বাঙালি, বর্ষবরণ ও ইতিহাসের কাসুন্দি
লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নচারী মাঝি ১৪ এপ্রিল, ২০১৬, ০৭:৩২:৩৮ সকাল
নতুন বছরকে সামনে রেখে নানারকম বাঙালিয়ানায় মত্ত নয় উন্মত্ত হয়ে পড়েছে তরুন তরুনীরা। সেই সুযোগে হিন্দুয়ানাকে বাঙালিয়ানা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টাও করছে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল। বাঙালিয়ানার এইদিনে জানার চেষ্টা করবো ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু আবছা হয়ে যাওয়া ইতিহাস।
ইতিহাসের সাথে যাদের নূন্যতম ওঠাবসা আছে তাদের কাছে ‘দেশ ভাগ’, ‘ভারত ভাগ’, ‘বাঙলা ভাগ’ ‘বঙ্গভঙ্গ’ শব্দগুলো বেশ পরিচিত। ভারত কখনো একটি দেশ ছিল না। আবার বাংলারও অখন্ড মানচিত্র ছিল না। ভারত কিংবা বাংলার ইতিহাস বরাবরই সীমানার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেছে।
১৯০৫ সালের আগেই বাংলার রাজনৈতিক সীমানা তিন তিন বার বদল হয়। ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠন করে চতুর্থবারের মত সীমানা নির্ধারন হয়। যেটাকে ওপারের চেতনাজীবিরা ‘বঙ্গভঙ্গ’ বলে থাকে। যদিও এই বঙ্গভঙ্গের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক কাজে সুবিধা, এতে দীর্ঘ অবহেলিত পূর্ববঙ্গের জনগণের উন্নয়নের কিঞ্চিৎ সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই নবগঠিত প্রদেশের আয়তন দাঁড়ায় ১,০৬,৫৪০ বর্গমাইল। লোক সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ১০ লক্ষ। এর মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ ১ কোটি ৮০ লক্ষ। এই পরিকল্পনায় মধ্য প্রদেশ ও মাদ্রাজের উড়িয়া অধ্যুষিত অঞ্চল বঙ্গ প্রদেশের সঙ্গে এবং হিন্দি ভাষাভাষী ছোটনানপুর মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব ছিল। এভাবে পুনর্গঠিত বঙ্গ প্রদেশের আয়তন দাঁড়ায় ১,৪১,৫৮০ বর্গমাইল এবং এর জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৯০ লক্ষ মুসলমানসহ মোট ৫ কোটি ৪০ লক্ষ।
এখানে আরো একটু ইতিহাসের গভীরে যেতে চাই। পলাশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে এদেশে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত হওয়ার পর নব্য শাসকদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলমানরা যাতে সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেদিকে কড়া নজর রাখা। এজন্য প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জমিদারী, আয়সাদারী থেকে বেছে বেছে মুসলমানদের উৎখাত করার ব্যবস্থা নেয়া হলো। পলাশী বিপর্যয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই পূর্বতন ভূমি ব্যবস্থা পরিবর্তন করে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে যে নতুন ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলো তাতে ইংরেজ-অনুগত এমন এক নব্য জমিদার গোষ্ঠী সৃষ্টি হলো যার সিংহভাগই ছিল হিন্দু।
প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ‘বঙ্গভঙ্গ’ করা হলে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশের দীর্ঘ অবহেলিত জনগণের উন্নয়নের কিঞ্চিৎ সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় টনক নড়ে কলকাতা প্রবাসী জমিদারদের। এর অবশ্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কারণও ছিলো। কলকাতা প্রবাসী জমিদারদের মনে আশঙ্কা সৃষ্টি হলো যে, নতুন প্রদেশ সৃষ্টির ফলে পূর্ববঙ্গে তাদের জমিদারীর প্রজাদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের জমিদারী। কারণ, সেসময়ে কলকাতায় বাংলায় জমিদারী পরিচালনাকারী প্রবাসী জমিদাররা প্রাসাদ নির্মানের একপ্রকার প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। ব্রিটিশরা এ অঞ্চল থেকে যেভাবে অর্থ সঞ্চয় করে বিলেত নির্মান করেছে। কলকাতার প্রবাসী জমিদাররাও একইভাবে জমিদারীর নামে শোষণ করে বাংলার সম্পদ দিয়ে কলকাতা নির্মাণ করেছে। এর পাশাপাশি নতুন প্রদেশে মুসলমানরা (যাদেরেকে তারা ঘৃণা করে ম্লেচ্ছ যবন বলে ডাকতো) সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পড়াটাও হয়নি। আর এসব বিবেচনায় এনে তারা বঙ্গকে নিমিষেই ‘মা-দূর্গা’ বানিয়ে ফেলে। ফলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হলো প্রবল বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন। এ আন্দোলন অচিরেই সাম্প্রদায়িক রূপ লাভ করল। হিন্দু তরুণরা অনেকে কালী দেবীকে সামনে রেখে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণের সংকল্প গ্রহণ করল।
যুগ যুগ ধরে ভোগ করে আসা কায়েমি স্বার্থে আঘাত মনে করে তখন বর্ণবাদী হিন্দুরা ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ অজুহাত খাঁড়া করে নতুন প্রদেশকে বাতিল করতে রাস্তায় রাস্তায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নতুন প্রদেশ বাতিলের জন্য রসুনের শিকড়ের মত হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা এক হয়ে যান। সেই সময় ভারতীয় কংগ্রেস শুরু করে স্বদেশী আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী একাধিক সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নের দিনকে ‘রাখিবন্ধন’ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন। এ রাখিবন্ধনের দিন সকালে গঙ্গাস্নানের মিছিলে কবি স্বয়ং নেতৃত্ব দেন। শুধু তাই নয়, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে সামনে রেখে কবি বেশ কয়েকটি হিন্দু ধর্মাশ্রিত গানও রচনা করেন। কলকাতার তৎকালীন পার্শীবাগান মাঠে অনুষ্ঠিত এক সভায় রবীন্দ্রনাথ এক জ্বালাময়ী বক্তব্যে বলেন : “আমরা প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের কুফল নাশ করিতে এবং বাঙ্গালি জাতির একতা সংরক্ষণ করিতে আমরা সমস্ত বাঙ্গালী আমাদের শক্তিতে যাহা কিছু সম্ভব তাহার সকলই প্রয়োগ করিব।”
পলাশী থেকে বঙ্গভঙ্গ পর্যন্ত এদেশের যে হিন্দু নেতৃবৃন্দকে ইংরেজ শাসকরা সবসময় মিত্রশক্তি হিসেবে পেয়েছে। তাই হিন্দুদের এই আকস্মিক রুদ্ররূপে তাদের মধ্যেও বিস্ময় ও আতঙ্ক দেখা দিল। এর ফলে মাত্র ছয় বছরের মাথায় ১৯১১ সালে দিল্লির দরবারে ইংরেজ শাসকরা বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দিয়ে তাদের পুরাতন মিত্রদের মনরক্ষার ব্যবস্থা করল। ইংরেজ শাসকদের এ ভূমিকায় খুশী হয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্য বিধাতা’ নামে গান রচনার মাধ্যমে ব্রিটিশ পঞ্চম জর্জকে অভিনন্দন জানায়।
বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণায় চরম ক্ষুব্ধ হন পূর্ববঙ্গের অবহেলিত জনগণের তদানিন্তন অবিসংবাদিত নেতা নবাব সলিমুল্লাহ এবং তাঁর দুই সহযোগী সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও উদীয়মান জননেতা একে ফজলুল হক। তাদের এ ক্ষোভ প্রশমনের লক্ষ্যে ইংরেজ সরকার তাদের অন্যতম দাবী ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে। আজকের ইতিহাসের কাসুন্দি ঘাটার মূল উদ্দেশ্যও এখানেই নিহিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষনা শোনামাত্রই আবারও ক্ষুব্ধ হয় কলকাতা-প্রবাসী হিন্দু জমিদার ও তৎকালীন চেতনাজীবীরা। প্রবল আপত্তি তোলে এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে। এর পেছনে তাদের যুক্তিও ছিল অদ্ভুত রকমের। ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ’ বলে কান্নাকাটি করে তারা বঙ্গভঙ্গ রদ করতে ইংরেজদের বাধ্য করেছিল। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে তাদের যুক্তি ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে নাকি বাঙালি সংস্কৃতি দ্বিখন্ডিত করা হবে।
তবে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে তারা আরেকটা যে যুক্তি দিলেন, তাতে তাদের মনের আসল থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ল। তারা বললেন, পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত, মুসলমান চাষাভুষা। তাই তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার নেই। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের জনগণ অশিক্ষিত, চাষাভুষা তারা, অশিক্ষিত চাষাভুষাই থাক, তাদের শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষার কোনোই প্রয়োজন নেই। তারা এর নাম দেয় ‘অভ্যন্তরীন বঙ্গভঙ্গ’। তারা ইংরেজদের বোঝাতে চাইল ‘পূর্ব বাংলার চাষাভূষাদের জন্য ‘এগ্রিকালচার’ দরকার ‘কালচার’ বা বিশ্ববিদ্যালয় নিষ্প্রয়োজন। কলকাতাকেন্দ্রিক তথাকথিত সেই বুদ্ধিজীবী বেশধারী চেতনাজীবিদের এই বিরোধিতার কারণে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা নবাব সলিমুল্লাহ এক বুক হতাশা নিয়ে ১৯১৫ সালে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর পর প্রথম মহাযুদ্ধসহ বিভিন্ন ছুতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা পিছিয়ে যায়। অবশেষে নবাব সলিমুল্লাহর দুই সহযোগী সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও একে ফজলুল হকসহ অন্যদের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রতিশ্রুতি ঘোষণার দশ বছর পর ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এরপরের ইতিহাসও খুব সুখের ছিল না। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবের কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক আওতা সীমাবদ্ধ রাখা হয় ঢাকা শহরের মধ্যে। আগের মতোই পূর্ববঙ্গের সব স্কুল ও কলেজের ওপর এফিলিয়েটিভ কর্তৃত্ব বজায় থাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ কর্তৃত্ব থেকে পূর্ববঙ্গের স্কুল ও কলেজসমূহ মুক্তি লাভ করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। ১৯২১-৪৭ এর সে ইতিহাসের দিকে আজ আর যেতে চাচ্ছি না।
একসময়ে যারা আমাদের `Uncultured' বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তো দূরের কথা প্রতিষ্ঠাই করতে দিতে চায়নি, আজ যখন সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কলকাতার সেই দাদাবাবু আর কাকাবাবুদের সংস্কৃতি চর্চা করতে দেখি তখন কষ্ট রাখার জায়গা খুঁজে পাই না। হাজার বছরের সংস্কৃতির কথা বলে যখন ওসব জাহেলী কান্ডকারখানা করতে দেখি, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় সেই ‘রাখিবন্ধন’ ‘চৈত্রসংক্রান্তি’ ‘বসন্তবরণ’ ‘মঙ্গল প্রদীপ’ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ প্রভৃতি হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির লালন করতে দেখি, তখন আফসোস হয় এ জাতির জন্য। যে নিজেই ভূলে গেছে নিজেদের রক্তমাখা লাঞ্চনা আর বঞ্চনার ইতিহাস...
বিষয়: রাজনীতি
২৪১৪ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন