আসছে বর্ষা, রাজধানী কি প্রস্তুত?
লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নচারী মাঝি ২৮ মে, ২০১৬, ০৭:১৪:০১ সন্ধ্যা
বর্ষাকে উপভোগ করতে গিয়ে পল্লী কবি জসিম উদ্দীন লিখেছেন- “বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ ডাকে,/এ সবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপকথা আঁকে!” উপভোগ্য এই বর্ষা যে কতখানি অনুপভোগ্য হয়ে উঠেছে তা বিগত কয়েক বছরের রাজধানীর বর্ষাচিত্র লক্ষ্য করলে অনুমান করা যাবে।
প্রতিনিয়ত শব্দ ও বায়ুদূষণে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত এই মহানগরে যখন যানজটে রীতিমত স্তব্ধতা বিরাজ করে, ঠিক সে সময়ে খুব সামান্য বর্ষায় তলিয়ে যাওয়া পথঘাটের বর্ণনা লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরা আদৌ সম্ভব নয়। মাত্র কয়েক মিনিটের বৃষ্টিতেই অধিকাংশ এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে জলজট-যানজটে পর্যুদস্ত হয় এক কোটিরও বেশি নাগরিক। আর ভারী বর্ষণে নাগরিক জীবনে যে দূর্ভোগের সৃষ্টি হয় তা অবর্ণনীয়। যেখানে স্বাভাবিক দিনেই রাজধানীর যানজট নিরসনে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয় সেখানে জলাবদ্ধতা যানজট তৈরিতে যোগ করে নতুন মাত্রা। সিটি কর্পোরেশন একটি থেকে দু’টি হলেও জনদূর্ভোগ কমার কোন লক্ষণ আজও দৃশ্যমান হয়নি। পরিবর্তন হয়নি জনগণের ভাগ্যের।
গতবছর ‘নগর ঢাকায় জলজট: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক সেমিনারে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন- ‘ঢাকার নিষ্কাশনব্যবস্থার এখন যে অবস্থা, তাতে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এই অবস্থার উন্নতি না করতে পারলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে রাস্তায় সাঁতার কাটতে হবে।’ কিন্তু গত বছর বর্ষা মৌসুমে রাজধানীর যে চিত্র সামাজিক মাধ্যম ও পত্র-পত্রিকায় উঠে এসেছে তাতে সাঁতার কাটতে যে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে না তা স্পষ্ট। ওই সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, আগে ঢাকায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়ে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো, এখন মাত্র ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে তেমন এবং কোথাও কোথাও তারও চেয়ে বেশি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এক ঘণ্টার বৃষ্টির পানি কোথাও কোথাও ১০ ঘণ্টাতেও নামে না। পানি নামতে না পারার কারণ- নিষ্কাশনব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। এখানে পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের নর্দমা ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের নর্দমা অনেক জায়গায় এক হয়ে গেছে। কঠিন বর্জ্য নর্দমার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। অনেক জায়গায় নর্দমা বন্ধ হয়ে গেছে। উপরন্তু পানি গিয়ে যেখানে পড়বে, সেই খাল ও জলাভূমিগুলো দখল ও ভরাট করে ফেলেছে প্রভাবশালীরা।
অনেকেই বলার চেষ্টা করেন যে নগরবাসী সচেতন নয়, ফলে যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলার কারণেই এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় কেন আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সেই জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারেননি? তারা নিজেরাই কি এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন? বিশ্বের অন্যতম পুরাতন এই নগর কেন পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা যায়নি? কেন ময়লা আবর্জনা সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে? পরিচ্ছন্নতা কর্মী কি আসলেই অপ্রতুল? যদি তাই হয় তবে কেন নিয়োগ দেয়া যায়নি পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মী? এসব প্রশ্নের কোন সঠিক জবাব নেই। তবে এসব প্রশ্নের সমাধানে কর্তৃপক্ষ আগ্রহী হলে আশা করি সমাধান মিলবে।
রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতার পেছনে অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো দখল-দূষণে জর্জরিত রাজধানী ঘিরে থাকা প্রধান চার নদী বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা। ঢাকার নদীগুলো আজ খালে পরিণত হয়েছে। আর খালগুলো সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব খালের অস্তিত্ব শুধু নগরের মানচিত্রেই আছে, বাস্তবে নেই। শুকনো মৌসুমে দুর্গন্ধে ওই প্রধান চার নদীর আশপাশ দিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। আর ওয়াসার তথ্যমতে, রাজধানীর ৪৩টি খালের ১৭টিরই কোন হদিস নেই। বাকি ২৬টি খালের ৫টি আছে ব্যক্তিমালিকানায়। পৃথিবীর বেশিরভাগ শহরেই নদীমুখী নগরায়ণ গড়ে উঠলেও দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নদীমাতৃক বাংলাদেশের রাজধানীতে নগরায়ণ হচ্ছে নদীকে পেছনে রেখে। দখলমূক্ত করতে মাঝে-মধ্যে লোক দেখানো অভিযান চালানো হলেও, অভিযান শেষে কিছু দিনের মধ্যে আগের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। অদৃশ্য অঙ্গুলি ইশারায় পাল্টে যাচ্ছে নদী তীরের চিত্র।
সেইসাথে বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে নদীগুলোর পানি যেমনি দূষিত হচ্ছে, তেমনি কলকারখানার রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে গেছে। ফলে নদীগুলোর পানি এতটাই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে যে, তা পরিশোধন করে ব্যবহারও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যা নগরবাসীর স্বাস্থ্যের জন্য ইতোমধ্যেই উদ্বেগজনক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মারাত্মক দূষণের শিকার হয়েছে রাজধানীর লেকগুলোও। সেইসাথে দখলের অশুভ প্রতিযোগিতা তো আছেই। কিন্তু এসব দেখার যেন কেউ নেই।
সকল পরিকল্পনা, আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তথাকথিত উন্নয়ন ও গৃহায়ন সমস্যা নিরসনের নামে নির্বিচারে গ্রাস করা হচ্ছে জলাভূমি খাল-বিল ও নদী-নালা। জলাভূমি ভরাটের এই মহোৎসব রোধ করার যেন কেউ নেই। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে একের পর এক প্রকল্প অনুমোদন পাচ্ছে ঠিক, কিন্তু তাতে নগরবাসীর দূর্ভোগ কতখানি লাঘব হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে কিনা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রকল্পের আড়ালে অর্থ লোপাটের খবর মিলছে। জলাবদ্ধতা দূর করার নামে গত চার বছরে খরচ করা হয়েছে ৩০৩ কোটি টাকা। কিন্তু এ অর্থব্যায়ের সুফল পাচ্ছে না রাজধানীর মানুষ। জনগণ রীতিমত কর পরিশোধ করে, কিন্তু ভোগান্তির শেষ হয়না। বরং দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে ভোগান্তির তালিকা।
স্থায়ী জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ সহজলভ্য পলিথিন। গত কয়েক বছরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে এই পলিথিনের ব্যবহার। পলিথিন যে নিষিদ্ধ তা বাজারে গেলে বোঝার উপায় নেই। এসব পলিথিনের শেষ গন্তব্য কোথায় তা কারো অজানা নয়। শুধু জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্যেই নয়, বরং পরিবেশ সংরক্ষনের জন্য এই পলিথিনের ব্যবহার শূন্যে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। নিষিদ্ধঘোষিত এই পলিথিন কিভাবে পুনরায় বাজার দখল করল? কিভাবে প্রশাসনের চোখের সামনে দিয়ে সহজলভ্য হয়ে বিক্রেতার হাতে পৌছল তা খতিয়ে দেখা দরকার। রাজধানীর নালা-নর্দমা আর ড্রেনেজ ব্যবস্থার জন্য পলিথিনের চেয়ে আর বড় কোন হুমকি থাকতে পারে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী কেনা-বেচায় পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে না পারলে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য শহরগুলোর শোচনীয় পরিণতি দেখার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রাচ্যের ভেনিস বলে খ্যাত ঢাকা সামান্য বৃষ্টিতেই পুঁতিগন্ধময় জলাবদ্ধ নগরীতে পরিণত হচ্ছে। বসবাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঐতিহ্যমন্ডিত এই প্রিয় নগরী। এটি কোন সুখের খবর নয়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এ নগরীর সুরক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। প্রতিবছর বর্ষা এলেই তবে মাথায় আসে যে আগেভাগে প্রস্তুতি নেয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সে বোধোদয় আমাদের সাময়িক বেদনা বৈ কিছুই দিতে পারে না। উপরন্তু দূর্ভোগকে সামনে রেখে সমাধানে এগিয়ে না এসে সিটি কর্পোরেশন ও সরকারের কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরস্পর কাঁদা ছোড়াছুড়ি যেন সে দূর্ভোগের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। সমাধানের জন্য কাঁদা ছোড়াছুড়ি চলে না। প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।
সভা, সেমিনার কিংবা লেখালেখির মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেতে পারে ঠিক। কিন্তু কাজের কাজটি করতে হবে সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথে তাদেরকেই আগে হাঁটতে হবে। জনদূর্ভোগ নিরসনে তাদেরকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। সকল প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে ঢাকা হোক বর্জ্যমূক্ত, জলাবদ্ধতামূক্ত, পরিচ্ছন্ন ও বাসযোগ্য নগরী।
বিষয়: বিবিধ
১৫১৬ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই বিষয়ে নগর প্রশাসন বা ওয়াসার তো কোন চিন্তা নাই। তারা শুধু ঘুষ খেতেই দক্ষ।
করা (1) Watershed Division.
(a) GIS Division
(b) Sewer and Water Modeling
(c Stormwater Management
(d) Environmental Protection Agency.
বিশ্বের বড় বড় শহর গুলো নগর প্রশাসনে অধিনে থাকে।
আমেরিকায় বিভিন্ন software free
(i)https://www.epa.gov/water-research/storm-water-management-model-swmm
(ii) http://www.hec.usace.army.mil/software/hec-ras/
(ii) http://qgis.org/en/site/
যারা Civil and Environmental Engineers, Hydrologist, Water resource Engineers, আছেন, তারা ইচ্ছা করলে Download করে নিতে পারেন। বাংলাদেশকে জলজট উত্তরণের
সহয়তা করতে পারেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন