ভাল মানুষ তৈরির মেশিন নেই, তবে উপায় আছে
লিখেছেন লিখেছেন খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ২৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০৯:০৮:২৬ সকাল
মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে দিন দিন। দেশ দিন দিন অশান্ত হয়ে উঠছে। মানুষের পকেটে টাকা থাকলেও মনে শান্তি নেই। পেটে ভাত থাকলেও অন্তরে স্বস্তি নেই। দিন দিন মানুষ আতঙ্ক বোধ করছে। খুন-খারাবি, মারামারি, রাহাজানি, গুম, অপহরণ বাড়ছে। তার ওপর রক্ষক হয়ে যারা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, তাদের কারণে এই অশান্তি আরও বেড়ে যাচ্ছে। এইসব অপরাধ কিভাবে কমানো যায় তা নিয়ে প্রতিদিন লেখালেখি হচ্ছে, অনেকগুলো টকশোর আয়োজন করা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের আইন বানানো হচ্ছে। কিছুদিন পরপর আবার এই আইনকে কঠোর করা হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। অপরাধ বাড়ছেই।
জ্ঞানীগুণী মানুষজনের আর্টিকেল আর টকশোগুলো দেখলে বোঝা যায় একটি বিষয়ে তারা সবাই একমত যে, অপরাধ বন্ধের জন্য শুধু আইন যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন মানসিক পরিবর্তন। এখানে এসেই বক্তব্য শেষ হয়ে যেতে দেখা যায়। এই মানসিক পরিবর্তনটা কীভাবে হতে পারে তা নিয়ে তেমন বেশি আলোচনা হতে দেখা যায় না। ভাবটা এমন যেন এমনি এমনিই মানসিক পরিবর্তনটা হয়ে যাবে অথবা কেউ ইচ্ছে করলেই তার মধ্যে মানসিক পরিবর্তন এসে যাবে। তবুও তো পরিবর্তন আসছে না। কিন্তু কেন? আমাদের নিবন্ধের অবতারণা সেখান থেকেই শুরু হবে, যেখানে এসে সবাই থেমে যায়। অর্থাৎ আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন কীভাবে আসতে পারে।
সবাই একমত যে, আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন না এলে অপরাধ প্রবণতা কমবে না। মানসিক পরিবর্তনটা আমাদের মধ্যে আসবে কীভাবে? অনেকেই মনে করেন লেখাপড়া করলে মানসিক পরিবর্তন আসে। কিন্তু দেখা যায়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেও পিস্তল আর রাম দা নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে অনেকে। সন্ত্রাসের গডফাদার যাদেরকে বলা হয়, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারাও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন। রাষ্ট্রের বড় বড় পদে আসীন হয়ে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের সম্পদ চুরি করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেকেই বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই একটি ডিগ্রি গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। অফিসের আরামদায়ক চেয়ারে বসে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে যারা দেশের বারোটা বাজাচ্ছে তাদের সবাই শিক্ষিত। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে যে, মানসিক পরিবর্তনের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে, সেই মানসিক পরিবর্তনটা লেখাপড়া করার পরও আসছে না।
তাহলে কি টাকা থাকলে অপরাধ কমবে? বা টাকা দিয়ে মানসিক পরিবর্তন কেনা যায়? টাকার জন্যই অধিকাংশ অপরাধ করা হয় তা সত্য। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে গরিবের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কম। ধনীরাই অপরাধ করে বেশি। লাখপতি অপরাধ করে কোটিপতি হয়। কিন্তু গরিব সেই গরিবই থাকে। তার মানে টাকা দিয়েও মানসিক পরিবর্তন আসে না। বরং এই টাকা অধিকাংশ সময় মানুষকে আরো বেশি অপরাধের জগতে ঠেলে দেয়। অধিকাংশ সময় টাকার কারণে মানসিক পরিবর্তনটা অবনতির দিকেই হয়ে থাকে।
আর আইন দিয়ে যে অপরাধ দমন করা যাচ্ছে না, তা প্রতিদিন কয়েকবারই প্রমাণিত হচ্ছে। যারা আইন প্রয়োগ করে তারাও অনেকে অপরাধীদের সাথে হাত মেলায়। অপরাধীরা আইন প্রয়োগকারীদের সহযোগিতা পেয়েই অপরাধ করে অধিকাংশ সময়। অপরাধ বন্ধে যে মানসিকতার পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে, সেটা এই জায়গায় এসে আরো প্রকটভাবেই ধরা পড়ে। কিন্তু মানসিক পরিবর্তন আসবে কীভাবে?
কারো কাজ দিয়েই তাকে চেনা যায় যে সে ভালো মানুষ নাকি খারাপ মানুষ। ভালো মানসিকতাসম্পন্ন মানুষেরাই ভালো কাজ করে। আর ভালো কাজ করলেই কেউ ভালো মানুষ হতে পারে। এই ভালোমানুষ তৈরি করার মতো কোনো মেশিন এখনও তৈরি হয়নি। তাহলে ভালো মানুষ তৈরি হয় কোথায়? কীভাবে?
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা গেছে যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও অনেকে ভালোমানুষ হতে পারছে না। টাকা দিয়েও অনেকে ভালোমানুষ হতে পারছে না। আইন দিয়েও ভালোমানুষ তৈরি করা যাচ্ছে না? তাহলে উপায়?
হ্যাঁ, উপায় আছে। আমরা জানি শিশুকাল থেকেই মানুষ তার আশপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। একটা শিশু যেরকম পরিবেশে বড় হয়, সেরকম মানুষ হিসেবেই গড়ে ওঠে সে। হিন্দুর ঘরে জন্ম নিলে সে হিন্দু হয়, মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলে সে মুসলমান হয়। অপরাধীদের সাথে থাকলে সে অপরাধী হয়, আর ভালোমানুষদের সাথে থাকলে সে ভালোমানুষ হিসেবেই গড়ে ওঠে। অর্থাৎ ভালো মানুষের সান্নিধ্যে থাকলেই শুধু ভালো মানুষ হওয়া যায়, অন্য কোনো ভাবেই নয়। যে ভালো মানুষের সান্নিধ্যে থেকে মানুষ ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সেই ভালোমানুষটা কে? এখানে এসে অনেকেই ভালোমানুষের সংজ্ঞাতে মতদ্বৈততা করতে পারেন। তবে আমরা যদি কিছু নির্দিষ্ট মাপকাঠির ভিত্তিতে এই ভালোমানুষটাকে খুঁজি তাহলে তাকে খুঁজে পাওয়া তেমন বেশি কঠিন কাজ নয়। এর জন্য অবশ্যই সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সৎসাহস আমাদের থাকতে হবে। এবং নির্বাচনি প্রচারণার মত সত্য মিথ্যা যাচাই না করে অমুক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র বলার মানসিকতা অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে।
অসৎ মানুষের অসদাচরণের কারণে আমরা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত যেসব অশান্তির মুখোমুখি হচ্ছি প্রতিদিন, তার ওপর ভিত্তি করেই আমরা সৎ আর অসতের পার্থক্য নির্ণয় করার চেষ্টা করতে পারি। যেমন যারা ঘুষ খায় না তারা সৎ, আর যারা ঘুষ খায় তারা অসৎ। যারা দুর্নীতি করে না তারা সৎ, আর যারা দুর্নীতি করে তারা অসৎ। যারা দেশের সম্পদ চুরি না তারা সৎ, আর যারা দেশের সম্পদ চুরি করে তারা অসৎ। যারা মিথ্যা কথা বলে না তারা সৎ, আর যারা মিথ্যা কথা বলে তারা অসৎ। যারা দেশকে ভালোবাসার প্রমাণ রাখতে পারে তারা সৎ, আর যারা দেশকে ভালোবাসে না তারা অসৎ। যাদের কথা আর কাজে মিল থাকে তারা সৎ, আর যাদের কথায় আর কাজে মিল থাকে না তারা অসৎ। যারা ক্ষমতায় যেতে বা ক্ষমতায় থাকতে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয় না তারা সৎ, আর যারা ক্ষমতায় থাকতে বা ক্ষমতায় যেতে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয় তারা অসৎ। যারা ধর্মের বিধান মতে জীবন যাপন করে তারা সৎ, আর যারা ধর্মের বিধান মানে না তারা অসৎ।
উপরোক্ত নীতিতে ভালোমানুষ কারা তা সহজেই শনাক্ত করা যায়। গ্রামের সব মানুষ জানে যে, তাদের গ্রামে কে ভালো মানুষ আর কে খারাপ মানুষ। তাদেরকে খুঁজে বের করা কঠিন কাজ নয়। খুঁজলে পাওয়া যায়। যেসব মানুষ সুযোগ পেয়েও দুর্নীতি করে না, অপরাধ করার সুযোগ পেয়েও যারা অপরাধ থেকে বেঁচে থাকে, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, তারা তাদের মন-মানসিকতাকে পবিত্র করেছেন। যে কারণে তাদের মনে অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার মত শক্তি সঞ্চিত হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের কাক্সিক্ষত মানসিক পরিবর্তন তাদের মধ্যে এসেছে। এসব পবিত্র মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে, তাদের পরিবেশে যারা থাকবে, তাদের মধ্যেও অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার মত মানসিকশক্তি অর্জিত হবে। দুর্নীতি থেকে বাঁচার মানসিকতা তৈরি হবে। লোহা যদি চুম্বকের সাথে লেগে থাকে, তাহলে লোহার মধ্যেও কিছুটা চুম্বকশক্তি চলে আসে। পানির মধ্যে নামলে ভিজতে হয়। রোদের মধ্যে দাঁড়ালে গরম লাগে, এটাই দুনিয়ার রীতি। ভালো মানুষের সাথে থাকলে ভালো মানুষ হওয়া যায়, আর খারাপ মানুষের সাথে থাকলে মানুষ খারাপ হয়ে যায়, এটাই দুনিয়ার নিয়ম। কথায় বলে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।
এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে পবিত্র কুরআন মাজিদে। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকো। সুরা তওবার আয়াত ১১৯। অন্য আয়াতে আছে, তিনিই সেই যিনি নিরক্ষরদের মধ্যে, তাদেরই মধ্যে থেকে, একজন রাসুল দাঁড় করিয়েছেন, তিনি তাদের কাছে পাঠ করছেন তাঁর নির্দেশাবলি, আর তিনি তাদের পবিত্র করেছেন, তিনি তাদের শিক্ষা দিয়েছেন ধর্মগ্রন্থ ও জ্ঞানবিজ্ঞান, যদিও এর আগে তারা তো ছিল স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে। সুরা জুমুআর আয়াত ২। এ থেকে বুঝা যায়, একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য শুধু শিক্ষা কখনই যথেষ্ট নয়। তার জন্য প্রয়োজন তাজকিয়ায়ে নফস বা মানসিক পবিত্রতা। নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষার পাশাপাশি নীতি নৈতিকতার শিক্ষা এবং চারিত্রিক দীক্ষা অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। যা আজকাল অনেকটাই অবহেলিত।
প্রবাদ আছে, যে জাতি জ্ঞানীর মর্যাদা দেয় না তাদের মধ্যে জ্ঞানী জন্ম নেয় না। আমাদের অবস্থাও হয়েছে সেরকম। ভালো মানুষদেরকে হয়রানি করা আর অপরাধীদেরকে প্রশ্রয় দেয়া আজকাল আমাদের দেশে ডাল ভাত হয়ে গেছে। দেশপ্রেমিকদেরকে হয়রানি করা আর দেশদ্রোহীদেরকে তোষামোদ করা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে যদি বেরিয়ে আসা যায়, তবেই দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে, অন্যথায় নয়।
সাপ্তাহিক লিখনী
বিষয়: বিবিধ
১৩১৭ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আর আমার লেখাও তেমন বেশি ভাল না। তাই হয়ত পড়তে ইচ্ছে করছে না। চেষ্টা করব ভাল লিখার। দোয়া চাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন