মিসর সংকট, মুরসির ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক ইসলাম প্রসঙ্গ
লিখেছেন লিখেছেন বিনীত তারেকুল ইসলাম ১৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০৪:১৮:৩২ বিকাল
সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে পুনর্বহালের দাবিতে এবং জগদ্দল সেনাশাসন ও সেনা কর্তৃক একতরফা নতুন সংবিধান বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে ব্রাদারহুড কর্মী ও সমর্থকরা ব্যাপকভাবে তাদের আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। গত ৫ জানুয়ারিতে সেনাতন্ত্র-প্রবর্তিত গণবিরোধী নতুন সংবিধান বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে মিসরের রাজপথে আন্দোলন-বিক্ষোভরত দশ লক্ষাধিক মুরসি সমর্থকদের ওপর সেনাবাহিনীর হামলায় ২০ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়েও হানা দিয়ে আন্দোলনকারী তিন ছাত্রীসহ দেড় শতাধিক মুরসি সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছে সেদিন। মুরসি সমর্থক ও কর্মীদের ওপর সিসি বাহিনীর এই 'জিরো টলারেন্স' নীতিতে আগ্রাসী দমন-পীড়ন ও বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কাতার তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে যে, মিসরের সেনা সরকার দেশটির বিক্ষোভাকারীদের দেখামাত্র গুলি করে হত্যাকা- চালানোর অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করার জন্যই মুসলিম ব্রাদারহুডকে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' বলে আখ্যা দিয়েছে। তথাপি মিসরজুড়ে মুরসিপন্থিদের চলমান এই আন্দোলন-সংগ্রামে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি, বরং রাষ্ট্রীয় জুলুম-নির্যাতন যতই বাড়ছে ততই যেন তারা দিন দিন অপ্রতিরোধ্য ও দুর্বিনীত হয়ে উঠেছেন। এমনকি নিহত ব্রাদারহুড কর্মীদের জানাজা নামাজ উপলক্ষে পরের দিন কায়রোর আল নূর মসজিদে অনুষ্ঠিত তাদের এক সমাবেশে তারা জীবনের বিনিময়ে হলেও সেনা সরকার এবং গণতন্ত্রবিরোধী অবৈধ এই নতুন সংবিধানকে হটাবেন বলে আরও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
বস্তুতপক্ষে সেনা সরকার কর্তৃক প্রণীত এই নতুন সংবিধান বাস্তবায়িত হলে সঙ্গত কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মিসরবাসীর পক্ষে তা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। কেননা নতুন সংবিধানে ইখওয়ানসহ সব ইসলামী রাজনীতি এবং ইসলামপন্থিদের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের সমর্থনের ওপর কড়া সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছে। এমনকি ভবিষ্যতে সেনাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ গঠন করা কিংবা দায় চাপানোর সুযোগও রাখা হয়নি নতুন সংবিধানটিতে।
মুরসিকে অপসারণের পর সেনা কর্তৃপক্ষ দ্রুত নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে বলে মিসরবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যত মুরসিকে অন্যায্যভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রতিবাদে এবং তাকে পুনর্বহালের দাবিতে ব্রাদারহুডের যুগপৎ আন্দোলনের মুখে নতুন নির্বাচনের ক্ষণ অনেকটা প্রলম্বিত হয়ে যায়। যদিও অত্যাসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল আল-সিসিও প্রার্থী হবেন বলে সবাই ধারণা করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মিসরের প্রধান বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি মুসলিম ব্রাদারহুডকে বাদ দিয়ে সেনা সরকার কি পারবে মিসরবাসীকে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে? তাতে করে কি চলমান সংকট ও বিরোধ নিরসন হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে? কারণ এই একতরফা নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড অংশগ্রহণ তো করবেই না, উপরন্তু একদলীয় নির্বাচন প্রতিহত করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। এই অবস্থায় মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে লিবারেল-সেক্যুলারিস্ট-মিলিটারিস্টদের সমঝোতা বা সংলাপের মাধ্যমে চলমান বিরোধ ও সংকট নিরসণের বাস্তবতাও সুদূর পরাহত। কারণ কোন পক্ষই সমঝোতার কোন জায়গা এখন আর বাকি রাখেনি। একদিকে জালিম সেনা সরকারকে প্রতিহতকরণে মুসলিম ব্রাদারহুড তার আপসহীন ঐতিহ্যবাহী লড়াই তথা ইখওয়ান বনাম সেনাতন্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে আর অন্যদিকে সেনা সরকার বারবার রেটরিকভাবে ব্রাদারহুডের সঙ্গে সংলাপ বা আলোচনার কথা বললেও সেটি অসম্ভবের দোরগোড়াতেই রয়ে গেছে। এছাড়া প্রবল আন্দোলনকারী মুরসি সমর্থকদের দমাতে যারপরনাই ব্যর্থ হচ্ছে সেনা কর্তৃপক্ষ। কার্যত উভয়পক্ষই এখনও 'কেউ কারে নাহি পারে সমানে সমান'। তবে সেনা কর্তৃপক্ষ পেশির জোরে টিকে থাকলেও নৈতিকভাবে অনেক আগেই হেরে গেছে। এতদসত্ত্বেও রাজনৈতিক লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত মুসলিম ব্রাদারহুড কৌশলগত কারণে সশস্ত্র পন্থায় ধাবিত হয়নি। তাতে ঝুঁকি ছিল বেশি, কেননা তাদের নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন সত্ত্বেও যখন সেনা সরকার তাদের 'সন্ত্রাসী সংগঠন' বলে আখ্যা দেয়, সেক্ষেত্রে সশস্ত্র পন্থায় গেলে তাদের সেই আখ্যাদান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ন্যায্যতা পাবে। তাই এখন পর্যন্ত বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে মুসলিম ব্রাদারহুড তার গণতান্ত্রিক ইমেজ ও গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ওপর নির্বিচারে দমন-পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর দায়ে সেনা সরকার নিজেই খলনায়করূপে বিশ্ব দরবারে চিত্রিত ও নিন্দিত হয়েছে এবং হচ্ছেও।
ক্ষমতাসীন থাকাকালে মুরসি সরকারের কিছু ভুল ছিল বটে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেই অজুহাতে সেনা ক্যু ঘটিয়ে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেই সেটি জায়েজ হয়ে যাবে। অধিকন্তু মুরসি সরকারকে এক বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকতে না দেয়াটাই ছিল বড় ভুল। ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার গণম্যান্ডেট নিয়েই তো মুরসি সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েছিল, তাহলে এত তাড়াহুড়োর তো কোন দরকার ছিল না। মুরসিকে আরও কিছু সময় বা সুযোগ দেয়া যেত অথবা তার বিরুদ্ধে সংগঠিত বিক্ষোভকারীদের ধৈর্যের বাঁধ আর না মানলে মুরসি নিজেই নতুন নির্বাচনের আয়োজন করতে পারতেন, অন্তত তাকে সেই গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সুযোগটুকুও তো দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু গায়ের জোরে সেনা কর্তৃপক্ষ সংবিধান স্থগিত করে দিয়ে অগণতান্ত্রিক পন্থায় মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তাছাড়া মুরসির বিরুদ্ধে সংগঠিত বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন ও জমায়েত যে সাজানো ছিল সেটা তো অনেক আগেই মার্কিন গোপন নথিতে ফাঁস হয়েছিল।
মুরসিকে উৎখাতের নেপথ্যে মিসরের সেনাবাহনী, সেক্যুলার, লিবারেল গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক জায়নিস্ট লবির পাশাপাশি রাজতন্ত্র ঝুঁকিমুক্ত রাখার স্বার্থে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রচ্ছন্ন তৎপরতাও বিদ্যমান ছিল। তবে মূল উদ্যোগী ছিল ইসরায়েল ও আমেরিকা। প্রথমত, ১৯৭৮ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের ক্যাম্পডেভিড চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুসারে মিসরের সেনাবাহিনীকে আমেরিকা প্রতি বছর ১.৫ বিলিয়ন ডলার করে দেবে আর বিনিময়ে সেনাবাহিনী ইসরায়েলের স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী ইসলামপন্থি দল ব্রাদারহুড ও প্রেসিডেন্ট মুরসি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল এই চুক্তির ধারাবাহিকতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় ছিল। কেননা মুরসির সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক আগে থেকেই ছিল মধুর এবং ক্ষমতাসীন-পরবর্তী গাজাবাসীর জন্য তা অত্যন্ত সহায়ক হয়ে ওঠে। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ গাজায় অবৈধ অভিবাসনের চেষ্টা চালালে হামাসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং তারা এক অসম লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এমতাবস্থায় মুরসি এই যুদ্ধে হামাসের পক্ষ নিয়ে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের সুবিধার্থে রাফাহ নামক সুড়ঙ্গ খুলে দেন এবং এর ফলে হামাস যখন শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করে তখন কার্যত ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে যেতে বাধ্য হয়। ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার আগেই মুরসি প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তেলআবিব থেকে মিসরীয় দূতাবাস প্রত্যাহার করে নেন। গাজাবাসীর জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্যও তিনি পাঠান। এছাড়া তিনি ক্ষমতায় গিয়ে দ্রুত মিসরের অবহেলিত সিনাই দ্বীপের ব্যাপক উন্নয়ন কাজ শুরু করেন। তবে ইসরায়েল অনেক দিন ধরেই এই সিনাই দ্বীপটি পুনরায় দখলের পরিকল্পনা ও তৎপরতা চালিয়ে আসছিল। ইতিপূর্বে একমাত্র মুরসিই ইসরায়েলের এই আগ্রাসী তৎপরতা ও পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। যার কারণে ইসরায়েলের স্বার্থ সংরক্ষণের খাতিরে মুরসির ক্ষমতাচ্যুত হওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের রক্ষক হিসেবে আমেরিকারও যে চক্ষুশূল হবেন মুরসি সেটি তো জানা কথাই। আমেরিকার চক্ষুশূল হওয়ার আরেকটি বিশেষ কারণ হচ্ছে সুয়েজ খালের উন্নয়নের জন্য মুরসি বিশাল অঙ্কের বাজেট করেছিলেন। ফলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেছেন, আগামী ২০২২ সালের মধ্যেই এখান থেকে মিসরের আয় ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। যদি তা-ই হয়, তাহলে মিসরের পক্ষে খুব তাড়াতাড়িই উন্নত দেশগুলোর সমকক্ষ হয়ে ওঠার ব্যাপক সম্ভাবনা ছিল। আর এমনটা হলে আরব দেশগুলোতে আমেরিকার কর্তৃত্ব ও খবরদারি নিশ্চিতভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে। বিশিষ্ট মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির এক সেমিনারে বলেছিলেন, 'মুরসির সুয়েজ খাল উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আরব আমিরাতের অর্থনীতিতে, বিশেষত দুবাইয়ে মারাত্মক ধস নেমে আসবে। কারণ দুবাই ও আবুধাবির সি-পোর্টগুলো তখন মূল্যহীন হয়ে পড়বে। ফলে আমেরিকার অর্থনীতি দুবাই থেকে আসা সুবিধাগুলো হতে বঞ্চিত হবে।' এসব কারণে আমেরিকা স্বস্তিতে ছিল না। তাই মিসরে মুরসির শাসনক্ষমতা আর বেশিদিন টিকে থাকুক, তা চায়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে মুরসি ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বকে প্রায় পাশ কাটিয়ে তুরস্ক, সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর দিকেই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এমনকি তিনি আমেরিকার বিপরীত মেরু চীন, রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলোর সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়নে তেমন সচেষ্ট ছিলেন না। ফলে উৎখাতের সময় আমেরিকার বিপরীত মেরুর কোন পরাশক্তিকেই তিনি পাশে পাননি। অন্যদিকে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে মুরসির বেশি আগ্রহ (জাতীয়তাবাদী তাড়না) থাকা সত্ত্বেও দেশগুলোর শাসকরা মিসরের সম্ভাবনাময় গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা তথা রাজনৈতিক ইসলামের সাফল্যের প্রেক্ষাপটে যাতে করে তাদের রাজতন্ত্রের ভিত দুর্বল হয়ে না যায়, সেজন্য তারাও একযোগে মুরসির পতনে সমর্থন জানিয়েছিল। এক্ষেত্রে অবশ্য মুরসির বৈদেশিক নীতিতে দূরদর্শিতা ও কূটনৈতিক দক্ষতার অভাব দৃশ্যমান ছিল। এ প্রসঙ্গে সমকালীন আন্তর্জাতিক চিন্তাবিদ ড. তারিক রামাদান তার 'বিয়ন্ড ইসলামিজম' প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, 'বিশ্বব্যবস্থা পাল্টেছে। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডসহ অন্যান্য ইসলামপন্থি দলগুলোর কার্যক্রম বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে সমানুপাতিক হারে পাল্টেনি। বিশ্ব-ইতিহাসের উন্নয়নের যে গতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তনের যে হার এবং মোবিলাইজেশনের যে নতুন ধারা, তার সঙ্গে ইসলামপন্থি দলগুলো সমান পদক্ষেপে সঙ্গতি রক্ষা করতে পারেনি।' বরং বিশ্বের ইসলামপন্থি দলগুলো ও তাদের রাজনীতি এখনও কিছুটা হলেও পুরনো জাতীয়তাবাদী তথা জাতি রাষ্ট্রের ধারণাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত তুর্কি খেলাফতের ভেঙে যাওয়া এবং মুসলিম বিশ্ব খ--বিখ- হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের তৎকালীন ইসলামী দল ও আন্দোলনকারী পক্ষগুলো জাতিরাষ্ট্র তথা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পলিটিক্যাল ইসলাম চর্চার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণযন্ত্রের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করার প্রয়াস নিয়েছিল। কিন্তু হালের বিশ্ববাস্তবতায় জাতীয়তাবাদী বা জাতিরাষ্ট্রের ক্ষমতার ধারণার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও সমকালীন বিশ্বের ইসলামপন্থি দলগুলো দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ক্রমশ পরিবর্তনশীল গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে সেই পুরনো জাতীয়তাবাদী ধারণার খোলস থেকে এখনও পুরোপুরি বের হতে না পারার দরুন তারা তাদের অভীষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যপথে বারবার হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে পড়ছে। যদি বর্তমান সময়ের কোন ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় অভিষিক্ত হওয়ার উপায় হিসেবে নির্বাচনী গণতন্ত্রের সুযোগকে কৌশলে ব্যবহার করতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে কট্টর জাতীয়তাবাদী সীমাবদ্ধতা বা বলয়ের বাইরে এসে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের সঙ্গে অনিবার্যভাবে সংশ্লিষ্ট গতিশীল ও পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বিশ্বায়ন ও বিশ্ব ইতিহাসের উন্নয়নের গতিধারার সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক কর্মকৌশল ও রাষ্ট্রপরিচালনার সমন্বয় সাধন করতে হবে। কেননা গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা এখনও পশ্চিমা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবাধীন। তবে এজন্য আমি বলছি না যে, পশ্চিমা গণতন্ত্রকে মডেল হিসেবে তাদের একমুখী অনুসরণ করা উচিত। আমার কথা হলো, গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের ধারক পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা বিশ্বকে মোকাবেলা করতে হলে এবং তার বিপরীতে যথাযোগ্য বিকল্প মডেল হিসেবে রাজনৈতিক ইসলামের নিজস্ব (র্যাডিক্যাল অর্থে) অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মানবিক ইস্যুগুলোর বৈপ্লবিক উত্থান ঘটাতে হলে চলমান বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ব্যাপক রূপান্তর ও পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে কৌশলগত সঙ্গতি রক্ষা করা বা খাপ খাইয়ে চলতে হবে। সম্ভবত মুরসির বিদেশনীতি সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার বশবর্তী হওয়ার কারণে সেসব সম্ভব হয়নি। যার ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির যোজন-বিয়োজন খেলার মারপ্যাঁচে পড়ে মুরসি অনেক দূরে ছিটকে পড়েছেন। মার্কিন তথা পশ্চিমা বস্নকে প্রবেশের ইচ্ছা তার ছিল না ঠিক, কিন্তু সেক্ষেত্রে মার্কিনবিরোধী চীন-রাশিয়ান বস্নকে অন্তত তিনি যদি কৌশলগত কারণে যুক্ত হতেন তাহলে হয়তো আজকে তার এই পরিণতি না-ও হতে পারত। নিঃসন্দেহে মুরসির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পেছনে তার নিজের এই ব্যর্থতাও একটি অন্যতম কারণ ছিল বলে আমি মনে করি।
এই পর্যায়ে যদি ধারণা করা হয় যে, মিসরে ২৫ জানুয়ারির বিপ্লব তথা আরব বসন্ত থেকে উদ্ভূত রাজনৈতিক ইসলামের পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে অথবা রাজনৈতিক ইসলামের সম্ভাবনা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে তাহলে খুবই ভুল হবে। কেননা আরব বসন্ত তথা রাজনৈতিক ইসলাম আরব জনগণের মধ্যে যে-নতুন গণতান্ত্রিক জাগরণ বা মোহ সৃষ্টি করেছে সেটি মিসরের সেনা সরকারের শত জুলুম-নিগ্রহের মুখে আদৌ স্তিমিত হয়ে পড়েনি। কেননা অঙ্গারকে আগুনে যতই পোড়ানো হয় অঙ্গার ততই জ্বলতে থাকে। তিউনিশিয়ার ইসলামপন্থি দল আননাহদা'র প্রধান এবং বর্তমান সময়ের একজন প্রাগ্রসর ইসলামী দার্শনিক ও চিন্তাবিদ রশিদ আল ঘানুশি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'প্রকৃতপক্ষে মিসরে যা ঘটেছে তা কোনভাবেই ইসলামী আন্দোলনের পতন নয়। এটি বরং আরব জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারদের পরাজয়। যদি তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে জনগণের সারিতে না আসে, তাহলে তাদের অতীত ভূমিকার পতন ঘটবে। ইতোমধ্যে মিসরের এই সামরিক ক্যু ইসলামী আন্দোলনের জন্য অনেক বাড়তি সুযোগ নিয়ে আসবে। ইসলামী আন্দোলন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের গৃহীত নীতির পুনর্মূল্যায়ন করতে পারবে এবং তাদের পূর্বের ভুলগুলো সংশোধন করতে পারবে। মিসরসহ যে কোন দেশের ক্ষেত্রেই ইসলামী আন্দোলন বিরোধী-দলগুলোর সঙ্গে আরও যোগাযোগ বাড়াতে শিখবে।' এছাড়া সাধারণত নিপীড়িত ও অত্যাচারিত রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগণ সবসময়ই সহানুভূতিশীল ও সংবেদনশীল হয়ে থাকে। মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর মিসরের সেনা শাসকদের নির্যাতন-নিপীড়ন নতুন কোন অভিজ্ঞতা নয়, স্বৈরশাসক জামাল আবদেল নাসেরের সময় থেকেই ধারাবাহিকভাবে দলটি নির্যাতিত হয়ে আসছে। সুতরাং এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইসলামের প্রতি মুসলিম ব্রাদারহুডের এই অপরিসীম আত্মত্যাগ ভবিষ্যতের দিনগুলোতে নিঃসন্দেহে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট লাভে সহায়ক হবে।
রশিদ আল ঘানুশি সমকালীন পশ্চিমা আধুনিকতার ক্রমশ ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক ইসলামের ত্বরিত সম্ভাবনাকে প্রতীয়মান করেছেন। তিনি বলেছেন, 'মিসরসহ কোন দেশেই পলিটিক্যাল ইসলাম বা ইসলামী আন্দোলন পরাজিত বা ব্যর্থ হয়নি। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে দর্শন ও চিন্তার জগতে ইসলাম আজ আরও শক্তিশালীভাবে দৃশ্যমান। যদিও আধুনিকতা তার সর্বশক্তি দিয়ে উন্নয়নমূলক বিভিন্ন মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে ইসলামকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে; কিন্তু ব্যক্তিক স্বাধীনতা, উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, জাতীয় ঐক্য অথবা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা_সবক্ষেত্রেই তাদের গৃহীত পদক্ষেপ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণে 'ইসলাম' প্রসঙ্গটি বারবার সামনে আসছে এবং আধুনিকতার ইতিবাচক দিকগুলোকে অস্বীকার না করে এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ইসলামের ভূমিকা কী হবে সে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে।' তাই মিসরে রাজনৈতিক ইসলামের সাময়িক এই বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এত তাড়াতাড়ি রাজনৈতিক ইসলামের ব্যর্থতা স্বীকার করা সমুচিত হবে না। মনে রাখতে হবে, আরব বসন্তের জনক তিউনিসিয়া এবং তুরস্ক এখনও বিশ্বে সফলভাবে আরব বসন্ত তথা রাজনৈতিক ইসলামের শিখাটুকু জ্বালিয়ে রেখেছে। বিশ্বের সব ইসলামপন্থি দলের জন্য যা প্রেরণার মশাল হিসেবে কাজ করছে।
পরিশেষে বলব, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে যদি জনগণই মূল শক্তি হয়ে থাকে তাহলে বলতে হয় মিসরের সেনা সরকারের সর্বময় দাপট বেশিদিন স্থায়ী হবে না। হতে পারে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং মিসরের বিপ্লবী জনগণকে এখন কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। তাদের এই নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম অবশ্যই অচিরে সেনা সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করবে। সেনা সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করে একের পর এক গণহত্যা ও জেল-জুলুম-গণগ্রেফতার চালিয়েও তাদের এতটুকুও টলাতে সক্ষম হয়নি। সেজন্যই বোধ হয় নতুন একতরফা সংবিধানে সেনা কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ গঠনের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।
[লেখক : কবি ও কলামিস্ট।]
দৈনিক সংবাদ
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১২৬৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন