‘ই’ নয় ‘ও’
লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নচারী মাঝি ০১ এপ্রিল, ২০১৮, ১১:৪৮:৩৩ সকাল
নারী নিগ্রহের জন্য আসলে কি দায়ী? পোষাক নাকি মানসিকতা? নাকি অন্য কিছু? এটি এখন সামাজিক মাধ্যমে বিতর্কের জায়গা দখল করে নিয়েছে। বিশেষ করে জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম এর একটি মন্তব্যকে ঘিরে এই বিতর্ক খুব জোরেশোরে চলছে। বাস্তবিক অর্থে এই বিতর্কের জায়গাটি আসলে বেশ নাজুক এবং স্পর্শকাতর।
প্রথমত: জানা দরকার বিতর্ক কি নিয়ে? অর্থাৎ বিতর্কের ক্ষেত্রটা কি? আমার হিসেবে ভাষাগত ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রত্যয়ের ব্যবহার নিয়ে এই বিতর্ক জমে উঠেছে। সেক্ষেত্রে আমার কিঞ্চিত সংশোধনী আছে। যারা বলছেন পোষাকই নারী নিগ্রহের জন্য দায়ী, বিনয়ের সাথে বলবো আপনার এই বক্তব্য সংশোধন করে নিন। সমাধানের স্বার্থে আপনার বক্তব্যে ব্যবহৃত ‘ই’ প্রত্যয়টি ছেড়ে দিন। সেখানে বরং ‘ও’ প্রত্যয় লাগাতে পারেন। কোন একটা গুরুতর সমস্যাকে একটি কারণ দেখিয়ে পাড় পাওয়ার চেষ্টা রীতিমত নির্বুদ্ধিতা। আর আমি এতদসংক্রান্ত যত জনের লেখা পড়েছি, তাদের মধ্যে যারা পোষাককে দায়ী করেন তাদেরকে কখনও শুধুমাত্র একমাত্র পোষাককে দায়ী করতে দেখিনি। তাহলে পোষাককে দায়ী করছে কারা? হ্যাঁ, শুধুমাত্র পোষাককে দায়ী করছে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল। যারা মূলত প্রচার করতে চায় যে, পোষাক কোনই সমস্যা না, সমস্যা শুধুমাত্র পুরুষের মানসিকতায়। আর যখনই এভাবে একলাইনে সমাধান বা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়া হয়, তখনই জন্ম নেয় বিতর্কের। অনেকটা ডিম আগে না মুরগী আগে সেই নিস্ফল বিতর্কের মত।
দ্বিতীয়ত: নিরুপন করা দরকার যে, আসল সমস্যা কি কি? কীভাবে সেই সমস্যার সমাধান পেতে পারি, তাও ভেবে দেখা দরকার। এখন কথা হচ্ছে, যে পোষাক নিয়ে বিতর্ক চলছে সেই পোষাক নিয়ে আমরা একটু চিন্তা করে দেখতে পারি। মানুষ অন্যান্য বন্য প্রাণীর মত সাধারণ ধাঁচের কোন প্রাণী নয়। বুদ্ধিমান প্রাণীজগতের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। আর তাই মানুষ যুগে যুগে নিজেদের জীবনাচরণ নিজেরাই বদলে নিয়েছে। একসময় পাহাড়-পর্বত, বন জঙ্গলে আবাস গড়লেও মানুষ এখন সেখানে বসে নেই। এখন সে আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা নির্মাণের প্রতিযোগিতায় মত্ত্ব। বিজ্ঞান আর প্রযূক্তি দিয়ে বদলে ফেলেছে পৃথিবীর চেহারা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন সভ্যতার বিনির্মাণ করেছে, বিকাশ ঘটিয়েছে। সেই মানুষ নিজেই পোষাক আবিস্কার করেছে। যা মানুষের জীবনে অনেকটা খাদ্য আবিস্কারের মতই গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার। একান্ত প্রয়োজনেই এই আবিস্কার।
যে পোষাক নিয়ে আমরা খুব সহজেই বিতর্ক করছি, সে পোষাক কিন্তু এত সহজে আমাদের মাঝে আসেনি। এখনও পর্যন্ত পোষাক খুব সহজে আমাদের হাতে পৌঁছায় না। এক প্রস্থ কাপড়ের পেছনে জড়িয়ে থাকে শত শত নারী পুরুষের শ্রম। তাহলে এই পোষাক নিয়েই কেন বিতর্ক হচ্ছে! হ্যাঁ বিতর্কের কারণ তো অবশ্যই আছে। আচ্ছা যদি প্রশ্ন করি পোষাক আবিস্কারের পেছনের কারণ কি? মানুষ কেন পোষাকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো? যদি এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর বের করা যায়, তাহলে এ নিয়ে আর কোন বিতর্কের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
পোষাক আবিস্কার হয়েছে মানুষের প্রয়োজনেই। কি সেই প্রয়োজন? শুধুই কি প্রকৃতির হাত থেকে বাঁচার জন্য? নাকি নিজেদের ইজ্জত আব্রু রক্ষা করার ব্যাপারটিও ছিল? ইজ্জত আব্রুর প্রশ্ন কি মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? যদি না হয়, তাহলে মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ কোথায়? এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ইজ্জত আব্রুর প্রশ্ন কি শুধুই নারীর জন্য? না। বরং পোষাক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে যে পর্দার বিধান রয়েছে, সেখানে নারী পুরুষ উভয়কেই সংযত ও শালীন পোষাকে সমাজে চলাচলের প্রত্যক্ষ নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু নানারকম প্রশ্নের জন্ম নেয় তখনই, যখন পোষাক পরিধানের পরও বাহ্যত কাউকে উলঙ্গই মনে হয়। অর্থাৎ নামমাত্র পোষাক যা পরিধানের পরেও নারী বা পুরুষের দেহের আকর্ষণীয় স্থানগুলো কার্যত উন্মুক্তই থাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরণের আপত্তিকর পোষাক কি শুধু নারীরাই পরিধান করছে? উত্তর ‘না’। পুরুষরাও পরছে। সেদিন মসজিদে জুময়ার নামাজ পড়তে গিয়ে আমি নিজেই বিব্রত হয়েছি। সুন্নত নামাজে দাঁড়াতে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার সামনের ভদ্রলোক এমন একটি জিন্সের প্যান্ট পরে সিজদায় গিয়েছেন যে, তার পশ্চাৎদেশ অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল। নামাজ শুরু করতে গিয়ে সত্যিই এমন দৃশ্য কারো কাম্য হতে পারে না। এখন বলতে পারেন যে, আপনি আপনার নামাজ পড়বেন। আপনি কি নামাজ পড়তে গিয়েছেন? নাকি অন্যের পশ্চাৎদেশ দেখতে গিয়েছেন? আপনার মানসিকতা এত খারাপ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ... বলতেই পারেন। কিন্তু আমি বাস্তবতার শিকার। এ তো গেল মসজিদের অভ্যন্তরের খবর। আর বাইরের খবর তো আরও ভয়ানক!
এখন বলার সুযোগ আছে যে, আপত্তিকর, কুরুচীপূর্ণ এমনকি যৌন উত্তেজক পোষাক পুরুষেরাও পরে রাস্তায় বের হয়। কিন্তু, নারীরাই শুধু নিগ্রহের শিকার কেন হয়? নারীরা কি পুরুষদের কোন প্রকার নিগ্রহ করে? তাহলে কি পুরুষের বিকৃত মানসিকতাই কি নারী নিগ্রহের কারণ নয়? হ্যাঁ, একথা সত্য যে, নারী নিগ্রহের জন্য পুরুষের মানসিকতাও দায়ী। তবে শুধু মানসিকতাই দায়ী নয়। অর্থাৎ এখানেও ‘ই’ আর ‘ও’ সংক্রান্ত সমস্যা বিদ্যমান। পুরুষের এই মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে, আরও আসতে হবে। কিন্তু যারা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত, তাদের ক্ষেত্রে সমাধান কি হবে?
সমাধান খুবই সহজ। দেশ স্বাধীন। তাই বলে কেউ বাড়ির দরজা খোলা রেখে ঘুমায় না। নিরাপত্তার কথা খোদ পুলিশের আইজিপিও চিন্তা করেন। তিনিও মনে করেন তার বাড়িতেও চুরি ডাকাতি হতে পারে। তাই লাগামছাড়া হয়ে তিনি দরজা খোলা রেখে মনের সুখে ঘুমাতে যান না। নারীকে ইসলাম তার নিজের নিরাপত্তার জন্যই পুরুষের চেয়ে একটু বেশি সতর্ক করেছে। ইসলাম নারীকে ভোগ্যপণ্য বা বিজ্ঞাপনের হাতিয়ার না বানিয়ে প্রকৃত মর্যাদা দিয়েছে। আর মানসিক বিকারগ্রস্তদের জন্য দিয়েছে কঠোর শাস্তির বিধান।
কর্পোরেট বিশ্ব নারীকে পণ্য বানিয়ে নিজেদের পণ্য বেচা-বিক্রির একটা বন্দোবস্ত করেছে। আর নারী স্বাধীনতার নামে এমন এক অদ্ভূত ধারণার জন্ম দিয়েছে যার পরিস্কার ধারণা খোদ নারীদের কাছেই অনুপস্থিত। সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগে এসে এমনটা কেন হবে যে, প্রস্তরযুগের মানুষের চেয়েও আমাদের স্বল্পবসনা হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে? নারী নিগ্রহ কিংবা ধর্ষণের পেছনে যদি পোষাকের কোনই ভূমিকা না থাকে, তবে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে মুসলিম বিশ্বের এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে আকাশ-পাতাল ব্যবধান কেন? কেনইবা নারীর শরীর দেখে উত্তেজিত পুরুষের সমান অপরাধী হবে না ওই নারী, যে কিনা নিজের শরীর প্রদর্শন করে অপরিচিত কোন পুরুষকে উত্তেজিত করেছে? নারী দেখলেই যে পুরুষ বাছ-বিচার ছাড়াই বন্য পশুর মত ঝাপিয়ে পড়ে সে যেমন মানসিক বিকারগ্রস্ত, তেমনিভাবে যে নারী শুধুমাত্র পুরুষকে দেখানোর জন্যই আপত্তিকর উত্তেজক পোষাক ও সাজসজ্জা গ্রহন করে সেও মানসিক বিকারগ্রস্ত। উভয়েরই মনের মধ্যে অশালীন চিন্তা চেতনা লালনের ব্যাপারটি এখানে দৃশ্যমান।
সংযমী ও সংযত হওয়ার প্রশ্নে নারী পুরুষ উভয়কেই যত্নবান ও দায়িত্বশীল হতে হবে। যে কোন এক পক্ষকে দোষারোপ করা হবে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। প্রকৃতিগতভাবেই নারী পুরুষ একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এটি তার অপরাধ নয়, স্বভাবজাত চরিত্র। কিন্তু সেই স্বভাবকে লাগামহীন-বল্গাহীন করে ছেড়ে না দিয়ে বরং নিয়ন্ত্রনের মধ্যে নিয়ে আসার মধ্যেই কল্যাণ। মনুষ্য সমাজ ব্যবস্থা রক্ষায় এই ভারসাম্য অর্জনে নারী পুরুষ সবাইকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। পোষাকে যেমন শালীন হতে হবে, তেমন পরিবর্তন আনতে হবে মানসিকতায়ও।
বিষয়: বিবিধ
৯৩৬ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন