বন্ধনঃ পর্ব ১ (পিঠাপিঠি ভাই বোনের গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন আতিক খান ০৯ জুন, ২০১৪, ০৮:২১:২৬ রাত
রোজার ঈদ আসছে। সৌভাগ্যবান অনেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে উৎসব করবে। আমাদের বয়সে এসে সবাইকে একসাথে পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। জীবিকার তাগিদে কেউ বিভিন্ন জেলায়, কেউবা বিদেশে। অনেক বছর আপুর সাথে ঈদে দেখা হয় না। কানাডা থাকে, ছুটিছাটায় আসে। গত ঈদে আপুকে খুব মনে পড়ল। পিঠাপিঠি হলে ঝগড়া ফ্যাসাদ যেমন বেশি হয়, টানও নাকি বেশি থাকে। পিঠাপিঠি ভাই বোনদের অনেক মজার ঘটনা থাকে। কয়েকটা শেয়ার করি।
কোরবানি ঈদঃ আমার বয়স ৬/৭ আর আপুর ৮ পেরিয়েছে। গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদ। আমাদের আনন্দ বাঁধনহারা। অনেকগুলো গরু ছাগল একটা খোলা জায়গার পাশে গাছের সাথে বাঁধা। হুজুরের অপেক্ষা। নামাজের পর হুজুর বের হয়ে ক্রমান্বয়ে বাড়ির পর বাড়ি ঘুরে ঘুরে কাজ শেষ করে। হুজুর আসলে আমাদের পশু গুলো কোরবানি (জবাই) করা হবে। আমার বয়সীরা ছাগলগুলোকে গাছের পাতা খাওয়াতে ব্যস্ত। হটাৎ দেখলাম আপু পা টিপে টিপে আমাদের দিকে আসছে। আমি মহা বিরক্ত। ছেলেদের কাজকর্মের মধ্যে পিচ্চি মেয়ে একটা এখানে কি করে! ও খুব ভীতু টাইপ এর ছিল। তখনো ওকে নাম ধরে ডাকতাম। ওকে ডাক দিলামঃ
“এই লিনা (নাম) - বাড়িতে যাও, এখানে আসিও না। হুজুর দেখলে তোমাকে জবাই করে দিবে”। আমার কথা উড়িয়ে দিবে এমন ভাব নিতে না নিতেই শখানেক গজ দুরে রাস্তার মুখে হুজুরকে দেখা গেল। হাতে বিশাল রক্তমাখা ছুরি, লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত ভাঁজ করে তুলে কোমরে গোঁজা। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসছে। আপুর মুখচোখ মুহূর্তেই রক্তশূন্য, বিশাল এক চিৎকার দিয়ে ছুটল বাড়ির দিকে। ওকে থামায় আর কার সাধ্য। চিৎকার আর কান্নাকাটিতে দাদার বাড়িতে ঢুকেই পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল। এখানে লুকায় তো সেখানে লুকায়। অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করা হল। আমি এত কিছু জানি না। কোরবানি শেষে হেলেদুলে বাড়িতে ঢুকতেই এই ধরনের ঠাট্টা করার জন্য যে যে পারল ধরে ধরে আমাকে উত্তম মধ্যম দিল।
আপু তে প্রমোশনঃ পিঠাপিঠি ভাইবোন কদাচিত হাতাহাতি করেনি এমন সংখ্যায় কমই পাবার কথা। ৯-১০ বছরের পর মেয়েরা কিছুটা শারীরিক ভাবে দ্রুত বাড়তে থাকে। একবার খাটের উপর হাতাহাতির এক পর্যায়ে আমাকে যে ধাক্কা দিল, তাতে আমি মেঝেতে কুপোকাত। বুঝে গেলাম আর এই রাস্তায় গেলে ভুগতে হবে। ততদিনে বাবা মাও বড় কন্যাকে হাতখরচ দিতে শুরু করেছেন। আমার ভাগ্যে তখনো শুন্য। তাই নাম ধরে ডাকা বাদ দিয়ে আপু ডাকতে শুরু করলাম। তাতে খুশি হয়ে আপু আমাকে একটা অংশ দিতেন মুড ভাল থাকলে। আমিও মুড ভাল রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখলাম।
হাড্ডি কন্যাঃ এক পর্যায়ে ও টের পেয়ে গেল আমার উদ্দেশ্য। আমার হাতখরচ বন্ধ হয়ে গেল। বাঁকা পথ নিতে হল। খাবার টেবিলে ওর পছন্দ ছিল মুরগির বুক আর রানের নরম হাড্ডি। আমি একটু আগে টেবিলে গিয়ে টুকরা দুইটা দখলে নিলাম। মুরগির মাংসের থালায় টুকরা দুইটা না পেয়ে বুঝে গেল ওগুলো কোথায়। আমি হাসি মুখে হালকা গলায় বললাম,
- রানের হাড্ডি ৫ টাকা আর বুকের কুরকুরা ১০ টাকা, হিহি।
আমাকে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিতে চাইলেও উপায়হীন হয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। সবসময় সফল না হলেও মাঝে মাঝেই এই পদ্ধতিতে উপার্জন অব্যাহত থাকল।
ভয়ঃ আপু ছিল ভীতুর ডিম। মাস্টার বেড এর পাশের বড় চাইল্ড বেডটা আপুর দখলে ছিল। আমি কোণার রুমে দাদির সাথে থেকে অনেক সাহসি হয়ে উঠেছি। রুমটার আশপাশ গাছপালায় ঘেরা ছিল। দাদি মারা যাবার পর ও আমি কোণার রুমে পরে রইলাম। আমার বেড টা সেমি ডাবল। ব্যাঙডাকা বা বজ্রপাতের রাতে বা আশপাশে কোন অদ্ভুত শব্দ হতে থাকলে ভীতুর ডিম আমার দরজায় এসে টোকা দিত।
- কি হয়েছে? মুখ ফ্যাকাসে - ‘ভয়ে ঘুম আসছে না’।
- আমার ঘুমের ডিস্টার্ব হবে। ৩০ টাকা দিলে পায়ের কাছে কোনায় ঘুমাতে পারো। (কি যে নির্দয় ছিলাম!!) ডিস্টার্ব করলে পরেরবার ৫০ টাকা।
“আচ্ছা ঠিক আছে, দিব দিব।“ রাজি না হয়ে উপায় আছে!!
ছাড়াছাড়িঃ ভাইবোনদের আপাত বিচ্ছেদ সাধারনত হয় বোনের বিয়ের সময়। এটা কলেজে পড়ার সময়কার কথা। আমি মহা খুশি। আমার লক্ষ্য ওর বড়রুম টা দখল করা। হলুদে গান বাজাতে লাগলাম জোরেজোরে – ‘আয় খুকু আয়......।।‘ বাবা আর আপু অশ্রুসিক্ত নয়নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার বিকার নেই। বিয়ের কান্নাকাটির পর আপুকে গাড়িতে উঠানো হল। বরের সাথে, গাড়ি চালু হতেই – আমার বুকটা মুহূর্তে খালি হয়ে গেল। মনে হল হৃদয়ের অর্ধেক কেউ ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। গাড়ির পিছে পিছে দৌড়াচ্ছি – আমার আপুকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ, গাড়ি থামাও.........। গাড়ির গতি বেশি, ধরতে পারলাম না। পাশের দেয়ালে আছড়ে পড়ে কাঁদলাম অনেকক্ষণ। এত জলের সমুদ্র কোথায় লুকিয়ে ছিল।
আত্মীয়স্বজন কান্না ভুলে আমাকে থামাতে ব্যস্ত। বলাবলি করছে -
“এত টান! ওকে তো কখনো কাঁদতেই দেখিনি।“ বাসায় ফিরে রুমটা আর দখল করা হল না। সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম। আপু যখন আসবে তখন থাকবে............।
বিষয়: বিবিধ
১৭৩১ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অন্নেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
আসলে সম্পর্ক এরকমই হয় পিঠাপিঠি হলে।
মডু ভাইয়ারা ঘুম ভাঙেন অনন্য এই পোষ্টটিকে স্টিকির মর্যাদা দেয়ার আবেদন রইলো।
খুবই সুন্দর লেখা। আশা করি মডু মামা / খালাদের ঘুম ভাংবে।
সাধারণত ভাইয়েরা বোনের বিদায়ের পরই বুঝতে পারে! জানি না এমন কেনো ভাই গুলো! ?
খুব সুন্দর করে লিখেছেন ভাইয়া। আরো লিখবেন প্লীজ। যাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন