আসুন ফিতরা সম্পর্কে জানি (রমজানের বিশেষ একটি ইবাদত)
লিখেছেন লিখেছেন ভোলার পোলা ২৩ জুলাই, ২০১৪, ১০:১৮:৫২ রাত
1. ফিতরা কাকে বলে?
ফিতরাকে শরীয়তে ‘যাকাতুল ফিতর
এবং সাদাকাতুল ফিতর’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ
ফিতরের যাকাত বা ফিতরের সদকা। ফিতর
বা ফাতূর বলা হয় সেই
আহারকে যা দ্বারা রোযাদার রোযা ভঙ্গ
করে। [আল মুজাম আল ওয়াসীত/৬৯৪]
আর যাকাতুল ফিতর বলা হয় ঐ
জরুরী দানকে যা, রোযাদারেরা ঈদুল ফিতর
উপলক্ষে অভাবীদের দিয়ে থাকে। [প্রাগুক্ত]
যেহেতু দীর্ঘ দিন রোযা অর্থাৎ পানাহার
থেকে বিরত থাকার পর ইফতার বা আহার শুরু
করা হয় সে কারণে এটাকে ফিতরের
তথা আাহারের যাকাত বলা হয়। [ ফাতহুল
বারী ৩/৪৬৩]
2. ফিতরার হুকুম (বিধান):
ফিতরা দেয়ার সামর্থ্য রাখে এরকম প্রত্যেক
ব্যক্তিকে নিজের ও পরিবারের ঐ সমস্ত সদস্যদের
পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ফরয যাদের
লালন-পালনের দায়িত্ব শরীয়ত কর্তৃক তার
উপরে অর্পিত হয়েছে। [ আল মুগনী, ৪/৩০৭,
বুখারী হাদীস নং ১৫০৩]
অবশ্য সেই ব্যক্তি এই আদেশের বাইরে যার নিকট
এক দুই বেলার খাবার ব্যতীত অন্য কিছু নেই।
[সউদী ফাতাওয়া বোর্ড, ৯/৩৮৭]
3. নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর
যুগে কি দ্বারা এবং কি পরিমাণ
ফিতরা দেওয়া হত?
বুখারী শরীফে ইবনে উমর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত
হয়েছে, তিনি বলেন: ‘‘আল্লাহর রাসূল
যাকাতুল ফিতর স্বরূপ এক সা খেজুর
কিংবা এক সা যব ফরয করেছেন মুসলিম দাস ও
স্বাধীন, পুরুষ ও নারী এবং ছোট ও বড়র প্রতি।
আর তা লোকদের নামাযে বের হওয়ার
পূর্বে আদায় করে দিতে আদেশ করেছেন’’।
[বুখারী, অধ্যায়: যাকাত হাদীস নং ১৫০৩/
মুসলিম নং ২২৭৫]
উক্ত হাদীসে দুটি খাদ্য দ্রব্যের নাম
পাওয়া গেল যা,
দ্বারা নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর
যুগে ফিতরা দেওয়া হত। একটি হচ্ছে খেজুর
অপরটি যব। এবার নিম্নে আর একটি হাদীস
পাঠ করুন।
আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) বলেন: আমরা-
নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যাকাতুল
ফিতর বের করতাম এক সা খাদ্য দ্রব্য
কিংবা এক সা যব কিংবা এক সা খেজুর
কিংবা এক সা পনীর কিংবা এক
সা কিশমিশ।” [ বুখারী- ১৫০৬ মুসলিম-২২৮১]
এই হাদীসে খেজুর ও যব ছাড়া আরও
যে কয়েকটি বস্তুর নাম পাওয়া গেল তা হল:
কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য দ্রব্য। উল্লেখ
থাকে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিগত হওয়ার
