পলাশী থেকে আজকের বাংলাদেশ, ষড়যন্ত্রের শেষ কোথায়?
লিখেছেন লিখেছেন ভোরের শিশির ২৩ জুন, ২০১৪, ০৩:৩৪:৫৩ দুপুর
ইতিহাস কালের সাক্ষী। ইতিহাস অতিত ভূল ভ্রান্তি শুদ্রিয়ে নতুন ভাবে পথ চলতে শিক্ষা দেয় । কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নেই না। আমরা ভুলে থাকতে চাই সকল অঘটন। আর এই ভুলে থাকাটাই কাল হয়ে দারায় তাও বেমালুম ভুলে যাই। আজ থেকে ২৫৫ বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া বিপর্যয় আমাদের বারবার সাবধান করে দিয়ে যায়। আমরা সে সাবধান বানী শুনতে পাই না। বা শুনেও না শোনার ভান করে থাকি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এই অসচেতনতা এমনি এক সময়ের মুখোমুখি এনে দার করায় যখন প্রতিরোধের কোন পথ থাকে না। বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দেয়। কোন ত্যাগেই আর তা থেকে পরিত্রাণ মেলে না। যেমন ঠেকানোর পথ ছিল না “পলাশী” বিপর্যয়ের।
“পলাশী” অসংখ্য গ্রামের মতই একটি বিশেষত্বহীন অজ পাড়া গাঁ ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। একাধারে একটি জাতীর পরাজয়, একদল স্বার্থপর লোভী মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কিছু মানুষের চরম আত্মত্যাগের সাক্ষী হয়ে। পলাশীর বিপর্যয় নিছক একটি ঘটনা বা দুর্ঘটনা নয়, এ ঘটনাটি একটি জাতীর চিরদিনের শিক্ষণীয় একটি পাঠ। বিশেষকরে বাঙ্গালী জাতীর। এ দিনটি একদিকে যেমন রসদ যোগায় স্বাধীনতা রক্ষার দৃপ্ত অঙ্গীকারের। তেমনি অন্যদিকে সজাগ করে তোলে ষড়যন্ত্রকারীদের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে আত্মরক্ষার।
ষড়যন্ত্রকারীরা যে তাদের মিশন নবাব সিরাজ উদ দৌলার শাসনামল থেকেই শুরু করেছিল তা নয়, এর শুরু সম্রাট আকবরের সময় বা তারও পূর্বে থেকে। যার পূর্ণতা পায় নবাব সিরাজ উদ দৌলার সময়ে এসে। যখন তারা খুঁজে পায় নবাব মহলের মিত্রদের। ঘরে-বাইরে এই যুগপৎ ষড়যন্ত্র অনিবার্য করে তোলে পলাশী ট্রাজেডিকে। পলাশী ট্রাজেডির পোস্টমর্টেম করলে দেখা যায় মীরজাফর যতটা না, তার থেকে অনেক বেশি প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে ঘসেটি বেগম, জগৎশেঠ, ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লব, সেনাপতি রায়দূর্লভ, নন্দকুমার, শিখ ব্যবসায়ী উমিচাঁদ প্রমুখ। ঘরের সত্রুর সহায়তা ছাড়া বাহিরের সত্রু বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে না। আর এই ঘরের শত্রুকে চিনতে না পারা এবং বিশ্বাসঘাতকের পবিত্র গ্রহ্ন ছুঁয়ে করা শপথকে বিশ্বাস করাই ছিল পলাশী ট্রাজেডির মূল কারণ।
আজ ২৫৫ বছর পরেও আমরা কি সেই ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে মুক্ত হতে পেরেছি? পারিনি। আজো চলছে সেই একই ষড়যন্ত্র। শুধু পাল্টেছে কুশীলব।
১৭৫৭ সালের বাংলার মতই আজকের বাংলাদেশের ভিতরে-বাইরে চলছে একই ধরনের ষড়যন্ত্র। সময়ের সাথে সাথে পাল্টেছে ষড়যন্ত্রের ধরন। একদা অর্থ-সম্পদ হলেও আজ তাদের লক্ষ্য এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্ম-সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ। যা ধ্বংস করা গেলেই সম্ভব এ দেশ ও জাতির অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করা। যা বাঙ্গালী জাতীর সবচেয়ে বড় অর্জন এবং একই সাথে টিকে থাকার অবলম্বন।
বাঙ্গালীর স্বকীয়তা, আত্মসম্মানবোধ, স্বাধীনচেতা মনোভাব আজ নতুন নয়। তাই কখনোই এ জাতী বেশিদিন কারো পদানত হয়ে থাকেনি। যতবার আধিপত্য বাদের স্বীকার হয়েছে ততবারই হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। সম্পদের অপ্রতুলতা থাকলেও কৌশলগত ভূ-রাজনীতির কারনে আজ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের স্বীকার হতে হচ্ছেএ দেশকে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা জিইয়ে রাখা,
ক্রমাগত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো,
অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করা,
শিল্পোন্নয়ন বাধা সৃষ্টি,
এমনকি ইতিহাস বিকৃতি কোনটিই বাদ যায়নি।
এই ক্রমাগত আক্রমণের ফলে আজ একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। জেঁকে বসেছে আধিপত্য বাদ। আধিপত্যবাদিরা তাদের তল্পিবাহকদের শক্তিশালী করতেই সুকৌশলে বরেণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করছেন। বিনিময়ে তারা বাস্তবায়ন করে চলেছেন আধিপত্য বাদের এজেন্ডা।
এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই একদিকে তৈরি করা হয় তসলিমা নাসরীন, দাউদ হায়দারদের অন্যদিকে তৈরি করা হয় জেএমবি, হিজ বুত তাহারীর এর মত সাংঘর্ষিক সংগঠন। যাতে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পরে। জনযুদ্ধ, লাল পতাকা, সর্বহারা বা শান্তিবাহিনীর স্রষ্টা কারা? কারা তাদের লালন করে?
বিন লাদেন বা আল-কায়েদার জন্ম তারাই দেয়। যারা তাদের নামে যুদ্ধ ঘোষণা করে দখল করে রাখে একের পর এক দেশ। সাদ্দাম হোসেন উদ্ধত না হলে, বিন লাদেন বা আল-কায়েদার জন্ম না হলে ইরাক-আফগানিস্তানে আধিপত্য বিস্তার সম্ভব হত না। তাই প্রয়োজনানুযায়ী এদের জন্ম হবে এবং আই ওয়াশ করতেই তাদের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হবে।
দেশি-বিদেশী এই কুশীলবরা সবক্ষেত্রেই করছে মাতব্বরি। আমরা তা মেনেও নিচ্ছি। এমনকি আমরা একে অন্যের বিরুদ্ধে নালিশ জানাই তাদের কাছে। তাদের ব্যাবস্থাপত্র ছাড়া আমাদের সমস্যার সমাধান হয় না। এ আমাদের রাজনীতিবিদদের দৈন্যতা। দেশপ্রেমের লেশমাত্র থাকলেও তারা এটা করতে পারতেন না। যারা আড়ালে বসে অশান্তির ইন্ধন যোগান আবার তারাই সমাধানের ব্যবস্থাপত্র দেন। আমরা ধন্য হই তাদের সংস্পর্শে এসে। আমরা তাদের কথায় মেনে নেই দ্বিধাহীন চিত্তে, চাহিবা মাত্র দিতে বাধ্য থাকি সব, তাতে দেশের স্বার্থ রক্ষা হোক বা না হোক। সময় এসেছে শত্রু-মিত্র চেনার। আধিপত্য বাদের তল্পি বহনকারীদের বর্জন করার।
আন্তর্জাতিক মাতব্বরীতা, অর্থনীতির মোড়কে এনজিওদের দৌরাত্ব্য এবং আকাশ সংস্কৃতির নামে উলঙ্গ পনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার এখনই সময়। নবাব সিরাজ উদ দৌলার মত উদারতা ও সরলতা নয়। প্রয়োজন সম্রাট আওরঙ্গজেব এর মত নৈতিক মান সম্পন্নতা ও বিচক্ষণতার। সেইসাথে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ। আমার চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক কে আছে এ ধরনের অর্বাচীনের প্রলাপ নয়। নয় ক্ষমতার জন্য আধিপত্য বাদকে নির্লজ্জ প্রশ্রয়। গত ১৮ জুন কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি স্বাক্ষর করার প্রেক্ষাপটেই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার চেয়ে কে বেশি দেশপ্রেমিক?’ তাই তাকে প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি সত্যি সত্যি একজন দেশপ্রেমিক। একজন সরকার প্রধান হয়ে কনোকো-ফিলিপস নামক একটি আমেরিকান কোম্পানির কাছে গভীর সাগরের বুকে দেশের তেল-গ্যাস সম্পদের খনি তুলে দিয়ে তিনি কিভাবে প্রকাশ্যে নিজেকে দেশের সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চা”েছন? এটা কি শুধু মুখের বুলি? আসলে ‘হরি ঘরে কে রে? আমি কলা খাই না’ এমন একটা ভাবইতো এখানে প্রকাশ পা”েছ। তাই দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিককে তিনি আগাম জানিয়ে দিলেন যে দেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দিতেই তিনি দিন-রাত কাজ করে যা”েছন। তাছাড়া তিনি বারবারই বলছেন, গ্যাস রফতানি করতে চাননি বলেই ২০০১ সালে তাকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। যদি এটা সত্যিই হয়ে থাকে, তবে কি তিনি দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়ে মীর জাফর আলী খাঁর মতো বাংলাদেশের মসনদে নিজের আসনকে পাকাপোক্ত করতে চান? যদি তা-ই হয়, তবে কি তিনি মীর জাফরের পরিণতি থেকে একটুও শিক্ষা নিতে চান না? একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। নিজের দেশের প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী না করে আমেরিকার কোম্পানিকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অধিকার প্রদান, নিজ দেশের সীমান্তকে প্রতিবেশী দেশের কাছে অরক্ষিত করে রাখা, নিজ দেশের ভূমি পাশের দেশকে দিয়ে দেয়া, প্রতিবেশী দেশ থেকে সরকারি ও সামরিক গুর“ত্বপূর্ণ লোকজনদের ঘনঘন বাংলাদেশ সফর কি আমাদের নব্য দেশপ্রেমের আলামত নাকি আমাদের নব্য গোলামীর প্রথম পদক্ষেপ? আজকের এই দিনে মেজর আবদুল জলিলের ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ বইটি আমাদের সবার একবার পড়া দরকার। আর প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা যাতে করে আমাদের রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতায় গিয়ে দেশের স্বার্থ-বিরোধী কোন কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করতে পারে। দেশের জনগণ যত সচেতন হবে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ততোই কমতে থাকবে। নতুবা জনগণকেই এর মূল্য দিতে হবে। আর কত এভাবে চলবে? আর নয়। প্রয়োজন ইস্পাত কঠিন শপথ গ্রহণ। প্রয়োজন আজকের মীর জাফর, জগৎশেঠ, রাজ বল্লভ, রায়দূর্লভ, নন্দকুমার, উমিচাঁদ ও ঘষেটি বেগমদের মুখোশ উন্মোচন। আমরা অনুকম্পা প্রদর্শন বা বিশ্বাসঘাতকের নাকি কান্নায় ভুলতে চাই না। আমরা কিছুতেই চাই না আরেকটি পলাশীর পুনরাবৃত্তি।
বিষয়: বিবিধ
১৭৪৪ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এবং
আওয়ামীলীগ তার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী ঐ তারিখে নির্ধারণ/পালন করে
এটা তাদের খুশীর দিন..
পড়ুন লাশির= পলাশীর
মন্তব্য করতে লগইন করুন