ঈদ মোবারক, মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের নিরানন্দ ঈদ

লিখেছেন লিখেছেন খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ২৮ জুলাই, ২০১৪, ০১:১০:২৮ দুপুর



মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৫০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করে। তাদের মধ্যে অধিকাংশই তিন বছর বা দুই বছরের মাথায় বাড়ী যাওয়ার সুযোগ পায়। এই দীর্ঘ সময় দেশ ও দেশের আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে থাকা কতটা কষ্টের তা একমাত্র ভুক্তভুগি ছাড়া আর কেও বুঝবে না। মোবাইল আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে আগের চেয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হলেও দেশের আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেশে থাকার ইচ্ছা, তাদের সাথে ঈদ করার আকুতি এবং তাদের থেকে দূরে থাকার কষ্ট প্রবাসীদের অন্তরে বিন্দুমাত্রও কমে না।

বছরের পর বছর আপনজনদের কাছ থেকে অনেক দূরে প্রচণ্ড গরম ও কনকনে শীতের মধ্যে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যায় তারা শুধু দেশের আপনজনদের মুখে একটু হাসি ফুটানোর জন্য। নিজের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়গুলো তারা উৎসর্গ করে দেয় আপনজনদের জন্য। দূর দেশে থেকেও তাদের মন পড়ে থাকে সেই মাতৃভূমিতে, যেখানে রয়েছে তার মাথার তাজ বাবা মা ও প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ছেলে মেয়ে ও আত্মীয়স্বজন। প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ে তাদের কথা। কখন দুটা টাকা নিয়ে দেশে গিয়ে আপনজনদের মুখের হাসি দেখবে সেই প্রতীক্ষায় কেটে যায় দিন মাস বছর। প্রতিটি সেকেন্ড এখানে কাটে ঘণ্টার মত, আর প্রতি ঘণ্টা কাটে দিনের মত আর প্রতি দিন কাটে যেন দীর্ঘ একেকটা বছরের মত। দিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষে যখন রাতে ঘুমাতে যায় তখন আবার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠে আত্মীয়স্বজনের মুখ। কখন দেশে যাবে, স্ত্রী সন্তান বাবা মার মুখ দেখবে এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়া যেন প্রতিদিনের রুটিন।

এখানে জীবন মানে রাত দিনের নিরানন্দ চক্র। যেখানে হাসি খুশির কোনো স্থান নাই। একই রকম কাজ আর একই রকমের নিয়মে ধরাবাঁধা জীবনচক্র যেন আর শেষ হতে চায় না। এক ঘেয়েমী কাটানোর জন্য কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ নাই। বাৎসরিক আনন্দ উৎসব ঈদ পরবের দিনগুলো এখানে প্রবাসীদের মনে সামান্যতম আনন্দের দোলাও দিতে পারে না। বরং এখানে ঈদ আসে বেদনার ক্ষত চিহ্নতে নতুন করে আরো একটু লবণের ছিটা দেয়ার জন্য। এই দিনগুলোতে মনের ভিতরের জমে থাকা কষ্টগুলো আবার জীবন্ত হয়ে যায়। এখানে ঈদ মানে চোখের পানি। ঈদ মানে বেদনার ক্ষত নতুন করে তাজা হয়ে উঠা।

দেশের আত্মীয়স্বজনেরা অনেক সময় জানতে চায় প্রবাসীদের ঈদ কেমন কাটে? তারা কি চাঁদরাতে বা তার আরো আগে থেকে ঈদের বাজার করতে মার্কেটে যায়? ঈদের দিন নতুন জামা পড়ে ঘুরে বেড়ায়? একে অন্যের কাছে গিয়ে ফিরনি সেমাই খায়? এইসব বিষয়ে জানার আগ্রহ থাকে দেশের অনেক মানুষের মধ্যে। তাই মধ্যপ্রাচ্যে বাঙালিদের ঈদ কেমন কাটে তার সামান্য ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করছি।

এখানে ঈদটা একেক জনের কাছে একেক রকম। অল্প কিছু মানুষের কাছে এখানে ঈদ আনন্দের হলেও অধিকাংশ প্রবাসীর কাছে ঈদ মানেই কান্না। সারা বছরের জমিয়ে রাখা কান্নার বাঁধভাঙ্গা স্রোত যেন ঈদের দিন আর কোনো বাঁধা মানতে চায় না। দু চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে বিরহের অশ্রু। বুকে চেপে বসে কষ্টের হিমালয়। কান্নার গতি যেন থামতেই চাই না। জোর করে থামাতে চাইলে গলায় কিছু একটা এসে আঁটকে থাকে। খানা খেতে বসলে চোখের পানি ঝরে পাড়ে ভাতের উপর। হায়রে কপাল, আমি আজ কোথায়? কোথায় আমার ছেলে মেয়ে? কোথায় আমার বাবা মা? কোথায় প্রাণপ্রিয় স্ত্রী? তারা কি নতুন জামা কাপড় কিনেছে? ফিরনি সেমাই রান্না করেছে তো? আমার কথা কি তারা স্মরণ করছে? আমার অনুপস্থিতি তাদের কাছেও কি কষ্টের? এইসব ভাবতে ভাবতে ভেজা চোখেই ঈদের দিনটা শেষ হয়। পর দিন কারো ছুটি আছে আর কারো নাই। আবার শুরু হল হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। উদ্দেশ্য আমার কষ্ট হলেও আমার আত্মীয়স্বজন যেন একটু সুখ পায়। বাবাকে যেন আর কষ্ট করতে না হয়। স্ত্রী যেন সুন্দর একটি শাড়ি পরতে পারে। আর আমার ছেলে মেয়েরা যেন স্কুলের বই খাতা কলম ঠিকমত পায়। পাশের বাড়ীর ছোট ছেলে মেয়ের হাতে সুন্দর খেলনা দেখে আমার সন্তানেরা যেন মনে কষ্ট না পায়। কয়েক বছর পরে বাড়িতে এসে যেন সবাইকে নিয়ে একটু সুখে থাকতে পারি। তাই আমার জীবনের কয়েকটা বছর আত্মীয়স্বজনদের জন্য যেন উৎসর্গ করে দিলাম। নিজের সুখ ত্যাগ করলাম স্বজনদের সুখের জন্য। এটাই প্রবাস। এটাই নিয়তি।

ঈদের আগের দিনগুলোতে এখানে বাজার সদায় করার কোনো রকমের ধুম পড়ে না। এখানে এদেশের মানুষের কাছেই শুধু ঈদ আসে। আমাদের কাছে আসে না। আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবে একপ্রকার নিজের অজান্তেই ঈদের তারিখটা শুধু আসে। যারা দোকানে কাজ করে তাদের জন্য এই রাতে কিছুটা বাড়তি সময় দোকানে থাকতে হয়, আর সকালে ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে হয়, এই ছাড়া অন্য কোনোভাবেই ঈদের লক্ষণ তাদের কাছে প্রকাশ পায় না।

আমানের কাছে ঈদ কেমন তা তার মুখেই শোনা যাক। রমজানের শুরুতেই রমজানে মাসের জন্য খরচটা দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। এবার ঈদের খচর পাঠানোর পালা। মাস ফুরাতে আরো দেরি আছে। তত দিন বসে থাকা যাবে না। তার আগেই ঈদের খরচ দেশে পাঠাতে হবে। কফিলের কাছে যদি বলি, হয়ত এ মাসের বেতনটা মাস ফুরানোর আগেই দিয়ে দিতে পারে। বোনাস তো দেবে না সেটা জানা কথা। অন্তত বেতনটাও যদি ক দিন আগে পাই, তাহলে দেশের আত্মীয়স্বজন ঠিকঠাক মত ঈদের বাজার করতে পারবে। গেলাম কফিলের কাছে। সালাম দিয়ে অনেক বুঝিয়ে বললাম যে এমাসের বেতনটা আমাকে একটু আগেই দিয়ে দিন। বাড়িতে ঈদের খরচের টাকা ক দিন আগেই পাঠাতে হবে। তিনি বললেন এক দিন আগেও বেতন দেয়া যাবে না।

এ দিকে টাকা পাঠাতে দেরি হলে দেশে বাজার করা খুব কষ্ট হয়ে যাবে। তাই বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে ধারকর্জ করেই দেশে টাকা পাঠিয়ে দিলাম। রমজানে আর ঈদে কিছু বাড়তি খরচ আছে। তাই নিজের জন্য একটি টাকাও না রেখে আরো কিছু কর্জ করে সব টাকাই পাঠিয়ে দিলাম।

চাঁদরাতে অনেকক্ষণ দোকানে থাকতে হয়েছে আমাকে। তাই রুমে ফিরতে প্রায় তিনটা বেজে গেল। একারণে যারা আগের নিয়মে ঘুমিয়ে আছে তাদের ঘুম ভাঙ্গল বাতির আলোর কারণে। একপ্রকার বিরক্তি সহকারে দুই একজন চিল্লায় উঠলো 'বাতি দিয়েছে কেরে?' পরক্ষণেই যখন তাদেরকে মনে করিয়ে দিলাম যে আজ ঈদ। উঠে গোসল সেরে নাও, তখন তারাও বুঝতে পারলো যে এই সময় ঘুম ভাঙ্গা আসলেই দরকার ছিল। কারণ ঈদের জামাত হবে সূর্য উঠার পনের মিনিটের মাথায়। এখনই গোসলটা সেরে না নিলে হয়ত ঈদের জামাতই পাওয়া যাবে না। তাই সবাই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গেল। তবুও আমি সবার আগে গোসল খানায় ঢুকতে পারিনি। সুযোগ বুঝে একজন সেখানে ঢুকে গেছে এরই মধ্যে। তাকে আমিসহ আরো পাঁচ ছয় জন বারবার তাদিগ দিচ্ছি তাড়াতাড়ি করেন, সবাই গোসল করবে। সে ভিতর থেকে কয়েকবার বলেছে এই তো হয়ে গেছে বের হচ্ছি।

গোসল সেরে তাড়াতাড়ি রাতের বাসি ভাত তরকারি অল্প খেয়ে ছেড়া গেঞ্জি আর পুরানো পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে ছুটলাম ঈদের নামাজের জন্য। ঈদগাহ থেকে তাকবীরের আওয়াজ আসছে মাইকে ভেসে। আমি ঈদগাহে পৌঁছার কয়েক মিনিট পরই ঈদের জামাত শুরু হলো। নামাজের পরে দেশের আত্মীয়স্বজনদের জন্য দোয়া করলাম। বিশেষ করে মরহুম আব্বা জানের জন্য খুব দোয়া করলাম। ঈদের সময় বাবার কথা খুব বেশি মনে পড়ে। দেশে থাকতে বাবা ঈদের সময় আমাদের জন্য কত কষ্ট করে জামা কাপড় জোগাড় করতেন তা চোখের সামনে ভেসে উঠে।

নামাজ শেষে রুমে এসে ঘুমাব বলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কাঁথামুড়ি দিয়ে ভাবলাম আগে একটু দেশে কথা বলা দরকার। মোবাইলটা হাতে তুলে নিলাম। কয়েকবার চেষ্টা করে লাইন পেলাম। আসসালামু আলাইকুম। আম্মা কেমন আছ?

ওয়ালাইকুমুস সালাম ভাল আছি বাবা, তুই কেমন আছিস?

ভাল আছি আম্মা, তোমাদের দোয়াই খুব ভাল আছি।

ঈদের নতুন জামা কাপড় পরেছিস তো বাবা? ফিরনি সেমাই খেয়েছিস?

জি আম্মা, নতুন জামা কাপড়ও পরেছি, ফিরনি সেমাইও খেয়েছি।

এখন কি করছিস বাবা? বন্ধু বান্ধবদের ওখানে বেড়াতে বের হস নি?

জি আম্মা। এখন বন্ধু বান্ধবদের ওখানে বেড়াচ্ছি। মজার মজার অনেক খানা খাচ্ছি।

আমার ভারি কণ্ঠ মায়ের কাছে গোপন থাকে না। তিনি বললেন কি হয়েছে বাবা তোর। তুই কাঁদছিস কেন? তার কণ্ঠও ভারি শোনালো।

না মা কাঁদছি না। তোমরা নতুন কাপড় পরেছ তো?

আমরা তো পরেছি। তুই কাঁদছিস কেন বাবা আজকের এই ঈদের দিনে? আম্মাও কেঁদে ফেললেন।

না মা কাঁদছি না। এখন রাখি আমি, আবার একটু পরে কল দেব। মোবাইলটা রেখে কম্বলের ভিতরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। সারা বছরের কান্না যেন আজকেই সব চলে আসছে চোখে। আমি আজ কোথায় পড়ে আছি? এরকম ঈদের দিনে যদি দেশে থাকতাম ছেলে মেয়েদের হাসি খুশি মুখটা দেখে অন্তরটা ভরে যেতো। ঈদের নামাজ পড়ে মা কে সালাম করতাম। তিনি আমার জন্য দোয়া করতেন। আজ আমি পড়ে আছি অনেক দূরে। আমার ঈদ কেমন কাটছে কেও দেখছে না। এইসব যতই ভাবছি কান্নার গতি ততই বাড়ছে। প্রথম যখন বিদেশে এসেছিলাম, তখনো এরকম কেঁদেছিলাম। প্রথম ছয় মাস কেটেছিল শুধু কেঁদে কেঁদে। আজ ঈদের দিনে কেন বেশি কান্না আসছে? এই ঈদের সময় দেশে থাকলে আজ কত আনন্দ কত মজা করতাম সেটা ভেবেই বেশি কান্না পাচ্ছে। অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে আবার মোবাইলটা হাতে নিলাম। স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলতে হবে।

ওপাশ থেকে আমার স্ত্রী সালাম দিলো।

বললাম, ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছ তোমরা? বাচ্চারা কেমন আছে?

আমরা সবাই ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?

আমিও ভাল আছি। নতুন শাড়ি পরেছ? বাচ্চারা নতুন জামা কাপড় পরেছে?

সবাই পরেছে।

তুমি পরনি?

আমার কথা বলে লাভ আছে? আমি নতুন শাড়ি পরলেও কি আর না পরলেও কি?

কেন কি হয়েছে?

না থাক। বলে আর কী হবে?

থাকবে কেন? কি হয়েছে বলো।

কি আর হবে? সবাই যার যার পছন্দের শাড়ি কিনেছে। আর আমার জন্য তোমার মা কিনেছে একটা কম দামের শাড়ি। সবাই বলছে এটা কি ডুবাই ওয়ালার বউয়ের জন্য উপযুক্ত শাড়ি হলো?

শাড়ির দাম কত?

মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। ভাবলাম পাঁচ হাজার টাকার শাড়ি বউয়ের পছন্দ হচ্ছে না। কত কষ্ট করে এখানে টাকা রোজগার করছি তা যদি তারা জানতো।

স্ত্রী বললেন, কি হলো কিছু বলছ না যে?

না ভাবছিলাম। তোমার জন্য একটা ভাল শাড়ি ক দিন পরেই কেনার ব্যবস্থা করব। তুমি নিজেই দেখে তোমার পছন্দ মত কিনে নিবে, ঠিক আছে? আমি এখন রাখি। কিছুক্ষণ পরে বাচ্চাদের সাথে কথা বলব।

এখন রাখছ কেন? এখনই বল।

না, এখন বলব না। এখন মনে একটু খারাপ লাগছে। পরে আবার কল দেব। বাচ্চাদেরকে দূরে যেতে দিও না।

ফোন রেখে ভাবলাম। হায়রে কপাল। পাঁচ হাজার টাকার শাড়ি বউয়ের পছন্দ হচ্ছে না। এত কষ্ট করে এখানে রোজগার করছি। তারপরেও যদি স্ত্রীর কাছ থেকে একটু শুকরিয়ার শব্দ শোনতে না পাই, তাহলে কেমন লাগে? মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

স্ত্রী যদি বলতো যা পেয়েছি আলহামদু লিল্লাহ। তুমি কত কষ্ট করে বিদেশে রোজগার করছ তাওতো আমাদেরকে বুঝতে হবে। তাহলে মনটা খুশিতে ভরে যেতো। এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

*.*.*.*.*

অধিকাংশ প্রবাসীর কাছে ঈদ আমানের ঈদের মত হলেও কিছু কিছু প্রবাসীর কাছে সামান্য হলেও ঈদটা খুশির বার্তা বয়ে আনতে পারে। যদিও তা একশত ভাল সফল হয় না কখনো। তবুও দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মত করে এখানে কেও কেও ঈদটাকে কিছুটা উপভোগ করার চেষ্টা করে। যেমন করিম। করিম ঈদের ক দিন আগে থেকেই বন্ধুবান্ধবদেরকে দাওয়াত করে রাখে। ঈদের দিন যেন করিমের এখানে আসতে ভুল না হয়। সে সবার জন্য সেমাই পোলাও বিরিয়ানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করে। সবাইকে নিয়ে নাস্তা পানি খাওয়ার পর বাড়িতে ফোন করে সবার খোঁজ খবর নেয়। নতুন জামা পরারও চেষ্টা করে। তবে তা সব ঈদে হয়ে উঠে না। বাড়ীতে ফোন করে তাদের সাথে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করার চেষ্টা করে সব প্রবাসীরাই। করিমও ফোন দিল তার বাড়িতে। তার মা বাবা জীবিত নাই। সন্তানদেরকে প্রথমেই সে তাদের দাদা দাদীর কবর জিয়ারতের তাগিদ দেয়। তার স্ত্রীও মাশা আল্লাহ খুব ভাল মেয়ে। করিমের মনে আঘাত লাগতে পারে এরকম কিছুই না বলার চেষ্টা করে। ঈদের ক দিন আগে থেকেই তার স্ত্রী বলে রেখেছিল আপনি নতুন জামা কাপড় না পরলে আমরাও পরব না। আপনার ফোন পেলে এবং আপনি নতুন জামা কাপড় পরেছেন তা বললেই কেবল আমরা নতুন কাপড় পরিধান করব।

তাই ঈদের দিন সে প্রথমেই করিমের কাছে নতুন জামা কাপড় পরেছে কিনা জিজ্ঞেস করে।

করিম বলে। হ্যাঁ। পরেছি। আজ ঈদ না? নতুন জামা কাপড় পরব না কেন? তুমি পরেছ? বাচ্চাদেরকে নতুন জামা পরিয়েছ?

হ্যাঁ। আমিও পরেছি এবং বাচ্চাদেরকেও পরিয়েছি। এবারের ঈদের খরচটা একটু বেশি হয়ে গেল বলেই মনে হচ্ছে। তুমি মনে কষ্ট নিও না। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আম্মা আমার জন্য শাড়ি কিনেছে। এত টাকা দিয়ে শাড়ি কেনার কোনো দরকার ছিল? বলেছিলাম, দুই হাজার টাকার শাড়ি হলেই আমার চলবে। কিন্তু না, আম্মা বললেন, নিয়ে নাও, করিমকে আমি বুঝিয়ে বলব।

ঠিক আছে ঠিক আছে। নিয়েছ ভাল করেছ। ঈদ তো আর প্রতিদিন হচ্ছে না।

ঈদ প্রতি দিন হচ্ছে না তাও ঠিক। তবে আমার কাছে এখন আর ঈদকে ঈদ বলে মনে হয় না। তুমি না থাকলে কিসের ঈদ? আমি কম খরচ করতে রাজি আছি। তবুও তুমি একটু তাড়াতাড়ি দেশে আসার চেষ্টা করো।

ঠিক আছে আসব। আর কয়েক মাস পরেই চলে আসব।

করিম বাচ্চাদের সাথেও ফোনে কথা বলে। তারা ঈদে কে কী পেয়েছে সব খোঁজ খবর নেয়। আত্মীয়স্বজনদের সাথেও কথা বলে। সবার কোশল জানার চেষ্টা করে।

বিকেলের দিকে কয়েকজন বন্ধুসহ সে কোথাও ঘুরতে বের হয়। রাতে আবার বন্ধুদেরকে নিয়ে গোস্ত রান্না করে সবাই একসাথে খানা খায়।

*.*.*.*.*.*

আবার কিছু প্রবাসীর কাছে ঈদ না আসলেও ঈদপূণর্মিলনী আসে। বিশেষ করে যারা ফেসবুক বা ব্লগের মাধ্যমে একে অন্যের খোঁজ খবর রাখে, তারা ঈদের পরে কোনো একটি হোটেলে বা পার্কে গিয়ে সবাই একত্রিত হয়। গল্পগুজব করে। চা নাস্তা এক সাথে খায়। এভাবেই ঈদের আনন্দটা উপভোগ করার চেষ্টা করে।

যেসব প্রবাসী সপরিবারে এখানে থাকে, তারা স্বাভাবিকভাবেই ঈদের আনন্দটা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি উপভোগ করে। তবে এরকম সপরিবারে খুব কম মানুষই এখানে থাকে। আমার শ্রদ্ধেয় উস্তাদ হযরত মাওলানা হাফেজ নুরুল হক সাহেব সপরিবারেই থাকেন কাতারে। আমি ঈদের দিন বা পরের দিন উনার কাছে চলে যাই। হুজুর আমাদেরকে ভাল মেহমানদারি করেন। ওনার কাছে গেলে মনে হয় যেন দেশের পরিবেশে আসলাম। হুজুর আমাদের সাথে মন খুলে কথা বলেন। আমাদের বাড়ী ঘরের খোঁজখবর নেন। দীনি আলোচনা করেন। অনেক কিছুই জানতে পারি হুজুরের কাছ থেকে।

যারা কোনো কোম্পানিতে কাজ করে তারা ঈদের দিন ছুটি পেলেও যারা বাসা বাড়িতে কাজ করে তারা ছুটি পায় না। বরং এ দিন তাদের কাজ আরো বেড়ে যায়। ফজরের নামাজের আগেই আরবি কফিলের বাড়িতে কয়েকটা ছাগল জবেহ করবে। এই ছাগলগুলো সম্ভবত কোরবানির নিয়তে নয়, শুধু খাওয়ার নিয়তেই জবেহ করে। এগুলো আরবিরা তাদের মজলিশে বসে খাবে অনেক মেহমানসহ। বড় থালার মধ্যে বিরিয়ানি ভাত, তার উপর পুরো একটা সিদ্ধ করা ছাগল বসিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে সবাই টেনে টেনে খায়। মেহমান সবাই আরবি। বিশ জন মানুষের জন্য দুইশত জনের খানা তৈরি করা হয়। বিশ জনের খাওয়ার পর বাকি খানাগুলো ফেলে দিবে। খানা ফেলে দেয়া তারা ফ্যাশন মনে করে। এইখানা তৈরি করতে যেসব শ্রমিক কাজ করেছে তাদের মধ্যে কেও এখান থেকে খেতে পারে আবার কেও খেতে পারে না। যারা জবেহ আর রান্না করেছে তারা এখানে আসে না। খেতেও পারে না। যারা খানা পরিবেশন করে শুধু তারাই এখানে খেতে পারে। তাও সবার পরে। এখানে যেসব শ্রমিক খানা খায় না, তাদেরকে প্রতি দিনের মত সাধারণ খানা দেয়া হয়। ঈদ উপলক্ষে তাদের জন্য কোনো ভাল খাবারের ব্যবস্থা করা হয় না। অনেকে নিজের পয়সা খরচ করে এ দিন কিছু ভাল খাবারের ব্যবস্থা করে।

বিশেষ করে কোরবানির ঈদের সময় অনেকেই কিছু গোস্ত কিনে রান্না করে এবং বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত দিয়ে একসাথে খানাপিনা করার চেষ্টা করে। এখানে কোরবানের দিনও দোকানে গোস্ত কিনতে পাওয়া যায়। সেটা অবশ্য কোরবানির গোস্ত নয়। স্বাভাবিক গোস্ত। প্রবাসীদের মধ্যে অনেকেই কোরবানের ঈদের দিন দোকান থেকে গোস্ত কিনে রুমে রান্না করে বন্ধু বান্ধবসহ খায়। আর অনেকেই কয়েকজন মিলে একটা ছাগল হয়ত কিনে যবেহ করে নিজেরা বন্ধুবান্ধবসহ খায়।

যারা কোনো কোম্পানিতে কাজ করে তারাতো সারা বছরই নিজেরা পাক করেই খানা খায়, তাই তারা কোরবানের ঈদের দিন গোস্ত কিনে রান্না করলে সেটা তেমন আশ্চর্য হবার মত বিষয় নয়। তবে আশ্চর্য হবার মত বিষয় একটা আছে। সেটা হল যারা কোনো আরবি কফিলের ঘরে কাজ করে তারা সারা বছর কফিলের বাড়ী থেকেই খানা খায়। তাদের জন্য কোরবানির দিনেও গোস্ত রান্না করা হয় না। প্রতি দিনের মত স্বাভাবিক ভাবেই তারা এ দিন খানা পায়। অনেকেই সেই খানা আনে তবে খায় না। সেটা ফেলে দিয়ে দোকানে গিয়ে গোস্ত দিয়ে ভাত খায়।

এখানে আমাদের দেশের মত যেখানে সেখানে গরু ছাগল যবেহ করার নিয়ম নাই। বাড়ীর ভিতরে যেখানে মানুষের চলাচল নাই সেখানেই আগে গরু ছাগল যবেহ করা হতো। এখন সেটাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন সরকারিভাবে কিছু যবেহখানা বানানো হয়েছে। সেখানে মানুষ গরু ছাগল নিয়ে যায়। সরকারি মানুষেরা সেটা যবেহ করে দেবে। কোনো টাকা পয়সা নেবে না। ওখান থেকে যবেহ করা গরু ছাগল বাড়িতে এনে কেটেকুটে রান্না করা হয়।

নিজেদের বাড়িতে যবেহ করার নিয়ম বন্ধ করার কারণ হলো গরু ছাগল যবেহ করা নিয়ে অনেকেই মহা মুশকিলে পড়ে যান। গরু যবেহ করা নিয়ে সমস্যা পাড়ে যাওয়ার মত দুটি ঘটনা বলি। আগে যখন বাড়িতে গরু যবেহ করার অনুমতি ছিল তখনকার কথা। বড় একটি গরু। ভাল মোটাতাজা আছে। দেখতেও সুন্দর। শিং দেখতে অনেকেরই ভয় লাগে। এই গরু যবেহ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সাত আটজন মানুষ। রসি দিয়ে গরুকে বাঁধা হয়েছে শক্ত করে। পাঁচ ছয় জন লোক গরুকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরেছে। একজন দা হাতে নিয়ে যেই না যবেহ করার জন্য একটু দায়ের পোঁচ দিয়েছে অমনি গরুটা একটু নড়ে উঠেছে। সাথে সাথে যে যবেহ করছে সে দা হাতে নিয়ে দিল এক দৌড়। এক দৌড়ে অনেক দূরে চলে গেছে সে। এদিকে তখন কি গরুটাকে মাটিতে ফেলে রাখবে? না। গরুর কষ্ট হচ্ছে তাই গরুর বাঁধ খুলে দেয়া হলো।

সেই লোককে আবার ডেকে আনা হলো। এবার শক্ত করে ধরা হবে। কোনো সমস্যা হবে না। এবার যবেহ করেন। কিন্তু এবারও গরু নড়ে উঠেছে এবং সেই ব্যাক্তি দা ফেলে দিল এক দৌড়। সে আর আসে নাই। চলে গেছে। অন্য এক ব্যাক্তি দা হাতে নিয়ে গরুটা যবেহ করে দিল।

অন্য এক জায়গায় কোরবানের ঈদের দিন গরু যবেহ করা হচ্ছে। বার বার তাগিদ দেয়া হচ্ছে যবেহ করার সময় গরু যেন হাত পা না নাড়ে। তাই শক্ত করে বাঁধা হচ্ছে গরুকে। বাঁধা শক্ত করতে করেত এমন শক্ত করেছে যে যবেহ করার আগে গরু কিছুটা নড়াচড়ার চেষ্টা করলেও যবেহ করার পরে গরুটা একটুও নিড়েনি। তার মানে সেটা যবেহ করার আগেই মারা গেছে। আর তা খাওয়া হলো না। এসব কারণেই এখন বাড়ীতে গরু ছাগল যবেহ করা নিষেধ করা হয়েছে।

এভাবে প্রবাসে একেকজনের কাছে একেক রকমভাবে নিরানন্দ ঈদ আসে আবার চলে যায়। কেও কেও এক দিন ছুটি পায় আবার কেও কেও শুধু ঈদের দিনটাই ছুটি পায়। আবার কেও কেও ঈদের দিনেও ছুটি পায় না। আবার শুরু হয় সেই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। দেশের আত্মীয়স্বজনদের কাছে যাবার অপেক্ষা আর নিয়মিত ডিউটি। প্রতিদিন একই রকমের কাজ একই রকমের নিয়মে সময় পার করা। হাসি খুশি আনন্দবিহীন এক জীবন। জীবন এখানে শুধু রাত দিনের নিরামিষ একটি চক্র ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু বাড়ীতে যাওয়ার একটি প্রবল অপেক্ষা আছে বলেই হয়ত এখনো এই জীবনের প্রতি কিছুটা মায়া আছে। তা না হলে এই জীবন আর জড়পদার্থের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতো না। এখনো কিছুটা পার্থক্য আছে শুধু দেশে গিয়ে প্রিয়জনের মুখ দেখার আশাটা অন্তরে চির অম্লান আছে বলেই।

বিষয়: বিবিধ

২১৫০ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

249031
২৮ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০১:১৩
বেদনা মধুর লিখেছেন : অনেক ভাল লেগেছে। প্রবাসীদের নিরানন্দ ঈদের চিত্র ফুটে উঠেছে। অনেক ধন্যবাদ। এই পোষ্ট স্টিকি করা হোক।
২৮ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০১:২২
193458
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ।
249037
২৮ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০২:২৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার পোষ্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
প্রবাসিরা যে কষ্ট করে দেশের জন্য আয় করছেন আমরা সরকারী ও পারিবারিক ভাবে তাকে বিন্দুমাত্র মুল্যায়ন করছিনা।
২৮ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০৩:১৪
193467
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ঈদ মোবারক।
249056
২৮ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০৩:০১
ভিশু লিখেছেন : ঈদ মোবারক!
Good Luck Good Luck Good Luck
Rose Rose Rose
২৮ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০৩:১৪
193468
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : ঈদ মোবারক
249060
২৮ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০৩:১৯
গ্রামের পথে পথে লিখেছেন : এই পোষ্ট স্টিকি করার জোড় দাবি জানাছ্ছি.......... ব্লগমডু।
২৮ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৪:০১
193472
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ঈদ মোবারক।
249101
২৮ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৫৭
সন্ধাতারা লিখেছেন : Eid Mubarak vhaiya. Thanks. For your valuable post. Jajakalla
২৯ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:২৮
193719
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : Eid Mubarak
249102
২৮ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৫৮
আফরা লিখেছেন : তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না অমিন্‌কুম ।
২৯ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০২:১৬
193652
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : তাক্বাব্বালাল্লাহু মিন্না অমিন্‌কুম
249262
২৯ জুলাই ২০১৪ দুপুর ১২:২৬
বুড়া মিয়া লিখেছেন : বিষয়টা অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাবলীল ভাষায় জানিয়েছেন, আপনাদের কষ্টস্নাত জীবনের কথা জেনে আমিও শোকাভিভূত!

আপনাদের ওখানে কেউ নাই আর হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রমের যুক্তিসঙ্গত বেদনা; আর আমাদের সব আছে তার পরেও না-শোকরী।

ঈদের শুভেচ্ছা আপনাকে।
২৯ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০২:১৫
193651
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ঈদ মোবারক।
249300
২৯ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০৩:২৭
আবু তাহের মিয়াজী লিখেছেন : মহিমান্বিত বরকতময় এই দিনে গাজাসহ বাংলাদেশ
ও বিশ্বের সকল মুসলিমদের শান্তিও কল্যাণ কামনা করছি ।আপনাকে ঈদ মোবারক!
২৯ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:২৮
193718
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : আপনাকে ঈদ মোবারক

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File