পরে মুআবীয়া (রাযিঃ) এর
খেলাফতে অনেকে গম দ্বারাও ফিতরাদিতেন।
[ বুখারী হাদীস নং ১৫০৮ মুসলিম ২২৮১ ]
প্রমাণিত হল যে, নবীজী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে যে সব
দ্রব্যাদি দ্বারা ফিতরা দেওয়া হয়েছিল
তা হল, খেজুর, যব, কিশমিশ, পনীর এবং খাদ্য
দ্রব্য। এবং এটাও প্রমাণিত হল যে ফিতরার
পরিমাণ ছিল এক সা।
যদি নবীজী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদ্য দ্রব্য
শব্দটি না বলতেন তো আমাদের প্রতি খেজুর, যব,
কিশমিশ এবং পনীর দ্বারাই
ফিতরা দেওয়া নির্ধারিত হত। কিন্তু আমাদের
প্রতি আল্লাহর রহমত দেখুন এবং ইসলামের
বিশ্বজনীনতা লক্ষ্য করুন যে খাদ্য দ্রব্য
শব্দটি উল্লেখ হয়েছে বলেই উপরোল্লিখিত
দ্রব্যাদি যাদের খাবার নয় তারাও নিজ
খাবার দ্বারা ফিতরাআদায় করতে পারবেন।
আর এখান থেকেই প্রশ্ন আসে যে, ধান
দ্বারা ফিতরা দিতে হবে না চাল দ্বারা?
দুটিই কি খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত ?
4. ধানের, না চালের ফিতরা?
ধান কিংবা চাল দ্বারা ফিতরা দেওয়ার
প্রমাণ হাদীসের সেই শব্দটি,
যেখানে সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ)
বলেছেন:
ﻛﻨﺎ ﻧﺨﺮﺝ ﻓﻲ ﻋﻬﺪ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ
ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻔﻄﺮ ﺻﺎﻋﺎ ﻣﻦ ﻃﻌﺎﻡ …
“আমরা খাদ্য দ্রব্যের মধ্য হতে এক
সা যাকাতুল ফিত্ র বের করতাম।
সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী আরও বলেন:
‘‘সে কালে আমাদের খাদ্য দ্রব্য ছিল: যব,
কিশমিশ, পনীর এবং খেজুর”। [ বুখারী, অধ্যায়:
যাকাত নং ১৫১০]
এই হাদীসটির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেখার
প্রয়োজন আছে যে, এ যুগে আমাদের সাধারণ
খাদ্য কি? সাধারণত: আমাদের খাদ্য ভাত
কিংবা রুটি তাই আমাদেরকে চাল কিংবা গম
দ্বারা ফিতরা দেওয়া দরকার। কারণ
বর্তমানে এটাই আমাদের খাবার
এবং আমাদের দেশের ফকীর মিসকিনদেরও
খাবার। আর কারো খাদ্য যদি ধান হয়
তাহলে তার ব্যাপার ভিন্ন!! ?
একটি সত্য রহস্য: যদি আমাদের
বাঙালী ভাইদের বলা হয় যে অমুক
স্থানে এক মন চাল কিংবা এক মন ধান
ফ্রি বিতরণ হচ্ছে। আপনি চাইলে এক মন ধান
নিতে পারেন আর চাইলে এক মন চাল
নিতে পারেন। বলুন
তো প্রত্যেকে কি নিতে চাইবে? আশা করি ১০০%
লোকই এক মন চাল নিতে আগ্রহী হবে।
তাহলে আমরা নিজে নেয়ার সময় চাল
নিতে চাই আর ফকীর-মিসকিনদের দেয়ার সময়
ধান দিতে চাই। এটাই কি দ্বীনের ভালবাসা!
এটাই কি আল্লাহর বিধানের
সাথে আন্তরিকতা? আল্লাহর রাস্তায় মন্দ
টা আর নিজের জন্য ভাল টা!
এবার আমরা আলোচ্য বিষয়ে প্রায় ৫০
থেকে ১০০ বছর পূর্বের ভারত উপমহাদেশের কিছু
শিরোমণি উলামায়ে কেরামের
ফতোয়া তুলে ধরার
চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
5. উপমহাদেশের কয়েকজন বরেণ্য
উলামায়ে কেরামের ফতোয়া:
• দিল্লীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান,
‘রহমানীয়া দারুল উলূমের’ শায়খুল হাদীস
মওলানা হাফেয আহমদুল্লাহ (রহঃ) এর
ফতোয়া:
“ফিতরায় ধান দেওয়া দুরুস্ত নয়; চাউল, গম,
আটা, ছাতু, কিশমিশ, খেজুর, ও যব
প্রভৃতি যে সকল বস্তুর জন্য ‘তাআম’
বা খাদ্য-শব্দ প্রযোজ্য হইতে পারে, সেই সকল
বস্তু দ্বারা সদকা প্রদান করা কর্তব্য।
আল্লাহ বলিয়াছেন:
ﻭ ﻻ ﺗﻴﻤﻤﻮﺍ ﺍﻟﺨﺒﻴﺚ ﻣﻨﻪ ﺗﻨﻔﻘﻮﻥ ﻭ ﻟﺴﺘﻢ ﺑﺂﺧﺬﻳﻪ ﺇﻵ
ﺃﻥ ﺗﻐﻤﻀﻮﺍ ﻓﻴﻪ
“তোমরা খাদ্যের খবিস (নিকৃষ্ট) অংশ
দ্বারা আল্লাহর পথে খরচ করার সংকল্প
করিও না। অথচ তোমরা স্বয়ং উহা গ্রহণ
করিতে প্রস্তুত নও।” (বাক্বারাহ/ ২৬৭] )
উল্লিখিত আয়াতটি ধানের ফিতরা হারাম
হইবার মৌলিক দলীল। নিকৃষ্ট ও বর্জনীয়,
যাহা খাদ্যের উপযোগী নয় বা খাওয়ার
কষ্টসাধ্য, এরূপ বস্তু সদকা করা হারাম।
অতঃপর তিনি আরও কিছু আলোচনা করার পর
বলেন: ধান ফিতরায় দান করা অবৈধ হইবার
আর একটি কারণ এই যে, এক সা ধানে শরীয়ত
কর্তৃক পরিমিত ফিতরা আদা হইবে না; এক
সা ধানে পৌনে এক সা চাউল টিকিবে,
সিকি অংশ এরূপ খোসায় পরিণত
হইবে যাহা পশুদের পক্ষেও গলাধঃকরণ
করা কষ্টসাধ্য। আর এক সা ধানে পৌনে এক
সা চাউল হইবার কারণে রাসূলুল্লাহর
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
হাদীসের বিরোধ করা হইল এবং এক সার
আদেশ অনুসরণ করা হইল না। আর প্রকৃত
পক্ষে যাহা সঠিক, তাহা আল্লাহ অবগত
আছেন।” ১-৮-১৩৬৬ হিজরী। [ফাতাওয়া ও
মাসায়েল, আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল
কাফী আল কোরায়শী (রহঃ) পৃ: ১৭৭-১৭৯,
মুদ্রণে: আল্ হাদীস প্রিন্টিং এন্ড
পাবলিশিং হাউজ, ঢাকা ১১০০ ]
• অবিভক্ত ভারত বর্ষের
জামায়াতে আহলে হাদীসের আমীর,
আল্লামা সানা উল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ)
এর ফতোয়া:
সাদাকাতুল ফিতর চাউল দিয়াই
আদা করা চাই। ধান দিয়া নয়। আর
ধানকে যবের উপর কিয়াস করাকে সহজ
বুদ্ধিতে স্বীকার করা চলেনা আর
যাহা সঠিক তাহা আল্লাহ অবগত আছেন।
২৮ শে জানুয়ারি, ১৯১৯ ইং। [ প্রাগুক্ত পৃ:
১৮২]
• মুখপত্র তর্জুমানুল হাদীসে প্রকাশিত
ফতোয়া:
যবের উপর কেয়াস (অনুমান) খাটাইয়া ধানের
ফিতরা জায়েয হইবে না, কারণ ধান
আদৌ আহার্য সামগ্রী ‘তাআম’ নয়। আহার্য
বস্তুর উপর কিয়াস করিয়া যব বা খুর্মার
ফিতরা দেওয়া হয় না মনসূস ( কুরআন
বা হাদীসে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখিত) বলিয়াই
দেওয়া হইয়া থাকে। তাআম বা আহার্য
সামগ্রীরূপে ফিতরা দিতে হইলে এক সা চাউল
দিতে হইবে। [ তর্জুমানুল হাদীস, ২য় বর্ষ, ৩য়
সংখ্যা, রবিউল আওয়াল, ১৩৭০ হি: প্রাগুক্ত
পৃঃ ১৭৫]
উপরোক্ত আলোচনা এবং আমাদের
পূর্বসূরি যোগ্যতাসম্পন্ন বরেণ্য লেখক ও গবেষক
উলামায়ে কেরামগণের জ্ঞানগর্ভ
ফতোয়া অনুযায়ী, আমাদেরকে প্রচলিত
নিয়মে ধানের ফিতরা না দিয়ে চাল
দ্বারা ফিতরা আদায় করা প্রয়োজন।
6. খাদ্য দ্রব্য
দ্বারা ফিতরা না দিয়ে টাকা-
পয়সা দ্বারা ফিতরা দেওয়া:
প্রত্যেক মুসলিম ভাইকে জানা দরকার যে,
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এর যুগে মুদ্রা হিসেবে দীনার এবং দিরহামের
প্রচলন ছিল। এবং সে কালেও ফকীর ও
মিসকিনদের তা প্রয়োজন হত।
তা দ্বারা তারা জিনিস-পত্র ক্রয়-বিক্রয়
করত। তা সত্ত্বেও নবী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
মুদ্রা দ্বারা ফিতরা নির্ধারণ না করে খাদ্য
দ্রব্য দ্বারা নির্ধারণ করেছেন। তাই
উপরে হাদীসে বর্ণিত খাদ্য বস্তু দ্বারাই
ফিতরা আদায় করা সুন্নত। আর এটাই জমহুর
(অধিকাংশ) উলামায়ে কেরামের মত। কারণ
বর্ণিত খাদ্য বস্তুর বদলে মূল্য তথা টাকা-
পয়সা দ্বারা ফিতরা দিলে নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর
আদেশকে উপেক্ষা করা হয়।
যারা মূল্য দ্বারা ফিতরা দেয় তাদের
সম্পর্কে ইমাম আহমদ (রহঃ)
কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের বরখেলাফ
হওয়ার কারণে আমার আশংকা হচ্ছে যে,
তা যথেষ্ট হবে না। [মুগনী, ইবনু কুদামাহ,
৪/২৯৫]
মূল্য দ্বারা ফিতরা দিতে গেলে আরও একটি বড়
বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। তা হল, প্রতি বছর
প্রতি অঞ্চলে এমন একদল লোকের প্রয়োজন
আছে যারা ফিতরার মূল্য নির্ধারণ
করে সাধারণ লোকদের জানাবে। কারণ স্থান
ও কালের ভেদে দ্রব্যের মূল্য কম-
বেশী হতে থাকে। তাই প্রতি বছর ফিতরার মূল্য
নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয় অথচ সোয়া চৌদ্দশ
বছর পূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরিমাণ নির্ধারণ
করে গেছেন। মানুষ এত সব করতে ইচ্ছুক কিন্তু
যা কিছু দ্বারা নবীজী (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফিতরা দিয়ে গেছেন
তা দ্বারা ফিতরা দিতে অনিচ্ছুক! কি আশ্চর্য!!
মুল • লেখক: আব্দুর রাকীব (মাদানী) দাঈ, দাওয়াহ সেন্টার খাফজী, সউদী আরব। • সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী, দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।
কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা হলো। আর এবার বাংলাদেশে সর্বনিম্ন ফিতরা জন প্রতি 65 টাকা।
বিষয়: বিবিধ
১১৩৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো। জাজাকাল্লাহু খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন