মাতারা তাদের সন্তানদের ইসলাম পালনের জন্য বাধ্য করতে পারবে না। অথচ ইসলাম পালন না করলে সন্তানদের মারধরের কথা হাদিসে রয়েছে।
সরকার ধর্মনিরেপক্ষতার নামে মসজিদ-মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করে দিলে তা মোকাবেলার কোন সাংবিধানিক ভিত্তি থাকবে না। নতুন মসজিদ-মাদ্রসা প্রতিষ্টার জন্য বাধ্যতামূলক সরকারী অনুমোদন লাগবে। বাতিল সরকার এই জায়গায় তাদের সুবিধাজনক নিয়ন্ত্রণ করবে।
কওমী মাদরাসাগুলোর সরকারী নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ইসলাম বিদ্বেষীদের অন্যতম টার্গেট।
ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ইসলাম ও ইসলাম প্রিয় জনগণের জন্য কথা বলার পথ রুদ্ধ করে দিবে।
রাষ্ট্রের সর্বস্তর থেকে ইসলামের অনুশীলন ও ইসলামপন্থীদের বিতাড়িত করে শাসনতন্ত্রকে ইসলাম বিদ্বেষীদের আকড়ায় পরিনত করবে।
শিশুদেরকে দ্বীনি শিক্ষা থেকে সরিয়ে ধর্মহীন ও ধর্মবিদ্বেষী করে গড়ে তুলবে।
সংবিধানের দোহায় দিয়ে কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। আর একই কায়দায় সংবিধানের দোহায় দিয়ে ইসলামী বিরোধী নানা আইন করে ইসলামকে তিলে তিলে ধ্বংশ করে দিতে চাইবে। মূলত ইসলাম উৎখাতের অংশ হিসাবে বাম প্ররোচনায় সরকার বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের পাঁয়তারা করছে।
রাষ্ট্রধর্ম সাথে ইসলামের মর্যাদার সম্পর্ক
একজন মুসলিম যেমন কখনো ধর্মনিরেপক্ষ হতে পারে না , তেমনি কোন মুসলিম রাষ্ট্রও ধর্মনিরেপক্ষ হতে পারে না। সে কেবল আল্লাহর হুকুমের তালিম করতে পারে। একটি মুসলিম রাষ্ট্রে কেবল আল্লাহর শাসন কর্তৃত্ব চলতে পারে। এমন নির্দেশনায় আল কুরআনে বিদ্যমান।
“লোকেরা বলে শাসন কর্তৃত্বের ব্যাপারে আমাদের কোন অংশ আছে কি? বলুন, শাসন কর্তৃত্ব সর্বাংশেরই আল্লাহর জন্য নির্ধারিত” [সুরা আল ইমরানঃ ১৫৪]
“সাবধান, সৃষ্টি যাঁর আইনও তাঁর” [সুরা আরাফঃ ৫৪]
ধর্মনিরেপক্ষতার বুলি গেয়ে ইসলামবিদ্বষীরা মূলত ইসলামকে মুড়িয়ে মসজিদে আটকিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু ইসলাম মসজিদে আটকিয়ে রাখার জন্য আসেনি। আল্লাহর জমিনে ইসলামকে প্রতিষ্টা করা মুসলমানের অপরিহার্য কাজ।
“নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে ইসলাম হল একমাত্র মনোনিত দ্বীন।” [সূরা আলে ইমরানঃ ১৯]
"তিনিই আপন রাসুল কে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহ পাটিয়েছেন, যাতে করে তিনি সমগ্র দ্বীনের ওপর তাকে বিজয়ী করে তুলতে পারেন”। -[সূরা আত তাওবাঃ ৩৩]।
ইসলাম গণতান্ত্রিক অধিকার
দেশের অনেক সচেতন মুসলিম গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু অধিকাংশ জনমতের কারণে সংবিধানে গণতন্ত্র স্থান পেয়েছে। তাহলে এদেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের ইসলাম সংবিধানে থাকাটা ন্যায্য। এটি ৯০ ভাগ মুসলমানদের গণতান্ত্রিক অধিকারও বটে। সংবিধান থেকে ইসলাম বাদ দেওয়া হল ৯০ ভাগ মুসলমানদের মতকে বাদ দিয়ে হাতে গোনা নাস্তিক ও ইসলাম বিদ্বেষীদের মনোবাঞ্চনা পুরন করা।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সবাই টানাটানি করছে। বাম ও ইসলাম বিদ্বেষীরা এটিকে ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছে। মূলত মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আওয়ামী লীগকে সামরিক জান্থা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার কারণে। মুক্তিযুদ্ধ কোন ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে এই যুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলা হয়নি, সমাজতন্ত্রের জন্যও না, ধর্মনিরেপক্ষতার জন্যও নয়। এটি ছিল জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষনা পত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে “বাংলাদেশের জনগনের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষনা করিলাম”। এই ঘোষনাপত্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের তিনটি লক্ষ্য পাওয়া যায়-
১/ জনগণের জন্য সাম্য প্রতিষ্ঠা করা;
২/ জনগণের জন্য মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা; এবং
৩/ জনগণের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
এই তিনটা বিষয়ের সাথে দলমত নির্বিশেষে সবাই একমত। এই তিন লক্ষের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার কোন সম্পর্ক নেই। বরং এই তিন লক্ষ্য প্রতিষ্টার জন্য যুগে যুগে নবী রাসূলরা আগমন করেছিলেন। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও এই তিন লক্ষের কোনটি প্রতিষ্ঠা পায়নি। এখনো ধর্ষণ হয়, হত্যা হয়, গুম হয়, নির্যাতন নয়, অর্থ লূট হয়।
বিষয়: বিবিধ
১১৬২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন