অভিশপ্তঃ (আমার জীবনে এরকম মর্মস্পর্শী ঘটনা খুব কমই শুনেছি)

লিখেছেন লিখেছেন আতিক খান ১৯ মে, ২০১৪, ০৯:৪৮:৩০ রাত

২০০৮ এর ঈদের পরদিন। কজন আত্মীয়ের ঝুলাঝুলিতে পতেঙ্গা সি বিচে বেড়াতে গিয়েছি। অন্যরা কেউ ফুচকা / পেঁয়াজু খেতে ব্যস্ত, কেউ ঘোড়ায় চড়বে, কেউ সি স্কুটারে চড়বে বলে দাঁড়িয়ে। আমি হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে এসে পড়েছি। বর্গাকৃতি বড় বড় পাথর খণ্ডের উপর পা ফেলে ফেলে আগাচ্ছি। একটা লোক আমার মনোযোগ কেড়ে নিল। এক মনে লোকটা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে অদ্ভুত শূন্যতা। তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছুই দেখছে না। অসম্ভব একটা হাহাকার আর কষ্টের অভিব্যক্তি ওর চোখেমুখে। আমি কিছুক্ষন তাকিয়ে ফিরে গেলাম। ঈদের সময় একা একজন এত কষ্ট নিয়ে বসে আছে, খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। ভুলে গেলাম একটু পরেই।

ঘণ্টাখানেক পর আবার ওদিকে হাঁটতে গিয়ে দেখি একই দৃশ্য। একচুল নড়েনি লোকটা। কৌতূহলে বসে পড়লাম পাশে। আমার দিকে তাকাবার গরজ দেখা গেল না। ১৫ মিনিট পর থাকতে না পেরে বললাম, ভাই ঈদের সময় এভাবে মন খারাপ করে বসে আছেন। আমি কিছু করতে পারি?

লোকটা ডুকরে কেঁদে উঠল। কিছুক্ষন ফুঁপিয়ে বলল - কিসের ঈদ। আমি অভিশপ্ত, আমার ঈদ ও অভিশপ্ত। আমার জীবনে ঈদ আর কখনো আসবে না। বলে আবার কাঁদতে লাগলো। আমি কান্না থামার অপেক্ষায় আছি। ওর আবেগ আমাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই সময় এক লোক এসে ওকে ধরে ধরে উঠিয়ে নিয়ে গেল।

আমি কথা আগাতে না পেরে একটু আফসোস নিয়ে ফিরতি পথ ধরছি। আরেক স্থানীয় লোক কাছেই দাঁড়ানো ছিলেন। আমার আগ্রহ দেখে বললেন, এই লোক প্রতিদিন এখানে এসে বসে থাকে আর এক দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাম লোকমান, এখানে থাকে না। ওর মামাত ভাই ওকে কয়দিন আগে নিয়ে আসছে, যে ওকে নিয়ে গেল। বাসায় ফিরেও লোকমানের কথা মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগলো।

পরদিন বেরিয়ে পড়লাম দুপুরে পতেঙ্গার দিকে। বুক ধকধক করছে লোকমানকে যদি না পাই। ওকে বসে থাকতে দেখে একটু আশ্বস্ত হলাম। সেই একই শূন্য দৃষ্টি আর রাজ্যের কষ্ট। পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। আমার উপস্থিতি বুঝলেও আমার দিকে তাকাল না লোকমান। ঘণ্টাখানেক পর ধীরে ধীরে আলাপ শুরু করলাম।

লোকমান বরগুনার বামনা উপজেলার অধিবাসী। গরু-বাছুর, ক্ষেত-খামার এই করে দিন কাটে। বছরখানেক আগেও ছিল তার সাজান-গোছান সংসার। বউ সুমি, এক ছেলে মনির আর এক মেয়ে রানুকে নিয়ে হাসিখুশি সময়। মনিরের বয়স ৭ আর রানুর ৪। ঘণ্টা দুয়েক আলাপের সারমর্ম ওর মুখে শুনেন -

" গত ঈদে যখন নতুন জামাকাপড় নিয়া বাসায় গেছি, বিশ্বাস করবেন না মনে হইছিল স্বর্গ আমার বাসায় এসে নামছে। মনির আমার বুকের উপর লাফ দিল, ছোটটা রানু আমার পা আর ছাড়েই না। সুমির মুখে লাখ টাকার হাসি। মনে হইছিল এই দুনিয়ায় আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নাই। ভাই কার অভিশাপ লাগছিল, বলতে পারেন? আমার পুরা জীবনটা লণ্ডভণ্ড হইয়া গেল।

গত নভেম্বরের ১৫ তারিখ (২০০৭)। রেডিও তে একটুখানি শুনছিলাম ঝড়ের কথা (সিডর)। মাইকিং বা অন্যকিছু শুনি নাই। আমার বাড়িটা শক্ত কইরাই বানাইছিলাম। ছাইড়া যাইতে মন চায় নাই। আমার আশেপাশের অনেকে গেছিল স্কুল ঘর আর সেন্টারে আশ্রয় নিতে। সূর্য ডোবনের পর থেইকাই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। রাইত ১০ টা - ১১ টার দিকে ঝড় বাইড়া গেল। বেড়িবাঁধ ভাইঙ্গা গেছে খবর পাইয়া এই ঝড়ের মধ্যে টিনের চালের ছাদে উইঠা পড়ছি। মনির আমার কোলে আর রানু আমার ঘাড়ে বইসা মাথা ধইরা আছে। চালের দক্ষিন দিকে একটা আম গাছ আছে। আম গাছের একটা ডাল চালের উপর দিয়া গেছে। সুমিরে লইয়া হেই কোনায় চইলা গেলাম। একজনের বেশি ডাল ধরবার জায়গা নাই। আমি এক হাতে মনিররে ধইরা আছি, অন্য হাতে ডাল। সুমি আমারে ধইরা আছে। এত পানি জীবনে দেখি নাই, ১৫-২০ ফুট হইব। চালের উপর দিয়া যাইতাসে। কোমর সমান পানি, আরও বাড়তেছে। বাচ্চা দুইটা চিৎকার দিয়া কানতাসে। সুমি আমারে ধইরা রাখনে আমার হাত ডাল থেইকা ছুইটা যাইতেসে দেইখ্যা সুমি ডাক দিল - তুমি আমার মনির আর রানুকে দেইখো। ওর চোখের দিকে তাকাইয়া ভয় পাইছি, মনে হইল সব কিছু হারাইয়া ফেলছে। আমার দিকে তাকাইল। সেই দৃষ্টি কোনদিন ভুলব না। আমার হাতটা ছাইড়া দিল। চোখের সামনে ভাসাইয়া নিয়া গেল সুমিকে। আমার তখন সুমির দিকে তাকানোর খেয়াল নাই। মনির আর রানু আরও জোরে চাইপা ধরসে। । এক হাতে আর পারতাছিলাম না। মনিররে বললাম তুই আমারে ধর। মনিররে ছাইড়া অন্য হাতেও ডাল ধরতে গেছি, দেখি মনির ও নাই। রানু আমারে মনিররে ধরা হাত ছাইড়া দিতে দেইখা ভয় পাইছে - আব্বা, আব্বা ভাই কই, ভাই কই? আমারে ধর। আমার মাথার চুল শক্ত কইরা টানতেছে।

পানি আমার মুখ বরাবর আইসা পড়ছে। ডাল ছাইড়া দিতে হইল। রানু আমার চুল ও ছাড়ে নাই, মাথাও না। ভাসতে গিয়া ডুইবা যাইতাসি, নিঃশ্বাস বন্ধ হইয়া আসতেছে। আমার কি হইছিল মনে নাই, এক ঝটকায় রানুর হাত ছাড়াই দিছি। আবার ধরতে চাইয়াও পারি নাই। আরেকটা গাছের ডালে আটকাইয়া বাইচা গেছি। পানি নামার পর সুমির লাশ খুইজা পাইছি, কিন্তু আমার মানিক মনির আর রানুরে আজো পাই নাই। সমুদ্রের সামনে বইসা থাকি, যদি কোনদিন সমুদ্র এদের ফিরাইয়া দেয়। ভাই এই অভিশপ্ত জীবন দিয়া কি করব? নিজ হাতে আমার বুকের ধনদের মারছি। আমাকেও কেন উঠাইয়া নিয়া গেল না। আমার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যই কষ্ট নিয়া বাইচা আছি। নইলে আমিও পানিতে ডুব দিতাম।"

হটাৎ অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকাল লোকমান। বলল - "আমার জায়গায় হইলে আপনি কি করতেন? নিজে বাঁচতেন না ওদের বাচাতেন। এইটা ঠিক যে আমি ডুবলেও ওরা বাঁচত না। তারপর ও নিজ হাতে ছাড়াই দিছি এই কষ্ট কেম্নে ভুলি? "

আমি উঠে দাঁড়ালাম। জিভে নোনা পানির স্বাদ, দুই চোখে সমুদ্র পরিমান জল। হাঁটছি আর প্রার্থনা করছি - আল্লাহ যেন এই জীবনে এই ধরনের পরীক্ষায় কাউকে না ফেলে। কোন এক সমুদ্রের ধারে খুঁজলে লোকমানকে মনে হয় পাওয়া যাবে, মনির আর রানুর অপেক্ষায় বসে আছে..................।

বিষয়: বিবিধ

১৪৩২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

223523
১৯ মে ২০১৪ রাত ১০:১৮
ঈগল লিখেছেন : আল্লাহ এ ভাইকে ধের্য্য ধরার তাওফিক দিন।
২০ মে ২০১৪ সকাল ১১:২৮
170978
আতিক খান লিখেছেন : আমিন। ভালো থাকুন, ধন্যবাদ।
223829
২০ মে ২০১৪ বিকাল ০৫:২৭
মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন লিখেছেন : পড়তে পড়তে কাঁদলাম। খুব কষ্টের কাহিনী। আল্লাহ সকলকে হেফাজত করুন।
২০ মে ২০১৪ রাত ০৮:৪০
171212
আতিক খান লিখেছেন : আল্লাহ্‌ সবাইকে হেফাজত করুন, আমিন। ধন্যবাদ।
224522
২২ মে ২০১৪ সকাল ০৯:৩৭
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : ১৯৯১ সালের ঘুর্ণিঝড়েও এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে। ঐ মূহূর্তে আসলে আর কিছু করার থাকেনা। এমন কঠিন পরীক্ষায় আল্লাহ কাউকে না ফেলুন।
২২ মে ২০১৪ দুপুর ০২:৫৯
171915
আতিক খান লিখেছেন : ৯১ সালে কর্ণফুলীর মোহনায় ছিলাম। লাশের সারি। বড় বড় বোটকেও দেখেছি গাছের উপরে ঝুলে থাকতে। এমন কঠিন পরীক্ষায় আল্লাহ্‌ কাউকে না ফেলুন,আমিন। ধন্যবাদ,আপা। ভালো থাকুন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File