বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম
লিখেছেন লিখেছেন মেহেদী জামান লিজন ২২ মে, ২০১৪, ০৭:১৫:১৫ সকাল
বিদ্রোহী বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবিতাসমূহের একটি। এটি কাজী নজরুল ইসলাম বিরচিত। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে, বিজলী পত্রিকায়। এরপর প্রকাশিত হয় মাসিক প্রবাসী, মাসিক সাধনা এবং ধূমকেতু পত্রিকায়। প্রকাশিত হওয়া মাত্রই এটি ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি "চির উন্নত শির" বিরাজমান।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বাংলা ভাষার সবচেয়ে দাপুটে কবিতা হিসেবে নিজের শীর্ষ আসনটি ধরে রেখেছে প্রায় একশ’ বছর ধরে। এ সুদীর্ঘ সময়ে এর সমপর্যায়ের বা কাছাকাছি আর কোনো কবিতা রচিত হয়নি। এ অসাধারণ কবিতাটি শুধু যে নজরুলের শ্রেষ্ঠতম কবিতা তাই নয়, কেউ কেউ এটিকে বাংলা ভাষারও শ্রেষ্ঠতম কবিতা বলে মনে করে থাকেন। কেউ কেউ বলেছেন, ‘বিদ্রোহী’ গোটা বিশ্বেরই একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা।
বাংলা ভাষার সর্বাধিক আলোচিত ও পঠিত সাড়াজাগানো এ কবিতাটি নজরুল রচনা করেন বিশের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে, সৈনিক জীবন অবসানের পর।
হয়তো অনেক বাঁশিই ছোঁয়া হয়নি তাঁর! তবু যত সুরে তিনি বাজিয়েছেন তাঁর অন্তরের আকাঙ্ক্ষা, যত উচ্চারণে উচ্চকিত করেছেন নিজ-সত্তাকে—তার কতটুকুই বা ধরতে পেরেছে আজও এই বৃহত্ বঙ্গের মানুষ। তার রুদ্র-রূপ আমাদের এই মহা-ক্ষুদ্রতাকে আজও অবিরাম লজ্জা দিয়ে যায়। কোথায় সে বীর, যার শির দেখে হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া নত হয়ে গেল!
চির যৌবনের কবি, চির তারুণ্যের কবি, চির নবীনের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিস্ময় হয়ে জন্মেছিলেন এই বঙ্গে। বিশ শতকের বিশ্ব তাঁকে চেনেনি, একুশ শতকের বিশ্ব কি চিনে নেবে সেই বিস্ময়কে, যখন তাঁর ভাষা যারা বোঝে তারাও চিনতে পারেনি তাঁকে। তাই তিনি আজও ‘কবর সবর করিয়া’ আছেন—সেই যৌবনের প্রতীক্ষায়, সেই তারুণ্যের প্রতীক্ষায়, সেই নবীনের প্রতীক্ষায়—যারা তাজ-ব-তাজার গাহিয়া গান, সজীব করিবে মহাশ্মশান। নজরুলের ভাষায়—
শক্তি ভিক্ষা করিবে যাহারা ভোট-ভিক্ষুক তারা! চেনো কি—সূর্য-জ্যোতিরে লইয়া উনুন করেছে যারা? এই ধূর্ত বুদ্ধিজীবী, ‘ক্ষুদ্র’ও বটে, আর রাজনীতিক এদেশে ‘কচুরিপানা’র মতোই বিস্তারিত হয়েছে বিস্তর। এদের ঘেরাটোপের মধ্যে পুরোপুরি বন্দি হয়ে পড়েছে এদেশের যুব শক্তি।
মজলুমের ডাকে যারা সব পিছুটান-শৃঙ্খল ছিঁড়ে সুখ-শয্যা ত্যাগ করে ছুটে যায়, তারাই নজরুলের অভিধানে ‘অমর সেনা’। এই অমর সেনাদলের জন্যই নজরুল ‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন। নজরুল এই আত্মশক্তিতে বলীয়ান সেনাদলের হাতেই নিজের পতাকা তুলে দিতে চান। এদের সিপাহসালার হওয়াই তাঁর চিরকালের সাধনা। অতএব তিনি বলেন—
আমি গেলে যারা আমার পতাকা ধরিবে বিপুল বলে— সেই সে অগ্র-পথিকের দল এস এস পথ-তলে! সেদিন মৌন সমাধি-মগ্ন ইসরাফিলের বাঁশি বাজিয়া উঠিবে—টুটিবে দেশের তমসা সর্বনাশী!
এদেশের বুক থেকে ‘তমসা সর্বনাশী’কে বিদায় করতে হলে সেই অমর সেনাদল সৃষ্টি করতে হবে, যারা নজরুলের পতাকা ‘ধরিবে বিপুল বলে’। এই ‘আজাদ মুক্ত-স্বাধীন চিত্ত’ সেনাদল কে সৃষ্টি করবে? যারা আধিপত্যকামী, তারা? যারা ফ্যাসিবাদী, তারা? যারা ধূর্ত বুদ্ধিজীবী, তারা? যারা লোভী-ভোগী, তারা? অসম্ভব, এদের হাতে কখনোই সেই অমর সেনাদল সৃষ্টি হবে না। তাই ‘অজর অমর’ নজরুল ‘কবরে সবর করিয়া’ আছেন, ‘শান্ত অটল ধৈর্য লইয়া’ প্রতীক্ষা করে আছেন ভগবত্-শক্তিতে শক্তিমান, আল্লাহর শক্তিতে শক্তিমান সেই তরুণদের; যারা আপনিই আপনাকে সৃষ্টি করবে, ঐশী শক্তির কৃপা ভিক্ষা করে যারা নিজেরাই ঐশী শক্তির আধার হয়ে উঠবে—তারা অমর, তারা অজর, তারা অবিনাশী, তারা পুরুষোত্তম সত্য।
‘বল বীর
চির উন্নত মম শীর।’
মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহসী উচ্চারণে সূচনা করলেন বিদ্রোহের বাণী। তিনি আর কেউ নন। আমাদের প্রিয় কবি নজরুল ইসলাম। একজন কবির দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করে তার সমসাময়িক অবস্থা বা প্রেক্ষাপটের ওপর। কোন সচেতন শিল্পী তার সময় ও সমাজকে কখনোই অস্বীকার করতে পারেন না। কবি কাজী নজরুল ইসলামও তার ব্যতিক্রম নন। কাজী নজরুল ইসলাম দেশের এমন এক সংকটময় মুহূর্তে আবির্ভূত হয়েছেন; যখন মুক্তি সংগ্রামের স্লোগান আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। ফলে এ আন্দোলন সংগ্রামের প্রভাব পড়েছে তাঁর কাব্যে। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার নেশায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন উন্মাদ। দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে হয়েছেন মহা বিদ্রোহী। কিন্তু তারপরও মানব মনের চিরন্তণ প্রেমের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে তাঁর কাব্যে। কখনো তাঁর বিদ্রোহের মাঝে প্রেম; আবার কখনো প্রেমের মাঝে বিদ্রোহ। দু’টোই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়েছিল প্রিয়তমার মতো।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বমহিমায় বাংলা সাহিত্যে চির ভাস্বর হয়ে আছেন। তাঁর ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ঘুমভাঙার গান’, ‘ফণিমনসা’, ‘সর্বহারা’, ‘জিঞ্জির’, ‘সন্ধ্যা’, ‘প্রলয় শিখা’, ‘সাম্যবাদী’ ইত্যাদি কাব্যের মাধ্যমে তিনি জাগরণের গান শুনিয়েছেন মানুষকে। জাতির বন্দীত্ব মোচনের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ছিল অকৃত্রিম। তিনি বিক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন-
‘লাথি মার ভাঙরে তালা,
যতসব বন্দীশালা,
আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা।’
তাঁর এ বিদ্রোহ অনাসৃষ্টির জন্য নয়। পুরাতনকে ভেঙে নতুন করে গড়ার বিদ্রোহ। দেশ-জাতি-সমাজকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর বিদ্রোহ শাসক যাজক ও সমাজপতিদের বিরুদ্ধে। তার এ বিদ্রোহ নিরন্তর। যতদিন না এর কোন প্রতিকার হবে। তাইতো তিনি বলেছেন-
‘মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত।
আমি সেই দিন হব শান্ত।’
নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পর কবির এ বিদ্রোহ সমাপ্ত হয়ে যাবে। বাস্তবিক অর্থে মানুষকে কতটা ভালোবাসলে এমন বিদ্রোহী হয়ে ওঠা যায়?
নিঃসন্দেহে কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্যই তিনি আজ সর্বত্র ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসাবে সমাদৃত। বিদ্রোহী অভিধায় অভিসিক্ত হলেও কাজী নজরুল ইসলাম একজন খাঁটি প্রেমিক। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য কারাবরণ করলেও প্রেমের মহিমার ক্ষেত্রে আরো বেশি সমুজ্জ্বল তিনি। অন্তরে প্রেম না থাকলে কখনো এমন বিদ্রোহ আসেনা। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য’- এ যেন কবি নজরুলের অন্তরের কথা। এছাড়া নারীর প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গানে ও কবিতায়। নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন তিনি। নারীকে যথাযথ মর্যাদা দিতে গিয়ে কবি বলেছেন-
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ কথা আমরা কখনোই অস্বীকার করতে পারি না।
‘আলগা করো গো খোপার বাঁধন’ কিংবা ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল’- এধরণের গানে তার অপার্থিব প্রেমের উৎসরণ লক্ষ্য করা যায়। এ ক্ষেত্রে তাঁকে প্রেমিক কবি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও অত্যুক্তি করা হবে না। বিদ্রোহী রূপের আড়ালে তাঁর চিরায়ত কামনা-বাসনা-প্রেমকে ঢেকে রাখার সাধ্য আছে কার?
নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে
বিষয়: Contest_father
৩০৬১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নজরুল এই বাংলার তরুনদের যে আহব্বান জানিয়েছিলেন তা এখনও আমরা বুঝিনি।
এখনও যতবার পড়ি ততবারই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন