ঈদ মোবারক, প্রবাসের ঈদ

লিখেছেন লিখেছেন খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ৩০ জুলাই, ২০১৪, ০১:৪৬:৩৭ রাত

মধ্যপ্রাচ্যের কথাই বলছি

ঈদের আগের দিনগুলোতে এখানে বাজার সদায় করার কোনো রকমের ধুম পড়ে না। এখানে এদেশের মানুষের কাছেই শুধু ঈদ আসে। আমাদের কাছে আসে না। আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবে একপ্রকার নিজের অজান্তেই ঈদের তারিখটা শুধু আসে। যারা দোকানে কাজ করে তাদের জন্য এই রাতে কিছুটা বাড়তি সময় দোকানে থাকতে হয়, আর সকালে ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে হয়, এই ছাড়া অন্য কোনোভাবেই ঈদের লক্ষণ তাদের কাছে প্রকাশ পায় না।

আমানের কাছে ঈদ কেমন তা তার মুখেই শোনা যাক। রমজানের শুরুতেই রমজানে মাসের জন্য খরচটা দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। এবার ঈদের খচর পাঠানোর পালা। মাস ফুরাতে আরো দেরি আছে। তত দিন বসে থাকা যাবে না। তার আগেই ঈদের খরচ দেশে পাঠাতে হবে। কফিলের কাছে যদি বলি, হয়ত এ মাসের বেতনটা মাস ফুরানোর আগেই দিয়ে দিতে পারে। বোনাস তো দেবে না সেটা জানা কথা। অন্তত বেতনটাও যদি ক দিন আগে পাই, তাহলে দেশের আত্মীয়স্বজন ঠিকঠাক মত ঈদের বাজার করতে পারবে। গেলাম কফিলের কাছে। সালাম দিয়ে অনেক বুঝিয়ে বললাম যে এমাসের বেতনটা আমাকে একটু আগেই দিয়ে দিন। বাড়িতে ঈদের খরচের টাকা ক দিন আগেই পাঠাতে হবে। তিনি বললেন এক দিন আগেও বেতন দেয়া যাবে না।

এ দিকে টাকা পাঠাতে দেরি হলে দেশে বাজার করা খুব কষ্ট হয়ে যাবে। তাই বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে ধারকর্জ করেই দেশে টাকা পাঠিয়ে দিলাম। রমজানে আর ঈদে কিছু বাড়তি খরচ আছে। তাই নিজের জন্য একটি টাকাও না রেখে আরো কিছু কর্জ করে সব টাকাই পাঠিয়ে দিলাম।

চাঁদরাতে অনেকক্ষণ দোকানে থাকতে হয়েছে আমাকে। তাই রুমে ফিরতে প্রায় তিনটা বেজে গেল। একারণে যারা আগের নিয়মে ঘুমিয়ে আছে তাদের ঘুম ভাঙ্গল বাতির আলোর কারণে। একপ্রকার বিরক্তি সহকারে দুই একজন চিল্লায় উঠলো 'বাতি দিয়েছে কেরে?' পরক্ষণেই যখন তাদেরকে মনে করিয়ে দিলাম যে আজ ঈদ। উঠে গোসল সেরে নাও, তখন তারাও বুঝতে পারলো যে এই সময় ঘুম ভাঙ্গা আসলেই দরকার ছিল। কারণ ঈদের জামাত হবে সূর্য উঠার পনের মিনিটের মাথায়। এখনই গোসলটা সেরে না নিলে হয়ত ঈদের জামাতই পাওয়া যাবে না। তাই সবাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গেল। তবুও আমি সবার আগে গোসল খানায় ঢুকতে পারিনি। সুযোগ বুঝে একজন সেখানে ঢুকে গেছে এরই মধ্যে। তাকে আমিসহ আরো পাঁচ ছয় জন বারবার তাদিগ দিচ্ছি তাড়াতাড়ি করেন, সবাই গোসল করবে। সে ভিতর থেকে কয়েকবার বলেছে এই তো হয়ে গেছে বের হচ্ছি।

গোসল সেরে তাড়াতাড়ি রাতের বাসি ভাত তরকারি অল্প খেয়ে ছেড়া গেঞ্জি আর পুরানো পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে ছুটলাম ঈদের নামাজের জন্য। ঈদগাহ থেকে তাকবীরের আওয়াজ আসছে মাইকে ভেসে। আমি ঈদগাহে পৌঁছার কয়েক মিনিট পরই ঈদের জামাত শুরু হলো। নামাজের পরে দেশের আত্মীয়স্বজনদের জন্য দোয়া করলাম। বিশেষ করে মরহুম আব্বা জানের জন্য খুব দোয়া করলাম। ঈদের সময় বাবার কথা খুব বেশি মনে পড়ে। দেশে থাকতে বাবা ঈদের সময় আমাদের জন্য কত কষ্ট করে জামা কাপড় জোগাড় করতেন তা চোখের সামনে ভেসে উঠে।

নামাজ শেষে রুমে এসে ঘুমাব বলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কাঁথামুড়ি দিয়ে ভাবলাম আগে একটু দেশে কথা বলা দরকার। মোবাইলটা হাতে তুলে নিলাম। কয়েকবার চেষ্টা করে লাইন পেলাম। আসসালামু আলাইকুম। আম্মা কেমন আছ?

ওয়ালাইকুমুস সালাম ভাল আছি বাবা, তুই কেমন আছিস?

ভাল আছি আম্মা, তোমাদের দোয়াই খুব ভাল আছি।

ঈদের নতুন জামা কাপড় পরেছিস তো বাবা? ফিরনি সেমাই খেয়েছিস?

জি আম্মা, নতুন জামা কাপড়ও পরেছি, ফিরনি সেমাইও খেয়েছি।

এখন কি করছিস বাবা? বন্ধু বান্ধবদের ওখানে বেড়াতে বের হস নি?

জি আম্মা। এখন বন্ধু বান্ধবদের ওখানে বেড়াচ্ছি। মজার মজার অনেক খানা খাচ্ছি।

আমার ভারি কণ্ঠ মায়ের কাছে গোপন থাকে না। তিনি বললেন কি হয়েছে বাবা তোর। তুই কাঁদছিস কেন? তার কণ্ঠও ভারি শোনালো।

না মা কাঁদছি না। তোমরা নতুন কাপড় পরেছ তো?

আমরা তো পরেছি। তুই কাঁদছিস কেন বাবা আজকের এই ঈদের দিনে? আম্মাও কেঁদে ফেললেন।

না মা কাঁদছি না। এখন রাখি আমি, আবার একটু পরে কল দেব। মোবাইলটা রেখে কম্বলের ভিতরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। সারা বছরের কান্না যেন আজকেই সব চলে আসছে চোখে। আমি আজ কোথায় পড়ে আছি? এরকম ঈদের দিনে যদি দেশে থাকতাম ছেলে মেয়েদের হাসি খুশি মুখটা দেখে অন্তরটা ভরে যেতো। ঈদের নামাজ পড়ে মা কে সালাম করতাম। তিনি আমার জন্য দোয়া করতেন। আজ আমি পড়ে আছি অনেক দূরে। আমার ঈদ কেমন কাটছে কেও দেখছে না। এইসব যতই ভাবছি কান্নার গতি ততই বাড়ছে। প্রথম যখন বিদেশে এসেছিলাম, তখনো এরকম কেঁদেছিলাম। প্রথম ছয় মাস কেটেছিল শুধু কেঁদে কেঁদে। আজ ঈদের দিনে কেন বেশি কান্না আসছে? এই ঈদের সময় দেশে থাকলে আজ কত আনন্দ কত মজা করতাম সেটা ভেবেই বেশি কান্না পাচ্ছে। অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে আবার মোবাইলটা হাতে নিলাম। স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলতে হবে।

ওপাশ থেকে আমার স্ত্রী সালাম দিলো।

বললাম, ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছ তোমরা? বাচ্চারা কেমন আছে?

আমরা সবাই ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?

আমিও ভাল আছি। নতুন শাড়ি পরেছ? বাচ্চারা নতুন জামা কাপড় পরেছে?

সবাই পরেছে।

তুমি পরনি?

আমার কথা বলে লাভ আছে? আমি নতুন শাড়ি পরলেও কি আর না পরলেও কি?

কেন কি হয়েছে?

না থাক। বলে আর কী হবে?

থাকবে কেন? কি হয়েছে বলো।

কি আর হবে? সবাই যার যার পছন্দের শাড়ি কিনেছে। আর আমার জন্য তোমার মা কিনেছে একটা কম দামের শাড়ি। সবাই বলছে এটা কি ডুবাই ওয়ালার বউয়ের জন্য উপযুক্ত শাড়ি হলো?

শাড়ির দাম কত?

মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। ভাবলাম পাঁচ হাজার টাকার শাড়ি বউয়ের পছন্দ হচ্ছে না। কত কষ্ট করে এখানে টাকা রোজগার করছি তা যদি তারা জানতো।

স্ত্রী বললেন, কি হলো কিছু বলছ না যে?

না ভাবছিলাম। তোমার জন্য একটা ভাল শাড়ি ক দিন পরেই কেনার ব্যবস্থা করব। তুমি নিজেই দেখে তোমার পছন্দ মত কিনে নিবে, ঠিক আছে? আমি এখন রাখি। কিছুক্ষণ পরে বাচ্চাদের সাথে কথা বলব।

এখন রাখছ কেন? এখনই বল।

না, এখন বলব না। এখন মনে একটু খারাপ লাগছে। পরে আবার কল দেব। বাচ্চাদেরকে দূরে যেতে দিও না।

ফোন রেখে ভাবলাম। হায়রে কপাল। পাঁচ হাজার টাকার শাড়ি বউয়ের পছন্দ হচ্ছে না। এত কষ্ট করে এখানে রোজগার করছি। তারপরেও যদি স্ত্রীর কাছ থেকে একটু শুকরিয়ার শব্দ শোনতে না পাই, তাহলে কেমন লাগে? মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

স্ত্রী যদি বলতো যা পেয়েছি আলহামদু লিল্লাহ। তুমি কত কষ্ট করে বিদেশে রোজগার করছ তাওতো আমাদেরকে বুঝতে হবে। তাহলে মনটা খুশিতে ভরে যেতো। এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

বিষয়: বিবিধ

১২৮৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

249412
৩০ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৫:৪৯
কাজি সাকিব লিখেছেন : আল্লাহ আপনাদের কষ্টের উত্তম যাজাহ দি
৩০ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৬:২০
193779
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : আমীন
249421
৩০ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৭:১২
মোহাম্মদ নূর উদ্দীন লিখেছেন : ইতা কি গল্পনি, নাকি হাছা কতা প্রবাসি ভাই ? ভাল থাকুন । ঈদ মুবারক ।
৩০ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৭:২৬
193780
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : বাস্তব।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File