অতীতের ভালোবাসা ,স্বপ্ন ছুঁয়া

লিখেছেন লিখেছেন মেহেদী জামান লিজন ২৩ জুন, ২০১৪, ১১:৪০:৪৬ রাত



তখন ক্লাশ নাইনে পড়ি। বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিলাম। পড়ালেখা ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। বলতে গেলে দুই তিন বছরের শিশুর মতই ছিলাম। পৃথিবী কাকে বলে বুঝতাম না। আমি বড় হয়েছি, সবকিছু বুঝতে শিখেছি তখন, যখন আমার বাবা মারা যায়। কারণ বাবা মারা যাওয়ার পরই আমি বাস্তব পৃথিবীর সামনে পড়ি। বলতে গেলে পৃথিবী কতটা নিষ্ঠুর হয় তাও বুঝতে শিখি। তখনি বুঝতে পারি স্নেহ ভালবাসা কাকে বলে ? হঠাৎ করেই একদিন বাবা আমার সেজু আপুর বিয়ে ঠিক করে। অনেক ধুমধাম করে বিয়ে হয়। তখন আমিই একমাত্র মানুষ যে আপুর বিয়েতে আনন্দ করবো। কারণ আমিই ছিলাম সবার ছোট এবং আদরের। সেদিন ২০১০ সালের নভেম্বর মাসের ১২ তারিখ ছিল। ঐ দিন আপুর গায়ে হলুদের দিন। যেহেতু আমি শিশু ছিলাম তাই ঐ দিন আপুর চেয়ে বেশী এবং আগে থেকেই সেজে বসে থাকি। ঐ দিন আমি শাড়ি পড়েছিলাম, হাতে ছিল চুড়ি আর মাথায় ছিল লাল টকটকে একটা মস্ত গোলাপ। হলুদ পড়াতে ঐ বাড়ি থেকে ১০ জন লোক আসে। সবাই সম্পর্কে বেয়াই ছিল। এদের মাঝে তিনজন ছিল আপুর দেবর। বাকীদের ভেতর একজন ছিল দুলা ভাইয়ের পাশের বাসার ভাড়াটে। দারাগোর ছেলে , নাম মেহেদী (বাবু)। নামটা বলতে গেলে আজও আমার বুকের ভেতরটা নাড়া নাড়া দিয়ে ওঠে। আমার গল্পের শুরু এবং শেষটা মূলত তাকেই ঘিরেই। কারণ সেই ছিল আমার জীবনের প্রথম ও শেষ প্রেম। আজও তার আশায় পথ চেয়ে থাকি, আমার ধারণা , আমার ভালবাসার টানে ও আমার কাছে ফিরে আসবেই। যাহোক তাদের মধ্যে একজন ছিল বাড়িওয়ালার ছেলে রিফাত। বাকীরা সবাই ছিল দুলা ভাইয়ের কাজিন। আপুর মেজ দেবরের নাম ছিল বাবু। উনি আমাকে আদর করে আপু বলে ডাকত। আমার তো বড় ভাই ছিল না, তাই আমিও তাকে বড় ভাইয়ের আসনে বসাই। আপুর সেজো দেবরের নাম ছিল সজীব। আর সবার ছোটটার নাম ছিল রাকিব। এদিকে আমরা এক এক জন এক একটা জিনিস হাতে দাড়িয়ে ছিলাম। আমার হাতে ছিল রজনীগন্ধার স্টিক , লাল গোলাপ, আর কাঁচের প্রিচে কিছু চুমকী। এক এক জনের হাতে ফুল দিয়ে কপালে চুমকী দিয়ে j¤^v ফোঁটা একে দেই। সবাইকে দেবার পর শেষে আসে দারোগার ছেলে মেহেদী (বাবু)। আমার সামনে দাড়ানোর পর তার হাতে ফুল দেই। যখন তার কপালে ফোঁটা দিতে যাব তখন চোখ বন্ধ করে কপালটা আমার হাতের দিকে ঝছে দেই। আমার ওটা এখনও মনে আছে। ওর চোখ বন্ধ করাটা সুন্দর ছিল। যতক্ষণ ফোঁটা একে দিচ্ছিলাম ততক্ষণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আপুকে সবাই সাজাচ্ছে। আমি আর আমার কিছু আন্টি মেহমানদের নিয়ে বসাই নাস্তা দেই। এরপর সবাই বাহিরে হাটতে বের হয়। বাসার ভেতরে থাকে সজীব ভাইয়া আমার মেহেদী। সজীব ভাইয়া আমাকে ডেকে আমার হাতটা ধরে তার পাশে বসাই। সামনে বসা মেহেদী। খুব ভয় আর লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমি হাত ছাড়িয়ে ভেতরে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলাম। সজীব ভাইয়া রোমান্টিক কথা শোনাচ্ছে। তখন রোমান্টিকতার কিছুই বুঝিনি আমি। মেহেদী আমার দিকে আড় চোখে তাকায় আর মাথা নিচু করে হাসে। খুব রাগ লাগছিল আমার। আমি হাতটা ছাড়িয়ে ভেতরে চলে যাই। এর পর আপুর গায়ে হলুদ লাগাতে ব্যস্ত সবাই। আমি খুব দুরন্ত ও দুষ্টু ছিলাম। সবাইকে রং আর হলুদ দেবার জন্য ছুটোছুটি করছিলাম। কাউকে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করে সজীব ভাইয়া বলল আমি ওদের ধরে দিলে তুমি খুশি হবে ? আমি খুব আনন্দ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে বললাম, হ্যাঁ ভাইয়া দেন। মেহেদী খুব শান্ত ¯^fv‡ei এবং লাজুক ছিল। ও এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সজীব ভাইয়া তাই সামনে পেয়ে ওকেই ধরে আনে। আমি খুব মজা পাচ্ছিলাম। সজীব ভাইয়া তাকে আমার হাতে এনে ছেড়ে দেয়। আমি ওর হাত ধরে কপালে, গালে আর মুখে হলুদ লাগিয়ে দেই। ও চোখ বন্ধ করে ছিল। ওর দুই হাতেও ভালোভাবে লাগিয়ে দেই। লাগানো শেষ হলে হাতটা ছেড়ে দেই। ও বলে “এবার খুশি তো ? নাকি আরো দিবেন ? যদি মন না ভরে তবে আরো দিতে পারেন ম্যাডাম”। এটাই ওর সাথে আমার প্রথম কথা। আমি কিছু বললাম না, শুধু এক গাল হেসে আরো হলুদ মাখিয়ে ছুঠে পালাই। ঐ দিন আপুর কাবিন হয়। ওরা সবাই চলে যায়। কেন জানি মনটা খুব খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে আমি খুব একা, খুব অসহায়। বড় আপুর আরেক দেবরের নাম বায়োজিদ। বায়োজিদ ভাইয়া আমাকে বড় ভাইয়ের মত স্নেহ করে। আমার মন খারাপ দেখে বলল, কীরে ? তুই এখানে একা বসে আছিস কেন ? আমি বললাম, এমনি ভাইয়া। তারপর ভাইয়া বলল তবে, এখানে একা বসে আছিস কেন ? সবাই কত আনন্দ করছে আর তুই একা বসে আছিস। আমার আবারো এমনিই বলে রুমে চলে যায় এবং শুয়ে থাকি। তারপর রাতে দুলাভাই আসবে শুনে, দুলা ভাইকে বিকেলে কল দিয়ে বলি যেন রাতে বেয়াইদের সাথে নিয়ে আসে। ঠিক সন্ধ্যার পর দুলাভাই কল করে তাদের এগিয়ে আনার জন্য। সাথে ছিল মেহেদী, রাকিব (দুলা ভাইয়ের কাজিন), রিফাত (বাড়িওয়ালার ছেলে)। বাড়িওয়ালা বলতে দুলা ভাই আর মেহেদীর ফ্যামিলি যাদের বাসার ভাড়াটে। সাথে বাবু ভাইয়াও ছিল। এরপর আমরা সবাই বাসার দিকে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে ওদের সাথে পরিচিত হয়। রাকিব ক্লাশ ফাইভে, রিফাত ৮ম শ্রেণীতে, আর মেহেদী বরিশাল পলিটেকনিক্যাল কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র। আর আমি তখন ছিলাম নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছাত্রী। ৬দিন পর কোরবানির ঈদ। তারপর আমার বার্ষিক পরীক্ষা। এরপর সবাই মিলে বাসায় আসলাম। রাতে অনেক মজা করলাম। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওরা সবাই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। আমি ও নাছোড়বান্দা কাউকে যেতে দেবনা। রিফাতের পরীক্ষা তাই ও চলে যায়। আর বাকীরা থেকে যায়। এরপর এক বাসায় যাওয়ার জন্য মেহেদীকে ডাকি। সাথে রাকিব আর আমার কাজিন মিরাজ ও ছিল। রাততো, বুঝতেই পারলাম মেহেদী অন্ধকারে হাঁটতে কিছুটা ভয় পাচ্ছিল। ওর মোবাইলের আলোতে হাঁটতে হাঁটতে কথা বললাম। ভালাই বন্ধুত্ব হল আমাদের। পরের দিন (২০১০-১১-১৩) সকালে দুলা ভাই এবং ওরা সবাই চলে যাবে। আমার কেন জানি খারাপ লাগা শুরু হল। মেহেদীকে বলার পর দুলাভাইকেও অনেক অনুরোধ করি যেন দুপুরে দুলাভাই ওদের (মেহেদীসহ) সাথে নিয়ে আসে। দুপুরে আবার কল আসে এগিয়ে আনার জন্য। আমি আর আমার কাজিন মিরাজ গিয়ে দেখি বাবু ভাইয়া, মেহেদী, রাকিব দাঁড়িয়ে আছে ওদের দেখে মনে মনে খুব খুশি হই। ওরা যেখানে দাড়িয়ে ছিল সেখানে আমরা সবাই বসে পড়ি। বাবু ভাইয়া ব্যাগ নিয়ে আগে চলে আসে। মেহেদী আমার হাত ধরে আমাকে বাসায় নিয়ে আসে। আসার সময় মেহেদী কিছু কথা বলে। ও বলে আমি আপনার সাথে ওয়াদা করেছিলাম, তাই এসেছি। আপনার জন্যই আসা। কিন্তু আমার গায়ে কেউ যেন চুমকী বা রং না দেয়। আমি বললাম, আপনি এসেছেন তাতে আমি খুশি হয়েছি। আপনাকে নিরাপদে রাখার দায়িত্ব আমার। তারপর ও বলল, “মনে থাকে যেন”। আমি বললাম আচ্ছা মনে থাকবে। এরপর ও রেপিন করা কি যেন একটা গিফট করে আমাকে। বিকেলে দুলাভাই আর আপুর হলুদ গোছলের পর মেজ আপু রং পানি নিয়ে বাবু ভাই আর মেহেদেীকে তাড়া করে। আমি দেখে খুব মজা পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল তাড়া খেয়ে মেহেদী ও খুব মজা পাচ্ছিল। রাতে রাকিব আমাকে বলে, আপু আপনাকে মেহেদী ভাই বাহিরে ডাকে। অনেক ভয় নিয়ে মেহেদীর সামনে দাঁড়াই। ও বলে ভয় পাচ্ছ ? আমি বললাম পাচ্ছিতো। তারপর ও বলল ভয় নাই। আমি বাঘ না যে তোমাকে খেয়ে ফেলব। আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। আমি বললাম বলেন। তারপর হঠাৎ করে কে জানি এসে পড়ে; আমি ভেতরে চলে আসি। আবার সে আমায় ডেকে নেয়। ডেকে নিয়ে বলে কি হল তুমি কিছু তো বললে না। আমার হাত, পা কাঁপতেছে, ও বলল আমাকে ফিরিয়ে দিওনা। ও বলল, প্রেম-টেম আমি পছন্দ করি না। জীবনে এই প্রথম কোন মেয়ের কাছে আসা। আমি বললাম আমিও না। অন্ধকার রাত। আমার চুল খোলা ছিল। মেহেদী আমার হাত ধরে। ভয়ে প্রচন্ড কাঁপতেছি। ও বলল ইচ্ছা করলে আমি এখন অনেক কিছু করতে পারি। কিন্তু না, আমি ঐ ধরনের ছেলে না। আমি বললাম আমি যাব, চুলগুলো সামনে চলে এসেছে। ও বলল আসতে দাও। যতক্ষণ পর্যন্ত হ্যাঁ না বলবে ততক্ষণ পর্যন্ত যেতে দেব না। আমি কিছু জানি না বলে দৌড়ে ভেতরে চলে আসি। ঐ দিন সজীব ভাইয়াও আমাকে একটা গিফট করে। মেহেদী আমাকে অনেকগুলো চকলেট গিফট করেছিল। সজীব ভাইয়ার গিফটা আমি ভেতরে রেখে এসেছিলাম। পরে অবশ্য এনেছিলাম। পরের দিন (১৪/১১/২০১০) সকালে রিফাত আসে। রিফাত আর মেহেদী আমার সামনে বসা। রিফাত অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে । আমি কোন শব্দই করতে পারছিনা। কিছুটা ইশারায় হ্যাঁ বলে চলে আসি। আগের দিন সকালে আমি টেবিলে বসা ছিলাম। আমাকে লক্ষ্য করে মেহেদী দুর থেকে একটা গোলাপ ছুঁড়ে মেরেছিল। কে মেরেছিল খেয়াল না করে গোলাপটা ছিড়ে পাপড়ী গুলো দিয়ে অনেকক্ষন দুষ্টুমী করে আপুর রুমে গিয়ে দেখি খুব বড় একটা গোলাপ। ও আমাকে একটা কলি দিল। আমি এটা মেহেদীকে দেবো। ওড়নার ফাঁকে লুকিয়ে এনে তার হাতে দিয়ে বললাম চুরি করে এনেছি। লুকিয়ে রাখো। তারপর একগাল হেসে দৌড়ে পালাই। এর পরই ও আমাকে চকলেট গিফট করে। যাহোক মেহেদী আর রিফাতের সাথে কথা বলে আসার পর সকালের নাস্তা দিচ্ছিলাম সবাইকে । সবার নাস্তা করার পর গিয়ে দেখি মেহেদী নুডুলস খায়নি। নুডুলস্‌ আমি বেসম্ভব পছন্দ করি। আমি মেহেদীকে বললাম এটা খাচ্ছেন না কেন ? ও বলল খাবো না। আমি বললাম না খাওয়া অবধি আমি প্রীচ নিয়ে যাব না। আপনাকে খেতে হবে। ও বলল আমি খাবো কিন্তু সাথে আপনাকেও খেতে হবে। (আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম) তারপর বলল, আচ্ছা আপনি অর্ধেক খেয়ে অর্ধেক আমাকে দিন। আমি আপনাকে খাইয়ে দেবো। নয়তো খাবো না। এরপর মেহেদী আমাকে নুডুলস্‌ খাইয়ে দেয়। ‌পানিটা ও নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দেয়। (এরপর দুই বছর আমি কখনো নুডুলস্‌ খাইনি। দুলাভাই আর ওরা সবাই চলে যাবে। রিফাত, মিরাজ, রাকিব, আমি দুতলার রুমে বসে সজীব ভাইয়ার গিফ্‌ট টা নিয়ে বসি। প্যাকেট টা রিফাত খুলেছিল। ভেতরে ছিল খুব সুন্দর একটা পুতুল (মেয়ে) এবং কিছু ফুল। ওদিকে মেহেদী মন খারাপ করে রাস্তায় দাড়িয়ে আছে। আর আমি দোতলার রুমে, জানালার পাশে দুজনের দৃষ্টি দুজনের দিকে। মেহেদী রিফাতের কাছে ওর নিজের পাসপোট সাইজের দু’কপি ছবি পাঠিয়ে দেয়। ও ইশারায় আমার ছবি চায়। কিন্তু ঠিক ঐ মুহুর্তে আমার কোন ছবি তোলা ছিল না। মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। তাই সজীব ভাইয়ার দেওয়া পুতুলটা আমার পক্ষ থেকে ওকে দেই। পুতুলটা দেখে মেহেদী ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। কারণ সজীব ভাইয়া লোকটা সুবিধার ছিল না। সজীব ভাইয়া এখন আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। আর তারই দেওয়া পুতুলটা ................। তারপর আবার ইশারায় আবার কথা। আমি মেহেদীকে ইশারায় বোঝালাম যে, মনে করবে ঐ পুতুলটাই আমি। ছোট্ট একটা হাসি দেয় ও। আমি আর বড় দুলাভাই ওদেরকে এগিয়ে দেয়ার জন্য কিছু দুর ওদের সাথে যাই। সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। সবার সামনে তো মেহেদী কিছু বলতে পারে না। তাই আমার সামনে এসে হাত মেলাতে মেলাতে বলে, বেয়াইন যাই। বলতে বলতে আমার হাতের ভেতর কি যেন একটা গুঁজে দেয় আর বলে যা দিলাম নিয়ে নাও। এখন দেখতে যেওনা, সবাই সন্দেহ করবে। তাই ওটা দেখলাম না। সবাই গাড়িতে উঠে বসে। যতক্ষণ গাড়ি মোড়ে না পৌঁছেছে ততক্ষণ ওদের চলে যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে রইলাম। মেহেদীও তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারলাম বিদায় বেলার মুহূর্ত খুব কষ্টের হয়। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে বাসায় চলে আসি। বাসায় আসার আগ পর্যন্ত দেখেনি যে, মেহেদীকে আমার হাতে কি দিয়েছিল। টেবিলের কাছে গিয়ে রসায়ন গাইডটা হাতে কয়েকটি পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখি অনেক খানি নুডুল্‌স। রাগ লাগছিল তবু খুব মজা পেয়েছি। ওটা রিফাতের কাজ ছিল। আবার কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখি পুতুলটা। যে কাগজের ভেতর ছিল ওটা ভেতর কয়েকটা রজনী গন্ধা রাখা। এইটা মেহেদীর কাজ। শেষের কভার পেজে গিয়ে দেখি একটা গোলাপের পাপড়ি কষ্টেপ দিয়ে লাগানো। তার একটু নিচে একটা ফোন নাম্বার দেওয়া ছিল। কিঞ্চিৎ হাসলাম। এই কাজটাও মেহেদীর। এবার দেখলাম মেহেদী যাবার আগে কি দিয়েছিল। আসলে ওটা ছিল ১০০ টাকার একটি নতুন নোট। নতুন টাকা আমার খুব প্রিয় ছিল। টাকাটা এখনো আছে। অবশ্য মেহেদী যেমনটা দিয়েছিল তেমনটা নাই। অনেক কিছু লিখে ভরে রেখেছি টাকাটাই । যেন টাকাটা কখনও খরচ করতে না পারি। যাহোক ১৭-১১-২০১০ ইং তারিখে মেহেদীর সাথে আমার প্রথম ফোনে কথা হয়। wW‡m¤^‡ii ২৫ তারিখ পর্যন্ত আমরা প্রায়ই প্রতিদিনই কথা বলতাম। যে কথার কোন অর্থ ছিল না। ছিল না কোন প্রেমালাপ। বাবু ভাইয়া, সজীব ভাইয়া কি করে, মেহেদীর বাবা-মা, বোন, আমার বাবা-মা, আপু, দুলা ভাই এদের নিয়েই বেশী কথা হত। সুযোগ পেলেই আপুর বাসায় যেতাম ও বরিশাল থেকে বাসায় আসতো। দুলাভাই আর ওরা পাশাপাশি বাসার ভাড়াটে। কিন্তু আমরা কথা বলতাম না। আমি ওকে একটা ছবি দিয়েছিলাম, ওর নিজের। আমি কখনও ভাবতেও পারিনি যে ছবিটা হুবহু ওর মতই হবে। ও যখন হোস্টেলে থাকতো, সুযোগ পেলেই কথা বলতাম। বিকেল বেলায় বেশি কথা হতো। রাতে কথা বলতে পারতাম না আমি। তাই ও রাত বারটায় (১২) ফোন করতো, আর আমি ভোর পাঁচটায় (৫) মিসকল দিতাম। ও কথা বলতো আর আমি শুনতাম। অনেকক্ষন কথা বলে ফোনটা ও রেখে দিত। ওর ঘুমের কন্ঠটা আমার সেইরাম ভাল লাগত। কিছু দিন পর বাবু ভাইয়া সব জেনে যায়। উনি জেনে যাওয়ার পর মেহেদী আর আমার বাসায় খুব সমস্যা হয়। মেহেদী বাসা থেকে হোস্টেলে গেছে ২ দিন হয়, তবুও কোন ফোন দেয় না। খুব দুঃচিন্তার মধ্যে পরে গেলাম। ওর ফোনটাও বন্ধ ছিল। ১৫-২০ দিন হয়ে যায়, কিন্তু ওর সাথে আমার কথা হয না। পাগলের মত হয়ে গেলাম আমি। মাঝে মধ্যে মেহেদী ওর বন্ধুদের ফোন দিয়ে কথা বলতো। ঐ bv¤^vi¸‡jv‡ZI কল দিতাম মেহেদীকে পাওয়ার আশায়। ১০-০২-২০১১ ইং তারিখে সন্ধ্যার দিকে একটা মিসকল দিয়ে মেহেদীর নতুন নাম্বার পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই আমি। সাথে সাথেই ঐ নতুন এয়ারটেল নাম্বারে কল করি। কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর এপাশ থেকে

-হ্যালো

-এতটা নিষ্ঠুর নির্দয় কিভাবে হলে। এতটা অভিনয় করার কি দরকার ছিল ? আমি তো তোমার কাছে যেতে চাইনি। তুমি নিজেই এসেছিলে। আজ যখন আসলাম তখন কেন তুমি চলে যেতে চাইছো ? কাঁদছি আর কথা গুলো বলে যাচ্ছি। তারপর ওপাশ থেকে........

-তুমি একটু থামো, কান্না করোনা।

-আমাকে ক্ষমা করে দিও। এতোদিন খুব সমস্যায় ছিলাম। তুমি আমাকে অভিশাপ দিয়েছো তাই না ? তাইতো অসুস্থ ছিলাম। ওর কণ্ঠটাও কান্নায় জর্জরিত ছিল। আমি বললাম, আমি তো তোমাকে অভিশাপ দেবার জন্য তোমার জীবনে আসিনি। এভাবে অনেকক্ষন কথা হয় ঐদিন মেহেদীর সাথে। এরপর ২-৩ দিন আর কথা হয় নি। কারণ ও বাসায় ছিল। আর বাসায় থাকলে ওর মা খুব ভয়ংকর ছিল। ৩-৪ দিন পর ওকে আমি কল করি কারণ ও তখন হোস্টেলে ছিল। ও আমাকে ফোনে বলে যে, ওর সাথে আমার সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়। এমন আরো অনেক কথা। আমি শুধু চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছি। কিছু না বলে ফোন রেখে বাবু ভাইয়াকে দেই। তিনি আমার সাথে ওয়াদা করেছিল যে ভাবেই হোক মেহেদী আর আমার পাশে সারাজীবন থাকবে। আমাদের সকল প্রকার সাহায্য করবে। তাকে কয়েকটা কথা বলে ফোন রেখে দৌড়ে বাসায় গিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসি। কারণ আমার বাবা আমার কাছে খুব প্রিয় ছিল। বাবার দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থেকে খুঁজে বাবার অনেক পুরোনো, পঁচা, মেয়াদহীন ৬০ টি ট্যাবলেট বের করে সবগুলো খেয়ে ফেলি। মৃত্যুর খেলায় মেতে উঠেছিলাম তখন। কিন্তু মরিনি। এখনো কেন বেঁচে আছি জানিনা। হয়তো মেহেদীকে ফিরে পাওয়ার আশায় ----------। ঐ দিন রাতে অনেক কষ্টে মেহেদীর কাছে একটা মেসেজ করি। কিন্তু কোন সাড়া দেইনি। ও আমাকে এভোয়েট করতো জেনেও নিলজ্জের মত বারবার কল দিতাম। হাজারটা কল দিলেও একটা রিসিভ করতো। ও খুব ভীতু ছিল। কিন্তু ফোনে আমি হয়ে যেতাম সবচেয়ে ভীতু। আমি শুধু ওর কণ্ঠটা শোনার আশায় ওকে ফোন দিতাম।

একদিন একটা কথা শুনলাম যে, দুইটা সিগারেটে যে পরিমাণ নিফোটিন থাকে তা একজন সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করালে ঐ মানুষটি সাথে সাথে মারা যাবে। থাক আমিও তাই করলাম। বাবা সিগারেট খেতো আর ডায়াবেটিকস্‌ ছিল। তাই সিরিঞ্জ ও পেতে কষ্ট হয়নি। বাম হাতে নিলাম দুই জায়গায়। অজ্ঞান হয়ে পরি কিন্তু মরিনি। খুব চঞ্চল, দূরন্ত এই আমি হয়ে পরি নিরব। ৪-৫ মাস চলে যায় মেহেদীর সাথে কথা হয় না। আমি ফোন কিনি মেহেদীর জন্য। কারণ ওর প্রতি আমার অঘাত বিশ্বাস যে ও আমাকে অনেক ভালবাসে, একদিন ও আমাকে নিজে কল দিবেই। কিন্তু দেয় না। আমি প্রতিদিন ওকে অসংখ্য বার মেসেজ দিতাম কিন্তু কোন রিপ্লাই পেতাম না। দশম শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষা শেষ হল। বাবার তো ডায়াবেটিকস্‌ ছিল। বাবাকে জীবনের চাইতে বেশী ভালবাসতাম। সারাদিন বাবার পাশে থাকতাম আর আড়ালে গিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতাম। আমার বাবা ও একদিন হঠাৎ করে না ফেরার দেশে চলে যায়। আমি খুব একা হয়ে যাই। আল্লাহ যে আমার ভাগ্যটা কেন এমন ভাবে গড়লো জানি না। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি সবার কাছেই যেন বোঝা হয়ে যায়। আমি আমার বাবাকে প্রতিটি মুহূর্ত মিস করি। আর মেহেদী--------? একটা মানুষ কত চোখের জল ফেলতে পারে ?

মেহেদীকে আমি এখনো ভালবাসি। কিন্তু ওকে নিয়ে আর স্বপ্ন দেখিনা। ওর দেয়া সেই টাকাটা এখনো আমার সাথেই রাখি। আর রসায়ন বইটা ? যে পৃষ্ঠায় পাপড়ীটা ছিল ঐ পৃষ্ঠার সাথে মেহেদীর ছবি দুইটা রেখে খুব সুন্দর প্যাকেট করে রেখেছি। প্রথম একটা বছর বইটা বুকে নিয়ে ঘুমোতাম। এখন তুলে রেখেছি। আমি এখনো মেহেদীর বন্ধুদের ফোন দেই শুধু ওর জন্য। তাদের কাছে খুব ছোট হয় জেনেও ফোন দেই। একজনের ফোনে টাকাও ভরে দেই। কারণ আমার জন্য ওরা কেনই বা নিজের টাকা শুধু শুধু খরচ করবে। খুব অনুরোধ করে বলি, ভাইয়া মেহেদী কে কল দিয়ে দয়া করে একটু কনফারেন্স করেন। আমি কোন কথা বলব না .............. শুধু তার কন্ঠটা শুনতে চাই। কিন্তু তারা দেয় না। যখন কল দেই খুব ব্যস্ততা দেখায়, জানি ইগনোর করতেছে তবুও বার বার ........... মেহেদীর জন্য কল দেই। ওর কন্ঠটা শুনে রেখে দেই। আমার জীবনের এই গল্পটা লিখার মাঝেও কয়েকবার ওর কন্ঠটা শুনে নিয়েছিলাম। জানিনা ব্যস্ততার মাঝেও অনলাইনে থেকে ও আমার লিখাগুলো দেখছে কিনা। যদি দেখে থাক তবে তোমাকে বলছি। আমি তোমাকে এখনও অনেক ভালবাসি। আর তাইতো আমি সকল কষ্ট সহ্য করে এখনও তোমার স্মৃতিগুলোকে সঙ্গী করে তোমারি পথ চেয়ে আছি। তোমার জন্য আমি সব সহ্য করতে পারবো। তবুও বলি একটা মানুষ কত কষ্ট করতে পারে ? কত চোখের জল ফেলতে পারে ? আমার কষ্টটা একটু হলেও অনুভব করে দেখো।



লিখেছেনঃ মেহেদি জামান লিজন


বিষয়: সাহিত্য

২৭১২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

238147
২৪ জুন ২০১৪ রাত ১২:০৩
ভিশু লিখেছেন : ভালো গল্প...Thumbs Up Rose

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File