ম্যানিয়ার জটিলতায় বিচলিত হবেন না
লিখেছেন লিখেছেন থেরাপিস্ট সজীব ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৮:৩২:৫৮ রাত
ম্যানিয়া রোগে আক্রান্ত রোগী সাধারণ মানুষের চেয়ে এবং তার নিজের পূর্ব অভ্যাসের চেয়েও বেশি কথা বলে, কথা বলতে বলতে এরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। তবু কথা বলা ছাড়ে না। ম্যানিয়ার কথা বলার এই ভাবকে বলে অতিকথন বা ওভার টকেটিভনেস। যে কোনো একটি বিষয়ে অধিকতর কথা বলার প্রবণতা এবং ঘনঘন আলাপের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করা বা এক বিষয় থেকে হঠাৎ অন্য আরেক বিষয়ে চলে যায়। অনেক সময় রাস্তার লোকজনকে ডেকে এনে ম্যানিক রোগীরা নানা বিষয়ে কথা বলা শুরু করে দেয়। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে এরা নানা রকম উপদেশ বা পরামর্শ দিতে থাকে।
এই রোগে রোগীর মাঝে এক প্রকার হামবড়া ভাব প্রকাশ পায়। অতিকর্মতৎপরতা যেন কত কাজ তার বাকি পড়ে আছে এমন ভাব দেখা দেয়, একে বলে ওভার অ্যাক্টিভিটি। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে জমা করে রাখে। এভাবে তারা অনেক টাকা-পয়সা খরচ করতে থাকে। বিভিন্নভাবে অপচয় করতে শুরু করে দেয়। এরা আবার অন্যের ব্যাপারে অযথা হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে দেয়। বাস্তব বুদ্ধিহীনতা বা বাস্তব জীবনকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়-
• রাগ/উত্তেজনা
• আক্রমণাত্মক ভাব
• নিদ্রার প্রয়োজন না করা
• গালাগাল করা
• ঝগড়াঝাঁটি করা
• ক্ষুধা কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
• মনোযোগ দিতে না পারা
• অস্থিরতা
• অহংকার করা
• পরামর্শ দেয়া
• যৌনতায় অধিক আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া
• বড় বড় কাজে হাত দেয়া
• মিথ্যা বলার প্রবণতা সৃষ্টি হওয়া
• ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় অঙ্কের টাকা খাটানো পরিণাম না ভেবেই
• উল্লাস-উৎফুল্লতায় মেতে ওঠা
• নাচ-গান করা
• শক্তি বেড়ে যাওয়া
• নিজেকে অনেক শক্তিশালী ভাবা
• নিজেকে অনেক সুন্দর ভাবা
• অনেক জ্ঞানী ভাবা
• মারমুখীভাব সৃষ্টি হওয়া
• হঠাৎ হঠাৎ বড় প্ল্যান মাথায় আসা
• হঠাৎ হঠাৎ এখানে-ওখানে যাওয়ার কথা মনে আসতে থাকা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
এ রোগের উৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং বংশানুক্রম এই দুটোরই বেশি প্রভাব দেখতে পেয়েছেন। জীববিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসব ওষুধ এই রোগ নিরাময় করে সেগুলো আমাদের শরীরের কতগুলো নিউরোকেমিক্যাল এবং হরমোনের ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কাজ করে।
ম্যানিয়ার চিকিৎসায় রোগীকে ভালোভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওষুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হয়। ম্যানিয়ার রোগী যদি মুখে ওষুধ খেতে না চায় তবে এই ওষুধগুলো পিষে চা, কফি বা শরবত, আলু ও ডালের ভর্তা বা পোলাওয়ের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। আর এটা সম্ভব না হলে রোগীকে কোনোভাবে ধরে তার মাংসপেশিতে-
• হ্যালোপেরিডল বা
• ক্লোপ্রোমাজিন ইনজেকশন হিসেবে প্রয়োজনে দিনে ২-৩ বার করে দেয়া যেতে পারে। আর এক্ষেত্রে ক্লোপ্রোমাজিন ১০০-১৫০ মিলিগ্রাম অথবা হ্যালোপেরিডল ৫-১০ মিলিগ্রাম করে ইনজেকশন পুশ করা যেতে পারে। তবে এ সময় রোগীকে ৫ মিলিগ্রামের পারকিনিল বা কেড্রিন ওষুধ খাওয়াতে হবে নইলে রোগীর খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। এসব অবস্থা শুধু জরুরি ক্ষেত্রে এবং রোগী যখন ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে তখনকার জন্য। এরপর দেরি না করে মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মনোরোগ চিকিৎসক রোগীর রোগ অনুযায়ী উপযুক্ত ওষুধ ও ব্যবস্থাপনা লিখে দেবেন। সেই সাথে দেবেন বিভিন্ন পরামর্শ। ম্যানিক কঠিন অবস্থাকে বলা হয় ম্যানিক ফেজ বা ম্যানিক এপিসোড। এ সময় কোনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্র কয়েক দিনের জন্য রোগীকে কোনো হাসপাতালে বা ক্লিনিকে ভর্তি রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। তবে যেটাই করা হোক না কেন, তা আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই করতে হবে। এ ব্যাপারে আপনার চিকিৎসক আপনাকে সিদ্ধান্ত জানাবেন। এক্ষেত্রে বিচলিত হওয়া ঠিক নয়। যদি রোগীর রোগের কঠিন অবস্থায় মানসিকতা ঠিক না থাকে তবু চেষ্টা করতে হবে বিচলিত না হওয়ার।
হাইপোম্যানিয়া : অবহেলা করবেন না
হাইপোম্যানিয়া হলো হাল্কা মাত্রার ম্যানিয়া, যেখানে মন-মেজাজ এবং আচার-আচরণের অস্বাভাবিকতা খুবই ঘনঘন ঘটতে থাকে এবং এটা অনেক সময় সাইক্লোথাইমিয়ার সাথে আসে। তবে এর সাথে থাকে না-
• হ্যালুসিনেশন বা
• ডিলিউশন
হাইপোম্যানিয়ায় অনেক দিন যাবৎ অব্যাহতভাবে মাইল্ড মুড এলিভেশন থাকে, অর্থাৎ এ সময় রোগীর-
• কর্মতৎপরতা বা অ্যাক্টিভিটি বেড়ে যায়।
• এনার্জি ভরপুর হতে থাকে।
• সব সময় একটা অকারণ ভালো লাগা অনুভূতি থাকে।
• শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
• সামাজিক কাজ-কর্মের সাথে বেশি বেশি জড়িত হতে থাকে।
• কথা বলার প্রবণতা বেড়ে যায়।
• ওভারফ্যামিলিয়ারিটি দেখা দেয়া।
• সেক্সুয়াল এনার্জি বেড়ে যায়।
• ঘুমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়, তবে ঘুমের সমস্যা ঘুম প্রকটভাবে দেখা দেয় না যাতে করে রোগীর দৈনন্দিন কাজ-কর্ম বা সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
• বিরক্তি বা রাগ দেখা দেয়।
• নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা সৃষ্টি হওয়া।
• বর্বর ব্যবহার দেখা দেয়, অনেক সময় এটা ইউফোরিক সোসিয়াবিলিটির স্থান দখল করে নেয় বা তার পরিবর্তে এই আচরণ প্রকাশ পায়।
• কনসেনট্রেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
• কোনো কাজ শেষ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়, অর্থাৎ প্রায় কাজই অসমাপ্ত অবস্থায় ছেড়ে দেয়। অবসর, ছুটি কাটানো বা বিশ্রাম নেয়ার প্রবণতা হ্রাস পাওয়া।
• নতুন নতুন কর্মকাণ্ড বা ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ হাতে নেয়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
• হাল্কা মাত্রার চেয়ে অপব্যয় বা অপচয় করতে শুরু করে।
ডায়াগনোসটিক গাইড লাইন
উপরে বর্ণিত বিভিন্ন ফিচার বা উপসর্গ যা একটি নিয়মিত রীতিমাফিক ঘটতে থাকে এবং সাথে মুড চেঞ্জ বা এলিভেটেড ও কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায় এবং তা যদি একটানা কয়েক দিন পর্যন্ত চলতে থাকে এবং সেই সাথে যদি কাজকর্মে ব্যাঘাত অথবা সামাজিক কর্মতৎপরতা থেকে থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন হাইপোম্যানিয়া ডায়াগনোসিস করা যেতে পারে, কিন্তু এসব গোলযোগ যদি মারাত্মক রকমের হয় তখন ম্যানিয়ার কথা ভাবতে হবে।
ডিফারেনসিয়াল ডায়াগনোসিস
মুড ডিসঅর্ডারে একটি ব্যাপক অংশকে হাইপোম্যানিয়া আচ্ছাদিত করে রাখে এবং এর তৎপরতার মাত্রা সাইক্লোথাইমিয়া এবং ম্যানিয়ার মাঝামাঝিতে অবস্থান করতে থাকে।
বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অ্যাক্টিভিটি এবং অস্থিরতা (প্রায় ওজন হ্রাস) অবশ্যই হাইপার থাইরয়েডিজম এবং অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা থেকে আলাদা করতে হবে, কারণ হাইপার থাইরয়েডিজম বা অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসায়ও রোগীর হাইপোম্যানিয়ার তৎপরতা বা অস্থিরতার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। আবার অ্যাজিটেটেড ডিপ্রেশনের আরলি স্টেট, বিশেষ করে মাঝারি বয়স্ক লোক। হাইপোম্যানিয়ার মতো রাগান্বিতভাব প্রকাশ করতে পারে। এক্ষেত্রে ডিপ্রেশনজনিত রাগ বা ক্রোধ হাইপোম্যানিয়াজনিত রাগ বা ক্রোধের মতো একই রকম লাগতে পারে। তাই এক্ষেত্রে সতর্ক দৃষ্টি প্রয়োজন রোগ ডায়াগনোসিস করার বেলায়।
হাইপোম্যানিয়াকে কোনোভাবেই অবহেলা করা ঠিক নয়, কারণ এটাও একটি মানসিক সমস্যা। অনেক সময় হাইপোম্যানিয়ার আড়ালে বড় ধরনের ম্যানিয়া লুকিয়ে থাকে অথবা লুকিয়ে থাকে বড় ধরনের ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। হাইপোম্যানিয়া যদিও ব্যক্তির জীবনে খুব বেশি ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না তবুও এর চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। কারণ চিকিৎসাহীন হাইপোম্যানিয়া রোগীর জন্য বড় ধরনের ভোগান্তি নিয়ে আসতে পারে।
বিষয়: বিবিধ
২৬২৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন