'ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশনে'র শিকার শার্লি হেবদো!
লিখেছেন লিখেছেন বিনীত তারেকুল ইসলাম ২৯ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৫:৫৭:০৬ বিকাল
(দৈনিক সংবাদ ২৮ জানুয়ারি, উপসম্পাদকীয়) ফ্রান্সের কুখ্যাত ব্যঙ্গাত্মক পত্রিকা শার্লি হেবদোর অফিসে ভয়াবহ হামলার ঘটনায় পশ্চিমা দুনিয়াবাসী সাম্প্রতিককালে এক নতুন রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। এই কুখ্যাত পত্রিকা শার্লি হেবদো এর আগেও ২০১২ সালে এবং ২০১৩ সালে হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর নগ্ন ও যৌনতাসংবলিত ব্যঙ্গাত্মক চিত্র (নাউযুবিল্লাহ) ছেপেছিল এবং এর প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে। এমনকি একপর্যায়ে বোমা হামলারও শিকার হয় পত্রিকা অফিসটি। আল-কায়েদার হুমকিতে থাকা পত্রিকাটি সবসময়ের জন্য বিশেষ পুলিশি প্রহরায় থাকা সত্ত্বেও কিভাবে এমন ভয়াবহ হামলার শিকার হতে পারে, তা নিয়ে বিস্মিত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবী মহল। প্রথমত, নিঃসন্দেহে হামলাকারীরা ছিল পেশাদার ও উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, হামলাকারীরা ঘটনাস্থলে 'আল্লাহু আকবার' বলে সেস্নাগান দিচ্ছিল এবং মহানবী (সা.)-এর অবমাননার প্রতিশোধ নিচ্ছে বলে জোরে চেঁচিয়ে জানান দিয়েছে। এমনকি তারা আল-কায়েদার যোগসাজশে হামলা চালাচ্ছে, সেটাও শোর করে জানিয়েছে অকুস্থলেই। আরও অদ্ভূত ব্যাপার হলো, সাধারণ মুসলিম জিহাদিস্টদের আচরণ ও পোশাকের সঙ্গে হামলাকারীদের বিশেষ কোনো সঙ্গতিপূর্ণ মিল নেই, উপরন্তু তাদের হামলার ধরন-ধারণ ও আচরণ ছিল অত্যন্ত উচ্চ প্রশিক্ষিত মিলিট্যান্ট বাহিনীর সদস্যদের মতো (সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও দেখে)। হামলার পরপরই তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পরে হামলাকারীদের ব্যবহৃত গাড়িতে ফেলে যাওয়া কথিত আইডি কার্ডের সূত্রে সন্দেহভাজন হামলাকারী দুই কোয়াচি ভাইকে যখন বিশেষ অভিযানে ফরাসি পুলিশ হত্যা করে, তখন সেই দুই ভাইকে কোনোভাবেই সত্যিকার পেশাদার সেই হামলাকারীদের মতো মনে হয়নি। আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে সেই বিশেষ অভিযান সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শার্লি হেবদোতে হামলাকারীদের পরিচয় পাওয়া যায় কথিত 'আইডি কার্ডে'র মাধ্যমে, যেটা হামলাকারীরা তাদের ফেলে যাওয়া ব্যবহৃত গাড়িতে ভুলক্রমে রেখে গিয়েছিল, এমন দাবি ফরাসি ইন্টেলিজেন্স সংস্থার। উচ্চ প্রশিক্ষিত পেশাদার হামলাকারীরা কখনও এ ধরনের ভুল করবে, এটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে একজন আমেরিকান বিশ্লেষক ড. কেভিন ব্যারেট (সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধনীতির অন্যতম একজন সমালোচক) তার সাম্প্রতিক একটি প্রবন্ধ Planted ID card exposes Paris false flag-এ যৌক্তিক প্রশ্ন তুলে বলেন, “What are the odds that skilled terrorists who have just carried out an ultra-professional special-forces style attack will accidentally leave their ID card in the abandoned getaway car? Answer : Effectively zero. So why are police reporting an event that cannot have happened? Assuming that French police really did find “terror suspect” Said Kouachi’s ID card in an abandoned getaway car, that ID card must have been planted by someone wishing to incriminate Kouachi. Even the legendary French idiot detective, Inspector Clouseau, could not fail to make this thunderingly obvious inference. The discovery of Kouachi’s ID does not implicate him; it exonerates him. It shows that he is an innocent patsy who is being framed by the real perpetrators of the attack.”
আইডি কার্ডের মালিক কোয়াচি ভাই দুজনই যে হামলাকারী, অদ্যাবধি এটা সুস্পষ্ট অনুমান বা ধারণা মাত্র। এমনকি ফ্রান্সের খ্যাতনামা গোয়েন্দাদের তদন্ত ও অভিযান এই সুস্পষ্ট অনুমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু দুই কোয়াচি ভাইয়ের বিরুদ্ধে এই অনুমানসিদ্ধ অভিযোগ নিশ্চিত বা প্রমাণিত হওয়ার আগেই তাদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এই হামলার পেছনের মূল নিয়ামক শক্তি ও যোগসাজশ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত। শুধু আইডি কার্ডের সূত্রেই কি প্রমাণিত হয় যে দুই কোয়াচি ভাই হামলাকারী ছিল? এর সদুত্তর পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা পরিকল্পিতভাবেই রাখা হয়নি। কেননা আমরা এখন আর কথিত সন্দেহভাজন দুই কোয়াচি ভাইর কাছ থেকে হামলার বিস্তারিত কিছুই জানতে বা শুনতে পারব না। শুধু তাই নয়, প্রকৃত হামলাকারী কারা ছিল, সেই বিষয়টা খোলাসা করা বা ভবিষ্যতে তদন্ত করার সম্ভাবনাও স্তিমিত করে ফেলা হয়েছে। আসলেই কি আইডি কার্ডের মালিক কেয়াচি ভাইয়েরা প্রকৃত হামলাকারী ছিল নাকি আইডি কার্ডের মিথ সাজিয়ে তাদের ওপর দোষ চাপিয়ে মূল হামলাকারীদের আড়াল করা হয়েছে? শার্লি হেবদোতে হামলা কি তবে 'ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন' ছিল? এ বিষয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাবেক সহযোগী সম্পাদক পল ক্রেইগ রবার্টসের একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি না দিলেই নয়, যখন তিনি এই আইডি কার্ডের ঘটনার সঙ্গে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলায় বিধ্বস্ত বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ থেকে অবিশ্বাস্যভাবে খুঁজে পাওয়া এক অক্ষত পাসপোর্টের ঘটনার সাদৃশ্য দেখতে পান। উল্লেখ্য যে, সেই পাসপোর্টের মাধ্যমেই নাইন-ইলেভেনের বিমান অপহরণকারীদের পরিচয় 'নিশ্চিত' করা হয়। পল ক্রেইগ শার্লি হেবদো ইস্যুতে তার এক কলামে লিখেছেন, “Usually Muslim terrorists are prepared to die in the attack; yet the two professionals who hit Charlie Hebdo were determined to escape and succeeded, an amazing feat. Their identity was allegedly established by the claim that they conveniently left for the authorities their ID in the getaway car. Such a mistake is inconsistent with the professionalism of the attack and reminds me of the undamaged passport found miraculously among the ruins of the two WTC towers that served to establish the identity of the alleged 9/11 hijackers.” পল ক্রেইগসহ আরও বেশ কয়েকজন গুরত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক নানা ধরনের যৌক্তিক প্রশ্ন ও রহস্যময়তার পরিপ্রেক্ষিতে শার্লি হেবদোর ওপর হামলার ঘটনাকে 'ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন' বলে অভিহিত করেছেন। ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন প্রায় অনেকটা স্টিং অপারেশন বা আন্ডারকভার অপারেশনের মতোই। নেপথ্যে বা আড়ালে থেকে নিজেদের সাজানো পরিকল্পনামতো হামলা বা অপারেশন অন্যদের মাধ্যমে কার্যকর করানো বা অন্যের পরিকল্পনা জেনেও বাস্তবায়ন করার সুযোগ দেয়া, যাতে এর ফলক্রিয়া নিজেদের অপারেশনের পক্ষে ব্যবহার করা যায়। ২০০১ সালের নাইন-ইলেভেনের ভয়ঙ্কর হামলার পর থেকেই মূলত কথিত 'পাসপোর্ট', 'নিরীহ ব্যক্তিদের সন্ত্রাসী বানানোর ভুয়া ডকুমেন্ট', স্টিং অপারেশন বা আন্ডারকভার অপারেশন এবং সর্বশেষ শার্লি হেবদোর ঘটনায় হামলাকারীদের ভুলক্রমে ফেলে যাওয়া কথিত 'আইটি কার্ড'- ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশনের নাটক মঞ্চায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পল ক্রেইগ এই হামলার ঘটনাকে স্পষ্টভাবে 'ফল্স ফ্ল্যাগ অপারেশন' বলে আখ্যায়িত করে লিখেছেন, “The Charlie Hebdo story simply doesn’t wash. If you believe it, you are no match for a Muslim. Some who think that they are experts will say that a false flag attack in France would be impossible without the cooperation of French intelligence. To this I say that it is practically a certainty that the CIA has more control over French intelligence than does the President of France. Operation Gladio proves this. The largest part of the government of Italy was ignorant of the bombings conducted by the CIA and Italian Intelligence against European women and children and blamed on communists in order to diminish the communist vote in elections.” এখানে তিনি একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের ইন্টেলিজেন্স সংস্থার যোগসাজশে সিআইএ কিভাবে পরিকল্পিতভাবে ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন ঘটানোর মাধ্যমে ওইসব দেশে মার্কিন স্বার্থ ও প্রভাব বজায় রাখার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে তার একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। এখন আমরা দেখব শার্লি হেবদোর ঘটনায় আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এবং মোসাদ ফ্রান্সে কিভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মেরে নিজেদের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে নিয়েছে। আগে আমেরিকার দিক থেকে সুবিধার কথাটা বলি। সাধারণত ন্যাটো আমেরিকার তত্ত্বাবধানে কিংবা বলতে গেলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অধীনেই পরিচালিত হয়, এর ফলে ন্যাটোর সদস্যদের পক্ষে আমেরিকার বৈদেশিক নীতির বাইরে তথা মার্কিন বলয় অতিক্রম করে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতিকে অন্তত পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কন্ডাক্ট করার ফুরসত সঙ্কুচিত থাকে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে ইদানীং মার্কিন বৈদেশিক নীতির বৃত্তের বাইরে গিয়ে একটু একটু করে নিজেদের সুবিধামতো ও স্বাধীনভাবে ফ্রান্সের ফরেন পলিসি নির্ধারণ করার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছিলেন। যেমন, রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমা দুনিয়ার (প্রকৃতপক্ষে মার্কিন বৈদেশিক নীতির) তীব্র অবরোধের মুখে স্বয়ং ফ্রান্সসহ ইউরোপের উল্লেখযোগ্য অনেক দেশ রাশিয়ার বাণিজ্যিক অর্ডারগুলো সে দেশে সরবরাহ করতে না পারায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ন্যাটোর ফেডারেল আবরণে থাকার কারণে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের মতো ওয়াশিংটনের নীতির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা ফ্রান্স- রাশিয়ার প্রতি অবরোধের বাস্তবতায় অর্থনৈতিকভাবে বেশ চাপে পড়েছে। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার প্রতি প্রকারান্তরে মার্কিন বৈদেশিক নীতির প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপে ফ্রান্সও কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এর বিপ্রতীপ নেতিবাচক প্রভাবে ধৃত ফ্রান্সের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ওঁলাদে রাশিয়ার প্রতি অবরোধ শিথিলকরণে সম্প্রতি কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। আর এতেই আমেরিকা ভালোভাবেই আপদ টের পায়। সাম্প্রতিককালে একদিকে চীন, অন্যদিকে রাশিয়া- উভয়ই বিশ্ব ব্যবস্থায় আমেরিকার একক সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এমতাবস্থায় মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আমেরিকা আরও বেশি হাতের মুঠোয় পেতে চায়। রাশিয়ার ওপর অবরোধের ব্যাপারে ফ্রান্স যদি কোনো নড়চড় করে, তাহলে এর দেখাদেখি ইইউর অন্যান্য দেশগুলোও অর্থনৈতিক স্বার্থে সেই পথ অনুসরণ করবে। তাই এই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্য আমেরিকা পুরোনো কৌশল অনুযায়ী তার ইন্টেলিজেন্ট রেজিমেন্টের সাহায্যে শার্লি হেবদোর অফিসে কথিত 'ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন'-এর নাটক মঞ্চস্থ করে। এই অপারেশনের উদ্দেশ্য হলো, ফ্রান্সসহ পুরো ইইউকে এই ব্যাপারে ভীত করে দেয়া যে, আন্তর্জাতিক মুসলিম জিহাদিস্টদের টার্গেটে তারা অত্যন্ত বিপজ্জনক পর্যায়ে অবস্থান করছে। সুতরাং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে টিকে থাকতে হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বাইরে মুভ করা মুশকিল। আর তাদের এই দুর্বলতার সুযোগে আমেরিকা খুব সহজেই ফ্রান্সসহ ইইউর দেশগুলোর বৈদেশিক নীতির ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার আরও পাকাপোক্ত করার মওকা পাবে। এসব প্রসঙ্গে পল ক্রেইগের একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি দেয়া জরুরি, তিনি লিখেছেন, “Shipyards are impacted from being unable to deliver Russian orders due to France’s vassalage status to Washington, and other aspects of the French economy are being adversely impacted by sanctions that Washington forced its NATO puppet states to apply to Russia... Indeed, the attack attributed to Muslims has ended French and European sympathy and support for Palestine and European opposition to more US wars against Muslims. Just recently France had voted in the UN with Palestine against the US-Israeli position. This assertion of an independent French foreign policy was reinforced by the recent statement by the President of France that the economic sanctions against Russia should be terminated. Clearly, France was showing too much foreign policy independence. The attack on Charlie Hebdo serves to cow France and place France back under Washington’s thumb.”
এবার আসি শার্লি হেবদোর ওপর হামলার ইস্যুতে ইসরায়েলের লাভালাভ প্রসঙ্গে। নানা কৌশল বিবেচনায় শার্লি হেবদোর ঘটনায় শুধু সিআইএ-এফবিআই নয়, এখানে মোসাদের ভূমিকা না থেকে পারে না। সদ্য বিদায়ী বছরে ফিলিস্তিনের নিরপরাধ জনগণের ওপর ইসরায়েলের চাপিয়ে দেয়া বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধাভিযানে হাজার হাজার নারী-শিশুসহ বেসামরিক মানুষ খুন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মজলুম জনগণের প্রতি খোদ পশ্চিমা দুনিয়ার জনসাধারণও ব্যাপকভাবে রাস্তায় নেমে সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশ করেছে। তাছাড়া ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী নৃশংসতায় পুরো বিশ্ব এবং ইউরোপজুড়ে ইহুদিবিরোধী চেতনা পুনরায় মাথাচাড়া দেয়ার লক্ষণ দেখা যায়। ইদানীং ফিলিস্তিনের প্রতিরোধযুদ্ধ সমর্থন করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রতি ইউরোপের কয়েকটি দেশের সরাসরি সমর্থন ব্যক্ত করার দৃষ্টান্তমূলক ঘটনায় ইসরায়েল প্রকটভাবে আন্তর্জাতিক ইমেজ সংকটে পড়েছে। এই অবস্থায় শার্লি হেবদোতে হামলার পেছনে ইহুদি-জায়নিস্ট রাষ্ট্রের কোনো উদ্দেশ্যমূলক সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা, তা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়। এই হামলার ঘটনা শুধু ইউরোপই নয়, পুরো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইহুদিবিদ্বেষ বা যুদ্ধবাজ ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সমালোচনাকে চাপা দিতে এবং মুসলিম প্রতিরোধযুদ্ধের প্রতি আর সবার ন্যায্য সমর্থন ও সহানুভূতি হ্রাসকরণে ইতোমধ্যে অনেকটাই সফল হয়েছে।
এই হামলা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে এটা স্পষ্ট যে, গোটা ইউরোপ মতপ্রকাশ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা চর্চার আড়ালে প্রকারান্তরে ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষ লালন করে চলছে। শার্লি হেবদোর দুষ্কৃতির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ যে-হামলা তার ওপর হয়েছে, সেটার প্রতিবাদ হতেই পারে; কিন্তু এই হামলার ঘটনাকে পুঁজি করে দুনিয়ার সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায় ও ইসলাম ধর্মকে একতরফা দোষারোপ করার যে প্রবণতা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে, সেটাই বরং আশঙ্কার বিষয়। আন্তর্জাতিক নেতাদের পক্ষ থেকে শার্লি হেবদোতে হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা সমস্বরে জানানো হলেও, হামলার পরপর ফ্রান্সের বিভিন্ন মসজিদে বিক্ষুব্ধদের হামলা ও অগি্নসংযোগের ঘটনাগুলোর নিন্দা জানানোর নৈতিক সাহস কেউ দেখাতে পারেননি, শুধু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়্যব এরদোগান ছাড়া। Barry University Dwayne-এর আইন বিভাগের প্রফেসর খালেদ বেইদোন আল জাজিরায় এক কলামে সম্প্রতি লিখেছেন, “The Charlie Hebdo killings manifest the baseline that Muslim identity is only relevant- and indeed newsworthy- when the subject is standing behind the gun. Not in front of it.”
ফ্রান্সের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় এই মুহূর্তে চরম নিরাপত্তা-সংকটে ভুগছেন। ইন্টারন্যাশনাল ফ্রন্টপেইজ ম্যাগাজিনের এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ফ্রান্সে মুসলিম জনসংখ্যা হচ্ছে ৭.৫ শতাংশ, কিন্তু ফরাসি জেলখানাগুলোতে সমগ্র কয়েদিদের মধ্যে ৬০ শতাংশই হচ্ছে মুসলিম! (১৬ জানুয়ারি ২০১৫)। এই পরিসংখ্যানেই প্রমাণিত হয় যে, ফ্রান্সে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে নানামাত্রিক অভিযান ও বিশেষ আইনে সন্দেহভাজন হলেই যে কোনো মুসলিমকে কারাবরণ বা আইনি ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান এবং যথাযথ সামাজিক ও নাগরিক মর্যাদা বা সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের বৈমাত্রেয়সুলভ পন্থায় বঞ্চিত করা হচ্ছে। তথাকথিত সেক্যুলার ডেমোক্রেসির চর্চার দাবি করলেও ফ্রান্সের সরকার মুসলিমদের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতীক ও কালচারাল চর্চাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করে সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ করে যাচ্ছে বহু দিন ধরে। খালেদ বেইদোন আল জাজিরায় তার উক্ত কলামে লিখেছেন, “The French laicite model provided the structural underpinnings to carry forward Islamophobic legislation. But more nefariously, guise it under the banner of state-sponsored secularism. Expectedly, the religious expression bans disparately impacted French Muslims. In addition, they chilled bodily and verbal expressions of Muslim identity. The state aim of compelling secularisation upon its Muslim citizenry was based upon the civilisational binary, and ultimatum, to choose between ‘Islam and the west’, ‘Muslim lands or France’.”
শার্লি হেবদো সম্পর্কে কয়েকটি কথা না বললেই নয়, তথাকথিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে শার্লি হেবদো পত্রিকাটি ধারাবাহিকভাবে মুসলমানদের সবচে স্পর্শকাতর জায়গা ও হৃদয়ের স্পন্দন হজরত মুহম্মদ (সা.)-কে নিয়ে অত্যন্ত জঘন্যভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে কার্টুন ছাপিয়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় অনুভূতিকে বারবার আঘাত করে গেছে। এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ও পরিণাম সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের এহেন ঘৃণ্য কর্মকা- অব্যাহত রেখেছে। সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যমতে, গত ৭ জানুয়ারি দুই ফরাসি মুসলিম নাগরিক রাসূল (সা.)-এর অবমাননার প্রতিশোধস্বরূপ ওই কুখ্যাত পত্রিকার অফিসে হামলা চালিয়ে সম্পাদকসহ বারোজনকে হত্যা করে। এখন এই হামলার ঘটনাকে পুঁজি করে পুরো দুনিয়া বিশেষত পশ্চিমা বিশ্ব এখন একদেশদর্শী দৃষ্টিকোণ ও বিবেচনাপূর্বক ইসলাম এবং মুসলমানদের ঢালাওভাবে সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী ও মৌলবাদী বলে পুনঃপ্রচারণা তুঙ্গে তুলেছে।
পশ্চিমা দুনিয়াবাসী নিজেদের 'শার্লি' দাবি করে র্যালি বের করার মাধ্যমে বস্তুতপক্ষে এটাই জানান দিল যে, কথিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে তারা আবারও মহানবী (সা.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক কার্টুন ও মতামত প্রকাশ করতে দ্বিধা করবে না। এখন ঠিক সেটাই হচ্ছে হামলা-পরবর্তী শার্লি হেবদো পত্রিকাটির প্রকাশিত চলতি সংস্করণে মহানবী (সা.)-কে আবারও ব্যঙ্গ ও কটাক্ষ করে নতুন কার্টুন ছাপানোর মাধ্যমে।
ফ্রান্সসহ ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্র অন্যের ভাবমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে ঠাট্টা-তামাশা করাকেই যখন মতপ্রকাশ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মানদ- বা আদর্শ হিসেবে ধারণ করে, তখন এটা বলা অত্ত্যক্তি নয় যে, ইউরোপ প্রকৃতপক্ষে সভ্য হওয়ার আরও কিছু মৌলিক গুণাবলী এখন পর্যন্ত আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা তথাকথিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অবাধ সুযোগে আমাদের প্রাণপ্রিয় মহানবী (সা.)-কে নিয়ে উপহাস ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করবে, আর রাসূলপ্রেমিক মুসলমানদেরও সহনশীলতা ধারণ করে সেসব সহ্য করে যেতে হবে (!), এহেন হাস্যকর পশ্চিমা নীতি অন্তত মুসলিম বিশ্ব মেনে নেবে না। ফ্রান্স এবং ইউরোপবাসীকে এখন ধৈর্য ধরে বিবেকোচিতভাবে সামগ্রিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। তাদের সেক্যুলার ডেমোক্রেসির মোড়কে নির্ণায়িত তথাকথিত বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মানদণ্ডের ব্যাপারে আরো পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবনাচিন্তা করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক।
বিষয়: বিবিধ
১৪৩৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
A PHP Error was encountered
Severity: Notice
Message: Undefined offset: 7228
Filename: views/blogdetailpage.php
Line Number: 764
এখন সময় হয়েছে বাস্তবতা বুঝার। নবী মোহাম্মদ কখনো সমালোচনার উর্ধে নন। ইসলামের মধ্যযূগীয় ব্লাসফেমি অচল এবং অপরাধ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন