সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র

লিখেছেন লিখেছেন বিনীত তারেকুল ইসলাম ১৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০৯:২১:০০ রাত

সম্প্রতি দেশ, জাতি, ইসলাম ও জাতীয়তবাদী শক্তির পক্ষে সোচ্চার একটি ঐতিহ্যবাহী জাতীয় দৈনিক ইনকিলাব নব্য বাকশালী সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো ধরনের পূর্বনোটিশ বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই শত শত সাংবাদিককে বেকার বানিয়ে অগণতান্ত্রিক পন্থায় এ ধরনের একটি সর্বজনবিদিত বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় দৈনিকের প্রেস সিলগালা করে দিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারের আন্তরিকতার পরিবর্তে মারাত্মক আক্রোশ ও বৈমাত্রেয় সুলভ আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তবে এটি নতুন নয়, বরং সুযোগ বুঝে ভিন্নমত দমনে বর্তমান সরকারের অতীতের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের রেকর্ডে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বর্তমান শাসনামলে অন্যায্যভাবে একের পর এক নিষিদ্ধ ও সিলগালা করে দেয়া হয়েছে ভিন্নমতের অসংখ্য সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল। একটি অতীব সাহসী জাতীয় দৈনিক আমার দেশকে দিয়ে সেই যে শুরু, তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ‘সাতক্ষীরায় যৌথ বাহিনীর অপারেশনে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা’ শীর্ষক একটি স্পর্শকাতর সংবাদ পরিবেশনের অপরাধে (সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণে) ইনকিলাবের প্রেসে এখন তালা ঝুলছে। এই আলোচিত সংবাদের পক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সরকার এটিকে গুজব ও মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চাইছে। ইনকিলাব তার ওই একই সংবাদে ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বীকার’ নামে আরেকটি ছোট করে শিরোনাম করেছিল। তার মানে ইনকিলাব যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ হাজির করে সংবাদ ছাপানোর আগেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অস্বীকার করে বসেছে। আর এটা তো স্বাভাবিক যে, প্রভাবশালী কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সবসময়ই তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে থাকে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ইনকিলাব সত্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে আপসহীন ও দ্বিধাহীন ছিল। সুতরাং এই আলোচিত সংবাদটি পরিবেশনের ক্ষেত্রে যেটুকু তথ্যপ্রমাণ হাজির করা হয়েছে, সেহেতু পাঠকের কাছে সংবাদটির বিশ্বাসযোগ্যতা কিংবা মিথ্যাচার তার নিজগুণেই প্রমাণিত হবে। বলপ্রয়োগ করে তো আর এটিকে মিথ্যা বা সত্য প্রমাণ করা যাবে না। কারণ সত্য স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়, কোনো শক্তিরই তোয়াক্কা সে করে না। অথচ দুর্ভাগ্যজনকভাবে পেশির জোরে ইনকিলাবের বার্তা সম্পাদকসহ কয়েকজনকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। যদিও একই সংবাদ আরাওদু-একটি সংবাদপত্রে ছাপা হলেও টার্গেটেড হয় ভিন্নমতের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও দেশ-জাতির পক্ষের দৈনিক ইনকিলাব। কারণ শিকার করার মোক্ষম সুযোগ যেহেতু পাওয়া গেছে, সেহেতু বড়টাকেই বেছে নেয়া হলো।

সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। রাষ্ট্র ও সরকারকে সঠিকভাবে পরিচালনায় মিডিয়া ও সংবাদপত্রের সহায়তা ও ভূমিকার বিকল্প কিছু নেই। সরকার ভুল করলে কিংবা জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সংবাদপত্র সেটি জনসম্মুখে তুলে ধরে জনসচেতনতা ও গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবেশ সৃষ্টিতে মূল অনুঘটক (ঈধঃধষুংঃ) হিসেবে কাজ করে। তাই বহুদলীয় গণতন্ত্রের একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দানে কুণ্ঠিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। অথচ আমাদের দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষা করা তো বহু দূরের কথা, উল্টো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রশক্তির রোষানলে পড়ে সংবাদপত্র ও প্রেস চরম বাকশালী প্রভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সত্য প্রকাশে সম্পাদকদের সর্বক্ষণ লিমিটেশন বজায় রাখতে হয়।

বহুদলীয় সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখা এবং এর উন্নীতকরণের অপরিহার্য শর্ত হলো সংবাদপত্র ও মিডিয়াসহ সর্বক্ষেত্রে অবাধ ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুব্যবস্থা। এক্ষেত্রে পরমতসহিষ্ণুতা থাকা বাঞ্ছনীয়। ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠানের যে কোনো ধরনের মতামত কিংবা অভিপ্রায় নির্বিঘ্নে ব্যক্ত করার পরিবেশই পারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুজ্জ্বল করতে। আর মত প্রকাশ তথা বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বর্তায় রাষ্ট্রযন্ত্র বা সরকারের ওপর। কিন্তু রাষ্ট্র কর্তৃক সেই দায়িত্ব যদি আন্তরিকতার সঙ্গে যথাযথ পালন না করা হয়, উপরন্তু রাষ্ট্র যখন বিরোধী মত দমনে ফ্যাসিবাদের চর্চায় লিপ্ত হয় তখন প্রকৃত গণতন্ত্র বলে যে আর কিছু থাকে না তা বলাই বাহুল্য। ঠিক এ কথাটিই আজকে আমাদের দেশের জন্য সুপ্রযোজ্য। বিশেষ করে গণতন্ত্রের লেবাসধারী চতুর আওয়ামী সরকার ২০০৮ সালে বিপুল গণম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এদেশে একের পর এক সাংবাদিক হত্যা, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা, সত্য প্রকাশে নির্ভীক সম্পাদকদের ওপর জেল-জুলুমের স্টিম রোলার চাপানো, পরমতে অশ্রদ্ধা ও গালিগালাজ, টিভি-চ্যানেল তথা গণমাধ্যমের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন ইত্যাদি অধুনা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিরোধী মতের বিপরীতে বা প্রতিক্রিয়ায় সরকারের দলীয় নেতাকর্মীদের স্যাডিস্ট আচরণ লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, আওয়ামী শাসক দল এখনও বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের প্রতি তাদের সেই অসহনশীলতার ঐতিহাসিক আবরণ অদ্যাবধি ত্যাগ করতে পারেনি।

মাহমুদুর রহমানকে স্কাইপ কেলেঙ্কারি ফাঁস করার দায়ে বর্তমানে জেলে রিমান্ডের নামে অকথ্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে। বিগত বছরে হেফাজতের ওপর রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র তথা কিলার বাহিনীর ৫ ও ৬ মে’র জেনোসাইড সংঘটনের আগে সব মিডিয়াকে সেখান থেকে বের করে দেয়া এবং হেফাজতের সমাবেশের সরাসরি লাইভ সম্প্রচারের অপরাধে (!) দিগন্ত ও ইসলামিক টিভিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের আগেই আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়, এখন পর্যন্ত তা বলবত্ রয়েছে।

২০১১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক ও প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়েছিল পুলিশ। দেশের সাংবাদিক মহল এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এর আগেও দৈনিক আমার দেশ ও জনপ্রিয় অনলাইন শীর্ষনিউজের সম্পাদকদ্বয়ের ওপর একইভাবে নেমে এসেছিল ফ্যাসিবাদের প্রলয় ঝড়। দৈনিক আমার দেশ, জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল ওয়ান, অনলাইন পত্রিকা শীর্ষনিউজ ও সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ বন্ধ করে দিয়ে এবং যমুনা টিভিকে সম্প্রচারে আসতে না দিয়ে এই সরকার গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এ ফ্যাসিস্ট চরিত্রটি আমরা ১৯৭৫ সালেও দেখতে পাই। এদেশে সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়ে গণমাধ্যমের ওপর খড়গহস্ত হওয়ার কু-সংস্কৃতি প্রথম চালু করেছিল আওয়ামী লীগই। বাংলাদেশের প্রথম সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের শাসনামলেই বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং মিডিয়ার কণ্ঠরোধের কালো আইন প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট ’৭৩ হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, বাকশাল তথা একদলীয় শাসন কায়েমের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে সংবাদপত্র সংক্রান্ত (ডিক্লারেশন বাতিল) দুটি অর্ডিন্যান্স জারি করে অনুগত চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকি সব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই সময় কত সম্পাদক ও সাংবাদিক যে কারারুদ্ধ ও হামলা-মামলার শিকার হয়েছিল তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বলতে গেলে পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের কলমকে সেদিন শিকল দিয়ে বেঁধে বেকার করে রাখা হয়েছিল। তার আগেও আইন করে দেশের সংবিধানসভার পারিষদদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয় তত্কালীন মুজিব সরকার। অর্থাত্ ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাক কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে আসার পর তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ পদ্ধতিতে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেন; কিন্তু তিনি ঘোষণায় যা বললেন পরে কার্যত সেটা পালন করেননি। কেননা গণতন্ত্রের নিয়মানুসারে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা সংবিধান প্রণয়নী সভার কেন্দ্রীভূত হলেও শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদকে সেই ক্ষমতা ইচ্ছাকৃতভাবেই দেননি। আর এ না দেয়াটা এবং সার্বিকভাবে নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখার মানসিকতা ছিল সম্পূর্ণটাই অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী। ফলে গণপরিষদের সদস্যরা তখন সংসদে তার (শেখ মুজিবুর রহমানের) স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারত না। কারণ বিরোধিতামূলক কোনো কথা বললেই প্রণীত সংশ্লিষ্ট আইনের (বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য আদেশ) জোরে গণপরিষদের সদস্যপদ থেকে বিতাড়িত করার প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল। সুতরাং দেখা যায়, বাংলাদেশের ইতিহাসের শুরু থেকেই স্বাধীন মত প্রকাশকে এক কথায় রুদ্ধ করে দিয়ে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই আজ সেই স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী নীতি অনুসরণ করে ক্রমাগত মিডিয়া ও গণমাধ্যমগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্রিয় ক্ষমতাসীন বর্তমান আওয়ামী সরকার। ঐতিহাসিক কলঙ্ক মোচনের দায়ভার উপেক্ষা করে বরং সেই কলঙ্ককে আরও প্রলম্বিত করতেই যেন শাসক দল ‘ডিজিটাল বাকশাল’ (নয়া সংস্করণ) কায়েমের পথেই হাঁটছে। ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সীমাহীন ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের অবিরাম সমালোচনার মুখ বন্ধ করার দুরভিসন্ধিতে দেশের গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রের ওপর আগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রয়োগের পথ সুপ্রশস্ত করতে বিগত ২০১১ সালের ৩১ জুলাই প্রস্তাবিত জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার খসড়া তৈরি করে। কিন্তু খসড়াটিতে নানা অসঙ্গতি ও অনিরপেক্ষতা থাকায় তথ্য মন্ত্রণালয়-বিষয়ক সংসদীয় কমিটির কাছে তা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। তাই সংসদীয় কমিটি খসড়াটি ফেরত পাঠিয়েছিল তথ্য মন্ত্রণালয়ে। সংবিধানে গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতার কথা বলা আছে, তার সঙ্গে সরকারের প্রণয়নকৃত জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার খসড়ার কোনো সামঞ্জস্য নেই। গণমাধ্যম-বান্ধব নয় এমন জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি করার উদ্দেশ্য আর যাই হোক সেটা মোটেও গণতন্ত্রসুলভ ছিল না। বিগত বছরে তথ্য-প্রযুক্তি ও যোগাযোগ আইন সংশোধন করে সরকার মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণকে আরও কঠোর করেছে।

বিশেষত গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রের ওপর বর্তমান সরকারের অসহিষ্ণুতা বিলক্ষণ মশহুর। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার নানা কিসিমের খেলা খেললেও আদতে রহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মখা আলমগীর এই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামিদের ধরতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকার জন্য কৌশলে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানোর কোশেশ চালিয়েছিল। তাছাড়া বর্তমান সরকারের সদ্য বিদায়ী শাসনামলে সাংবাদিকদের ওপর উদ্বেগজনক হারে নির্যাতন চলছে। দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ সম্পাদকীয়তে জানা যায়, “মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর তথ্য অনুযায়ী ২০০৯, ২০১০ এবং ২০১২ সালে পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতিত সাংবাদিকের সংখ্যা যথাক্রমে ১৪৫, ১৭৮ এবং ২০৬ জন। বর্তমান বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই এই সংখ্যা একশ’র অনেক ওপরে উঠে গেছে। পুলিশ কর্তৃক প্রথম আলোর তিনজন ফটোসাংবাদিকের নিগৃহীত হওয়ার দু’দিনের মধ্যেই মহাখালীতে সন্ত্রাসীরা বিডিনিউজ কার্যালয়ে ঢুকে কর্তব্যরত সাংবাদিকদের এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে। এই নৃশংস হামলায় আহত সাংবাদিকের সংখ্যা দশ। সাংবাদিকদের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই পরদিন খোদ আদালত চত্বরে পুলিশ কর্তৃক এক তরুণীর শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আবারও তিন সাংবাদিককে পুলিশের লাঠিপেটা খেতে হয়” (শুক্রবার, ১ জুন, ২০১২)। এই হচ্ছে বিদায়ী আওয়ামী শাসনামলে সাংবাদিকদের হালহকিকত। আজ তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে, দুর্নীতির খবর ফাঁস করলে, সরকারি দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অনৈতিক ও জিঘাংসামূলক অবস্থানের চিত্র তুলে ধরলে ক্ষমতাসীনদের চোখে সেটা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়!!

সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করে শাসকবর্গ কোনোকালেই সফল হয়নি। বরং তাদের জায়গা হয়েছে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। ব্রিটিশ শাসকরা যখন সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে একচ্ছত্র দাপটে শাসনকার্য চালাচ্ছিল তখন ইংরেজ শাসকরা বুঝে নিয়েছিল যে, ভারতীয়দের শুধু শাসন করলেই হবে না, বরং তাদের চিন্তা ও প্রতিবাদের ভাষা তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে যদি সীমাবদ্ধ বা মুষ্ঠিবদ্ধ করা না যায় তাহলে যে কোনো মুহূর্তেই ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু হয়ে যেতে পারে। এই ভেবে তারা ভারতীয়দের স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী কায়দায় নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়। ইংরেজ শাসকরা সময়ান্তরে বিভিন্ন সংবাদপত্র নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করতে নানা ধরনের এক্ট ও অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল এবং লেখক ও সম্পাদকদের নানাভাবে সাজা দিয়েছিল। কিন্তু পরিণামে দুইশ’ বছর শাসন করেও ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠীকে ভারতবর্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত বিতাড়িত হতে হয়েছে। এরপর পাকিস্তান আমলে বিশেষ করে আইয়ুবীয় শাসনামলে বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করার জন্য সংবাদপত্রের ওপর কড়া সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। কিন্তু তবুও কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে? সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশের শাসক শ্রেণী অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। যার দরুন তাদের মধ্যে গণবিরোধী কার্যক্রমের পৌনঃপুনিকতা পরিলক্ষিত হয়। গণতন্ত্রের নিয়মানুযায়ী যারা ক্ষমতাসীন হবে তাদের কর্তৃত্বপরায়ণ না হয়ে জনগণের সেবাদাস হিসেবে কাজ করে যেতে হবে। অথচ শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতায় গিয়ে গণতন্ত্রকে খণ্ডিতকরণের মাধ্যমে স্বার্থান্ধ মানসিকতা ধারণ করে এবং স্বার্থের প্রয়োজনে প্রতিপক্ষ ও বিরোধী মত দমনে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে। তাদের আজীবন জোরপূর্বক গদি দখলে রাখার মানসিকতার কারণেই বারবার এদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও ধারা বিপর্যস্ত হচ্ছে। কোনোভাবেই আমাদের শাসকবর্গ এর দায় এড়াতে পারে না। পারস্পরিক সেই দলাদলি, বাদ-বিবাদ, বচসা, বাহাস, কটূক্তি ও কাদা ছোড়াছুড়ি ইত্যাদি যেন লেগেই আছে। কিন্তু আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেশের বিবদমান রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা অত্যাবশ্যক। রাজনীতির পুরনো ও নোংরা ধারা বর্জন করতে হবে। বিচার বিভাগ ও প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত রেখে সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকারকে অবশ্যই মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হতে হবে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের এই দেশে বহুবিধ ও বহুমুখী মত-বিমত থাকাটা অতি স্বাভাবিক; তাই এক্ষেত্রে সহনশীলতার ধর্ম আয়ত্ত করে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দিতে হবে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্বার্থেই পরস্পরের সহাবস্থান এবং রাজনৈতিক দর কষাকষিতে সমঝোতা ও উদারনৈতিক পন্থা অবলম্বন করা উভয় দলেরই অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। পরিশেষে আমাদের মনে রাখতে হবে, গণমাধ্যমের ওপর খবরদারি করে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কুক্ষিগত করে এবং স্বচ্ছ তথ্যপ্রবাহের গতিকে বাধাগ্রস্ত করে বস্তুতপক্ষে কোনোভাবেই ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা সম্ভবপর নয়।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

দৈনিক আমার দেশ

বিষয়: বিবিধ

১৮৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File