নির্বাচনের ইতিহাস ও বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা

লিখেছেন লিখেছেন সত্যের সৈনিক ২ ০৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০৬:৩৮:০৪ সন্ধ্যা

প্রাচীন যুগে মানুষ যখন সভ্যতার সূচনা করতে শুরু করেছে তথা আগুন আবিষ্কার করেছে মাত্র, তখন থেকে যদি আমরা দেখা শুরু করি- তাহলে আমরা দেখতে পাব এক দল শিকারির মাঝেও একজন বা দুজন সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছিল। মানুষের সংখ্যা কম থাকায় তখন মানুষের মাঝে ভেদাভেদ, হানাহানি ও মারামারি প্রায় অনুপস্থিত ছিল।

এরপর আস্তে আস্তে মানুষ সভ্যতার পথ ধরে অনেক দূর চলে এল। নানা সভ্যতা পৃথিবীর বুকে আসলো। এর মাঝে উল্লেখ করার মতো হলো- প্রাচীন রোমান, গ্রিক, মেসোপটেমিয়া, ইনকা, মায়া, মিশরীয় ও চৈনিক সভ্যতা ইত্যাদি। সভ্যতার ইতিহাসের প্রাচীন কাল থেকেই প্রাচীন গ্রিস ও প্রাচীন রোমে নির্বাচনের ব্যবহার হয়ে আসছে। গোটা মধ্যযুগে পবিত্র রোমান সম্রাট ও পোপের মতো শাসক বাছাই করতেও নির্বাচন হতো। প্রাচীন ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজারা বাছাই করতেন রাজাদের। বাংলার মধ্যযুগের গোড়ার দিকে পাল রাজাদের মধ্যে গোপালকে বাছাই করতে এই নির্বাচন করা হয়েছিল।

আধুনিক সময়ে এসে নির্বাচনের নানা দিক পাল্টে গেছে। এখন নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়। আধুনিক নির্বাচন বলতে এখন বোঝায় জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচন। সপ্তদশ শতক থেকে আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি আবশ্যিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আধুনিক বিশ্বে নির্বাচন দেয়া হয় সমাজের সবার কল্যাণ সাধনের জন্য সবার মতের প্রতিফলন ঘটাবার জন্য। উন্নত দেশের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে তাদের নির্বাচন ব্যবস্থা কতটা স্বাধীন। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান নির্বাচন পরিচালনা করে তারা সরকারের হস্তক্ষেপের বাইরে। আধুনিক ইউরোপের ইতিহসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের নির্বাচন ব্যবস্থা এতই সভ্য হয়ে গেছে যে, কোনো রকম পিনের আঘাতের ভয় নেই নির্বাচনের সময়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে মানুষ নির্বাচন নিয়ে অনেক বেশি প্রচারণা চালায়, অনেকদিন ধরে মানুষ কাজ করে। বড় বড় পার্টি নানা ঘোষণা দেয়, কিন্তু কেউ কারো সাথে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় যায় না। আইনের প্রতি নাগরিকরা যেমন শ্রদ্ধাশীল একইভাবে দলের নেতাকর্মীরাও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

আমারিকার নির্বাচন ব্যবস্থা এতটায় সুনিয়ন্ত্রিত যে আল গোর অনেক বেশি ভোট পাওয়ার পরও বুশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে পারেনি। এভাবে সারা বিশ্বে নির্বাচন ব্যবস্থাকে জনগণের মতামত ফুটিয়ে তোলার মাধ্যম হিসাবে গড়ে তোলা হচ্ছে।

আমাদের বাংলাদেশ বিশ্বের বাইরের কোনো অঞ্চল নয়, এখানেও নির্বচন পদ্ধতি বিদ্যমান, এখানেও জনগণের ভোটে সরকার পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা নানাভাবে পরিবর্তিত হতে হতে এখন প্রধানমন্ত্রী শাসিত ব্যবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে রাষ্ট্রপতি কাঠের পুতুল ছাড়া আর কিছু নয়।

বাংলাদেশের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হয়। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার কারণে এখানে রাজনীতি পুরোদস্তুর পেশায় পরিণত হয়েছে যেখানে রয়েছে বিত্ত-বৈভব করার অপার সুযোগ, সেই সঙ্গে এখানে নেই জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। তাই কেউ একবার ক্ষমতায় গেলে আর নামতে চায় না তাকে জনগন পছন্দ করুক বা না করুক। এতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ কেউ কারো থেকে কম যায় না। মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি যা করে হোক না কেন ক্ষমতায় থাকতে হবেই।

বাংলাদেশে সদ্য পাঁচ ধাপে উপজেলা নির্বাচন হয়েছে। প্রথম দুই ধাপে বিএনপি ভালো করার পর ভোটের ওপর সরকারি দল যুদ্ধ ঘোষণা করলো। নির্বাচন কমিশন অনেক আগে থেকেই ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য হত, কিন্তু এবারের নির্বাচনে এসে প্রকাশ করে দিল যে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন কমিশনের দরকার নেই। সারা বিশ্বে নির্বাচন ব্যবস্থাকে সুন্দর করে গড়ে তোলা হচ্ছে, নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা হছে এবং এ ব্যবস্থাকে মতো প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে ঘটে চলেছে সম্পূর্ন উল্টো ঘটনা। আমাদের দেশের সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের কোন ভূমিকা এবার ছিল না। নির্বাচনে রক্তপাতের দায় কমিশন এড়াতে পারে না কোনোভাবেই। কিন্তু কমিশনাররা নির্লজ্জের মতো বলে চলেছে আল্লাহর ইচ্ছাতেই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। এটা জাতির সাথে প্রতারণার শামিল।

গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী সংবাদ সন্মেলনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলেছেন- জাসদের কাছ থেকে গণতন্ত্র শিখতে হবে? সেখানে নির্বাচন কমিশন কতটুকু কাজ করছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশ্ন হল এরকম নৈরাজ্যকর অবস্থার মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষতি সাধন করলে জাতি কি পরিণামে সুফল ভোগ করবে?

উপজেলা নির্বাচনে কী হয়নি? ভোটকেন্দ্র দখল, বোমাবাজি, হত্যা-রাহাজানি, মধ্যরাতে ভোটের বাক্সভর্তি থেকে লজ্জার আর কিছু আছে কিনা তা দেশবাসীর জানা নেই। নির্বাচন কমিশনের হয়তো জানা আছে বা সরকারের হয়ত জানা আছে। এখন আধুনিক সমাজে সময়ে কী করে কেন্দ্র দখল করলেই ভোট জিতে যায় তা বোঝার কোন যোগ্যতা আমাদের হয়নি। টিভিতে দেখা গেছে- কেন্দ্র দখল, জাল ভো‌ট, এজেন্ট বের করে দেয়া এবং প্রিজাইডিং অফিসারের ভোট দেয়া থেকে শুরু করে নানা অনিয়ম। অথচ নির্বাচন কমিশন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা সরকার কিছুই দেখল না। এভাবে যদি ভোট হয় তাহলে জনমতের কোন প্রতিফলন উঠে আসে না এবং তা রাষ্ট্রকে অন্ধকারের দিকে ধাবিত করে। এ উপজেলা নির্বাচনে অবাক করার মতো বিষয় যে সংসদের প্রধান বিরোধী দল উল্লেখযোগ্য কোনো ভোট পাচ্ছে না। এতে কি বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে না?

প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে যে প্রহসনের নির্বাচন হয়ে গেল তার পরিষ্কার চিত্র কি সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছে গেল না? জাতি হিসাবে আমাদের মান-সম্মান আমরা বিকিয়ে দিচ্ছি কেবল কিছু মানুষের জন্য ও অথর্ব কিছু প্রতিষ্ঠানের কারণে। নির্বাচনে যদি মানুষের ভোট দেবার অধিকারই না থাকে বা মানুষ মতামত দিলে তা যদি গ্রহণ করার মত মানসিক শক্তি না থাকে তাহলে নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজন করার দরকার নেই। হ্যাঁ, অনিয়ম সবখানেই কিছু না কিছু হয়, কিন্তু যেখানে পুরোটাই অনিয়ম সেটাকে কেন বৈধ বলে রায় দিতে হবে।

ভোটকেন্দ্রে কোনো গোলযোগ হলে বা কেন্দ্র দখল বা ব্যালট ছিনতাই হলে সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন বন্ধ করে দেয়া নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। আমাদের পাশের দেশ ইন্ডিয়াতে ভোটকেন্দ্রে গোলমাল বাঁধলে সাথে সাথে কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়। আমাদের দেশে সবার সামনে জাল ভোট দিলে তা দিনের শেষে গণনা করে চোরকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশকে তার নিজের স্বার্থেই এই পথ থেকে সরে আসার উপায় খুঁজতে হবে। ভোট চোরকে বিজয়ী বলে ফুলের মালা দেবার প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে হবে।

আমাদের পাশের দেশ থাইল্যান্ডে প্রধান বিরোধী দলহীন নির্বাচনকে সে দেশের সাংবিধানিক আদালত অবৈধ ঘোষণা করে নতুন নির্বাচন দিতে বলেছে এবং হবেও তাই। আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে শুরু থেকেই বিরোধী দলহীন নির্বাচনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান যদি এভাবে ধবংস হয়ে যায় ব্যক্তির ইচ্ছায় তাহলে জাতিকে এর জন্য অনেক কঠিন মূল্য দিতে হবে। এস্তোনিয়ায় আজ মানুষ ঘরে বসে ইন্টারনেটে ভোট দিচ্ছে আর আমাদের দেশে মধ্যরাতে ভোট চুরি হয়ে যাচ্ছে, আমরা দিনে দিনে ভূতের মতো উল্টো দিকে হাঁটছি।

একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য যেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা ও শক্তিশালী সরকার ব্যবস্থা থাকা দরকার সেখানে আমরা যেনতেন প্রকার নির্বাচন নামক প্রহসন করে বিদেশিদের কাছে ধর্না দিয়ে বেড়াচ্ছি আর বিদেশি বেনিয়াদের কাছে নিজের স্বার্থ বিকিয়ে দিচ্ছি ক্ষণে ক্ষণে। সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে দেশে এক আতঙ্কময় অবস্থা সর্বদা বিদ্যমান। অস্থিতিশীলতা, হত্যা-গুম, আন্দোলন আর পুলিশি নির্যাতন আজ মানুষের ঘরে ঘরে দুঃস্বপ্নের মত হানা দিচ্ছে। এরকম অবস্থার মাধ্যমে একটা দেশ এগিয়ে যেতে পারে না।

ভোট চুরি, কেন্দ্র দখল এখন আর বিছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখানো সম্ভব নয়। এখন দিনে কারচুপি হয় বলে মধ্যরাতে ব্যালট বাক্সে ভোট দিয়ে আসেন ক্ষমতাসীনরা। এভাবে জনগণের অধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়ার ফলাফল জনগণ সময়মতো পরিশোধ করে দেবে। আশা করবো- সরকার তার ভুলের বৃত্ত থেকে বাইরে এসে জনগণের ভাষা বুঝে ব্যবস্থা নেবে আর সেই সঙ্গে বিরোধী দলকে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে। জনগণ যে পক্ষে রায় দেয় তার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। কেননা রাষ্ট্রের মালিক জনগণ আর যাই হোক তাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের কে প্রতারিত করা দীর্ঘমেয়াদে অনেক বড় ভুল হয়ে যাবে।

বিষয়: বিবিধ

১২৫০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

205215
০৯ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৫১
প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন লিখেছেন : গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র নির্বাচন আর সেই নির্বাচনের পদ্ধতি যদি বন্ধ হয়ে যায় ,ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় ,নির্বাচনে যদি সুষ্ট পরিবেশ না থাকে, তাহলে গণতন্ত্র তার জায়গায় টিকতে পারেনা , ভালো লিখেছেন অনেক ধন্যবাদ।
205269
০৯ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৪৪
205285
০৯ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৪৯
আঁধার কালো লিখেছেন : ভালো লিখেছেন অনেক ধন্যবাদ।
205301
০৯ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৫৮
অনেক পথ বাকি লিখেছেন : ভালো লাগলো । ধন্যবাদ ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File