তাজউদ্দীনের ভাষণ ও তার মেয়ের লেখায় গড়মিল

লিখেছেন লিখেছেন মুজিব সেনা ৩০ এপ্রিল, ২০১৪, ০৫:০৮:৩২ বিকাল





বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তার জ্যেষ্ঠ মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শারমিন আহমদ রিপির বক্তব্যে গড়মিল পাওয়া গেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ বইয়ে রিপির দেয়া তথ্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

ওই বইতে শারমিন আহমদ রিপি দাবি করেন, ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বললেও তিনি অস্বীকার করেন। বঙ্গবন্ধু এ ঘোষণা না দেয়ার যুক্তি হিসেবে বলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল দেয়া প্রথম বেতার ভাষণে তাজউদ্দীন বলেন, ‘২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরোধ করবার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’

এই ভাষণে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকার কথা জানাতে গিয়ে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধব্যূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলের ভাই-বোনেরা যে সাহসিকতার সাথে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে।’

উল্লেখ্য, তাজউদ্দীন ও জোহরা দম্পতির বিয়ে হয় ১৯৫৯ সালে। এই দম্পতির প্রথম সন্তান রিপির জন্ম হয় ১৯৬০ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১১ বছর।

রিপি তার বইয়ে তার ১১ বছর বয়সের স্মৃতিকথা বর্ণনা করেছেন নিজের ভাষায়। এতে দেখা যায় তিনি যেভাবে প্রেক্ষাপট ও সংলাপ ব্যবহার করছেন তা তাজউদ্দীনের ভাষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

রিপি তার বইয়ে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের সাক্ষাত ও আলাপচারিতায় তার বাবার অসন্তুষ্ট হওয়ার যে বর্ণনা দিয়েছেন এর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদে মুক্তিযুদ্ধকালে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটির মিল নেই। বরং তিনি (তাজউদ্দীন) বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের কথাই বলেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে রিপি লিখেছেন, ‘পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চের ভয়াল কালোরাতে আব্বু গেলেন মুজিব কাকুকে নিতে। মুজিব কাকু আব্বুর সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন সেই ব্যাপারে আব্বু মুজিব কাকুর সাথে আলোচনা করেছিলেন। মুজিব কাকু সে ব্যাপারে সম্মতিও দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী আত্মগোপনের জন্য পুরান ঢাকায় একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল। বড় কোনো সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আব্বুর উপদেশ গ্রহণে মুজিব কাকু এর আগে দ্বিধা করেননি। আব্বুর সে কারণে বিশ্বাস ছিল যে, ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে মুজিব কাকু কথা রাখবেন। মুজিব কাকু, আব্বুর সাথেই যাবেন। অথচ শেষ মুহূর্তে মুজিব কাকু অনড় রয়ে গেলেন।’

‘তিনি আব্বুকে বললেন, বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো, পরশু দিন (২৭ মার্চ) হরতাল ডেকেছি। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী আব্বু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে এসেছিলেন এবং টেপ রেকর্ডারও নিয়ে এসেছিলেন। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর প্রদানে মুজিব কাকু অস্বীকৃতি জানান।’

স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বঙ্গবন্ধুর অস্বীকৃতির ব্যাপারে তাজউদ্দীনের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে রিপি লেখেন, ‘মুজিব কাকুর তাৎক্ষণিক এই উক্তিতে (বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো প্রসঙ্গে) আব্বু বিস্ময় ও বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়লেন।’

তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে লেখেন, ‘কথা ছিল যে, মুজিব কাকুর স্বাক্ষরকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে শেরাটন) অবস্থিত বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে এবং তারা গিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করবেন।’

২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীনের সঙ্গে শেখ মুজিবের কথা হচ্ছিল তার শোবার ঘরে। এখানকার পরিস্থিতি বর্ণনায় রিপি লেখেন, ‘এদিকে বেগম মুজিব ওই শোবার ঘরেই সুটকেসে মুজিব কাকুর জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখতে শুরু করলেন। ঢোলা পায়জামায় ফিতা ভরলেন।’

তিনি আরো লেখেন, ‘পাকিস্তানি সেনার হাতে মুজিব কাকুর স্বেচ্ছাবন্দি হওয়ার এই সব প্রস্তুতি দেখার পরও আব্বু হাল না ছেড়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উদাহরণ টেনে মুজিব কাকুকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। তিনি কিংবদন্তি সমতুল্য বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদাহরণ তুলে ধরলেন, যাঁরা আত্মগোপন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু মুজিব কাকু তার এই সিদ্ধান্তে অনড় হয়ে রইলেন। ‘

আব্বু বললেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য হলো- পূর্ব বাংলাকে সম্পূর্ণ রূপেই নেতৃত্ব্বশূন্য করে দেয়া। এই অবস্থায় মুজিব কাকুর ধরা দেয়ার অর্থ হলো আত্মহত্যার শামিল। তিনি বললেন, মুজিব ভাই, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হলেন আপনি। আপনার নেতৃত্বের ওপরই তারা সম্পূর্ণ ভরসা করে রয়েছে। মুজিব কাকু বললেন, ‘তোমরা যা করবার কর। আমি কোথাও যাব না।’

স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছেন জানিয়ে রিপি লেখেন, ‘মুজিব কাকু তখন উত্তর দিয়েছিলেন-‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’

২৬ মার্চ তাজউদ্দীনের লেখা স্বাধীনতার ঘোষণা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয় জানিয়ে রিপি লেখন, ‘ধারণা করা যায়, ২৫ মার্চের কয়দিন আগে রচিত এই ঘোষণাটি আব্বু তার আস্থাভাজন কোনো ছাত্রকে দেখিয়ে থাকতে পারেন। স্বাধীনতার সমর্থক সেই ছাত্র হয়তো স্বউদ্যোগে বা আব্বুর নির্দেশেই স্বাধীনতার ঘোষণাটিকে বহির্বিশ্বের মিডিয়ায় পৌঁছে দেন। মুজিব কাকুকে স্বাধীনতার ঘোষণায় রাজি করাতে না পেরে রাত ৯টার দিকে আব্বু ঘরে ফিরলেন বিক্ষুব্ধ চিত্তে। আম্মাকে সব ঘটনা জানালেন।’

রিপি তার বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে তাজউদ্দীনের যেই বিক্ষুব্ধ চিত্ততার কথা বলেন শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে দেয়া ভাষণে তার এই ক্ষোভের ছাপ পাওয়া যায় না।

বরং ১৯৭১ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে বাংলাদেশের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ এবং স্বশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রশ্নাতীত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আনুগত্যের কথা জানান।

ভাষণে তাজউদ্দীন বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতা পেলেই বঙ্গবন্ধুকে আমাদের মাঝে পাব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যদি খোদা না করুন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুহয় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে, তাইলে বঙ্গবন্ধু শহীদ হয়েও স্বাধীন বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে অমর ও চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। তিনি একটি নতুন জাতির জনক হিসেবে ইতিহাসে স্বীকৃত হবেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিবের ছায়া হয়ে তার পাশে আজীবন রাজনীতি করেছি, জেলে থেকেছি। তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন দেশের জন্য জীবন দিতে। তিনি নিজেও বারবার বাংলার পথে প্রান্তরে বলেছেন, বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য জীবন দিতে তিনি কুন্ঠিত নন। আজ যদি বঙ্গবন্ধু মুজিবের জীবনের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পাই, তাহলে সেই স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যেই আমরা পাব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। আমি নিশ্চিত, বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিব কিছুতেই পাকিস্তানিদের কাছে তার নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপোষ করবেন না, আত্মসমর্পণ করবেন না এবং করতে পারেন না। এটাই আমার প্রথম ও শেষ বিশ্বাস।’

পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ পেলেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোস করবেন না তা জানিয়ে তাজউদ্দীন বলেন, ‘আমার স্থির বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবর পাকিস্তানিদের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। বাঙ্গালি জাতির গলায় গোলামির জিঞ্জির পরিয়ে দেবার পরিবর্তে তিনি নিজে বরং ফাঁসির রজ্জু গলায় তুলে নেবেন হাসিমুখে। এটাই আমার বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এটাই আমার ঈমান।’

ভাষণের শেষের দিকে এসে তাজউদ্দীন বলেন, ‘আমার শেষকথা, যেকোনো কিছুর বিনিময়ে আমরা বাংলার মাটিকে দখলদার মুক্ত করব। বাংলার মুক্ত মাটিতে মুক্ত মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমারা ফিরিয়ে আনব। মুজিব স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরে আসবেন এবং তাকে আমরা জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনব ইনশাল্লাহ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবর রহমানের প্রাণ রক্ষার জন্য বিশ্ব মানবতার কাছে আমরা আকুল আবেদন জানাচ্ছি’।

সম্প্রতি স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে দুই দফায় বিতর্ক উস্কে দেন বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি তারেক রহমান। তিনি দাবি করেন প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

এদিকে তারেকের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিপর্যয় হয়েছে। জাতীয় সংসদে তুই তোকারি উচ্চারিত হয়েছে। ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা অনেকটা দল বেধেই তারেককে গালমন্দ করেন।

এই ঘটনার মাঝেই গত ১৮ এপ্রিল বিকেলে রাজধানীর এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে শারমিন আহমদ রিপির লেখা ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’ বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

- See more at: http://www.timenewsbd.com/news/detail/11257#sthash.6kuUoDHH.dpuf

বিষয়: বিবিধ

১২৩৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

215609
৩০ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৯:৩৮
ইকুইকবাল লিখেছেন : পরে দেখবো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File