জন্মসনদঃ বিচিত্র অভিজ্ঞতা
লিখেছেন লিখেছেন আতিক খান ১২ মে, ২০১৪, ১২:৫৩:২২ দুপুর
মেয়ের জন্মসনদের (Birth Certificate) ইংরেজি ভার্শন নিতে গিয়ে আজকে আমার পুনর্জন্ম হল। পিএসসি (ক্লাস ফাইভ) পরীক্ষার জন্য নাকি জন্মসনদের কপি জমা দিতে হয়। বাংলা সনদ এর কপি জমা দিতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। ইংরেজি লাগবে। যেখানে সর্বস্তরে বাংলা চালু হবার কথা সেখানে একটা সামান্য জন্মসনদের ইংরেজি কেন দরকার বোধগম্য নয়। আমি স্কুলে জানতে চাইলাম বাংলা জমা নিলে সমস্যা কি? স্কুল হতে বলল, শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে নাকি জানানো হয়েছে ইংরেজি সনদ নিতে। আমি এই ব্যাপারে সরকারী কোন আদেশ বা সার্কুলার দেখতে চাইলে দেখাতে পারলেন না। জানালেন ফোনে জানানো হয়েছে। এই ধরনের সরকারী আদেশ স্কুলে ফোনে ফোনে জানানো কি গ্রহনযোগ্য?
তর্ক না বাড়িয়ে কমিশনারের কার্যালয়ে গেলাম। দায়িত্বপ্রাপ্তা মহিলা অন্য একটা টেবিলে বসে খোশগল্পে মশগুল। জানালেন বাংলা হতে ইংরেজি করতে হলে ৮ দিন সময় লাগবে এবং অনেক লম্বা সিরিয়াল। অবশ্য দিন কমিয়ে আনতে চাইলে ও উপায় আছে, ইঙ্গিত দিলেন। তাও ২/৩ দিন কম, ব্যাস। আবেদনপত্র জমা দিয়ে যেতে বলে আবার গল্পে মশগুল হলেন। কাজের চাপের নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি।
এই অফিসটা সরকারী দলের নিয়ন্ত্রনে। আরেকজনের পরামর্শে অন্য একটা ওয়ার্ডের কমিশনারের কাছে গেলাম। সহকারি ঢুকতেই সাদরে বসতে বললেন,
- বলেন আপনার জন্য কি করতে পারি?
- আমার একটা জন্মসনদ ইংরেজি করব, কয়দিন সময় লাগবে?
- এই ৫/১০ মিনিট। দেন করে দিচ্ছি।
আমি সত্যিই হতবাক। এখানের ১০ মিনিটের কাজ আরেক জায়গায় ৭/৮ দিন। মজার তথ্য হল এই অফিসটা জামাতের নিয়ন্ত্রনে......।।
দুর্ভাগ্যক্রমে কাজটা হল না। কারন বাংলা সনদ যাদের দ্বারা ইস্যুকৃত, ইংরেজিটাও তাদের থেকে নিতে হবে।
প্রথম কমিশনার অবশ্য আমার পরিচিত ছিলেন। ফোন দিতে জানালেন, সাথে সাথে করিয়ে দিতে পারবেন।
প্রশ্ন হল, যাদের পরিচয় নেই তাদের কি অবস্থা? অফিস সহকারিদের হাতে বাকিরা কি জিম্মি?
বিদেশ যাবার ব্যাপার থাকলে ইংরেজি সনদের ব্যাপারটা বুঝতে পারি। কিন্তু দেশের বোর্ডের পরীক্ষার জন্য, শুধু মৌখিক আদেশ বলে ইংরেজি সনদ চাওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
২য় দিনঃ
আজকে মেয়ের জন্ম সনদ (বার্থ সার্টিফিকেট) না নিয়ে ফিরব না, ঠিক করেছি। আবার কমিশনারের অফিসে গিয়ে হাজির হলাম।
সেক্রেটারি মনোযোগ দিয়ে পত্রিকার ভিতরের পাতার ভিতরের সংবাদ পড়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। আমাকে দেখে অফিসের ভিতরের টেবিল দেখিয়ে আবার পত্রিকায় মনোযোগী হলেন। ভিতরে একজন ভদ্রলোক আর একজন ভদ্রমহিলা বসা। জন্ম সনদের জন্য এসেছি জানাতেই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
- আবেদনপত্র দিয়ে যান, পরে যোগাযোগ করবেন... । আমি ঠাণ্ডা সুরে বললাম,
- কমিশনারের সাথে কথা হয়েছে, এখুনি লাগবে। মোবাইলটা হাতে নিলাম যেন এক্ষুনি ফোন লাগাব ওদের বসকে।
দুজনে এমন ভাবে আমার দিকে তাকাল যেন মঙ্গলগ্রহ থেকে এইমাত্র নামলাম। তারপর একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল -'এও কি সম্ভব'? দুপুর ১টা ১৫ মিনিট। আমি আরাম করে চেয়ার টেনে বসলাম। বললেন,
- আজকে চাইলে সময় লাগবে। বসতে হবে অনেকক্ষণ।
আমি নির্বিকার, একটা ঠাণ্ডা চাহনি দিলাম। হাল ছেড়ে দিয়ে সে অন্য কাজে মনোযোগ দিল। ৫ মিনিট পর দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক উঠে জানাল, জোহরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাবে। আমাকে বসতে হবে। বসে না থেকে আমিও উনার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। ১ টা ৪০ মিনিটে মসজিদ হতে ফিরছি, ভদ্রলোককে দেখলাম অফিসের বাইরে ৩ জনের সাথে খোশগল্পে মশগুল। আমাকে জানালেন,
- দরকারি কথাবার্তা সেরে আসছি একটু পর, আপনি বসেন।
মাত্র ২ দিন আগে মোবাইলে নেট একটিভেট করেছি, এতদিন ছিলনা। এর উপকারিতা টের পেলাম। খামোখা মহিলার সামনে বেকুবের মত বসে না থেকে ফেসবুক খুলে বসলাম। বাইরের ভদ্রলোক এরমধ্যে ২ বার উঁকি মেরে দেখেছেন আমি আছি নাকি গেছি। ২ টা বেজে গেছে, অফিস এর সময় শেষ। মহিলা বিরক্ত হয়ে বাইরে গিয়ে দাড়িওয়ালাকে ডেকে নিয়ে আসলেন।
'উনি বসে আছেন, করে দাও'। অগত্যা গুরুত্বপূর্ণ আলাপ ছেড়ে ভদ্রলোক ফিরলেন টেবিলে। আমার মত আরেকজন ও জন্ম সনদের জন্য অনেকক্ষণ ধরে ঝুলাঝুলি করছে। উনিও কাউকে ধরে টরেই এসেছেন।
অনেক অনুরোধ করায় দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক জানালেন,
- ভাই, এত কাজ করা সম্ভব বলেন? কাজ করে করে চোখে অন্ধকার দেখতেছি। একটা মানুষের পক্ষে এর বেশি সম্ভব না। আগামি দিন আসেন। কাজের চাপে চোখ খুলে রাখতে পারতেছি না .........।। (অফিস সম্ভবত সকাল ৯.০০ - দুপুর ২.০০ টা )
আমি ব্যস্ত মোবাইলে, উনার কথা শুনে বেদম হাসি পেলেও এমন মুখ করে রাখলাম, ভদ্রলোকের দুঃখে সমব্যথী। ৫/৬ মিনিটে আমার সনদটা কম্পিউটারে টাইপ হয়ে গেলো.........। ফিস ৫০ টাকা। উপরি দিতে ইচ্ছা করছিল না, তাও আবার এই অফিসে ফিরতে হবে ভেবে ১০০ টাকা দিলাম। কেউ না দেখে মত টাকাটা তালুবন্দি হয়ে গেল।
৫ মিনিটের কাজ ৫৫ মিনিটে শেষ করে অফিস হতে বের হলাম। হাতে জন্ম সনদ।
মনে হল V (বিজয় চিহ্ন) দেখিয়ে বলি - "পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম। ইহা আমার সম্পত্তি নয়, ইহা আমার সম্পদ"। (হৈমন্তী)
বিষয়: বিবিধ
১১৬৮ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দুই নাম্বারীতে হল নিঃশেষ।
আসলেই ভাই এমন দেশটি কোথাও খুজে পাবে নাকো তুমি
(আমার মেয়ের নাম ও জুমানা, ভেবেছিলাম নামটা আনকমন )
রেহনুমা বিনত আনিসলিখেছেন : বুঝলাম,পরিপূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করা হচ্ছে! নইলে মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা আর কি অর্জন করলাম!
আমি তো বিরক্ত হয়ে আর আনলাম না।
প্রায় পাঁচ বছর হয়ে যাচ্ছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন