সাম্প্রদায়িকতা নয়, অসহিষ্ণুতাই নিন্দনীয়
লিখেছেন লিখেছেন খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ০৮ মে, ২০১৬, ০৪:৩৭:৫০ রাত
সাম্প্রদায়িকতা নয়, অসহিষ্ণুতাই নিন্দনীয়
সম্প্রদায় থেকে সাম্প্রদায়িকতা। সম্প্রদায় মানে জাতি, গোষ্ঠী। জাতি সেটা ভাষাভিত্তিক হতে পারে, অঞ্চল বা ভৌগোলিক ভিত্তিতেও হতে পারে আবার ধর্মভিত্তিকও হতে পারে। যেমন আমরা ভাষার দিক দিয়ে বাঙালি সম্প্রদায় আর অঞ্চলের হিসেবে আমরা বাংলাদেশী সম্প্রদায়। ধর্মের ভিত্তিতে সারা বিশ্বের মুসলমানরা মুসলিম সম্প্রদায়। একইভাবে সারা বিশ্বের হিন্দুরা হিন্দু সম্প্রদায় আর সারা বিশ্বের বৌদ্ধরা বৌদ্ধ সম্প্রদায়। সব জাতি বা সম্প্রদায়ই তাদের আলাদা পরিচয় সবার সামনে তুলে ধরতে চায়। তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে চায়। তাদের স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রাখতে চায় সবখানে। তাদের আলাদা পরিচয় এবং স্বাতন্ত্র্যকে মুছে দিতে বা বিলীন করে দিতে কেউ কখনও চায় না। বরং প্রত্যেকেই তার জাতিগত বা সম্প্রদায়গত অন্যকথায় সাম্প্রদায়িক পরিচয় সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করে। জাতিগত পরিচয় তুলে ধরাটা সংস্কৃতি চর্চারই অংশ বলে মনে করা হয়। প্রত্যেক গোষ্ঠীর এই আলাদা স্বকীয়তা আর সাতন্ত্র্য সংক্ষেপে বলা হয় সাম্প্রদায়িকতা। যদিও আজকাল এই সংজ্ঞাতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছুটা পরিবর্তন আনা হচ্ছে এবং শব্দটা আসলে খারাপ না হলেও খারাপভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। শিশুর জন্মের পর প্রথমেই নাম রাখা দিয়েই তার আলাদা পরিচয়ের গুরুত্বের ব্যাপারটা শুরু হয়। এই নামের মধ্যে তার আলাদা পরিচয় প্রকাশ পায়। নিজেকে আলাদা প্রকাশ করার মানসিকতা প্রত্যেক শিশুর মধ্যেই থাকে। তাই শিশু লালন-পালনের নিয়মের মধ্যে শিশুকে তার আলাদা একটা গুরুত্বের প্রতি সমর্থন এবং তাকে প্রকাশ হওয়ার সুযোগ দেয়ার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। ব্যক্তি পর্যায়েও দেখা যায় মানুষ নিজের স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। ছেলেকে মেয়ে ডাকলে সে রাগ করে। আবার মেয়েকে ছেলে ডাকলেও সে রাগ করে। আবার কোনো কোনো বংশের পরিচয়টা মানুষ অন্যের কাছে গর্ব সহকারে তুলে ধরতে পছন্দ করে। যেমন খান বংশ, চৌধুরী বংশ ইত্যাদি। মানুষ যে ধর্মেই বিশ্বাসী হোক না কেন, তাকে অন্য ধর্মাবলম্বী বলে আখ্যায়িত করলে সে নারাজ হয়। মুসলমানকে হিন্দু ডাকলে অপছন্দ করে। একইভাবে হিন্দুকে মুসলমান ডাকলেও সে রাগ করে। প্রত্যেকে চায় তার আলাদা সাম্প্রদায়িক পরিচয়টা বজায় থাক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপজাতিদের বাঙালি হয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু উপজাতিরা তা গ্রহণ করেনি, বরং অপছন্দ করেছে। কারণ, তারা তাদের নিজেদের আলাদা সম্প্রদায় হিসেবেই টিকিয়ে রাখতে চায়। তারা তাদের আলাদা সাম্প্রদায়িক পরিচয় মুছে দিয়ে বাঙালি হয়ে যায়নি। এখনও তারা বাংলাদেশী হয়েও বাঙালি সংস্কৃতিকে বা বাংলাদেশী সংস্কৃতিকে আপন করে নিতে পারেনি। তাদের মেলা-মজলিস বা পূজা-পার্বণের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এখনও পাহাড়ি সংস্কৃতিই ফুঠে ওঠে। আর পাহাড়ি সংস্কৃতিকেই তারা নিজেদের সংস্কৃতি মনে করে। মানুষের আলাদা পরিচয়, আলাদা সামাজিক মর্যাদা, স্বতন্ত্র ধর্মীয় পরিচয়, আলাদা ভৌগোলিক পরিচিতি, এ সবকিছুই সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। একে হাজার চেষ্টা করেও মিটিয়ে দেয়া যাবে না। যারা অসাম্প্রদায়িক স্লোগান তোলেন তারাও রাজি হবেন না তাদের আলাদা পরিচয় মুছে দিতে। নিজেদের আলাদা পরিচয় তুলে ধরাতে দোষেরও কিছু নেই। আল্ল¬াহ তায়ালা সৃষ্টিগতভাবেই এসব বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে রেখেছেন। তাই এটা জোর করে ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে এটাকে খারাপ পথে ব্যবহার করা রোধ করা যেতে পারে। সাম্প্রদায়িক হলে সমস্যা নেই, তবে পরমতসহিষ্ণু হতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা দোষের নয় বরং পরমত-অসহিষ্ণুতাই দোষের। মানুষের মধ্যে সামাজিকভাবে আলাদা পরিচয়ের ব্যাপারটা আল্লাহ তায়ালারই সৃষ্টি। তিনি কোরআনে বলেছেন, ‘ওহে মানবজাতি! নিঃসন্দেহে আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি পুরুষ ও নারী থেকে, আর আমরা তোমাদের বানিয়েছি নানান জাতি ও গোত্র যেন তোমরা চিনতে পার।’ (সূরা হুজুরাত-১৩) এতে বোঝা যায়, মানবজাতির মধ্যে আলাদা সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। এটা মানুষের বানানো বিষয় নয়। তাই মানুষ চাইলেও মানবজাতির আলাদা সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচিতিকে মুছে দিতে পারবে না। মানুষ হাজার চেষ্টা করলেও প্রকৃতি পাল্টে দিতে পারে না। আর অসম্ভবের চেষ্টা বিফল হয়। তাই যারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাদের উচিত সাম্প্রদায়িকতা নয় অসহিষ্ণুতার বিপক্ষে জনমত গঠন করা। তাদের এভাবে বলা উচিত যে সাম্প্রদায়িক হোন কোনো সমস্যা নেই, তবে পরমতসহিষ্ণু হতে হবে। এই সামাজিক আলাদা পরিচিতির জন্য মানুষ দুনিয়াতে মর্যাদা পেতে পারে, তবে আখেরাতে এর জন্য কোনো মর্যাদা নেই। আখেরাতে শুধু আমলের কারণেই মানুষ মর্যাদাবান হতে পারে। একই আয়াতে আল্ল¬াহ্ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেজগার।’ প্রত্যেক ব্যক্তি, সমাজ এবং জাতি যেভাবে নিজেদের আলাদা স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য ও আলাদা পরিচিতি টিকিয়ে রাখতে চায়, ঠিক সেভাবে অন্যের আলাদা স্বকীয়তা, আলাদা পরিচিতি, মানসম্মান মর্যাদাকে স্বীকার করে নেয়াটাও যুক্তিসঙ্গত এবং বিশ্বশান্তির জন্য অপরিহার্য। মেনে নিতে হবে অন্যের আলাদা অস্তিত্বকে। নিজের মতামত অন্যের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া যাবে না। মানুষ নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা অন্যের জন্যও পছন্দ করতে হবে। অন্যের মতকে সহ্য করতে হবে। এটাই পরমতসহিষ্ণুতা। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে মহান সত্তার কুদরতি হাতে আমার জীবন তারই শপথ করে বলছি- কোনো ব্যক্তি মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করবে, নিজের ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করবে।’ (বোখারি, মুসলিম) আর বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায় মুসলিম জাতি অন্যান্য জাতির তুলনায় অনেক বেশি সহিষ্ণু। ভারতে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের দ্বারা সংখ্যালঘু মুসলমানদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ভূরিভূরি আছে। এমনকি খোদ হিন্দুদের মধ্যেই নিম্নবর্ণ আর উচ্চবর্ণের ভেদাভেদের কারণে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কথা প্রায়ই শোনা যায়। আর অন্যদিকে মুসলমানদের নিজেদের জানপ্রাণ দিয়ে অমুসলিমদের জানমাল রক্ষা করার ঘটনা ইতিহাসে অনেক আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সম্প্রদায় আর সাম্প্রদায়িক শব্দগুলোকে আজকাল ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ইসলাম আর মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক বলে প্রচার করা হচ্ছে। এই ভুল প্রচারে অংশ নিচ্ছে সুশীল নামধারী একটি গোষ্ঠী, আর ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়া। বাস্তবতার সঙ্গে যার দূরতম সম্পর্কও নেই। এই বিষয়ে শাহ আবদুল হান্নানের একটি লেখার কিছু অংশ তুলে ধরা সঙ্গত মনে করছি যা ১০ অক্টোবর ২০১২ তারিখে দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন : ‘সমাজতত্ত্বে বা সোশ্যিওলজিতে সম্প্রদায় (কমিউনিটি, সোসাইটি) একটি পজিটিভ পরিভাষা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। সমাজতত্ত্বে এটা কোনো নিন্দনীয় পরিভাষা নয়। সমাজে সম্প্রদায় থাকবে। সব সম্প্রদায়ের অধিকার রয়েছে তার বিশ্বাস মোতাবেক চলার এবং কর্মসূচি নেয়ার। মুসলিম সমাজ বা সম্প্রদায়েরও একই অধিকার। ইসলাম একই সঙ্গে একটি ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা। তাই মুসলমানরা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে তাদের ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র গঠন করার সব ধরনের চেষ্টা করা তাদের অধিকার। এটাকে সাম্প্রদায়িক চেতনা বলে নিন্দা করা যায় না। অসাম্প্রদায়িক অর্থ যার কোনো সম্প্রদায় নেই। তার মানে তার কোনো আদর্শ ও নীতিবোধ নেই। এ ধরনের নীতিহীনতা ও নীতিহীন লোক দিয়ে কোনো কল্যাণ হতে পারে না।’ সম্প্রদায় আর সাম্প্রদায়িক শব্দের অর্থ যেটাই করা হোক না কেন, ইসলাম সব ধর্মের সহাবস্থান এবং পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘এক আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য দেবদেবীর উপাসনা যারা করে, তাদের উপাস্যদের তোমরা গালি দিও না।’ (সূরা আনআম-১০) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল¬াম ঘোষণা করেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি জুলুম করে তাহলে আমি কিয়ামতের ময়দানে সেই মুসলিমের বিরুদ্ধে অমুসলিমের পক্ষে আল্লাহর আদালতে মামলা দায়ের করব’ (আবু দাউদ)। এরকম স্পষ্ট ঘোষণার পরও ইসলাম আর মুসলমানদের অসহিষ্ণু হিসেবে প্রচার করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং জ্বলজ্যান্ত মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যদি কেউ মুসলমান হয়েও অসহিষ্ণু আচরণ করে তাহলে সে নিজে দোষী হবে কিন্তু ইসলামকে এবং পুরো মুসলমান জাতিকে এর জন্য দোষারোপ করা যুক্তিসঙ্গত নয়। লেখক: কাতার প্রবাসী
দৈনিক ইনকিলাব
বিষয়: বিবিধ
১৪৭৮ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সমস্যাটি সেখানেই। আর যারা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক দাবি করে তারাই এই অসহিস্ঞুতার সৃষ্টি করে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন