পারমাণবিক দূষণযুক্ত চিংড়ি আসছে বাংলাদেশে!
লিখেছেন লিখেছেন মানসুর ১০ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:৪৪:৩৮ সকাল
পারমাণবিক দূষণযুক্ত এলাকা থেকে মা চিংড়ি আমদানি করছে বাংলাদেশ। জাপানের ফুকুসিমায় পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াসহ হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের জলরাশিতে পারমাণবিক দূষণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর পরও ওই এলাকার জলসীমায় উৎপাদিত মা চিংড়ি আমদানি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ৩ ধাপে ৩১২টি মা চিংড়ি আমদানি করেছে কক্সবাজারের এমকেএ হ্যাচারি। প্রথম ধাপে ১২টি, দ্বিতীয় ধাপে ১০০টি ও তৃতীয় ধাপে ২০০টি মা চিংড়ি আমদানি করেছে তারা। এ সব চিংড়ি থেকে পোনা উৎপাদনের জন্য হ্যাচারিতে নিবিড়ভাবে তত্ত্বাবধান করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হ্যাচারির সুপারভাইজার মুসা খান ।
তিনি জানান, এ সব চিংড়ি বর্তমানে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এখনও গ্রাভেটিং হচ্ছে না। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মারা গেছে। কাজেই চাষি পর্যায়ে পোনা সরবরাহ করতে আরও সময় লাগবে। তবে এ সব চিংড়ি পারমাণবিক দূষণযুক্ত কিনা তা নিয়ে কোনো তথ্য নেই তার কাছে।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদের কাছে জানতে চাইলে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মৎস্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক গুলজার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলেন।
পরে গুলজার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পারমাণবিক দূষণযুক্ত কিনা এ ইস্যুটি আমাদের সামনে কেউ আনেননি। ওয়ার্ল্ড ফিস ফাউন্ডেশনই মাছের ভাইরাসসংক্রান্ত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। হাওয়াই থেকে আমদানিকৃত এ সব মা চিংড়িতে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পারমাণবিক কিছু আছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। বিষয়টি যখন সামনে এসেছে তখন এটির খোঁজখবর নিয়ে দেখা হবে। এরকম কিছু হলে এ সব চিংড়ি আমদানি করা ঠিক হবে না। কারণ এর প্রভাবে আমরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ব।
জানা গেছে, শ্রিম্প অ্যান্ড ফিস ফাউন্ডেশন দীর্ঘদিন যাবৎ এসপিএফ জাতের চিংড়ি আমদানির চেষ্টা করে আসছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি মাওনা টেকনোলজির সঙ্গে মা চিংড়ি আমদানির একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। চুক্তি অনুযায়ী মাওনা টেকনোলজিস নামে ওই কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই থেকে দেশে ভাইরাসমুক্ত মা চিংড়ি রফতানি করবে। এ জন্য বাংলাদেশে একটি হ্যাচারিও নির্বাচন করা হয়। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ থেকে মা চিংড়ি আমদানি করছে এমকেএ হ্যাচারি। এ হ্যাচারিটি দীর্ঘদিন যাবৎ ফিস ফিডের ব্যবসা করে আসছিল।
এ চিংড়ি আমদানির বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ শ্রিম্প অ্যান্ড ফিশ ফাউন্ডেশনের (বিএসএফএফ) চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ মাহমুদুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে এখনই লেখালেখির সময় হয়নি। এটি এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে আছে। মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি কমিটি এ নিয়ে কাজ করছে। ইতোমধ্যে কিছু চিংড়ি আনা হয়েছে এবং সেগুলো নিবিড় পরিচর্যা করা হচ্ছে। এপ্রিলের মধ্যেই এ সব চিংড়ি থেকে পোনা উৎপাদন করে চাষি পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে।
এ বিষয়ে বিএসএফএফের নির্বাহী পরিচালক ড. মাহমুদুল করিম জানান, আমেরিকার হেলথ বিভাগের ছাড়পত্র নিয়েই এ সব চিংড়ি আমদানি করা হচ্ছে। আর আমেরিকানরা এ হেলথ সার্টিফিকেট দেওয়ার বিষয়ে খুব সতর্ক। কাজেই এ সব চিংড়িতে স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। এটি একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে আনা হচ্ছে। মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে প্রধান করে ১২ সদস্যের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি এটি তত্ত্বাবধান করছে। এ সব চিংড়ি ভাইরাসমুক্ত কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে ওয়ার্ল্ড ফিস ফাউন্ডেশন।
হিমায়িত খাদ্য রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি মো. আমিন উল্লাহ বলেন, বর্তমানে বঙ্গোপসাগর উপকূল থেকে চিংড়ির রেণু সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু এগুলো মারাত্মকভাবে ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ায় বড় হওয়ার আগেই অধিকাংশ মারা যায়। তাই চাষ শেষে প্রতি হেক্টর জমিতে ৫০০ থেকে ৭০০ কেজির বেশি পরিণত চিংড়ি পাওয়া যায় না। ফলে চিংড়ি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এর বদলে ভাইরাসমুক্ত মা চিংড়ি থেকে পোনা সংগ্রহ করে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ৫ হাজার কেজি চিংড়ি পাওয়া যেতে পারে। এ সব কারণে আমদানির বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু হাওয়াই থেকে আমদানিকৃত এ সব মা চিংড়ি পারমাণবিক দূষণযুক্ত কিনা, তা জানা নেই।
আমদানিকৃত এ সব মা চিংড়ি পারমাণবিক দূষণযুক্ত কিনা, সে বিষয়ে ওয়ার্ল্ড ফিস ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞানী ড. মঞ্জুরুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি আমরা পরীক্ষা করিনি। আমরা শুধু এসপিএফ জাতের ৯টি ভাইরাস পরীক্ষা করেছি।
উল্লেখ্য, বিএসএফএফের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ২ লাখ ১৮ হাজার হেক্টর জলাশয়ে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার হেক্টরে বাগদা ও ৪৮ হাজার হেক্টরে গলদা চিংড়ি চাষ হচ্ছে।
এদিকে, শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (সেব) সিনিয়র সহ-সভাপতি এসএম শাহ আলম বিদেশ থেকে মা ও বাগদা চিংড়ি পোনা আমদানির সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়ে বলেন, এ আমদানির মাধ্যমে আমাদের চিংড়ি বাজার অন্যদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের সমুদ্রে লবণাক্ততা কম হওয়ায় এখানকার চিংড়ি অনেক ভালো। কক্সবাজারের ৪৫টিসহ দেশের ৬৫টি হ্যাচারিতে উৎপাদিত প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ কোটি পোনা দিয়ে সারাদেশে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এ চিংড়ি খাতটি ধ্বংস করার জন্য একটি মহল মা চিংড়ি ও পোনা আমদানির সরকারি অনুমতি নিয়েছে। অথচ আমরা গভীর সাগর থেকে ধরে আনা মা চিংড়ি হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করে ভাইরাসমুক্ত পোনা উৎপাদন করে সারাদেশে সরবরাহ করছি। এ খাতটি ক্রমেই আমদানিনির্ভর করার জন্য এটি একটি প্রথমধাপ মাত্র। এখন মা চিংড়ি আসছে ভবিষ্যতে হাওয়াই থেকে পোনাও আমদানি করা হবে।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে প্রতি মৌসুমে হ্যাচারিতে দরকার হয় ৮০ হাজারের বেশি মা চিংড়ি। বর্তমানে ৪০টির বেশি জাহাজ সাগরে মা চিংড়ি ধরছে। আমরা তাদের থেকে বাছাই করা চিংড়ি নিয়ে পোনা উৎপাদন করি। বাকিগুলো তারা বিদেশে রফতানি করে দেয়। এখন বিদেশ থেকে উল্টো মা চিংড়ি আমদানি করা হলে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে ৬৫টি হ্যাচারি বন্ধের পাশাপাশি চিংড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা বেকায়দায় পড়বেন।
তিনি আরও জানান, এক সময় ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পোনা আমদানি চালু ছিল। তখন খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের ঘেরগুলোতে ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে চিংড়ি মারা যেত। কাজেই এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
(দ্য রিপোর্ট/এআই/এইচএসএম/শাহ/এপ্রিল ০৮, ২০১৪)
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১০৮৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন