দারিদ্র্য বিমোচনে ওয়াকফ, ক্ষুদ্র বিনিয়োগ জাকাত ও ওশরের ভূমিকা
লিখেছেন লিখেছেন সত্য কন্ঠ ১৫ জুলাই, ২০১৪, ০৮:০৬:১১ রাত
দারিদ্র্য বিমোচনে ওয়াকফ, ক্ষুদ্র বিনিয়োগ জাকাত ও ওশরের ভূমিকা ~~শাহ আবদুল হান্নান~~
======== পড়ুন ও শেয়ার করুন======
আমাকে ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে চারটি বিষয়ের ওপর বলতে বলা হয়েছিল। আমি সংক্ষেপে মূল কথাগুলো বলার চেষ্টা করব। বিষয়গুলো হচ্ছে ওয়াক্ফ, মাইক্রো-ফাইন্যান্স, জাকাত ও ওশর। আমি প্রথমেই ওয়াক্ফ সম্পর্কে আলোচনা করব। আমরা জানি, মুসলিম ইতিহাসে ওয়াক্ফ একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল। কোনো কোনো গবেষণায় দেখা যায়, মুসলিম বিশ্বের ভূসম্পত্তির বা অন্যান্য সম্পদের ১০-১৫ ভাগ সম্পত্তি ছিল ওয়াক্ফ করা। ওয়াক্ফের দ্বারাই সেই সময় মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও অন্যান্য জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান ও কাজ পরিচালিত হতো। সেসব বিষয় সরকারকে তেমন দেখতে হতো না। এমনকি পথে পথে সরাইখানা নির্মাণ করা হতো, যাতে পথযাত্রীদের অসুবিধা না হয়। এটা ওয়াক্ফ ফান্ড থেকেই করা হতো। যেহেতু ওয়াক্ফ ফান্ড সবার জন্য ব্যয় করা যায় এবং এতে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, তার ফলে সব জাতির, সব সমাজের প্রয়োজন এর মাধ্যমে পূরণ করা যেত। ড. উমর চাপড়া তার ‘ইসলাম ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ’ বইতে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সোভিয়েত মুসলিম ইতিহাসের ওপর আলেকজান্ডার বেনিগ্সন তার বইতে দেখিয়েছেন যে, মধ্য এশিয়ার প্রায় ১০ শতাংশ সম্পত্তি ওয়াক্ফের অধীনে ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর এসব ওয়াক্ফ সম্পত্তি দখল করে নেয়া হয়। সেগুলো সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত করে অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়।
বর্তমান বিশ্বে ওয়াক্ফ গতি হারিয়ে ফেলেছে। ওয়াক্ফের যে বিরাট গুরুত্ব, তা আমরা ভুলে যাচ্ছি। এই ওয়াক্ফব্যবস্থা আবার ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোর জন্য বেশ কিছু দিন ধরে একথা বলে আসছি যে, ‘একটি নতুন ওয়াক্ফ আন্দোলন’ প্রয়োজন। সে আন্দোলনের ফিকাহগত দিক ইসলামিক ফাউন্ডেশন কতৃক প্রকাশিত ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ বইতে পাওয়া যাবে। এখানে এর শুধু প্রয়োগগত দিক ব্যাখ্যা করতে চাই।
আমাদের দেশে যারা বিপুল সম্পত্তির অধিকারী, তাদের সংখ্যা কয়েক শত। তারা যদি তাদের সম্পত্তি শুধু এক-দুইজন সন্তানের জন্য না রেখে, জাতিকে যদি তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দিয়ে যান ওয়াক্ফের মাধ্যমে, তাহলে সেটা খুবই ভালো কাজ হবে। এর পরিমাণ কোনো সম্পত্তির যেকোনো পরিমাণ অংশ হতে পারে। যেমন তা চার ভাগের এক ভাগ কিংবা তিন ভাগের এক ভাগ অথবা দশ ভাগের একভাগ¬ যে কোনো পরিমাণ হতে পারে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি যে, প্রত্যেক বড় বড় ধনবান পরিবার, শিল্পপতি, যাদের সামর্থের পরিমাণ ১০০ কোটি বা তার বেশি, তাদের মালিকানাধীন কারখানার মধ্য থেকে একটি বা দু’টি ওয়াক্ফ করে দিতে পারেন। তাদের নগদ অর্থেরও একটি অংশ ওয়াক্ফ করতে পারেন। তাহলে সেটি সমাজের জন্য অনেক বড় কাজ হবে। ওয়াক্ফ ফান্ড বা সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য একটা মোতাওয়াল্লি কমিটি থাকে।প্রত্যেক ওয়াক্ফকারী তার ওয়াক্ফের জন্য একটি মোতাওয়াল্লি কমিটি করে দিতে পারেন।ওয়াক্ফ সম্পত্তির মূল অংশ ব্যয় করা হয় না। ব্যয় করা হয় সেখান থেকে আয়ের বা লাভের অংশকে। এর সব কিছুই জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়।
এমনিভাবে যদি আমাদের দেশের পঞ্চাশ জন শিল্পপতি পঞ্চাশটি ওয়াক্ফ ফান্ড বা ট্রাস্ট জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য গঠন করেন, তাহলে এটা বিরাট একটা কাজ হতে পারে। এরপর যদি ট্রাস্টগুলো নিয়ে একটি ফেডারেশন গঠন করা যায়, তাহলে সেখান থেকে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাজ ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। সবাই একই রকম কাজ না করে এবং একই এলাকায় না করে ফেডারেশনের মাধ্যমে কে কোন এলাকায় কাজ করবেন, তা ঠিক করে নিতে পারবেন। কে কোন্ কাজ করবেন কোথায় করবেন¬ এ রকম একটি সমন্বয়ের ব্যবস্থা যদি করা যেতে পারে তাহলে এটা জাতীয়ভাবে বিশাল একটা কাজ হয়ে যাবে।
ওয়াক্ফ নগদ টাকায়ও দেয়া যায়। যেকোনো সম্পদ দেয়া যায়। সেটা ভূ-সম্পত্তি হতে পারে, ইন্ডাস্ট্রি হতে পারে। যেমন আমরা জানি, ইসলামী ব্যাংকের ক্যাশ ওয়াক্ফ রয়েছে। সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ক্যাশ ওয়াক্ফ রয়েছে। কাজেই প্রত্যেক শিল্পপতি ওয়াক্ফ ট্রাস্ট বা ফান্ড করলে সেখানে নগদও দিয়ে দিতে পারেন। এই তহবিলের সবটাই ব্যয় করা হবে শুধু জনকল্যাণমূলক কাজে।
ইসলামী ব্যাংকের ক্যাশ ওয়াক্ফে যে কেউ অর্থ দিতে পারেন। একটা শরিয়াহ কমিটির তত্ত্বাবধানে এটা পরিচালিত হয়। তার মাধ্যমে তারা জনকল্যাণমূলক কাজে এটা ব্যয় করতে থাকেন। সেখানে যে কেউ তার টাকা নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করার জন্য উল্লেখ করে দিতে পারেন। যেমন¬ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা কিংবা শিশুদের জন্য ব্যয় করার কথা নির্দিষ্ট করে বলে দেয়া যায়। অথবা বলে দেয়া যায়, যে দিকে বেশি প্রয়োজন ব্যাংক সেখানে ব্যয় করতে পারে। সাধারণভাবে না বলে দিলে সুবিধা হলো, ব্যাংক যে দিকে বেশি দরকার সে দিকে ব্যয় করার সুযোগ পাবে।
সুতরাং আমাদের নতুন করে একটি ওয়াক্ফ আন্দোলন প্রয়োজন। আমি মনে করি, এই আন্দোলন আমাদের দেশের চেহারা পরিবর্তন করতে সাহায্য করবে। এখন মাইক্রো-ফাইন্যান্স নিয়ে আলোচনা করব। ‘ক্রেডিট’ বলি আর ‘ফাইন্যান্স’ বলি, ইসলামের দৃষ্টিতে তা করতে হবে সুদমুক্ত। মাইক্রো-ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে ইসলামের আওতায় যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করা সম্ভব তা অনেক ধরনের হতে পারে এবং তার মাধ্যমে ব্যাপক ফল পাওয়া যেতে পারে। ইসলামের আওতার মধ্যে যেসব পদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্ভব, তার ক’টি উল্লেখ করছি।
প্রথমত, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মাইক্রো-ফাইন্যান্সের কাজ করা যেতে পারে। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে যে পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ করছে, সেটা। তারা বাই-মুয়াজ্জাল বা বাই-মুরাবাহা পদ্ধতিতে গ্রামাঞ্চলে যাদের প্রয়োজন তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। তারা এর জন্য মুরাবাহা বা মুয়াজ্জাল চার্জ (অর্থাৎ বিক্রয়-ক্রয় মূল্যের পার্থক্য) খুবই কম নিয়ে থাকে। এতে কেবল প্রশাসনিক বা পরিচালনা ব্যয় পূর্ণ হয়। এখানে তারা লাভ করতে চাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেছেন, তারা বেশি পরিমাণ আদায় করছেন কি না, এমনকি প্রশাসনিক ব্যয়ের তুলনায়ও বেশি নিচ্ছেন কি না তা স্টাডি করে দেখছেন। তাতে যদি তারা দেখতে পান, আদায়ের পরিমাণ বেশি এবং তা আরো কমানো সম্ভব, তাহলে তারা সেটা কমিয়ে দেবেন। এটা একটা ট্রাডিশনাল পদ্ধতি, যেটা আমরা করতে পারি এবং বর্তমানে তা করা হচ্ছে।
একথা বলে রাখা ভালো যে, মাইক্রো-ফাইন্যান্সের জন্য বর্তমানে যে সময় দেয়া হয় অর্থাৎ ছয় মাস বা এক বছর, সে সময়টা খুবই অল্প। তাই সময় বাড়ানো দরকার। সেই সাথে বিনিয়োগের পরিমাণটাও বাড়ানো দরকার, যেখানে যেখানে বাড়ানো প্রয়োজন। আদায়ের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আদায় সাথে সাথে শুরু না করে কয়েক মাস পর শুরু করা উচিত। ব্যবসার অগ্রগতির জন্য কিছু সময় দেয়া দরকার। এই অবকাশ তিন মাস, ছয় মাস বা নয় মাস হতে হবে। অথবা প্রয়োজন বিশেষে এক বছরও হতে পারে। এটা নির্ভর করবে পরিস্থিতি, ঘটনা, কোন খাতে বিনিয়োগ দেয়া হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ের ওপর। এ ধরনের পরিবর্তন আনা ইসলামী ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে আইডিবি’র সাথেও আমার আলোচনা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের সাথেও হয়েছে। আমি আশা করি, তারা এ বিষয়গুলো দেখবেন। এখন অন্যান্য কী পদ্ধতিতে মাইক্রো-ফাইন্যান্সকে জনগণের প্রয়োজনে লাগানো যায় তা দেখা যাক।
এর একটা দিক হচ্ছে, মাইক্রো-ফাইন্যান্সের সাথে ওয়াক্ফ চ্যারিটি কিংবা জাকাতকে জড়িয়ে একটি পরিকল্পনা করা যায়। তাহলে আমরা দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য আনতে পারি। এর মধ্যে একটা পদ্ধতি হচ্ছে, সব টাকা কর্জে হাসানা দেয়া এবং পুরো টাকাটাই ফেরত নেয়া আর এতে যে প্রশাসনিক ব্যয় তা আমরা ওয়াক্ফ ফান্ড থেকে বহন করব। অথবা আমরা সেটা চ্যারিটি, সাদাকাহ বা জাকাত ফান্ড থেকে ব্যয় করব। কেননা জাকাতের অন্যতম একটা খাত হচ্ছে ‘আমিলিনা আলাইহা’ অর্থাৎ জাকাত আদায়কারী কর্মচারীদেরকে তা থেকে বেতন দেয়া যায়। সুতরাং আমরা এখানে একটি বৈচিত্র্য বা পরিবর্তন আনতে পারি।
আমরা এটাও করতে পারি যে, একেবারে দেয়ারই সাধ্য যাদের নেই, যারা হতদরিদ্র, তাদের চিহ্নিত করে কিছু ক্ষেত্রে আমরা তাদের বিনিয়োগ দেবো। কিন্তু ফেরত দেয়ার সময় তাকে সেই বিনিয়োগের ৭৫ শতাংশ ফেরত দিতে হবে না। বাকি মাত্র ২৫ শতাংশ ফেরত দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে এই ৭৫ শতাংশ এবং প্রশাসনিক ব্যয় আমরা বহন করব জাকাত ফান্ড, চ্যারিটি ফান্ড অথবা ওয়াক্ফ ফান্ড থেকে। এভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা ২৫ শতাংশ বা ৫০ শতাংশ নাও নিতে পারি। এসব ক্ষেত্রেও তা নেয়া হবে না এবং প্রশাসনিক খরচ ওয়াক্ফ ফান্ড, জাকাত ফান্ড বা অন্যান্য সাদাকাহ ফান্ড থেকে বহন করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে আমরা ১০০ শতাংশই নেব না। প্রথমবারের ১০০ শতাংশ নেবো না। কিন্তু যদি দ্বিতীয়বার দেখা যায় যে, সে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে তার কাছ থেকে যতখানি সম্ভব নেবো। প্রকৃতপক্ষে জাকাত তো এ ধরনেরই। কেননা জাকাত আসলে সম্পদ স্থানান্তর। কাজেই এটা করা যায়। এই টাকা আমরা নেবো না। অর্থাৎ বলছি ২৫ শতাংশ, ৫০ শতাংশ বা ১০০ শতাংশ¬ সেটা আসলে ব্যয় হবে জাকাত, ওয়াক্ফ, চ্যারিটি বা সাদাকাহ থেকে। সুতরাং মাইক্রো-ফাইন্যান্সকে যদি ওয়াক্ফ, সাদাকাহ, চ্যারিটি ও জাকাতের সাথে সমন্বিত করতে পারি তাহলে এর ভেতর নানা ধরনের বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন আমরা নিয়ে আসতে পারি, যেটা ট্রাডিশনাল মাইক্রো-ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে করা সম্ভব নয়। এ কথা সত্য যে, তাদের কনসেপ্টে ওয়াক্ফ নেই। এ ধরনের জাকাতের ধারণা নেই। আর যদি থেকে থাকে বা তারা এ রকম কিছু করে নেয়, তাহলে ভালো কথা। তারা এ ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করুক। ইসলামের ভালো নীতি যদি কেউ নেয়, তাহলে আমরা খুশি হবো। তাদেরও ভালো দিকগুলো আমরা গ্রহণ করে থাকি। আমি এটাই জানালাম যে, ইসলামের মাইক্রো-ফাইন্যান্স কত উত্তম হতে পারে। যতটুকু আমি জানি, আইডিবি এ ধরনের চিন্তা করছে। ইসলামী ব্যাংকেরও এ ধরনের নতুন প্রজেক্ট নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্পর্কে ইসলামী ব্যাংকের কর্তৃপক্ষকে আরো চিন্তা-ভাবনা করতে অনুরোধ করছি।
আজকের তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে জাকাত। জাকাত সম্পর্কে এখানে আমি এই আলোচনা করব না যে, এর রেট (হার) কী, এর আইটেম কী এবং এর প্রাপক কে? এ বিষয়ে আপনারা বিভিন্ন দেশের জাকাত অ্যাক্ট দেখতে পারেন। আমার জানা মতে, ইসলামী ব্যাংকের সেক্রেটারির কাছে এর কপি আছে। এর জন্য বাংলাদেশের জাকাতের আইন দেখতে পারেন। সর্বোপরি এ বিষয়ে ড. ইউসুফ আল কারজাভির বই ‘ইসলামে যাকাতের বিধান’ প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড সবার দেখা উচিত। তাতে তিনি জাকাতের সম্পূর্ণ বিষয় আলোচনা করেছেন। যেসব বিষয়ে মতবিরোধ আছে সেসব বিষয়েও তিনি সেখানে আলোচনা করেছেন। সেই বই দেখলে জানা যাবে, কোন মতটা বেশি শক্তিশালী। তিনি সব মত দিয়েই সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে এর চেয়ে মূল্যবান বই আর নেই।
জাকাতের ওপর শুধু একটি কথা এখানে বলব। সরকারের একটা জাকাত ফান্ড আছে। কিন্তু এটাতে জাকাত আদায় হয় না, হচ্ছে না বা কম হচ্ছে। এর নানা কারণ আছে। আমার মনে হয়, সরকারের পক্ষে বাধ্যতামূলক জাকাত আদায় করা সম্ভব হবে না। আমাদের দেশে রাজনীতির যে অবস্থা, জনগণের মধ্যে যে ধরনের বিভক্তি এবং যে ধরনের বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে, তাতে বাধ্যতামূলক জাকাত আদায় করা আমাদের দেশে বর্তমানে সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না, যেটা কোনো কোনো দেশে হচ্ছে। তাহলে আমাদের কী করতে হবে? এর জন্য আমাদের প্রাইভেট সেক্টরেই জাকাত আদায় করতে হবে। আর প্রাইভেট সেক্টরে জাকাত আদায় করলে সেটা উত্তম হবে। ওয়াক্ফের মতো এই প্রস্তাবই দিতে চাই যে, প্রত্যেক মুসলিম শিল্পপতি ও বড় বড় ব্যবসায়ী নিজেরাই এক একটা জাকাত ফান্ড করুন। আপনারা যারা বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী আছেন, যাদের সম্পদের পরিমাণ অনেক, যাদের জাকাতের পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা, আপনারা প্রত্যেকে একটা করে জাকাত ফান্ড করুন। তারপর সেখান থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যয় করার চেষ্টা করুন। চিন্তা করুন, কিভাবে লোকদের কর্মসংস্থান করে দেয়া যায়। এর জন্য যার যার চাহিদানুযায়ী তাকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিন। যেমন, যার ঘর নেই, তাকে একটা ঘর করে দিন। যার টিউবওয়েল দরকার, তাকে টিউবওয়েল দিয়ে দিন।
আমি অনুরোধ করি প্রাইভেট সেক্টরের বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি ও কমার্শিয়াল হাউস এসব বিষয় গুরুত্ব দিতে। যারা বড় বড় আমদানিকারক, হোলসেলার, যারা শত শত কোটি টাকার আমদানি করেন, তারা যদি তাদের প্রদত্ত জাকাতের জন্য একটি ফাউন্ডেশন করেন, একটি করে নিজস্ব জাকাত ফান্ড করেন তাহলে তার দ্বারা আমাদের দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। যারা নিজেরা জাকাত দিচ্ছেন, তারা কখনোই এই ফান্ড নষ্ট করবেন না। আর যিনি এত টাকা দিতে পারেন, তিনি এই টাকা থেকে কিছু নিয়ে নেয়া অসম্ভব ব্যাপার। সুতরাং প্রত্যেকে জাকাত ফান্ড গঠন করুন এবং একটি কমিটি গঠন করে তা ব্যয় করুন। জাকাতের আইন মোটামুটি সবারই জানা¬ কে জাকাত পায় আর কে পায় না, সে বিষয়ও সবার কাছে স্পষ্ট। খুব বেশি প্রয়োজন হলে বা সন্দেহ থাকলে আলেমদের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
জাকাতের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। আরেকটি উদ্দেশ্য মানুষ যেন লোভী না হয়ে যায়। এ জন্যও আল্লাহ তায়ালা জাকাতের বিধান করেছেন। মানুষ যেন লোভী না হয়। মানুষের অন্তরকে ভোগবাদী না বানানোই এর উদ্দেশ্য। সূরা তওবায় আল্লাহ বলছেন ‘হে রাসূল! তাদের মাল থেকে জাকাত আদায় করুন এবং তাদেরকেও পবিত্র করুন এবং তাদের পরিচ্ছন্ন করুন।’ আমরা বলি জাকাত আদায় করলে সম্পদ পরিচ্ছন্ন হয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক। কিন্তু এই আয়াত দ্বারা এই বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে যে, জাকাত আদায় দ্বারা দাতাকেই পরিচ্ছন্ন করা উদ্দেশ্য। এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। আমরা যারা দান করতে অভ্যস্ত হয়ে যাব আল্লাহ চাইলে আমরা দুনিয়াতে অত লোভী হবো না। এ বিষয়টি সবার বিবেচনায় আনার জন্য অনুরোধ করছি।
পরিশেষে, ওশর সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব। ফসলের জাকাতকে ওশর বলে। এ ব্যাপারে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণে এখানে ফসলের জাকাত আদায় হচ্ছে না। এ ব্যাপারে মুফতি শফীর মত হচ্ছে, বাংলাদেশের ভূমির ওপর জাকাত প্রযোজ্য। ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ কাউন্সিলের সাবেক সেক্রেটারি মরহুম মাওলানা সাইয়েদ মোহাম্মদ আলী লিখে গেছেন, এ দেশে ওশর প্রযোজ্য। সেন্ট্রাল শরিয়াহ কাউন্সিলের বর্তমান চেয়ারম্যান মুফতি আবদুর রহমান সাহেবের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। তিনি ফতোয়া লিখে রেখেছেন যে, এখানে ওশর দিতে হবে। আমি তাকে এটা তাড়াতাড়ি প্রকাশ করতে বলেছি। প্রত্যেক এলাকায় যদি ওশর আদায় হয় এবং যারা বড় বড় ভূ-সম্পত্তির মালিক তারা যদি ওশর আদায় করেন, তাহলে সেই আদায়কৃত ওশর ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক হবে। আমরা জানি, সেচ লাগলে ওশর দিতে হবে ৫ শতাংশ এবং সেচ না লাগলে ১০ শতাংশ দিতে হয়। এখানে হার বেশি, কিন্তু তার পরও আল্লাহ তায়ালা মানুষকে উৎসাহিত করেছেন দান করার ক্ষেত্রে। যিনি বেশি পারেন তিনি তার পাশেরজনকে দান করবেন, তাদের সাহায্য করবে, খেদমত করবে। এভাবে তাদের নিজ অন্তরকে নিজে পরিচ্ছন্ন করবেন।
আমি ইসলামী ব্যাংককে খুব ভালো জানি। এটা এ দেশের একটা মহৎ প্রতিষ্ঠান। এর দ্বারা গোটা দেশের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবারই উপকার হচ্ছে বলে জানি। তারা এ দেশে দারিদ্র্য বিমোচনেরও চেষ্টা করছেন। তারা একটি ফাউন্ডেশনও করেছেন। এসব কিছু কল্যাণকর কাজ। ভবিষ্যতে এসব কাজ তারা আরো বাড়াবেন বলে আশা করি। (ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড আয়োজিত ‘দারিদ্র্য বিমোচনে ওয়াক্ফ, ক্ষুদ্র বিনিয়োগ, জাকাত ও ওশরের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও ইফতার মাহফিলে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধ।)
লেখকঃ চিন্তাবিদ, সাবেক সচিব বাংলাদেশ সরকার
(কপি)
বিষয়: বিবিধ
১৬৩৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন