লঞ্চ ডুবি আর নিরীহ প্রানহানিঃ ভিতরের কারন অনুসন্ধান
লিখেছেন লিখেছেন আতিক খান ০৫ আগস্ট, ২০১৪, ০৮:০৯:১৪ রাত
ঈদের আগে টিভিতে একটা খবরে দেখাচ্ছিল, লঞ্চ মালিকরা মন্ত্রীর কাছে মিটিং এ অঙ্গীকার করেছেন অতিরিক্ত যাত্রী বহন করবেন না এবং আনফিট লঞ্চ দিয়ে যাত্রী পরিবহন করবেন না। আর দিন তিনেক আগে শুনলাম প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, এবারের ঈদে দুর্ঘটনা ছাড়াই মানুষ শান্তিতে ঈদ করতে পেরেছে। একটু দম ফেলার সুযোগ না দিয়েই শুরু হল ট্রেন দুর্ঘটনা আর লঞ্চ ডুবি। সাম্প্রতিক কালে ৩ টা লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হতে পারত বা হয়েছে।
১। কর্নফুলী-১: ঈদের দু’দিন আগে ২৭ জুলাই রোববার বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া সংলগ্ন নদীতে ঢাকা থেকে ভোলার দৌলতখানগামী কর্নফুলী-১ লঞ্চের তলা ফেটে যায়। এসময় লঞ্চে প্রায় ২ হাজার যাত্রী ছিল। পুরাতন লঞ্চ দিয়েই বিশেষ সার্ভিসের ব্যবথা করা হয় স্বীকার করেন বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপপরিচালক আবুল বাশার মজুমদার। তিনি বলেন, অধিকাংশ বিশেষ সার্ভিসের লঞ্চ ঝালাই করা ছিল। ফলে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ঝালাই স্থান ফেটে গিয়ে পানি ঢুকে পড়ে।
২। আঁচল-৪: ৩ আগস্ট রোববার পিরোজপুরের হুলারহাট থেকে ঢাকাগামী এমভি আঁচল-৪ লঞ্চের তলায় ফাটল ধরে। লঞ্চে প্রায় ২ হাজার যাত্রী ছিল। শিকারপুর ঘাটে লঞ্চ ভিড়াতে গেলে লঞ্চের সামনের দিকের তলায় ফেটে যায়। তবে সেই অবস্থায় লঞ্চটি আবারও চলতে শুরু করলে লঞ্চে পানি উঠে। পরে বাবুগঞ্জের বাহেরচরে লঞ্চটি নোঙ্গর করলে মারাত্মক দূর্ঘটনা থেকে বেচে যান যাত্রীরা।
৩। এমভি পিনাক-৬: সবশেষ পদ্মায় ডুবল পিনাক-৬ নামের লঞ্চটি। সোমবার সাড়ে তিনশ যাত্রী নিয়ে তীব্র স্রোত ও ঘূর্ণাবর্তের মোকাবেলা করতে না পেরে মাঝপদ্মায় ডুবে যায় এমভি পিনাক-৬। লঞ্চটি মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে মাওয়া ঘাটে আসার আগেই অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে মাঝপদ্মায় ডুবে যায়।
মেরিনার হিসাবে দায়বদ্ধতা থেকে লঞ্চডুবি নিয়ে লেখা দরকার। সম্ভাব্য কারনগুলো হতে পারে এরকম,
১। ত্রুটিপূর্ণ নকশা এবং ত্রুটিপূর্ণ নৌযানঃ ভুল নকশায় তৈরি হওয়া, নৌযান তৈরির সময় মনিটরিং না থাকা এবং সনদ ইস্যুর আগে সার্ভে ঠিকমত না হওয়া অথবা একেবারেই না হওয়া। লঞ্চ চালু হবার পর নির্দিষ্ট সময় পরপর আবার সার্ভের মাধ্যমে সনদ নবায়ন করে নিতে হয়। সেটাও অনেকসময় ঠিকমত হয় না। আবার সনদ ইস্যুর পর লঞ্চের কাঠামোগত যে কোন পরিবর্তন এর জন্য পুনরায় সার্ভের মাধ্যমে সনদ নিতে হয়। এসমস্ত প্রক্রিয়াগুলোর মাঝে কোথাও কোথাও ফাঁক থেকে যেতে পারে এবং ঠিকমত অনুসরন করা নাও হতে পারে। একটি লঞ্চ ৩০-৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত কাত হলেও ডুবে যাবার কথা নয়, কিন্তু পিনাক ৬ সহজেই ডুবে গেল।
২। জনশক্তিঃ দেশের সমস্ত সমুদ্র এবং নদী বন্দরগুলোয় প্রায় ৮৫০ টি লঞ্চ চলাচল করে। বড় ২৫০ টি এবং ছোট ৬০০ টি। এতগুলো নৌযান এর জন্য মাত্র ৪ জন সার্ভেয়ার নিতান্তই অপ্রতুল। এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো দরকার, নাহলে ঠিকমত সার্ভে করা কাগজ কলমেই থেকে যাবে।
৩। অতিরিক্ত যাত্রী এবং মালপত্র বহনঃ প্রতিশ্রুতির পর ও মালিকরা কথা রাখেননি। লঞ্চ মালিক এবং নৌযান এর কর্মচারীরা না চাইলে অতিরিক্ত যাত্রী উঠা সম্ভব নয়। আনফিট লঞ্চ নামিয়ে তাতে ক্ষমতার বেশি বহন করলে ডুবে যাবার সম্ভাবনা থেকেই যাবে। এজন্য মালিক এবং লঞ্চ কর্মচারীদের শাস্তি হবে কি?
৪। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াঃ এই ব্যাপারে আমাদের কোন হাত নেই। নিয়মিত আবহাওয়া সংবাদ রাখা, লঞ্চ চালকদের সেটা জানা এবং ব্যবস্থা গ্রহন করা। অবশ্যই অতিরিক্ত যাত্রী না নেয়া এবং প্রয়োজনে যাত্রা বাতিল করা উচিত ছিল। সেদিনের আবহাওয়াতে ৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের নিচের লঞ্চ যাত্রা করার কথা নয়, কিন্তু পিনাক- ৬ ছিল ৫২ ফুট।
৫। অদক্ষ চালকঃ চালকের দক্ষতায় অনেক সময়ই অনেকের জীবন রক্ষা পায় আবার উল্টোভাবে অদক্ষ হলে প্রয়োজনে জীবনহানি ঘটে। এই চালকদের সনদপত্র চেক করে দেখা দরকার।
৬। ডুবোচর এবং নাব্যতাঃ নিয়মিত ড্রেজিং করা এবং ম্যাপ আপডেট করা হয় কি? অভিজ্ঞ চালকরা অবশ্য যার যার নৌ পথের জটিলতা গুলো অনেকটুকু জানেন। নতুন চালকরা এক্ষেত্রে সমস্যা এবং বিপদজনক। নতুন চালকদের একটা নির্দিষ্ট সময় ট্রেনিং এর ভিতর দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু ঈদের সময় হটাত অনেক নতুন নৌযানের আগমনে বাধ্য হয়ে স্বল্প অভিজ্ঞদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়।
৭। যাত্রীদের অসচেতনতাঃ খারাপ আবহাওয়াতে লঞ্চ বোঝাই করে যাত্রা কি করতেই হবে? প্রতি বছর একই ঘটনা। দুই ক্ষেত্রেই যাত্রীরা নিজেরাও কি পারেন না যাত্রা বাতিল করতে? আমরা ভুলে যাই, সময়ের চেয়ে জীবনের মুল্য বেশী।
৮। জীবন রক্ষা সামগ্রীঃ নৌযান গুলোতে যাত্রীদের জীবন রক্ষার্থে লাইফ বয়, লাইফ জ্যাকেট ইত্যাদি থাকা উচিত। অনেকে এগুলো কম ছিল বলে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে মনে রাখা দরকার, এগুলো যদি থাকেও সনদে উল্লেখ করা যাত্রীসংখ্যা অনুপাতেই থাকবে। অতিরিক্ত যাত্রীদের জন্য থাকবে না।
৯। তদন্ত কমিটিঃ প্রতি দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং অবশ্যই রিপোর্ট কখনো আলোর মুখ দেখে না। আগের রিপোর্টগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন করা গেলে বাঁচানো যেত অনেকগুলো নিরীহ প্রান। এবারো ভালো কিছু হবে আশা করা বোকামি। আর যাদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ও বিবেচ্য।
- গত ১৪ বছরে ৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। অপর দিকে দেশে ২৩ হাজার নৌযানের মধ্যে ২২ হাজার নৌযানেরই লাইসেন্স নেই। ফলে নৌপথে চলাচলকারী জনসাধারণ চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আর ঈদের সময় রংচং লাগিয়ে অতিরিক্ত টাকা কামাইয়ের নেশায় নষ্ট এবং আনফিট লঞ্চ গুলো পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
মনে হয় তদন্ত রিপোর্টে সম্ভাব্য কারন হিসেবে উঠে আসবে - আবহাওয়া, অতিরিক্ত যাত্রী আর যাত্রীদের দৌড়াদৌড়ীর ফলে লঞ্চ একদিকে কাত হয়ে যাওয়া। বাকি গুলো চাপা পড়ে যাবে।
- প্রতি দুর্ঘটনার পর আমরা সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করি উদ্ধারকাজে। উদ্ধারকারি জাহাজ, নৌ বাহিনি এবং কোস্টগার্ড এর উদ্ধারকাজ, লক্ষ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ, হেলিকপ্টার, পরিবারের ক্ষতি এবং মেধাবিদের অকালে ঝরে যাওয়া - সব মিলিয়ে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি এই দেশের। এর অংশবিশেষ ব্যয় করলেও রোধ করা যায় অনেক অমুল্য প্রাণহানি। কর্তৃপক্ষের গভীর নিদ্রা আদৌ ভাঙ্গবে কি?
বিষয়: বিবিধ
১২৫১ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন