বাবা বলে তুমি নিজের প্রতি অনেক careless

লিখেছেন লিখেছেন প্রফেসর ফারহান ২৩ জুন, ২০১৪, ১১:১৭:২২ সকাল

বাবার হাতের আঙ্গুল ধরে হাঁটা, বাবার পিঠে চড়া অনেক গুলা স্মৃতি মনে পড়ছে; ছোটবেলায় এই গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ভর্তি হবার জন্য মতিঝিল থেকে অফিস করে এসে নাকে মুখে ভাতডাল গিলে আমাকে ভর্তি কোচিং বেলায়েত স্যারের কাছে নিয়ে যেত বিকালে। বিকাল ৪ টার মধ্যে কেমনে পৌঁছতাম কোচিং এ জানতাম না, তখন আমাদের বাসা ছিল মিরপুর পাইকপাড়ায় আর কোচিং ছিল স্কুলের ভিতরে অর্থাৎ ধানমণ্ডি ১ নম্বরে অবস্থিত বেল টাওয়ারের পিছনে। আমার মনে আছে তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল অনেক কম আর মিরপুর রোড এ অল্প কিছু লোকাল আর সিটিং বাস, ম্যাক্সি, ট্যাঁম্পু চলত তবে কোচিং থেকে আসার সময় ভিড় হত অনেক। একবার বাবা বাসের জানালা দিয়ে আমার ফাইল রেখে ২ টা সিট রেখেছিল, কিছু কিছু মানুষ জানালা দিয়েও বাসে উঠে গিয়েছিল। এটা ১৯৯৬ সনের কথা, সেদিন নিউমার্কেট থেকে মিরপুর যাতায়াতের জন্য আব্বু নরমাল বাস পাচ্ছিল না আর ঠিক তখনি মিরপুরগামি একটা স্টাফ বাস আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসল কিন্তু সিট রাখা সত্বেও ভিতরে ঢুকে দেখা গেল আমাদের ২ সিটের এক সিটে এক লোক বসে পড়ল আর সেই আমার জন্য এক সিটের জন্য তর্কাতর্কি কারণ ফাইল দিয়ে সিট রাখা সত্ত্বেও কেন সেই লোক অনৈতিকভাবে আমাদের সিটে বসবে? আমার জন্য পুরা ৬ টা মাস কোচিং টানা, রোদ-বৃষ্টিতে পুড়ে ভিজে এক ছাতার নিচে আগলে রেখে, হাতে হাত ধরে রাস্তা পার করে আমাকে নিয়ে যেত কোচিং এ;শুধু কি এটাই? কোচিং থেকে এসে আবার ভর্তি গাইড আর শিট লেখা। তখন কম্পিউটারের যুগ ছিলনা, শিক্ষকেরা হাতে লেখে শিট দিয়ে ফটোকপি করে চালাত। সাধনা অবশেষে সফলঃ ১৯৯৭ সনে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হই বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল এ।

বাবার প্রতি এটুক বললেও ভুল হবে, স্কুলে ভর্তি হবার আগে কিন্ডারগার্ডেন স্কুল শেষ হত আমার সকাল ১০.৩০ এ, তারপর গোসল করিয়ে দিত বাবা। আমার মনে আছে কসকো সাবান দিয়ে গোসল করানোর সময় আমার চোখে ফেনা পড়ে চোখ জ্বলত আর আমি উউউ করে পানি দাও, চোখে পানি দাও বলে চিল্লাতাম। বাবার অফিস শিফটিং যখন ছিল দুপুরে তখন তার আগে আমাকে তার বিশ্রাম সহায়ক বালিশের পাশে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। বাবা কিন্তু চোখ বন্ধ করে আমার সাথে ঘুম ধরার ভান করতেন,আসলে তিনি বিশ্রাম নিতেন। আর আমিও কেন জানি তার ভানেভানে ঘুমিয়ে পড়তাম আর ২-৩ ঘণ্টা পড়ে উঠে দেখতাম পাশে বাবা নেই, আসলে তিনি তো অফিসে চলে গেছেনে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে।

