রাজনীতিতে বৈচিত্র্য এনেছে হেফাজত
লিখেছেন লিখেছেন বিনীত তারেকুল ইসলাম ২০ এপ্রিল, ২০১৪, ১০:২০:৩৯ সকাল
দৈনিক ইনকিলাববাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জাতীয় ঐকমত্য পরিগঠনের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন যে নেতৃত্বশূন্যতা বিরাজ করছিল, সেটা সুবৃহৎ কওমী গোষ্ঠী থেকে অর্থাৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও গণসমর্থিত আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মাধ্যমে পূরণ হয়েছে বলা যায়। এ সুযোগ্য নেতৃত্বের গুণেই হেফাজতে ইসলাম দেশের তৌহিদি জনতাকে সাথে নিয়ে ১৩ দফাভিত্তিক ন্যায্য দাবিতে অবিস্মরণীয় গণজাগরণ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। ফলে এতকাল দেশের যে ক্ষুদ্রসংখ্যক নাস্তিক ও মুরতাদ শ্রেণি (চূড়ান্তরূপে শাহবাগ) নানা কায়দায় প্রচারাভিযান চালিয়ে আল্লাহ, ইসলাম ও রাসূল (সা.)কে নিয়ে যেভাবে আক্রমণাত্মক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে ইসলামী মূল্যবোধ ও আক্বিদা-বিশ্বাসকে ধ্বংস করার উপক্রম করছিল, সেই জনপ্রত্যাখ্যাত নাস্তিক-মুরতাদ গোষ্ঠীই আজ ইতিহাসের চরম বাস্তবতায় এসে আত্মরক্ষামূলক পন্থা অবলম্বন করে গর্তে মুখ লুকাতে বাধ্য হয়েছে। তাছাড়া হেফাজতে ইসলাম বিদ্যমান রাজনীতিতে টার্নিং পয়েন্ট তথা নতুন মেরুকরণে নিজেকে হাজির করে বাংলাদেশের ভবিষ্যত-রাজনীতিতে অপরিহার্য প্রভাবকরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিগত পাঁচটি সিটি নির্বাচনের সময় বর্তমান রাজনীতিতে হেফাজতের নিরঙ্কুশ প্রভাব ও আধিপত্য পরিলক্ষিত হয়েছে। যদিও ৫ ও ৬ মে’র নৃশংস ক্র্যাকডাউনের ফলে হেফাজতের ওপর যে অমানবিক প্রলয়-ঝাপটা বয়ে গেছে, তাতে করে কৌশলগত কারণে হেফাজত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। তাই সঙ্গত কারণে রাজপথে তাদের ঈমানি আন্দোলন সঙ্কুচিত হওয়ায় অনেকে হেফাজতের ওপর আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল; কিন্তু সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম পুনঃসংগঠিত হয়ে এবং আরো সাংগঠনিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নতুন কর্মসূচি নিয়ে আবার মাঠে নেমেছে। এবার তাদের এই আন্দোলন শুধুমাত্র ১৩ দফা দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক-সামাজিক সকল অপশক্তি এবং বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলোৎপাটনের আন্দোলনে সমন্বিত হবে আশা করি।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ক্ষুদ্রসংখ্যক নাস্তিক-মুরতাদ ব্লগারদের দিয়ে শাহবাগ নাটক মঞ্চস্থ করে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর সাথে নির্মমভাবে তামাশা করেছে। শাহবাগের তথাকথিত আন্দোলনকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলে অভিহিত এবং রহস্যময় কারণে খুন হওয়া গণজাগরণমঞ্চের কর্মী কুখ্যাত ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক রাজীব হায়দার শোভন ওরফে থাবা বাবাকে চরম ধৃষ্টতার সাথে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। শাহবাগ আন্দোলনকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় ও বহিঃশক্তির ষড়যন্ত্রে যখন এদেশের ইসলামপন্থী দল ও ইসলামী রাজনীতিকে এবং আমাদের এই জনপদের আবহমানকাল ধরে বিরাজমান লোকাচার, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় চেতনা-প্রভাব-বিশ্বাসকে উপর্যুপরি আঘাতের মাধ্যমে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হচ্ছিল, ঠিক তখনই সময়ের প্রবল তাগিদে কাউন্টার পয়েন্ট থেকে ঝড়ের বেগে দোর্দ- প্রতাপ নিয়ে রাজপথে হেফাজতের আবির্ভাব ঘটে। এটা অনিবার্য ছিল, কেননা ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। সত্যি কথা বলতে, এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, হেফাজতে ইসলামের উদয়ন না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগের ইসলামবিরোধী প্রকল্প ও ষড়যন্ত্রকে সফলভাবে হটানোর শক্তি ও সম্ভাবনা কার্যত অনুপস্থিত ছিল। সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারে একতরফা ফাঁসির দাবির আড়ালে নাস্তিক-মুরতাদ শ্রেণির বিপজ্জনক উল¬ম্ফনের বিরুদ্ধে হেফাজতের যুগপৎ ঈমানি আন্দোলনের ফলে মুখথুবড়ে পড়ে ইসলাম ও দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী শাহবাগ মুভমেন্ট। অবশেষে শাহবাগীদের থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ে। গণজাগরণ মঞ্চের অধিকাংশ ব্ল¬গার তথা কর্মীদের ইসলামবিদ্বেষী চরিত্র উদ্ঘাটিত হওয়ায় শাহবাগীদের আন্দোলন গণভাবে ধিকৃত হয়। পক্ষান্তরে সরকার এবং সরকারপন্থী মিডিয়াগোষ্ঠী একদিকে যেমন হেফাজতের বিরুদ্ধে নির্লজ্জভাবে নানামাত্রিক অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে, আবার অন্যদিকে সরকার গোপনে গোপনে হেফাজতকে নানা প্রলোভনও দেখিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। না হেফাজতকে কায়দা করে জনগণের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা গেল, আর না হেফাজতকে নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে বাগে আনা গেল। এর কোনোটাতেই সফল হয়নি সরকার।
বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতিতে হেফাজত কী ধরনের বৈচিত্র্য বা নতুনত্ব এনেছে সে প্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে বিশ্বব্যাপী ইসলামী দল এবং রাজনৈতিক ইসলাম চর্চায় তাদের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলা দরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত তুর্কি খেলাফতের ভেঙে যাওয়া এবং মুসলিম বিশ্ব খণ্ড-বিখণ্ড হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের তৎকালীন ইসলামী দল ও আন্দোলনকারী পক্ষসমূহ জাতিরাষ্ট্র তথা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পলিটিক্যাল ইসলাম চর্চার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণযন্ত্রের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করার প্রয়াস নিয়েছিল। কিন্তু হালের বিশ্ববাস্তবতায় জাতিরাষ্ট্র বা জাতীয়তাবাদী ধারণার উল্লে¬খযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। দুঃখের বিষয় হলো, এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সমকালীন বিশ্বের ইসলামপন্থী দলগুলো সেই পুরোনো জাতীয়তাবাদী ধারণার খোলস থেকে এখনো পুরোপুরি বের হতে না পারার কারণে তারা তাদের অভীষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যপথে বারবার হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে বর্তমান সময়ের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ তারিক রামাদান তার সাম্প্রতিককালে লেখা ‘বিয়ন্ড ইসলামিজম’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলো জাতীয়তাবাদী হওয়ায়, জাতিরাষ্ট্রের ধারণা তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বর্তমানে জাতিরাষ্ট্রের ‘ক্ষমতার ধারণা’র পরিবর্তন ঘটেছে। যখন জাতিরাষ্ট্রের ধারণার উৎপত্তি ঘটে, তখন রাষ্ট্রক্ষমতাকে মনে করা হতো সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের একমাত্র নিয়ামক। আজ জাতিরাষ্ট্রের এই চরম ক্ষমতার সমাপ্তি ঘটেছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলোর মৌলিক উদ্দেশ্য ও কর্মকৌশলের মাঝেও অনেক ভুল এবং পরিবর্তন বাধ্যগতভাবে এসেছে। এ সকল ফ্যাক্টরের কারণে কালপরিক্রমায় ইসলামপন্থী আন্দোলনগুলোর মাঝে এক ধরনের অসংলগ্নতা তৈরি হয়েছে এবং তারা ব্যর্থ হয়েছে নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে।”
তারিক রামাদান লিখেছেন, ‘বিশ্বব্যবস্থা পাল্টেছে। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডসহ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর কার্যক্রম বিশ্বব্যবস্থার সাথে সমানুপাতিক হারে পাল্টেনি। বিশ্ব-ইতিহাসের উন্নয়নের যে গতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তনের যে হার এবং গ্লে¬াবালাইজেশনের যে নতুন ধারা, তার সাথে ইসলামপন্থী দলগুলো সমান পদক্ষেপে সঙ্গতি রক্ষা করতে পারেনি।’ তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বর্তমান বিশ্বের ইসলামী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকৌশল ও রাষ্ট্রপরিচালনা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী-বস্তুবাদী পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে লড়াই করার যোগ্যতা ও সমকক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে; উপরন্তু এর ফলে তারা বারংবার মার খেয়েই যাচ্ছে কেবল। তারা রাজনৈতিক ইসলামকে বা ইসলামপন্থী রাজনীতিকে শুধুমাত্র নির্বাচন প্রক্রিয়া ও গতানুগতিক রাষ্ট্রক্ষমতা চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। তারিক রামাদানের ভাষায়, “তারা যেমন একদিকে অবহেলা করেছে অর্থনৈতিক ইস্যু, সাংস্কৃতিক ইস্যু তেমনি ব্যর্থ হয়েছে স্বাধীনতা, নাগরিকত্ব, ব্যক্তিক বিকাশের মতো মৌলিক প্রশ্নগুলোর সমাধান দিতে। বিরোধী দল হওয়ায়, তারা নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণকে পশ্চিমাদের দৃিষ্টতে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার কাজে। ফলে ইসলামপন্থিরা পরিণত হয়েছে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ গোষ্ঠীতে এবং ‘প্রয়োগবাদ’-এর নামে একের পর এক ইস্যুতে ‘আপসমূলক’ অবস্থান গ্রহণ করেছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের যে অমিত সম্ভাবনা ছিল সেটা নিষ্ফল করে তারা তাদের ‘রিলিজিয়াস রেফারেন্স’ অক্ষুণ্ন রেখেছে।” এমতাবস্থায় তারিক রামাদানের কথামতো তাদের মূল করণীয় হলো, আপাতত প্রচলিত ‘নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থা’র বলয়ের বাইরে গিয়ে ‘ইসলামিজম’ কন্সেপ্টের ওপর প্রচুর ‘অনুসন্ধানী গবেষণা’ চালিয়ে যাওয়া। তো এই আলোচনাগুলোর সাথে হেফাজতে ইসলামের সম্পর্ক বা প্রাসঙ্গিকতা হলো, এখন পর্যন্ত হেফাজত কার্যত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ও ক্ষমতাচর্চার বাইরে থেকেই তাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এই জায়গা ধরে রেখে হেফাজত যদি ‘ইসলামিজম’ কন্সেপ্টের ওপর ব্যাপক অনুসন্ধানমূলক গবেষণা বা ইজতেহাদের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণপূর্বক তাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে সেটিই হবে সুদূরপ্রসারী ফলদায়ক।
হেফাজত আমাদের দেশীয় তথা বঙ্গীয় রাজনীতিতে এক নতুন ও অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে। সেটি হচ্ছে, নির্বাচনী কর্মপন্থা কিম্বা ‘নির্বাচনবাদী ইসলামপন্থা’ অবলম্বন না করেই শুধুমাত্র ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থান থেকে আন্দোলন করে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিদ্যমান নির্বাচনী রাজনীতিতে অবিসংবাদী নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় হেফাজতে ইসলামের অবতীর্ণ হওয়াটা অন্তত বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক বিরল বাস্তবতা বটে। আমাদের দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির নোংরা খেলায় হেফাজত নিজেকে সম্পৃক্ত না করে সরাসরি কার্যকর ও সম্ভাবনাময় গণবিপ্লবের যে অভিমুখ ধরে তাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেটাকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। দৃশ্যত হেফাজত নিজেকে অরাজনৈতিক দাবি করলেও তাকে বিভিন্ন সময়ে বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে হচ্ছে। এমনকি আমরা দেখেছি, বিগত পাঁচটি সিটি নির্বাচনে হেফাজতের প্রভাব কতটা নিরঙ্কুশ ও গণমুখী ছিল। এতদ্সত্ত্বেও হেফাজত কি শুধুমাত্র নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ক্ষমতাচর্চা পরিহার করার কারণে অরাজনৈতিক থেকে যাবে? মানে আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, যেহেতু বর্তমান রাজনীতি হেফাজত দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত এবং হেফাজতকে উপেক্ষা বা অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি হেফাজতে ইসলাম কেবল একটি ধর্মীয় দল বা সংগঠন মাত্র নয়, এটি হালের অত্যধিক জনপ্রিয় এক বিপুল গণশক্তির নাম। কিন্তু শুধুমাত্র নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কারণেই হেফাজত অরাজনৈতিক থেকে যাবে, এটা কতটা যুক্তিসঙ্গত তা আলোচনার দাবি রাখে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বা ক্ষমতাচর্চার অভিজ্ঞতা না থাকলেও অন্তত ঐটুকুর জন্য হলেও হেফাজতের মধ্যে রাজনৈতিক চরিত্রের উপাদান লক্ষণীয়। এই বাস্তবতা বিবেচনা করে বলা যায়, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বা ক্ষমতাচর্চার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও যে রাজনীতিতে একটি অরাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন নিরঙ্কুশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম তা একটি নতুন ধারা বা নজির স্থাপন করেছে আমাদের দেশে। তবে এটাকে আমি শুধু ইতিবাচক বলে এর মাহাত্ম্যকে খাটো করবো না, বরং অন্যান্য গণভিত্তি ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ধর্মভিত্তিক দল থাকা সত্ত্বেও হেফাজতে ইসলাম জনগণের সম্মুখে সমকালে নতুন রাজনৈতিক আবেদন ও বৈচিত্র্য তুলে ধরেছে। ফলে হেফাজত তার সমমনা অন্যান্যদের মধ্য থেকে নিজেকে এতটা নিরঙ্কুশভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ড. ইউসুফ আল কারজাভীসহ বিশ্ব ওলামাবৃন্দ হেফাজতের আন্দোলনে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়া পর্যন্ত হেফাজতকে নিয়ে তোলপাড় করেছে। আমাদের দেশের বেশকিছু ইসলামী দলও হেফাজতের তেরো দফা দাবির সাথে সম্পূর্ণ একাত্মতা পোষণ করেছে। তাদের প্রতিও অনুরূপ ধর্মপ্রাণ তৌহিদি জনতার ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। তবে হেফাজতের যে নতুন রাজনৈতিক আবেদন ও বৈচিত্র্য অর্থাৎ নির্বাচনী কর্মপন্থা ও ক্ষমতাচর্চার বাইরে গিয়ে আন্দোলনপূর্বক যে রাজনৈতিক-সামাজিক জনপ্রিয়তা ও গণশক্তি অর্জন-সেটা তারা পারেননি। হেফাজতে ইসলাম একদিকে যেমন নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেরাই ক্ষমতায় গিয়ে তেরো দফা দাবি বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়, তেমনি অন্যদিকে যে দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক না কেন, এই তেরো দফা দাবিকে উপেক্ষা বা অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ তারা ক্ষমতাসীনদের দেবে না। তারা ক্ষমতাচর্চা না করেই কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ তৌহিদি জনতার অকুণ্ঠ সমর্থনের ওপর ভর করে গণতান্ত্রিক সরকারকে তাদের তেরো দফা দাবি মানতে বাধ্য করতে চায়। আর বিপুল জনসমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে এহেন দাবিনামা বাস্তবায়ন করা মোটেও অযৌক্তিক হবে না। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী কোনো ক্ষুদ্র মহলবিশেষের ইন্ধনে ও প্ররোচনায় তেরো দফা দাবি মানতে যতক্ষণ গড়িমসি করবে ততক্ষণ আন্দোলন চালিয়ে যাবে হেফাজত। হোক না সেটা আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি। এটাই হেফাজতের তেরো দফা দাবির আন্দোলনের নীতিগত বৈশিষ্ট্য।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট।
বিষয়: বিবিধ
১২৫৯ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তের দফা বাস্তবায়ন হলে কি ইসলামি মূল্যবোধ সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন ? মিডিয়ার কারনে যেভাবে অপসংস্কৃতি ও নাস্তিকতা বেড়েই চলেছে সেখানে তের দফার বাস্তবায়ন কতটুকু ইসলাম আনতে পারবে দেশে ? ঢিলেঢালা ভাবে যদি তারা যে কোন সরকারকেই তের দফা মানতে বাধ্য করে কিন্তু সেটা কতদিন কার্যকর থাকবে বলে মনে করেন ? সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু অরাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করা কি করে সম্ভব হবে বলে মনে করছেন আপনি ?
মন্তব্য করতে লগইন করুন