আমার অংক ও গণিতের হাতেখড়ি বাবার হাত ধরে, গণিতে বেশ কয়েকবার ভাল মার্ক্সও পেয়েছিলাম এমনকি হাইয়েসট নাম্বার; পাবনা কেন বলেন? উদাহরণের প্রতিটি অংক হাতে ধরে ধরে করিয়ে তারপর অনুশীলনের অংকে যেতেন বাবা আর পরীক্ষার আগে বলতেন যে উদাহরণ থেকে একটা অংক আসবেই, পরীক্ষা হলে যাবার পরে প্রশ্ন হাতে পাওয়া মাত্র দেখি যে বাবার কথা ১০০% সঠিক। একবার স্কুলে খেলতে খেলতে আরেকবার পাড়ায় খেলতে খেলতে কেটে গিয়েছিল, ফোস্কা পড়েছিল; এসব দেখলে তো বাবাকে অনেক জবাবদিহি করতে হয় তাই সবসময় ফুলহাতা একটা গেঞ্জি পরে থাকতাম। অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত কিন্তু কতদিন? ধরা পড়ে শেষ পর্যন্ত মারাই খেতে হয়।

সেই বাবা দিন দিন বড় হল, আমিও বড় হলাম, ঘুরলাম ফিরলাম, বাবার কাঁধেই ঘুমিয়ে পড়লাম। পঞ্চম শ্রেণীতে সেই যে Seizure এ আক্রান্ত হলাম সেটা সারল দফা ২০০৯ সালে ও ২০১৪ সালে। ২০০২-২০১৪ এই ১২ টি বছর একটা মৃগী রোগীর সেবা চিন্তায় বাবা হয়ে গেলেন সাদা দাড়িপাকা, কমচুল বিশিষ্ট হাজী। আর এজন্যই আমাকে বলেন তুমি নিজের প্রতি অনেক কেয়ারলেস। আসলেই আমার কাছেও তাই, জীবনে মনে হয় কোন বিষয়ে বাবাকে সিরিয়াসলি ভাবলাম না। অফিস থেকে এসে আমাকে ডাক্তারের সিরিয়াল চ্যাম্বারে নিয়মিত আমাকে চেকআপ করানো, ওষুধ কেনা, আমার পছন্দমত কোন খাবার কিনে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি সেবা। বাবার হোটেল এর ২৪ ঘণ্টা ফ্রি সার্ভিস তখন বুঝতে পারতাম না যেটা এখন উপলব্ধি করি।

একবার বাবার সাথে রাগ করে টানা ২-৩ দিন কিচ্ছু খাইনাই পানি ছাড়া। কারণ ছিল কলেজের পিকনিকে যেতে না দেওয়া। এটা ২০০৭ সালের কথা। কক্সবাজারে ৪ দিন ব্যাপি ট্যুর, আর্থিক সংকটের কারণে বাবা যেতে দিতে চাইলেন না,আমাকে বুঝালেন। একদিন গ্রিল চিকেন এনে আমার মেজাজ ঠাণ্ডা করলেন। ছোটবেলা থেকে রিক্সাভাড়া দিয়ে বলতেন যে ''বাবা এটা তোমার টাকা, এখান থেকে সেভ করতে পারলে এটা তোমার, খরচ হলেও তোমার পকেটের টাকা খরচ''; ব্যাপারটা ২-৩ দিন পর উপলব্ধি করতে পারলাম। আর তাই রিক্সাভাড়া আমাকে ১০ টাকা দেওয়া সত্বেও আমি বাসা থেকে স্কুলে যাওয়া আসা করতাম টেম্পুতে ৭টাকা দিয়ে যার কারণে আমার প্রতিনিয়ত সেভ হত ৩ টাকা করে আর সেই ৩ টাকা দিয়ে আমি একটা সমুচা খেতে পারতাম আর না হয় বড় সেভিংস থেকে আরও ভাল কিছু খেতে পারতাম। প্রথম কয়েকদিন বাবাকে সেভিংস ফেরত দিয়েছিলাম যার কারণে বাবা এখনো অনেকের কাছে বলে ''আমার ছেলেটাকে রিক্সাভাড়া বা অন্য কিছু কিনতে দিলে সে খরচ করে বাকিটা ফেরত দিত, রিক্সাভাড়া ২ টাকা সেভ হলে সে সেটা আমাকে ফেরত দিত, আমার ছেলেমেয়েদের এই গুণটা আছে''।

সেই বাবাটা ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হল প্রায় ১০ বছর, বংশের প্রাপ্তি। তার উপর শুরু হল অফিস শিফটিং পরিবর্তন হয়ে ৯-৫টা অফিস এবং অদ্ভুত রদবদল। সোনালি ব্যাংকের হেড অফিসের এসি রুম থেকে আরেক রুমে, এর মধ্যে পদোন্নতি হল বেশ কয়েকবার কিন্তু কাজের চাপ বেড়ে গেল কাঙ্ক্ষিত কর্মজীবী না পাওয়ায়। শেষ বয়সে এসে সিলেটে সহকারী সাধারণ ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি যেটা তাকে পীড়া দিছিল প্রায় গোটা ১ টা বছর, ঢাকায় আসাযাওয়ায় স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হল তার। অবশেষে ব্যাক টু দ্যা প্যাভিলিয়ন আর পুরনো কলিগদের সাথে দেখা। ও এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি যে ছোটবেলায় মাঝেমধ্যে আবার অফিসে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল, কি বোর্ড চাপার সুযোগ হয়েছিল আর আব্বুর কলিগরা তখন বলত ক্ষুদে চাকুরে, ক্ষুদে টাইপিস্ট।

লেখা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে, শেষ করতে হচ্ছে কিছু জিনিস বকেয়া রেখেই। অসুস্থ হলে মাথায় কেরা উঠে বাবা-মাকে নিয়ে; আজ বাবাকে নিয়ে লিখলাম। আরেকদিন মা আর বোনদের নিয়ে লিখব। অনেক ধৈর্য নিয়ে বিরতি দিয়ে লেখাটা লিখলাম, জানি না কেমন হইছে!!!! অনেক মিস করি বাবা তোমাকে, আমি আসলেই তোমার প্রতি অনেক কেয়ারলেস।

''ছেলে আমার বড় হবে

মাকে বলত সে কথা

হবে মানুষের মত মানুষ এক

লেখা ইতিহাসের পাতায়

নিজ হাতে খেতে পারতাম না

বাবা বলত '' ও খোকা

যখন আমি থাকব না

কি করবি রে বোকা?''

কেও বলেনা তোমার মত

ওরে খোকা বুকে আয় ................................. :'( :'(

বিষয়: বিবিধ

১২৪৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

237836
২৩ জুন ২০১৪ সকাল ১১:৪৭
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো পিলাচ
237866
২৩ জুন ২০১৪ দুপুর ১২:৫৫
নজরুল ইসলাম টিপু লিখেছেন : ছোটবেলা থেকে রিক্সাভাড়া দিয়ে বলতেন যে ''বাবা এটা তোমার টাকা, এখান থেকে সেভ করতে পারলে এটা তোমার, খরচ হলেও তোমার পকেটের টাকা খরচ''; ব্যাপারটা ২-৩ দিন পর উপলব্ধি করতে পারলাম। আর তাই রিক্সাভাড়া আমাকে ১০ টাকা দেওয়া সত্বেও আমি বাসা থেকে স্কুলে যাওয়া আসা করতাম টেম্পুতে ৭টাকা দিয়ে যার কারণে আমার প্রতিনিয়ত সেভ হত ৩ টাকা করে আর সেই ৩ টাকা দিয়ে আমি একটা সমুচা খেতে পারতাম আর না হয় বড় সেভিংস থেকে আরও ভাল কিছু খেতে পারতাম।

অনেক সুন্দর অনুভুতি! আমার খুবই ভাল লাগল। আজ-কাল এসব অনুভুতি লোপ পেয়ে যাচ্ছে। একদা বাল্য কালে বাবারা একটি টেনিস বল দিলেও সন্তান যেভাবে খুশী হত, এখন তেমনটি হয়না কেননা এখনকার বাবাদের টার্চ স্ক্রিন মোবাইল কিনে দেবার সক্ষমতা নাই! অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File