তোমার সিমান্তে আমি

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ শাহিদ শিলন রেহমান ০৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০৭:৫৭:১৬ সকাল



কয়দিন থেকে মনের মধ্যে সবসময় একরকম অস্থিরতা বিরাজ করছে। অতীতের পাওয়া উষ্ণ সেইসব সৃতি গুলো তাড়া করছে করছে আমাকে সদা। সেগুলোকে ফিরে আবার ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। মাঝে মাঝে এলোমেলো বাতাস আমাকে উদাসিন করে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেদিনের সময়টাতে।

এদিকে বাসার অভিভাবক গুলো বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। একটু পরপর এসে আমাকে আমার মতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসায় ফেলতেছে। বড় আপু তো ওইদিন বলেই ফেললো, কীরে আমাদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করবি না ঠিক আছে, কিন্তু তোর পছন্দের মেয়েটির নাম টাই নাহলে বল, দেখি আমি বাবা কে ম্যানেজ করতে পারি কিনা?

আমি বললাম, কি বলছ আপু?

তুই তো জানিস আম্মা মারা যাবার পর বাসাটা কেমন খালি খালি লাগছিলো। পাঁচ বছর আগেই তোর বিয়ের কথা চলছিলো। যাতে বাসার খালি খালি ভাব টা দূর হয়। আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে তখন বাধা দিয়েছিলাম, বাবা কে বলেছিলাম, না বাবা, ওর বিএসসি টা শেষ হউক। তা নাহলে বিয়ের পর নানা ঝামেলায় পড়ার পাঠ চুকে যাবে। বাবা সেদিন কি মনে করে যেন আমার কথাটা মেনে নিয়েছিল। তাই আজ নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে তোর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছি। আপা কথা গুলো বলে থামলো।

আমি বললাম, প্লিজ আপা আমার এখন ভাল লাগছে না। আমি এখন বিয়ে করবো না।

আপা বলল, কেন করবি না? এখন তো তোর বিএসসি শেষ, ভালো একটা জব করতেছিস, এখন সমস্যা কি? তোর কোন পছন্দ থাকলে আমাদের বল। আমরা তো না করতেছি না। তাছাড়া বাবার শরীর আগের থেকে অনেক দুরবল হয়ে গেছে এইটা তো বুঝিস। তাকে দেখার তো একজন আপন লোক চাই। আমি এইভাবে এসে বারবার দেখলে আমার সংসার দেখবে কে?

আমি কোন কথা না বলে নীরব থাকলাম।

মরিয়ম আবারো বলল, কীরে আলি তুই কি এখন চুপ করেই থাকবি?

আপা প্লিজ আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও। আমি খুব ক্লান্ত।

-কয়েকটা দিন মানে কতদিন? মরিয়ম বলল।

-ইয়ে মানে দুমাস মত আর কি। আমি বললাম। আপার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

-কয়েকটা দিন যে দুইমাস হতে পারে তা জানতাম না তো। আপা কিছুটা বিস্ময় ভাবে বলল।

-ইয়ে মানে ঢাকাতে যায় আগে পরের বার এসে তোমাদের কথা আমি মানবো। যা বলবে তাই করবো।

আপা এবার আরও অবাক হয়ে বলল, এইতো মাত্র তিন দিন হলো তুই বাড়ি এসেছিস। এরমধ্যে ঢাকাতে যাবি আবার! তুই না বললি, এবার মাস খানেক থাকবো।

-থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আর থাকতে পারবো না। একজন কে আমায় খুজে বের করতেই হবে যে করে হউক। দৃঢ়তার সাথে জবাব দিল আলি।

-কাকে খুঁজবি? আর কেনই বা খুঁজবি? আমি তো কিছুই বুঝতেছি না। মরিয়ম বলল।

-আমি আগে তাকে খুজে পায় পড়ে তোমাকে সব বলব। আলি বলে থামল।

-তার মানে তোর কি পছন্দের কেউ ছিল। যাকে খুঁজবি। আপার প্রশ্ন।

-জানিনা। তবে মনে হচ্ছে আমার জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে তার অবস্থান। যা আগে কখন বুঝিনি। তাকে আমার খুব প্রয়োজন। আপা প্লিজ তুমি বাবা এবং ফুফুকে ম্যানেজ করো দুইমাসের জন্য।

মরিয়ম দাড়িয়ে কিছুটা ভাবল। কিন্তু কিছু বলল না। আচ্ছা দেখছি বলে আলির ঘর থেকে চলে গেলো। মরিয়ম আপা চলে যাবার পর, আলি তার পুরানো ডায়রি গুলো ঘাটতে লাগলো এই ভেবে যে কোথাও মালিহার বাসার ঠিকানা আছে কিনা দেখার জন্য।

মালিহা, পুরো নাম ফাইরুজ মালিহা চৌধুরী, বাড়ি বরিশাল, মোবাইল নং ০১৭৪২৯১৯৩৯২। নাম্বার টা টানা পাঁচ বছর থেকে বন্ধ। আর তেমন কোন ইনফরম্যাশন নেই। মেয়েটা আলি কে বড্ড ভালোবাসতো। সারাক্ষণ জ্বালাতন করতো। আলি তার প্রতি খুব বিরক্ত ছিল। প্রতি ঘণ্টাতে মালিহা আলির কাছে ফোন করতো। এখন অবশ্য আলি মালিহার সেই জ্বালাতন গুলো কে খুব মিস করে। আলি এখন খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে যে মালিহার মত এত গভীর ভাবে কেউ ওকে ভালবাসতে পারেনা। মাথার মধ্যে এই ভাবনা গুলো গিজগিজ করতেছে।

আলি প্রতিজ্ঞ হয় যখন মালিহার একপাক্ষিক ভালবাসা তাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ভাবে যেভাবেই হউক মালিহা কে তার খুজে বের করতে হবেই। কিন্তু কিভাবে এই চিন্তা তার মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাড়ায়। মালিহার শেষের দিন গুলোর কান্না আহাজারি গুলো আলিকে তার হৃদপিণ্ডে চাবুক দিয়ে আঘাত করে প্রচণ্ড বক্র ভাবে।

মাঝে মাঝে মালিহা বলতো, শোন আমাকে এখন এভাবে অবহেলা করতেছো তো, একদিন এমন দিন আসবে যখন আমাকে পাওয়ার জন্য তুমি পাগল প্রায় হয়ে যাবে। কিন্তু সেদিন হয়তো আমি তোমার পাশে থাকবো না আর আমাকে খুজতে খুজতে তুমি হয়রান হবে।

সত্যিই তো আজ আমি মালিহা কে কত উন্মুখ হয়ে গেছে। তার ভালবাসা এখন আমাকে সারাদিন ভাবায়। মনের গহীনে তার জন্য এত সুপ্ত ভালবাসা আগা অনুভব করতে পারিনি কখনও।

অনেকগুলো পুরনো ডায়েরি ঘাটা হলো কোথাও মালিহার সন্ধান মিলল না। আলি একটা ডায়েরি লেখার আসক্তি আছে সে প্রতিমাসেই নতুন নতুন ডায়েরি লেখে এবং প্রতিমাসে তার জিবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর আদ্যপ্রান্ত সে লিপিবদ্ধ করে। মালিহা তো তার জীবনের বড় একটা ঘটনা সে তাকে নিয়েও লিখেছে এইটা মনে আসছে কিন্তু কোন ডায়েরিতে লিখেছে এইটা সথিক জানা নাই। এইজন্য সবগুলো ঘাটতে লাগলো।

সবগুলো ডায়েরির মধ্যে খোজ করার পর বুঝলাম এখানে দুইটা ডায়েরি নাই। যার একটা প্রাইমেট মেডিক্যাল কোচিং সেন্টার থেকে দেওয়া। যে ডায়েরিটা আলি ভীষণ পছন্দ করতো। মেডিক্যাল কোচিং করার সময় প্রাইমেট কর্তৃপক্ষ সবাই কে একটা করে সুন্দর ডায়েরি দিয়েছিলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো নোট করার জন্য। কিন্তু আলি অই ডায়েরি টা তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নোট করার কাজে ব্যবহার করতো।

কিন্তু শেষে চাকরি তে যোগদানের পর পুরনো ডায়েরি গুলোকে আর যত্ন নেইনি। কিন্তু এখন সে ভাবছিল আমার মনে হয় অই ডায়েরি টায় আমি মালিহার বিষয়ে কিছু লিখেছি। আলি সব সময় কোন ব্যক্তির বিষয়ে লেখার আগে তার পুরো নাম ঠিকানা দিয়ে শুরু করে। এমন কি কোন স্কুলে পড়েছে তাও সে লিখে রাখতো। এইজন্যই ডায়েরি টাকে তার খজার জন্য মন উতালা হয়ে উঠলো।

অনেকক্ষণ একমনে ভাবলো। মনে পড়লো পুরানো সব কাগজ-পত্র তো জহুরী মহল্লার যে বাসাতে ভাড়া থাকতো সেখানে ফেলে এসেছিলো। তখন ভেবেছিলো ওইগুলো তার প্রয়োজনীয় না। এজন্য সে তাচ্ছিল্য ভাবে ফেলে রেখেছিলো। নেবার প্রয়োজন মনে করেছিল না। আলির মনে এবার ভাবনা আসলো দুই বছর হয়ে গেলো ওখান থেকে চলে এসেছি। জানিনা আমার মেসের যেসব পোলারা থাকতো তারা আছে কিনা? আমার মনে শুধু এই দ্রিড়তা ভর করলো, আমার অই ডায়েরি টা প্রয়োজন, যেভাবে হউক আমার ওটা ম্যানেজ করতেই হবে।

সেইদিন রাতেই আলি ঢাকাতে চলে আসলো আপা মরিয়ম কে ম্যানেজ করে। প্রথম দুইদিন আলি নিজের ফ্ল্যাটে প্রতিটি টেবিল এবং র্যা ক চেক করলো। এই ফ্ল্যাটে আলি একাই থাকে। চাকরি পাওয়ার পর কোম্পানি থেকে ফ্ল্যাট টা আলি কে দিয়েছে। সে নিজের বাসার আরও অন্যান্য ডায়েরি, নোটবুক গুলো খুটে খুটে দেখলো এর মধ্যেও কোথাও মালিহার ঠিকানা আছে কিনা। আলির কোন কিছুই মনে আসলো না। শুধু এইটুকু জানে মালিহার বাড়ি হচ্ছে বরিশাল। এর বেশি কিছু না। তবে আলি জানে যে মালিহা নিজের ঠিকানা তার ডায়েরিতে লিখে দিয়েছিলো। তখন বারবার আলি কে বলতো যে বরিশালে যাবার জন্য। কিন্তু আলি মালিহা কে সহ্য করতে পারত না। কিন্তু এখন টাকে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে গেছে। সব ডায়েরি গুলো দেখলো না, কোথাও নেই মালিহার ঠিকানা এবং সেই ডায়েরি গুলোর মধ্যে অই ডায়েরিটা নেই!

এভাবে রাত ২ টা পর্যন্ত সব আলমারি, টেবিল, র্যা ক তন্নতন্ন করে খুজলো কোথাও সেই ডায়েরি নেই। এবার ভাবল আগের ম্যাচে একসাথে থাকা বড় ভাই মইনুলের কাছে ফোন দেই। মইনুল ভাইয়ের নাম্বার ফোনে ছিল কিন্তু প্রায় ২ বছর হয়ে গেলো একবারও ফোন করা হয়নি। আসলে আসার সময় একটা বিষয় নিয়ে মইনুল ভাইয়ের সাথে আলির মন কষাকষি হয়েছিলো। এই থেকে আর ফোন দেওয়া হয়নি। তো আজকে ফোন দেওয়া হলো, কিন্তু “দুঃখিত, আপনার ডায়েল কৃত নাম্বার টিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষন করে আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।“ মানে ফোন বন্ধ আছে। এভাবে অই রাতে প্রায় আমি আরও ২০-২৫ বার ফোন দিলাম একই রকম উত্তর। মানে বন্ধ আছে।

আলি সিদ্ধান্ত নিলো সকাল বেলা জহুরী মহল্লা টার সেই ফ্ল্যাটে যাবে। খোজ নিয়ে দেখবে কোন ধরনের কুল কিনারা পায় কিনা। কারণ এখন আলির মনে পরছে আসার সময় মইনুল ভাই বলেছিল এই ডায়েরি গুলো নিয়ে যাও। আলি বলে ছিল এই গুলো আপনি রেখে দিন। এখন আলির সেই গুলো ফিরে পেতে চাই।

পরদিন সকাল দশটার দিকে আলি গেলো জহুরী মহল্লার সেই সুপরিচিত ফ্ল্যাটে। যেখানে জীবনের অনেক গুলো মধুর সময় কাটিয়েছে এই মেস বাসাতে। মনে পড়ে এই মেসে মাঝে মাঝেই মালিহা চলে আসতো। তাঁর সকল রুম মেট দের সাথে গল্প করতো। তাঁর এলোমেলো বই খাতা গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতো। যেদিন আসতো সেদিন পলাশ ফুল নিয়ে আসতো অনেক করে। রুমে ছিটিয়ে দিতো। যার ঘ্রাণে পুরো ঘর সুবাসিত হতো। আলির মেসের সব মেম্বারের সাথে তাঁর ভালো খাতির। এমন কি বাড়িওয়ালা পর্যন্ত জানতো মালিহা হচ্ছে আলির ভালবাসার মানুষ। কিন্তু আলি এইগুলো একদম সহ্য করতে পারতো না। অনেক ভাবে অপমান করতো মালিহা কে। এই জন্য মেসের অন্যান্য মেম্বার পর্যন্ত আলির ওপর রাগ করতো। আলি মালিহা কে খুব মেরে ছিল একদিন। কিন্তু মালিহা বলতো, ভালবাসার মানুশের হাতে মার খাওয়ার নাকি অনেক মজা। মেসের প্রতিটি সদস্য মালিহার দিক নিয়ে আলি কে বোঝাতো। কিন্তু আলি মানতো না। এই জন্যই মেস ছেড়ে চলে আসে আলি।

আলি গিয়ে কলিং বেল বাজালো। একটা অপরিচিত মুখ যেন ভেসে আসলো আলির সামনে দরজা খোলার সাথে সাথে।

-কে, কাকে চাচ্ছেন? ভিতরের ছেলেটা বলল।

-আলি বলল, এখানে মইনুল, শামিম, তুহিন, মিজান বলে অনেক গুলো ছেলে থাকতো না। তাঁরা কি আছেন?

-ছেলেটা আলির মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, আসেন ভিতরে আসেন।

-আপনাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে মনে হচ্ছে। দাঁড়ান আপনার জন্য পানি আনি। বলে একগ্লাস পানি এনে আলির দিকে এগিয়ে দিলো। পানিটা খেয়ে নিন, তারপরে আপনার কথা শুনি।

- আসলে আলি খুব ক্লান্ত ছিল, কারণ মনের মধ্যে মালিহার চিন্তা বুদ করে রেখেছে। আলি খুব অবাক হলো। ঢাকা শহর বাসির দেখছি সৌজন্যতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আলি কিছু না বলে পানিটা ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।

-ছেলেটা বলল, ভাইয়া একটু বসেন, আমি আসছি। এই বলে সামান্য সময়ের জন্য ভিতরের দিকের রুমে গেলো।

এবার আলি রুমের মধ্যে একটু পর্যবেক্ষণ করতেই প্রথমে ভাবল সে ভুল বাসাতে এসেছে। কারণ রুম গুলোর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সবগুলো কেমন ছিমছাম। আলিরা যখন এখানে থাকতো সবসময় কেমন উৎসব উৎসব থাকতো। এখন যে নিরবতা সেই গুলো কে গ্রাস করেছে। তাঁর মনে এইটা বারবার আসলো হয়তো ভুল বাসাতে এসেছে। পরে ছেলেটা এসে আমাকে আশ্বস্ত করলো যে আমি ঠিক বাসাতেই এসেছি।

-ছেলেটি এসে বলল, ভাইয়া আসলে আমি এখানে থাকিনা। ভর্তি পরিক্ষা দেবার জন্য দুইদিন আগে এসেছি। এটা আমার খালার বাসা। তবে আপনার ইনফরম্যাশন অনুযায়ী এইটাই আপনার অনুসন্ধিৎসু বাসা। এইটা আমি হলফ করে বলতে পারি।

আমি বুঝলাম মইনুল ভাইয়েরা মেস ছেড়ে চলে গেছে এবং এখন এই ফ্ল্যাট টা ফ্যামিলি ফ্ল্যাট হয়ে গেছে। আমার মাথা ধরেছিল এবং কানের মধ্যে বুম ধরে আসছিলো। হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম মনে হলো। তারপরেও জিজ্ঞাসা করলাম,

-তোমার খালারা কতদিন আগে এই বাসাতে উঠেছে কিছু জানো?

-ছেলেটি বলল, ভাইয়া সামান্য অপেক্ষা করুন, খালামনি আসছে উনাকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো উনি আপনাকে অনেক ইনফরম্যাশন দিতে পারবে।

আনটি টাইপের ভদ্র মহিলা টা এসে আমাকে বলল, আমরা তো প্রায় দুইবছর হয়ে গেলো এই ফ্ল্যাটে উঠেছি। আগের ছেলে গুলো কোথায় আছে তাতো বলতে পারবো না। মহিলাটি সিলেটী বলে উনার অধিকাংশ ভাষায় আমার বোধগম্য হলো না। তবে এইটুকু বুঝতে পারলাম উনি বলল, আমরা এসে বাসা খালিই পেয়েছিলাম। কারণ আমরা সেই মাসের ৫ তারিখে উথেছিলাম তো তাই।

-এবার ছেলেটি আমার সমস্যা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল বোধই। আপনি বরং বাড়িওয়ালার কাছে যান। উনি কোন তথ্য দিতে পারে কিনা দেখেন।

-পরামর্শ টা খুব ভালো লাগলো আলির। আলি জানে বাড়িওয়ালা পাচতলাতে থাকতো। এবং উনার সাথে আলির একটা ভালো ভাব আছে। নামাজ পড়তে যেতো একসাথে। ইফতারে আলি কে মইনুল কে দাওয়াত দিতো। সোজা পাঁচতলাতে গিয়ে কলিং বেল বাজালে বাড়িওয়ালাই খুলল এবং আলি কে একবারেই চিনে ফেলল। কিছুক্ষন কুশল বিনিময় করে উনি আগমন সম্পরকে জানতে চাইলো।

-আলি তাঁর প্রয়োজনের কারণ টা বলল।

-বাড়িওয়ালা ওকে বস্তে বলে ভিতরে গেলো এবং একটা বড় নোটবুক এনে আলির সামনে রাখল। এই খানে সবার নাম ঠিকানা লিখে রাখেন। কবে উঠেছে, কবে গেছে সব ইনফরম্যাশন নোট করে রাখেন। মোবাইল নাম্বার সহ। এবং কেউ চলে গেলে সে কোথাও বর্তমানে আছে সেটাও মাঝে মাঝে কয়েকজনার লেখা আছে।

-নোটবুক থেকে আমাদের সাথে যারা মেসে ওই ফ্ল্যাটে থাকতাম সবার নাম ও মোবাইল নং আমি একটা কাগজে লিখে নিলাম। শেষে চাচা কে বিদায় জানিয়ে চলে আসলাম।

নিজের ফ্ল্যাটে এসে একের পর এক নাম্বারে ফোন দিতে লাগলো আলি, কিন্তু একি সব নাম্বার গুলোই বন্ধ দেখাচ্ছে। রাগে ক্ষবে নিজের দামি হ্যান্ড সেট টা বেডের উপর জরে একটা আছাড় দিলো। তারপর খানিক ক্ষণ ব্যাল্কনিতে রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকলো চোখ বুজে। চোখ ফেটে কান্না আসছিলো। কিছু বুঝতে পারছিলো না। একটা কথা মনে বারবার আঘাত করছিলো তাহলো মালিহা কে ঠিক একই ভাবে কাঁদিয়েছিল। এজন্যই আজকে কষ্টটা এত বেশি লাগছে।

কিছুক্ষণ ভাবনার মাঝে ডুবে থেকে হটাত মনে পড়লো মইনুল ভাইয়ের কথা, ওহ মইনুল ভাই তো সাভার ইপিজেডে চাকরি করতো। সেখানে গেলেই তো হয়! হয়তো মইনুল ভাইকে ওখানে পাওয়া যাবে।

পরেরদিন সাভারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো শ্যামলি বৈশাখী বাসের কাউন্টার থেকে। বাস যখন আমিন বাজারের কাছে তখন পকেটে ফোনের ভাইব্রেশন টের পেলাম। মোবাইল টি নিয়ে দেখলাম স্ক্রিনে লেখা কাবেরি আপু। কাবেরি আপু হচ্ছে আলির বড় বোন মরিয়মের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। কাবেরির গ্রামের বাড়ি মেহেরপুর জেলাতেই। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে এখন পুলিশ প্রশাসনে আছেন। বিসিএস পরিক্ষা দিয়ে প্রথমে সিভিল পুলিশ থেকে র্যাড়বের অপারেশন কমান্ডার হিসাবে দায়িত্বরত আছেন।

ফোন রিসিভ করতেই প্রশ্ন, আলি তুই কোথায় আছিস? বাড়ি থেকে কাউকে না বলে নাকি ঢাকা চলে এসেছিস। তোরা ছেলেরা একটু বড় হলেই বাবা-মা এবং বড় ভাইবোনের আদেশ অমান্য করতে ব্যস্ত। কেন না বলে এসেছিস?

-এড়িয়ে গিয়ে বললাম, না মানে আমার একটু কাজ ছিল তো তাই।

-মিথ্যা বলছিস কেন? আমি তোর অফিসে গিয়েছিলাম তোর খোঁজে তাঁরা বলল, তুই নাকি দুইমাসের ছুটি নিয়েছিস। ছুটি যদি নিলি তো বাসাতে না কাটিয়ে আবার ঢাকাতে ফিরে আসলি কেন? আর এখন আমাকে কাজ বুঝাচ্ছিস। কি কাজ তোর?

-তুমি বুঝবে না।

-আমি জানতাম তুই এমন কোথায় বলবি। কি কাজ বল আমাকে। আমি জানতে চাই। শোন একটা কথা বলি আমি কোন না কোন ভাবে তোর এই কাজে উপকারে আস্তে পারি। কি বল। কাবেরি আপু জোর করতে লাগলো।

-তুমি আমার কি উপকার করবে। আমার কোন মানুষের উপকার দরকার নাই। তবুও বলি আমি একজনার খোঁজে যাচ্ছি।

-কার খোঁজে, বউ খুজছিস নাকি বন্ধু? কাবেরি আপু একটু হেসে হেসে বলল।

-মনে করো দুটোই। তুমি হাসছ। তুমি নাকি আমার উপকারে আসবে। আমি জানি তো তোমার দৌড় কতখানি। আলি একটু রাগান্বিত ভাবে বলল।

-আচ্ছা বল, কোথায় যাচ্ছিস? দেখি আমি তোর কোন ভাবে উপকার করতে পারি কিনা। এবার কিছুটা আগ্রহ নিয়ে বলল কাবেরি আপু।

-সাভার ইপিজেড। আলি বলল।

-কেন? আবার প্রশ্ন করলো কাবেরি আপু।

-একজনার খোঁজে। মানে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মেসমেট। ওকে আমার খুব প্রয়োজন।

-তুই একটা গাধা!

-কেন?

-তুই জানিস ইপিজেডের মধ্যে বাইরের লোক প্রবেশ করা নিষেধ। কোন মতেই প্রবেশ করতে দেবে না। কাবেরি আপা বলল।

-তাহলে কি হবে। আলি কিছুটা শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলো।

-এবার কাবেরি আপু একটা সুযোগ নিয়ে বলল, একটা পথ অবশ্য আছে, তবে আমাকে পুরো কাহিনীটা শেয়ার করতে হবে। তাহলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি।

-এবার আলি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ঠিক আছে তুমি সাভারে আসো আমি থাকবো। তোমাকে সব বলব। কিন্তু আমারও একটা শর্ত তুমি আপু কে বলতে পারবে না। প্রমিজ।

-প্রমিজ। শোন আমি নবীনগর আছি। তুই আয় আমিও চলে আসছি। কাবেরি বলল।

তারপর কাবেরি আপু আসলে আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসলো। হ্যা এবার বল কারণ কি এতোসব ঘটনার?

-আমি বলতে শুরু করলাম। না মানে বাসায় থেকে বিয়ের জন্য খুব চাপাচাপি করছে। বাবা এবং আপু বলেছে আমার কোন পছন্দের কেউ থাকলেও নাকি মেনে নেবে। আসলে বর্তমানে আমার কেউ পছন্দের নেই তবে বছর পাঁচ ছয় আগে আমাকে ফাইরুজ মালিহা বলে একটা মেয়ে খুব পছন্দ করতো। আমার জন্য সে অনেক কিছু করেছে। আমাকে খুবই ভালোবাসতো। তোমাকে মাঝে বলেছিলাম না। সেই মালিহা কে আমার খুব মনে পড়ছে। টাকে এই মুহূর্তে জানা আমার কর্তব্য।

-কাবেরি আপু এতক্ষন চুপ করে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। আমার কথা শেষ হতেই বলে উঠলো, তুই কি মনে করিস ছয় বছর আগে তোকে ভালোবাসতো বলে এখনো তোর জন্য মোমবাতি জালিয়ে তোর পথ চেয়ে বসে আছে?

-হ্যা হ্যা ঠিক এইটা জানার জন্যই তো তাঁকে আমার খুঁজে বের করতে হবে। তুমি আমাকে একটু হেল্প করো প্লিজ আপু। আলি অনুনয় নিয়ে এই কথা গুলো বলল।

-আমি দেখছি কী করা যায়? এখন এইটা তো বল সে কোথায় থাকে? আবারো প্রশ্ন করলো কাবেরি আপু।

-ইয়ে মানে সেইটা আমি এখনো জানিনা। তবে এইটুকু জানি মালিহার গ্রামের বাড়ি বরিশালে। আলি বলে থামল।

-তুই আসলেই একটা বড় গাধা! জানিস না মানে কি? তাহলে তাঁকে খুঁজবি কি করে? কাবেরি বলল।

-আলি এবার জড়তা ঝেড়ে ফেলে বলল, সেজন্যই তো এখানে আসা।

-মানে কি? তাহলে সে কি গার্মেন্টসে কাজ করে? বলে কাবেরি হাস্তে লাগলো।

-দেখ আপু প্লিজ ফান করো না। আমি কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি। তাঁকে আমার খুজতেই হবে। সে গার্মেন্টসে কাজ করবে কেন? আলি বলল। আমি এখানে এসেছি মইনুল ভাইয়ের খোঁজে।

-কিছুই বুঝতেছি না। একটু খোলাসা করে বল দেখি।

-মানে খুব সোজা, মালিহার টোটাল ঠিকানাটা আমার একটা ডায়েরিতে আছে। আলি বলে থামল।

-কাবেরি আপু এবার উচ্ছাসিত হয়ে বলল, তাহলে তো হয়েই গেলো। চল সেই ঠিকানায় গিয়ে খোজ করি।

-ইয়ে মানে সেই ডায়েরিটা তো এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। যখন আমি মইনুল ভাইয়ের কাছ থেকে চলে আসি তখন ভুলে ডায়েরিটা রেখে আসি। তখন ভেবেছিলাম ওইটা আমার প্রয়োজন হবে না। কারণ তখন আমি মালিহা কে দেখতে পারতাম না। ওই ডায়েরিটা মালিহা আমাকে আমার বার্থডে তে দিয়েছিলো। আসলে সেই সময় আমি মালিহা কে একেবারে দেখে সহ্য করতে পারতাম না। সেইটা তো তুমি জানো। কারণ তোমাকে আমি মাঝে মাঝে এইগুলো বলতাম। এইজন্য তখন মালিহার দেওয়া ডায়েরিটা আমি মইনুল ভাইয়ের খাটের নিচে ছুরে ফেলেছিলাম। মইনুল ভাই আবার সেইটা খুব জত্ন করে রেখে দিয়েছিলো জানি। আমাকে অনেকবার দিতে গেলেও আমি নেয়নি। যে ডায়েরিতে মালিহার নিজের লেখা ঠিকানা ছিল।

-এবার কাবেরি আপু সত্যি সত্যি খুবই রেগে গেলো, তুই কি মনে করিস যে তোর সেই মইনুল ভাই এখনো যত্ন করে তোকে দেবার জন্য ডায়েরি টা রেখে দিয়েছে? তুই নিজেকে কি ভাবিস আল্লাহই ভালো জানে।

-তুমি সবসময় নেগেটিভ চিন্তা করো কেন? আলি বলল, আমি অতকিছু জানিনা তবে মালিহা কে আমার খুঁজে বের করা লাগবেই। তুমি জাননা আপু ওর প্রতি ভালবাসা আমার প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাড়ছে। আপু প্লিজ তুমি শুধু ইপিজেডের ভিতরে ঢুকে মইনুল ভাইয়ের সম্পর্কে ইনফরম্যাশন নিতে সাহায্য করো।

-আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে। চল দেখি কি করা যায়। কাবেরি আপু বলল।

ওখান থেকে সিএনজি করে সাভার ইপিজেডে গেলাম। প্রথমে ঢুকতে দিচ্ছিল না। পরে আপু নিজের পরিচয় দেবার পর আর বাধা দিলো না। প্রথমে আমরা প্রবেশ করে জিএম স্যারের চেম্বারে গেলে উনি বসতে বলল। জানতে চাইলো কি ব্যাপারে এসেছি।

-আসলে আমরা একজনার সম্পর্কে দেখা করতে এসেছি। বলতে পারেন ইনফরম্যাশন নিতে এসেছি। আলি বলল।

-জী বলুন, কার সম্পর্কে জানতে চান। উনি বললেন।

-আমি আবার বললাম, মইনুল হোসেন বলে কি কেউ আপনার গার্মেন্টসে চাকরি করে? উনার সাথে দেখা করবো।

-উনি এবার বলল, মইনুল বলে তো প্রায় শখানেক প্রার্থী আছে। আপনি কাকে চাচ্ছেন? কিভাবে বুঝবো। কোন সেক্টরে কাজ করে সেটা কি জানা আছে?

-আমি বললাম, জী বায়িং সেক্টরে।

উনি অ্যাকাউন্ট স্যার কে ডেকে আমাদের সমস্যাটা বলল, এবং এটাও বলে দিলো যে উনারা প্রশাসনের লোক আপনি ভালো করে খুঁজে তাঁর সাথে ওদের দেখা করিয়ে দ্যান।

-অ্যাকাউন্ট স্যার এবার খাতা বের করে অনেকক্ষণ খুঁজে খুঁজে বের করলো, হ্যা বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী বাড়ি একজনার এই মইনুল আছে। এখানে অবশ্য উনার ছবি আছে দেখেন ছবিতে চিনতে পারেন কিনা?

-এবার আমিও আমার ব্যাগে থাকা ডায়েরিটা নিয়ে মইনুলের একটা ছবি বের করে ওই ছবির সাথে মিলিয়ে দেখলাম ঠিক আছে কিনা।

-এবার কাবেরি আপু একটু দেখে বলল, হ্যা হ্যা মিলে গেছে। এই মইনুলই সেই মইনুল।

-এবার উনি বললেন, কিন্তু ব্যাপার কি বলুন তো। আপনার প্রশাসনের লোক যেহেতু, তাহলে কি উনার কোন পুলিশি ঝামেলা হয়েছে?

-আমি এবার বললাম, না না কোন সমস্যা নই। আসলে বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত। সরি আপনাদের অনেক কষ্ট দিলাম।

-জিএম স্যার এবার বলল, না না ঠিক আছে। কোন ব্যাপার না।

-এবার অ্যাকাউন্ট স্যার বলল, কিন্তু এবার একটা দুঃসংবাদ আছে! উনি তো ছয় মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।

-চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন! আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। এইটুকু বলে আমি যেন আর কিছু বলতে পারলাম না।

-কাবেরি আপু আমার সমস্যা টা বুঝতে পারলো। আচ্ছা উনি এখন কোথায় কোন চাকরি কুরছেন কি না কিছু জানেন?

-অ্যাকাউন্ট স্যার বলল, কোথায় কোন চাকরি করছেন কিনা তাতো কিছু জানান নি। তবে মাস খানেক আগে একবার আমার সাথে উনার দেখা হয়েছিলো। উনি জানিয়েছিলেন বিদেশে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উনার নাকি ডিভি তে লটারি লাগছে। পরে আর কিছু জানান নি।

-আপু বলল, আচ্ছা এখানে উনার পুরো ঠিকানা লেখা আছে না? এইটা আমাদের দেন।

-হ্যা হ্যা আছে তো। উনার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপিও আছে। যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে মইনুলের ঠিকানা লেখা আছে।

উনি ওখান থেকে পেজটা ফটোকপি করে দিলো। কাবেরি আপুর মুখের দিকে তাকালাম। পুরো ঘেমে গেছে। বুঝলাম আমার সমস্যা টাকে আমলে নিয়েছে। তবে আপুর এনার্জি লেবেল খুব লো।

-আপু অনেক থ্যাংকস তোমাকে। তুমি না থাকলে এই ঠিকানাও পেতাম না। আমি বললাম।

-দেখ আলি, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এতোগুলো বাধা অতিক্রম করে মালিহা কে কি খুঁজে পাবি? আপু বলল।

-তুমি চিন্তা করো না। আমি সব বাধা ঠিকই পার করে মালিহার কাছে পোঁছাবো। আমার সব কিছু ম্যানেজ করায় লাগবে।

আপু কে বিদায় জানিয়ে বাসাতে ফিরে আসলাম। রাতে ঘুমানোর সময় ভাবলাম, আগামি কালই পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। হটাতই মইনুল ভাইয়ের ডিভি লটারির কথা মনে পড়লো। কোন একটা আশাংকার জন্য আর থাকতে পারলাম না। তখনি ব্যাগ এবং কিছু টাকা নিয়ে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সদরঘাটে এসে একটা ভিআইপি কামরা ভাড়া করলাম। কারণ গত কয়েকদিন ধরে ঘুমানো হয়নি। লঞ্চের মধ্যে অন্তত যেন একটু আরাম করে ঘুমানো যায়। তাহলে ক্লান্তিটা একটু দূর হবে। রাত ৯:১৫ তে লঞ্চ ছেড়ে যাবে বরিশালের উদ্দেশ্যে। পটুয়াখালী পোছাতে ভোর ৪:০০ নাগাত বাজবে। নিজের কামরাতে বসে ছিলাম। ব্যাগে ল্যাপটপ, মোবাইল, আর কিছু টাকা ছিল। ল্যাপটপ টা বের করে কিছুক্ষণ টেপাটেপি করলাম। কিন্তু ভালো লাগছিলো না। মনের মধ্যে অজানা শংকা এসে ভোর করতেছিল। বুকটা মাঝে মাঝেই ধকধক করে উঠছিল। ল্যাপটপ টা বন্ধ করে ব্যাগে ভরে রাখলাম।

মনের মধ্যে এবার ভোর করলো মালিহার সাথে অতীতের সৃতি গুলো। মেয়েটা কত দুষ্টু এবং চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। কত গভীর ভাবে আমাকে ভালোবাসতো। কত সুন্দর সুন্দর কথা বলতো কত স্বপ্ন দেখাতো। কত উষ্ণ আলিঙ্গন এবং চুম্বনে ভরিয়ে দিতো আমাকে। আমার কোন বাধায় সে মানতে চাইতো না। ওর নাম নিয়ে আমার সাথে বন্ধুরা কত মজা করতো। হায়রে সেদিন গুলো তে আমি মালিহার এতো গভীর ভালবাসার কোন দামই দেইনি। বন্ধুদের মজা করাটাকে আমার সম্মান হানি ভেবে মালিহা কে কত কথাই না শুনিয়েছি। কত ভাবে যে গালাগালি করেছি।

আজ শুধু সেইদিন গুলির কথা মনে পড়ছে,। ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে সেই চঞ্চলা মেয়েটিকে আমার জীবনে। সেদিনের উষ্ণ আলিঙ্গন কে আজ কতনা অনুভব করতেছি।

মনে পরে সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার সে জার্নি করতো আমার জন্য। প্রতি শুক্রবার সারাদিন আমার সাথে কাটানোর জন্য সেই বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্রি হোস্টেল থেকে ছুতে আসতো ঢাকাতে। সারাদিন আমার সাথে ঘুরত জোর করে আমাকে নিয়ে যেতো ঢাকার বিভিন্ন জায়গাতে। আমাকে কত রকম খাবার খাওয়াতো।

খুব মনে পড়ছে মালিহার সাথে আমার আকস্মিক পরিচয় এবং বন্ধুত্বের কথা। প্রথম দিন কার কথা। আমি তখন ঢাকা সিটি কলেজে ইন্টার মিদিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হওয়ায় অনেক রাত জেগে পড়াশোনা করতে হত। এইটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।

শোভন, রাশেদ আর আমি একই গ্রামের হওয়ায় হোস্টেল সুপার আমাদের তিনজন কে একই রুমে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। সেই সময় আমার ক্লাস মেট শোভন আমাদের গ্রামের অনেক মেয়ে, ঊর্মি, মিতা, রুমি, রিতা, তৃষ্ণা এই ধরনের অনেক মেয়ের সাথেই ফোনে কথা বলতো। আমি কারো সাথে তেমন কোন কথা বলতাম না।

-হটাত একদিন একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে আমার ফোনে ফোন আসলো। প্রথমে অপরিচিত নাম্বার দেখে রিসিভ করলাম না। পরে আরও পরপর দুবার ফোন দিলো। তৃতীয় বারের বেলায় আমি রিসিভ করতেই, ওপাশ থেকে সুমিষ্ট কণ্ঠে একটা মেয়ে বলে উঠলো, জুবায়ের তুই কি টেস্ট পেপার কিনে ফেলেছিস?

-আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না। আরও কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বুঝলাম মেয়েটা ভুল করে ফোন দিয়েছে। এইজন্য আমি কিছু না বলেই কেটে দিলাম।

-আবার ফোন দিয়ে বলল, কিরে মোর কথা কি তোর কানে ঢোহে না। টেস্ট পেপার ক্যানছো?

বরিশালের ভাষাতে আরও কিছু বলল, যার বেশির ভাগ আমি বুঝতে পারলাম না। প্রথমে ঢাকা তে এসেছি অনেক ভাষায় আমি বুঝিনি।

-তাই শুধু বললাম, টেস্ট পেপার! কিসের টেস্ট পেপার? আমিতো কিছুই বুঝতেছি না।

-আবারো সেই বরিশালের ভাষায় বলল, ফাজলামো হরো, মোর লগে মশকরা হরো। মোর লগে মশকরা হরলে কিন্তু ভালা অইবো না কয়ে দিলাম।

-এবার তো আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, বরং কিছুটা ভড়কে গেলাম। শোনেন আমি আপনার এই সব হিন্দি কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। দয়া করে শুদ্ধ বাংলায় বললে খুশি হতাম।

-কিরে খুব বেশি শুদ্ধ বলা শিখেছিস মনে হচ্ছে? মেয়েটা বলল।

-এবার আর আমি কথা বাড়াতে চাইলাম না। শোনেন আপনি মনে হয় ভুল করতেছেন। আমি জুবায়ের না। আমি আলি রহমান। আপনি জানেন আমি ঢাকা থেকে বলছি?

-মেয়েটা এবার হতভম্ব হয়ে গেলো, ওহঃ তাহলে সরি। কিছু মনে করেন না। আসলে আমি...

-আমি টাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, জী জী বুঝতে পেরেছি। আপনি ভুল করে কল দিয়েছেন। ঠিক আছে নাম্বার টা চেক করে আবার ফোন দ্যান। আরও কিছু কথা বলে আমিই কেটে দিলাম।

পরের দিন আবার সেই নাম্বার থেকে ফোন আসলো। এবার সে একটু ভুমিকা নিয়েই শুরু করলো, এভাবে বলতে লাগলো যে, আমি ফাইরুজ মালিহা চৌধুরী। বরিশাল রয়েল কলেজ থেকে এবার বানিজ্য বিভাগ থেকে এইচএসসি পরিক্ষা দেবো। গত দিন আসলে আমি জুবায়ের কে টেস্ট পেপার কিনতে দিয়ে ছিলাম, সেই টা আনার জন্য ফোন দিতে গিয়ে আপনার কাছে চলে গেছিলো। কিছু মনে করেন না।

-আমি বললাম, আপনি এবার এইচএসসি পরিক্ষা দিবেন? আবারো প্রশ্ন টা করে ফেললাম বোকার মত।

-হ্যা তাই।

-তাহলে তো আপনি আমার দুই বছরের সিনিয়র। আমি নিউ ফার্স্ট ইয়ার।

-সমস্যা নাই। বন্ধুদের মাঝে আবার ছোট বড় আছে নাকি? আমি কি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি?

ওর কথার স্বরটা ছিল খুব মিষ্টি। আর বলার স্টাইল টা ছিল আরও মহনীয়। সারাক্ষণ শুনতে ইচ্ছে করতো। তাছাড়া সেই মুহূর্তে আমার কোন মেয়ে বন্ধু ছিল না। আমার রুম মেট রা সারাদিন তাদের মোবাইল ফ্রেন্ড দের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলল। যা আমার মাঝেও ইচ্ছে হতো, ইশ আমারও যদি অমন একটা বন্ধু থাকতো? আমিও তাঁর সাথে আমার হাসি-কান্না এবং সুখ-দুঃখ কে শেয়ার করতে পারতাম। আজকে সেই সুযোগ আমাকে হাত ছানি দিচ্ছে দেখে আমি না করলাম না। আমি এক কথাই রাজি হলাম।

তারপর থেকেই শুরু হলো তাঁর সাথে আমার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলা। জীবনের এমন কোন বিষয় ছিল না যে সে আমার কাছ থেকে শুনে নি। আমার পরিবার, গ্রাম, ভাইবোন, আমার ভাললাগা, আমার পছন্দের বিষয় সব গুলো সে শুনেছে। তাঁর জীবনেরও প্রত্যেক টা খুঁটিনাটি বিষয় সে আমার কাছে বলতো।

সারাক্ষণ কল দিয়ে শুরু হতো তাঁর মুখে কথার ফুল ঝুরি। শেষই হতে চাইতো না তাঁর কথা গুলো। মালিহাই বেশি কথা বলতো। আমি কথা বলতে কিছুটা ইতস্ত বোধ করতাম। আমি তেমন ভাবে প্রসঙ্গ টেনে এনে কথা বলতে পারতাম না। এই জন্য মালিহা আমার রুম মেট দের কাছে আমার নামে কমপ্লেন দিতো কেন কথা বলি না ভালো করে। আমার বন্ধুরা বলতো, আলি আসলে এই ধরনের। বেশি কথা বলে না। তাছাড়া ও আগে কোন মেয়েদের সাথে কথা বলেনি তো তাই। তুমি একটু শিখাইয়া নিও।

এর মাঝেই মালিহার পরিক্ষা শুরু হয়ে গেলো। তখন ও একটু কম কম কথা বলতো। আমি নিজে থেকেই বলেছিলাম ভালো করে পরিক্ষা দেন আগে। কথা পরেও বলা যাবে। আমার সাথে কথা বলাতে আপনার যেন পরীক্ষার কোন ক্ষতি না হয়। তাহলে কিন্তু আমি ভীষণ রাগ করবো।

-মালিহা মাঝে মাঝেই বলতো আমি যেন তাঁকে তুমি করে বলি।

-আমি তাঁকে শর্ত দিয়ে ছিলাম যদি আপনি আপনার এইচএসসি পরীক্ষাতে A+ করতে পারেন তাহলে আমি আপনার কথা মত আপনাকে তুমি করে বলবো।

-প্রমিজ করো। আমাকে তুমি করে বলবে? মালিহা বলল।

আমি প্রমিজ করেছিলাম। ওর পরীক্ষা চলা সময় টাতে আমি নিজে থেকেই কথা কমিয়ে দিলাম। বেশি বেশি কল দিলে আমি কথা সংক্ষেপ করতাম। এভাবে এক দিন দুইদিন করে সপ্তাহ পার হয়ে মাস পেরিয়ে যাচ্ছিলো। ওর পরীক্ষার আপডেট আমাকে জানাতো।

এতো কিছু ভাবনার মাঝে আমি ডুবে ছিলাম। হটাত আমার কামরাতে খটখট করে আওয়াজ হতে লাগলো। আমি বুঝলাম কেউ আমার কামরার কাছে কড়া নাড়ছে। ভাবলাম হয়তো, কন্ট্রাক্টর টিকিত চেক করতে এসেছে। এই বলে দরজা খুললাম।

-দরজা খুলতেই আনুমানিক চল্লিশ বছর বয়স্ক এক মহিলা আমাকে কি যেন একটা বিষয়ে অনুরধ করতে লাগলো আমি বুঝতে না পেরে উনাকে ভিতরে আস্তে বললাম।

-মহিলার সাথে আরও দুইটা ছেলে মেয়ে ছিল তারাও আসলো। ভিতরে আসার সাথে সাথেই আমার কাছে হাতজোড় করে বলতে লাগলেন, বাবা তুমি একমাত্র আমায় উপকার করতে পারো।

-আপনার সমস্যা কি আমাকে খুলে বলেন আমি অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করবো। আমি ভেবেছিলাম কিছু টাকা পয়সা হয়তো চাইবে।

-না মানে আমার বাচ্চা টা একটু অসুস্থ তো তাই। যদি আপনার কামরাতে ওকে একটু রাখতে দিতেন তাহলে ওর অসুবিধা হতো না। ওর কিছুদিন আগেই অপারেশন কড়া হয়েছে তো তাই। তাছাড়া আজকেই আমাদের বরিশাল যেতে হবে, সব গুলো সিট বুক হয়ে গেছে। যদি আপনি একটু দয়া করেন তাহলে আমাদের জন্য খুব উপকার হতো।

-আমি এবার বাচ্চাটার দিকে একবার তাকালাম। কিছুটা পীড়িত মনে হল। ঠিক আছে সমস্যা নায় আমার কামরাতে তো দুইটা খাট আছে আপনারা একটাতে আসেন আমার কোন সমস্যা নায়।

-এবার দেখালাম উনারা ওই খাট টাতে এসে বসলো এবং ছেলেটিকে শুইয়ে দিলো। আমি আবার মালিহার সাথে আমার অতীত জীবনে ফিরে গেলাম।

পরীক্ষার মাঝে আমাদের কথা গুলো তাঁর পরীক্ষা কেদ্রিক ছিল। কেমন হল এই পরীক্ষা টা কেমন হয়েছে ওই পরীক্ষা টা ইত্যাদি ইত্যাদি। যেদিন টায় মালিহার পরীক্ষার শেষ হল সেদিন আমার সাথে মালিহা একটানা সাড়ে চার ঘণ্টা কথা বলেছিল।

-আমি ওকে বললাম, দেখেন আপনার কিন্তু এখনো পরীক্ষা শেষ হয়নি। এখনো আপনার পড়ার বাকি আছে। প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষাও ভালো রেজাল্ট এর সহায়ক। সুতরাং আরও পড়াশোনা করতে হবে আপনাকে যেন কাঙ্ক্ষিত ফল আমি আশা করতে পারি।

মালিহা সেই কথা গুলোও প্রতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলো। এভাবে একদিন ওদের প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেলো। মালিহা সম্পূর্ণ ফ্রি হয়ে গেলো। সেই সময় গুলোতে মালিহা প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন দিতে লাগলো। প্রথম দিকে কথা বলার খুব আগ্রহ ছিল আমার। এক সময় আমার পড়াশোনার চাপ বাড়তে লাগলো। আমারও ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসলো। সেই সময় মালিহার এইচএসসি রেজাল্ট হওয়ার দিন এগিয়ে আসলো। ও আমাকে আগে থেকেই ওর রোল নং এবং রেজিস্টার নং আমাকে দিয়েছিলো।

আমার ধারনা ছিল যে মালিহা হয়তো A+ পাবে না। কিন্তু সাইবার ক্যাফে থেকে যখন আমি ওর রোল নং দিয়ে রেজাল্ট বের করলাম আমি তো পুরো তাই তাস্কি খেয়ে গেলাম। একি ফাইরুজ মালিহা চৌধুরী নাকি গোল্ডেন A+ পেয়েছে এই কথা টা জানালো সাইবার ক্যাফের মারুফ ভাই। আমি দ্রুত উনাকে টাকা মিটিয়ে দিয়ে রুমে এসেই মালিহা কে ফোন দিলাম দেখি নাম্বার বিজি দেখাচ্ছে। পরক্ষনেই মালিহার নাম্বার থেকে ফোন আসার সাথে সাথে আমি ধরে তুমি করেই সম্বোধন করলাম।

-কংরাচুলেশন। তুমি জানো তুমি গোল্ডেন A+ পেয়েছ। আমি অনেক খুশি হয়েছি মালিহা আমি অনেক খুশি।

-ঠিক আছে তাহলে আমার গিফট কোথায়? মালিহা বলল।

-বলেন কি গিফট চান আমার কাছ থেকে?

-আবার আপনি করে বলছ। এই তোমার কথা রাখা। মালিহা কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল।

-সরি সরি। ভুল হয়ে গেছে। বলো কি গিফট চাও আমার কাছ থেকে। কিন্তু তুমি যত দূরে থাক সেই বরিশালে গিয়ে আমি তোমায় গিফট দিতে পারবো না। সেই সাথে আমি পোস্ট অফিস থেকেও দিতে পারবো না। তুমি পারলে ঢাকায় আসো তাহলে আমি দিবো।

আমি ভেবেছিলাম ও মেয়ে মানুষ সেই বরিশাল থেকে একা একা কখনও ঢাকাতে আস্তে পারবে না। এইজনই একটু কনফিডেন্স নিয়ে বললাম যে তুমি পারলে ঢাকায় আসো। কিন্তু মালিহা আমাকে চমকে দিয়ে তিনদিন পর শুক্রবার আমাকে ফোন দিলো।

-আলি তুমি এখন ঢাকার কোথায় আছো বল তো?

-কেন? আমি তো একটু তাজমহল রোডে এসেছি কোচিং করতে।

-তুমি তাড়াতাড়ি জিয়া উদ্যানে আসো। আমি এখানে আছি। মালিহা বলল।

-আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাই বললাম, শোন এখন ফাজলামো করার সময় আমার নাই। তাছাড়া ফাজলামো করার একটা সময় আছে।

-আলি প্লিজ বিশ্বাস করো আমি সত্যি বলছি, আমি এখন জিয়া উদ্যানে। তুমি একবার এসে দেখে যাও তো আগে।

-আমার কোচিং ক্লাস শেষ হয়ে গেছিলো। শোভনের ক্লাস শেষ হলে দুজনা একসাথে রুমে ফিরবো বলে অপেক্ষা করছিলাম। শোভন আসার সাথে সাথে আমি বললাম তাঁকে সম্পূর্ণ ঘটনা। ও আমাকে একবার খোজ নিতে বলল।

আমি শোভন কে সাথে করে একটা রিক্সা ভাড়া করে জিয়া উদ্যানে আসলাম। এসে দেখি তাঁর দেওয়া ঠিকানাতে কেউ নাই। আমি ফোন দিলাম। আমি তখনও বিশ্বাস করে আছি যে মালিহা আমাকে হয়তো মজা করার জন্য বলেছে। কিন্তু শোভন বলল, আমি যততুকু কথা বলে জেনেছি মালিহা মিথ্যা বলার মেয়ে না। তুই এক কাজ কর ফোন দে।

-অগত্যা জানার জন্য ফোন দিলাম। কোথায় তুমি। এখানে তো কেউ নেই দেখতেছি।

-আলি তুমি মসজিদের উপরে চলে আসো আমি এখানে আছি।

-গিয়ে প্রথমে চোখ পড়লো, হাল্কা সবুজ রঙের থ্রি-পিচ পরা একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। দেখতে খুবই সুন্দর। অত্যন্ত ফর্সা। মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে পরী নেমে এসেছে। পাশে আরেকটা ছোট মেয়ে দাঁড়ানো।

-আমি ভাবলাম, না এই মেয়ে মালিহা হতে পারেনা। এতো সুন্দর মেয়ে আমার মত একটা আন স্মার্ট ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারেনা। তাছাড়া আবার দুই বছরের সিনিয়র মেয়ে। তাছাড়া মালিহা তো বলেনি যে তাঁর সাথে কেউ আছে। আমি শোভন কে এই গুলা বললাম।

- শোভন বলল, এখানে তো অরা দুজন ছাড়া কাউকেই দেখছি না। আমার মনে হয় এরায়। তুই আমার ফোন দিয়ে জেনে নে।

-আমি আবার ফোন দিলাম। আর শোভন কে মেয়েটার দিকে নজর রাখতে বললাম, যে ফোন ধরে কিনা?

কিন্তু না মেয়েটির কোন ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া দেখলাম না। এবার শোভন বলল, কয় মেয়েটি তো ফোন ধরল না? তাহলে মনে হয় এই মেয়ে তোর মালিহা না। ফোন ধরেছে।

-আমি বললাম না ফোন তো ধরছে না।

চলে যাচ্ছিলাম। হটাত পেছন থেকে মেয়েটি আমার নাম ধরে ডাকল। এগিয়ে এসে বলল, কি তুমি কি কাউকে খুজছো?

-না মানে... ইতস্ত করছিলাম। আপনি আমার নাম জানলেন কি করে? আপনিই কি মালিহা?

-জী ভাইয়া আমিই মালিহা। কিছুটা ঢং করে বলতে লাগলো। এবার বলল, কি ব্যাপার আবার আপনি আপনি করছ কেন?

-না মানে প্রথম তো। আর হবে না।

- কি ব্যাপার তোমার না প্রিয় রঙ হাল্কা সবুজ। আমি সেই রঙের পোশাক পরে আসলাম তবুও চিনতে পারলে না?

-আমি বললাম, ঠিক আছে সরি। কিন্তু তুমি এভাবে চলে আসবে আমি বুঝতে পারিনাই। এবার পাশের দাঁড়ানো ছোট মেয়েটাকে দেখিয়ে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম।

-মালিহা এবার মেয়েটির একটা হাত ধরে বলল, এর নাম স্নেহা। আমার দূর সম্পর্কের আত্নিয় হয়। ও ঢাকা ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রি।

- যাই হউক তোমাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এই কথা বলেই আমাকে জরিয়ে ধরলো। এক নাগাড়ে দশ থেকে পনের টা কিস করলো আমাকে।

-আমি পুরো হতভম্ব হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারলাম না। মনে এবং শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। আমার পাশে দাঁড়ানো আমার ক্লাস মেট বন্ধু শোভন মিটিমিটি হাসছিল। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। বললাম, কি হচ্ছে মালিহা এসব। প্লিজ স্টপ দিস। আমার তোমার বন্ধু হয়। এসব ঠিক না। প্লিজ ছাড়।

-মালিহা কোন কোথায় শুনল না। আরও কিছুক্ষণ আমাকে জরিয়ে থাকলো। পরে আরও গোটা দশেক চুমু দিয়ে তবে ছাড়ল।

এবার আমি শোভন কে দেখিয়ে তাঁর সম্পর্কে বললাম। মালিহা বলল, ভাইয়া আমি একটু আপনাদের ডিস্টার্ব করে ফেললাম তাই না। কি যেন ইশারা করে শোভন কে বিদায় করে দিলো। শোভন আমাকে বলল, আলি তুই পরে আস। আরও কথা বল, মালিহার সাথে আমি একটু চাচ্চু দের বাসায় যাব। এভাবে শোভন সেদিন আমাকে এড়িয়ে চলে গেলো।

তারপর সেদিন মালিহার সাথে আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত একসাথে ছিলাম। বিভিন্ন রকম কথা বললাম। বাদাম কিনে এনে তিনজনা মিলে খেলাম।

পরের দিন মালিহা বলল, যে বরিশাল চলে যাবে বাসার কাউকে না বলেই সে এসছে। আসলে মালিহা বরিশাল রয়েল কলেজের মহিলা হোস্টেলে থাকে। মালিহা বলল, তাঁর গিফট কোথায়? পরেরদিন যখন ওকে লঞ্চ উঠিয়ে দিলাম, তখন একটা সুন্দর দেখে ডায়েরি কিনে দিলাম গিফট হিসাবে। মালিহা ডায়রি টা নিয়ে বলেছিল এইটা আমি সারাজীবন যত্ন করে রেখে দিবো।

এভাবে মালিহা প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার আমার সাথে দেখা করার জন্য বরিশাল থেকে ঢাকা চলে আসতো। তখন ওর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষা দেবে চলে কোচিং করার জন্য ভর্তি হয়েছিল। বৃহস্পতিবার কোচিং শেষে রাত্রে লঞ্চে অথবা বাসে করে চলে আসতো ঢাকায়। সকাল বেলা থেকে সারাদিন আমার সাথে ঘোরার জন্য আমাকে ডাকতো। আবার শুক্রবার রাত্রে আবার চলে গিয়ে সকাল বেলা কোচিং করতো।

ধিরে ধিরে মালিহার চালচলনে কিছুটা পরিবর্তন আসলো। আমাকে বারবার জরিয়ে জরিয়ে ধরতো। যাবার সময় আমাকে কিস করতো। এগুলো আমি সহ্য করতে পারতাম না। কারণ আমি মালিহা কে শ্রেফ আমার একটা খুব ক্লোজ বন্ধু ভাবতাম। কখনও আমি ওর সাথে প্রনয়ের কথা ভাবতে পারতাম না। এজন্য যে মালিহারা পারিবারিক ভাবে অনেক ধনি। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান সে। তাছাড়া ও আমার দুই বছরের সিনিয়র। এই গুলো আমাকে একটা দ্বিধার মধ্যে ফেলে দিলো।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম। ওকে এড়িয়ে যেতে হবে না হলে ও আস্তে আস্তে আরও দুরবল হয়ে পড়বে। আমি মালিহা কে মনে মনে এড়িয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু ও কষ্ট করে এতদুর আসতো বলে কিছুটা সময় আমি ওর সাথে ঘুরতাম। ওকে বোঝাতাম এগুলো ঠিক না, আমি তোমার শুধুমাত্র বন্ধু অন্য কিছু হতে পারবো না।

-মালিহা আস্তে আস্তে আমার কোন কোন বিষয় ভালো লাগে। কি করলে আমি নিজেকে একটু সুখি ভাবি। আমার প্রিয় সকল বিষয়, যেমন, প্রিয় ফুল, প্রিয় রঙ, প্রিয় গান। আমার শখ। ইত্যাদি সব বিষয় গুলো আমার সাথে কিছুটা এবং আমার বন্ধু দের সাথে কিছু কিছু জেনে ছিল। এর মধ্যে মালিহা আমার জন্মদিন কবে তাও জেনে নিয়েছিলো।

মালিহা প্রতি সপ্তাহে যখন আমার সাথে দেখা করতে আস্তে। ঠিক প্রত্যেক বারই আমাকে কোন না কোন গিফট করে যেতো। আমি কোন কিছু দিতে গেলে নিতে চাইতো না। শুধু বলতো তোমার গিফট আমার তোলা রইলো পরে একসময় আমি চেয়ে নিবো। এখন তোমাকে কিছু দেওয়া লাগবে না। মালিহা আমার কোচিঙের বেতন দিয়ে দিতো আগে থেকেই। আমি ভীষণ রাগ করতাম। ও বলতো পরে না হয় দিয়ে দিয়।

কলেজের মাসিক বেতন, আমি দিতাম একটু দেরি করে। কারণ আমার বাবা টাকা গ্রাম থেকে পাঠাতো দেরি করে। অ্যাকাউন্ট স্যারে একবার আমাকে বকা দিয়েছিলো এইটা ও আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছিল। তারপর থেকে ও প্রতিমাসের এক তারিখে আমার অজান্তেই বেতন দিয়ে দিতো। আমার বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র দের স্পেশাল কোচিং করার জন্য কোচিং সেন্টার থেকে বলে। কিন্তু সেখানে মাসিক বেতন সাবজেক্ট প্রতি দেড় হাজার হওয়াতে না করার সিদ্ধান্ত নিলে। মালিহা মনে মনে আমার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে সেই স্পেশাল ব্যাচে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে তাও আবার ফ্রি ফ্রি। আমি মালিহার টাকা নিতে চাইবো বলে মালিহা কৌশলে আমাদের কোচিং অ্যাকাউন্ট সার কে বলে যে প্রতি ত্রিশ জন ছাত্রে নাকি একজন কে ফ্রি নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে নাকি আমাকে বিবেচনা করা হয়েছে আমার রেজাল্ট ভালো বলে।

আমি অবশ্য এগুলো পরে জেনেছিলাম আমার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী বড় ভাইদের কাছ থেকে।

আমি লক্ষ্য করলাম, মালিহা আমার প্রতি আস্তে আস্তে খুব দুর্বল হয়ে পড়লো। খুব ভালবাসতে শুরু করলো। আমাকে সব সময় আপন করে রাখতে লাগলো। আমার বন্ধুদের দিয়ে আমার হোস্টেলের খাওয়া এবং থাকার টাকা সহ দিয়ে দিতো মাঝে মাঝে। মালিহা অল্প দিনের মধ্যেই আমার সকল বন্ধু কে বশ করে ফেলে। সবাই তাঁর বাধ্য হয়ে যায়। আমাকে আমার রুম মেট বন্ধুরা ওর নাম নিয়ে আমাকে সারাক্ষণ খেপাত। অবশ্য তাঁরা সবাই বলতো মালিহার মত মেয়ে এই যুগে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

মালিহার দুর্বলতার মাত্রা দেখলাম বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। আমিও ওকে বোঝাতে লাগলাম। আমার অবস্থান। কিন্তু ও কোন কোথায় শুনতে চাইতো না। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম, মালিহা কে পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে চলতে হবে। এজন্য জিয়া উদ্দ্যান কিংবা অন্য কোথাও যেখানে ও বলতো যেখানে যাওয়া বাদ দিয়ে দিতে লাগলাম। ওর ফোনও বেশি ধরতাম না।

-সেদিন ছিল ১৭ই ডিসেম্বার। আমি সিম চেইঞ্জ করে রেখে ছিলাম। তাই মালিহা ফোন করে আমাকে পাইনি। সরাসরি আমার কলেজে চলে আসে। স্যার দের কাছে আমার নাম বলাই সাথে সাথে চিনতে পারে। মালিহা কে টিচার্স ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রিসেপশনের মেয়ে তানিয়া আমাকে এসে ডেকে বলে, আলি আপনার গেস্ট এসেছে।

-আমি তো অবাক হয়ে বললাম, আমার আবার গেস্ট কোথায়? বললাম, কি নাম, কোথায় থেকে এসেছে?

-তানিয়ে আপা, বলল, অনেক সুন্দর একটা মেয়ে দেখলাম, আপনার খোজ করছে। স্যারেরা তাঁর সাথে অবশ্য এখন কথা বলছে। আপনি গিয়ে দেখা করেন। আপনাকে চাচ্ছে।

-এবার আর কোন কথা না বাড়িয়ে তানিয়া কে অনুস্মরণ করে ওয়েটিং রুমে গেলাম। দরজার একটু দূরে থেকে বুঝলাম, মালিহা এসেছে। আমি কিংকর্তব্য বিমুর হয়ে গেলাম। কি করবো ভাবতে পারছিলাম না। আবার দেখালাম অনেক স্যারেরা ভিড় করে আছে মালিহা কে ঘিরে। সবাই মেয়ে তাঁকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করছে।

-আমি রুমে ঢোকার সাথে সাথে দৌড়ে এসে আমাকে জরিয়ে ধরল। আমি এবার আর কোন কথা বলতে পারলাম না। বারবার নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।

-ক্কি ব্যাপার তোমার ফোন বন্ধ কেন? এই কথা গুলো বলতে বলতে কেদে ফেলল।

আমি এবার ওকে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে দিলাম। তুমি কলেজে কেন? তোমাকে ঠিকানা দিলো কে? তুমি জানো তুমি আমার কত বড় ক্ষতি করে ফেলেছ। আমার মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ড স্পন্দনহীন হয়ে পড়েছে। খুব বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম। আমার মনের মধ্যে এই ভয় ঢুকে গেলো, ভাবলাম হয়তো আর এই কলেজে আমাকে আর রাখা হবে না। কারণ এই কলেজের কড়াকড়ি খুব।

-তবে তানিয়া আপা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অবস্থা কিছুটা আমলে নিলো। যে স্যারেরা এখানে ছিল তাঁরা অবশ্য আমাকে খুব ভালোবাসতো। তাছাড়া মালিহা এসে সবাই কে তাঁর কথার মাধ্যমে বশে এনে ফেলেছে। আগে আমি ক্লাসে মেয়েদের সাথে কথা বললেই স্যারেরা খুব রাগ করতো আর এতো রীতিমত সিনেমাতিক শুট। আমি ভয়ে কাপছিলাম।

-সারেরা আমাকে আশ্বস্ত করলো। জাহিদ স্যার আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলো। ওকে বোঝাল ঢাকার কলেজের কড়াকড়ির কথা অন্য কেউ দেখলে আলি কে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হতেও পারে। তানিয়া ওকে বলল, আপনি বরং বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, নতুবা বাসায় ফিরে যান আগামি কাল তো ছুটি তখন দেখা কইরেন। আলির এখন ক্লাস আছে এবং আজকে প্রাক্টিক্যাল ক্লাস আছে। শেষ হতে এখনো অনেক টা দেরি।

-সেদিন ক্লাস শেষ করতে আমার বিকেল পাঁচটা বেজে গেলো। ক্লাস শেষে বের হয়ে দেখলাম, মালিহা কলেজের পাশে এখনো দাড়িয়ে। হাতে দুইটা গিফটের বাক্স দেখলাম। এবার আমার কিছুটা মায়া হল ওর মুখের দিকে তাকানোতে। ওকে নিয়ে চলে আসলাম, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে এসে বসলাম।

-মালিহা একে একে ওর অভিমানের কথা গুলো বলতে শুরু করলো। কেন আমার ফোন বন্ধ, কেন রিসিভ করতেছি না ইত্যাদি আরও এমন শখানেক প্রশ্ন। আমাকে দিয়ে সরি বলালো।

-আমিও সরি বলার পড়ে তাঁকে বললাম, তোমার কলেজে যাওয়া ঠিক হয়নি। জানিনা কাল কে আমার জন্যে কি অপেক্ষা করছে?

-ও আমাকে অভয় দিয়ে বলল, চিন্তা করোনা কিছুই হবে না। এবার গিফট বক্স দুইটা আমার হাতে দিয়ে বলল, দেখ তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা। এই গুলা তোমার জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমার পক্ষ থেকে।

-আমি নিজেয় ভুলে গেছিলাম যে আজ আমার জন্মদিন। আসলে আগে কখনও কেউ এইভাবে জন্মদিনে গিফট করেনি তো তাই। বক্স দুইটা নিয়ে একে একে খুললাম। একটাতে কাচের সুন্দর একটা গ্লোব ছিল যেটাকে রটেট করা যায়। অন্যটাতে ছিল আমার জন্য পোশাক। একটা জিন্স প্যান্ট ও একটা হাল্কা সবুজ রঙের ফতুহা। দুইটা গিফট আমার খুবই পছন্দ হল।

সেদিন মালিহা আমার সাথে ওয়াদা করিয়ে নিয়েছিলো যে আমি যেন কখনও আর এমন ব্যবহার না করি এবং ফোন যেন বন্ধ না রাখি। আমি সেদিন যেন কি মনে করে ওর সব কথা গুলো রাখার জন্য আশ্বাস শ ওয়াদা করেছিলাম। সেই থেকে আজ অবধি আমি আমার ফোন নাম্বার চেইঞ্জ করিনি।

এভাবে আরও একটা বছর পার হয়ে গেলো। আরও একটা জন্মদিন চলে আসলো। ফের আমাকে অনেক সুন্দর সুন্দর গিফট দিয়েছিলো। মাঝে ওর জন্মদিনের কথা বলায় আমিও একটা গিফট দিতে চাইলে মালিহা নেইনি। বলছিল তোমার ছোট ছোট গিফট গুলো আমার কাছে জমা থাকুক যখন বড় দাবির হয়ে দারাবে তখন চেয়ে নেবো।

দেখতে দেখতে আমার এইচএসসি পরীক্ষা আসন্ন হলো। আমি ওকে বললাম, খুব বেশি কথা বলতে পারবো না। কারণ অনেক পড়াশোনার চাপ। এর মধ্যে মালিহা নিজে বরিশাল বিএম কলেজে ভর্তি হল অর্থনীতিতে। আমি কথা কম বলতে চাচ্ছিলাম। তারপরেও ও কিন্তু জোর করে কথা বলতে চাইতো। সপ্তাহে একদিন আমার সাথে ঘোরা অব্যাহত রাখলো। এভাবে মালিহা আমাকে গভীর থেকে আরও গভীর ভালবাসতে থাকলো। আমি কিন্তু ওকে বন্ধুর মতই ভাবতাম।

এর কয়েক দিনের মধ্যে আমার এইচএসসি পরিক্ষা শুরু হয়ে গেলো। মালিহা কে বললাম, দেখো, এভাবে তোমার সাথে আমি রাত জেগে জেগে কথা বললে এবং তোমার সাথে এভাবে ঘুরে বেড়ালে আমার লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। তুমি তো জানো সাইন্স এর ছাত্র দেড় একটু বেশি পড়া লাগে। তাছাড়া আমার শিক্ষকেরা আমার কাছ থেকে একটা ভালো ফলাফল আশা করে। আমি এভাবে কথা বলতে পারবো না। তুমি এতো ফোন দিবা না। দিনে একবার কথা বলতে পারবো তাঁর বেশি পারবো না।

মালিহা আমার কোন কথাই শুনতে চাইতো না। আমি যখন ওকে বললাম, পরীক্ষার দুমাস আমার সাথে দেখা করতে এসো না। কে শোনে কার কথা মালিহা আরও বেশি বেশি আসতো। আমার পরীক্ষার হলে আমার পরীক্ষা শেষ না অবধি দাড়িয়ে থাকতো।

এইজন্য ওর প্রতি আমার রাগ আরও বেড়ে গেলো। একদিন রাগ আমার চরমে উঠে গেলো। ওকে দেখে আমি প্রচণ্ড বিরক্তি বোধ করলাম। সেদিন ছিল আমার ফিজিক্স পরীক্ষা। মালিহা আমার সাথে দেখা করতে আসলো তাও আবার আমার পরীক্ষা শুরু হওয়ার মাত্র দুই ঘণ্টা আগে।

আমি হোস্টেলে বসে বসে তখনও পরছিলাম। নিচের দারোয়ান মামা এসে বল্ল,যে একটা সুন্দরি মেয়ে আপনাকে নিচে ডাকছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যখন নিচে আসলাম। মালিহা আমাকে প্রচণ্ড আবেগি ভঙ্গিতে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

-আমি নিজেকে কোন মতে তাঁর বাহু বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, আজ আমার ফিজিক্স পরীক্ষা, এই সাবজেক্ট টাকে আমি ভীষণ ভয় পায়। প্লিজ এখন এমন করোনা। পরীক্ষা দিয়ে আসি পড়ে কথা বলব।

-মালিহা বলল, চল আমি হল পর্যন্ত যাবো। তোমার পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাড়িয়ে থাকবো।

-না না, তোমার যাওয়া লাগবে না। তাছাড়া আমাদের একটা স্যারে এসে গারিতে করে নিয়ে যায়। উনি দেখতে পেলে ভীষণ সমস্যা হবে। প্লিজ তুমি এখন যাও।

-কোন সমস্যা হবে না। আমি তোমার স্যার দেড় কে ম্যানেজ করবো।

এভাবে মালিহা সেদিন স্যার দের কে ম্যানেজ করেছিল। সেদিন আমি আর মালিহা রিক্সা করে আমার পরীক্ষার কেন্দ্র মহাম্মাদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে এসেছিলাম। আমাদের সব স্যার গুলো কে মালিহা বশে এনেছিল। স্যারেরা আমাকে তখন বলল, সত্যি আলি তোমার ভাগ্য অনেক ভালো যে মালিহার মোট একটা জীবন সঙ্গি পেয়েছ।

আমি বলতাম, স্যার এসব কি বলছেন, অহহ শুধু মাত্র আমার বন্ধু আর কিছু নয়। স্যারেরা বলতো কেন আর কিছু হলে সমস্যা কি। তোমার জন্য মালিহা পৃথিবীর সব কিছু করতে রাজি আছে। আমাদের পক্ষ থেকে তোমাকে সমরথন দিলাম।

এভাবে একটা একটা করে সব গুলা পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। ওর একদিনের উপস্থিতির জন্য আমার রসায়ন বিজ্ঞান পরীক্ষা টা খারাপ হয়ে ছিল। সেদিন আমি মালিহা কে খুব বকা দিয়েছিলাম। অনেক আজে বাজে ভাষায় কথা বলে ছিলাম।

এভাবে পরীক্ষার ফলাফলের দিন ঘনিয়ে আসলো। আমার টিচারেরা আমাকে নিয়ে খুব আশাবাদী ছিল। সবার আশা ছিল আমি A+ পাবো। কিন্তু না সামান্য একটুর জন্য পেলাম না। আমার রেজাল্ট ছিল 4.90 । স্যারেরা খুব কষ্ট পেল মাত্র হাফ পয়েন্টের জন্য A+ মিস করলাম বলে আমিও মালিহার প্রতি খুব রেগে গিয়েছিলাম। ওকে যাচ্ছেতাই ভাবে গালি দিয়ে ছিলাম।

মালিহা সেদিন একটু কেদে ছিল। আমি আবার তাঁকে কান্না থামিয়ে বুঝিয়ে বললাম, দেখো আম্মি অনেক গরিব ঘরের একটা ছেলে, যদি রেজাল্ট ভালো হতো তাহলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ অনেক টা সোজা হয়ে যেতো। আমাদের তো অনেক টাকা পয়সা নাই যে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়বো সরকারিতে চান্স না পেলে। যাইহোক তোমার পড়াশোনার খবর বল।

মালিহা কিছুক্ষণ পড়ে বলল, A+ পাওনি তাই কি হয়েছে? তাও তুমি ভালো জায়গায় চান্স পাবে এইটা আমার বিশ্বাস। আরও বিভিন্ন রকম সান্ত্বনা দিলো আমাকে। যাতে আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম।

তারপরে কোচিং এ ভর্তি হয়ারর পালা। প্রাইমেট কোচিং এ ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ওখানে আগে থেকেই স্টুডেন্ট ফিল আপ হয়ে গেছে বলে আমাকে বিদায় দিলো। আমার এই বিষয় টা জেনেছিল মালিহা। তারপরের দিনই সে ঢাকাতে এসে কিভাবে যেন আমাকে ওই প্রাইমেট কোচিং এ ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলো। সেদিন আমি ওর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ জানিয়েছিলাম। মালিহা সেদিন খুব হেসে ছিল আমার তাঁর প্রতি এমন ব্যভারের জন্য। আজো চোখের সামনে ভাসে মালিহার সেদিনের হাসির শব্দ গুলো।

আমার খুব আশা ছিল বুয়েটে পড়বো। এই স্বপ্ন টা আম্মার ছেলে বেলাকার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আমার পূরণ না হওয়ায় আমি কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছিলাম। সেবারও ওর প্রতি রাগের মাত্রা আমার বেড়ে গেছিলো। আমি ওকে দুষছিলাম বারবার। ওর ওপরে রাগের মাত্রা আরও বেড়ে গেলো। ওকে আবারো এড়িয়ে যেতে লাগলাম। এতোটাই রেগে ছিলাম যে আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় দিলাম না।

-মালিহা আমাকে বুদ্ধি দিলো যে আমি যেন বেসরকারি তে ভর্তি হয়। প্রথমে আমি এই কথা গুলো একেবারেই আমলে নিলাম না। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যা টাকা লাগবে আমার পরিবার থেকে সেটা বহন করা সম্ভব না। কারণ ৮-১০ লাখ টাকা খরচ করে বেসরকারিতে পড়া শেষ করা সম্ভব না। তাছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন হল নাই। আরও খরচ বেড়ে যাবে। আমি রাজি হলাম না।

পরে একদিন মালিহা আমাকে একরকম জোর করেই আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ক্যাম্পাসে নিয়ে আসলো। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং সমৃদ্ধ লাইব্রেরি দেখে খুবই সন্তুষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে কোন ইচ্ছা ছিল না এখানে ভর্তি হবার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার রেজাল্ট শুনে কোন রকম ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই অনেক টা ছাড়ে ভর্তি নিতে চাইলো। আমার খরচ বারো লাখের জায়গায় মাত্র সাড়ে ছয় লাখে শেষ করার প্রস্তাব দিলো।

-আমি ভর্তি ফিসের টাকা কত সেটা জানতে চাইলাম।

-ওরা বলল, ৬৩ হাজার ৫০০ টাকা।

এদিকে মালিহা উনাকে ইশারা করতে ছিল আমি তখন সেটা বুঝতে পারিনাই। উনি আমাকে বলল, আগামি পরশু আসতে আমরা আপনার জন্য কিছুটা কম করার চেষ্টা করবো। আসলে আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের সাথে আলচনা করবো। একজন গরিব মেধাবি ছাত্র বিবেচনার কিছুটা কম করা জায় কিনা?

দুইদিন পরে যখন মালিহা আমাকে সেখানে নিয়ে গেলো। উনারা বলল, আপনাকে আমরা সর্বাধিক ৭০% টিউশন ফি দিতে পারতেছি। মাঝে রেজাল্ট ভালো করলে আরও ছাড় দেওয়া হবে। মানে সাড়ে ১২ লাখ টাকার স্থানে মাত্র আপনার সাড়ে ৪ লাখ মত খরচ হবে। যেতা আপনি মাসে মাসে অথবা প্রতি সেমিস্টারে সেমিস্টারে দিতে পারবেন। তবে আপনার জন্য আমি ভবিষ্যতে আরও অনেক সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করবো। আর এখন ভর্তি ফি হিসাবে ৪৫ হাজার টাকা দিতে হবে।

আমি ভাবলাম দেশের এতো দামি একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে এতো ছাড় দিচ্ছে যেটা আমি অন্য কোথাও পাবো না। তাহলে এই সুযোগ মিস করা যাবে না। মনস্থির করে ফেললাম হ্যা ভর্তি হব। কিন্তু আমার কাছে তখন ভর্তি হবার জন্য ৪৫ হাজার টাকা ছিল না। ভেবেছিলাম বাবার কাছ থেকে আগামি দুই তিন দিনের মধ্যে নিয়ে তবেই ভর্তি হব। তাই বললাম।

-কিন্তু আমার কাছে তো এখন অত টাকা নাই। আমি বরং এক সপ্তাহ পড়ে ভর্তি হই। এখনও তো সময় আছে?

-মালিহা এতক্ষন চুপ করে শুনছিল। এবার আমাকে বলল, ঠিক আছে তোমার কাছে এখন কত টাকা আছে?

-এইতো বারো হাজার টাকা মত। এই দিয়ে তো কিছুই হবে না।

-মালিহা আমাকে তখন হাত টা একটু চেপে বসিয়ে বলল, ওখান থেকে তুমি দশ হাজার টাকা দাও বাকি ৩৫ হাজার আমি দিয়ে দিচ্ছি। তুমি আজকেই ভর্তি হয়ে যাও।

-আমি সাথে সাথে উঠে পড়ে বললাম, তোমার কাছ থেকে আমি টাকা নিবো কেন? সরি আমাকে ক্ষমা করো আমি তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে পারবো না।

-মালিহা আমাকে আবার বসাল। দেখো আলি বোঝার চেষ্টা করো। তোমার আব্বুর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার পরে শোধ করে দিও আমাকে। তাহলে তো মিটে গেলো। তাছাড়া আমি তোমার এতো কাছের মানুষ হয়ে যদি তোমার কোন উপকার না করতে পারি তাহলে আমি তোমার কেমন বন্ধু! তাছাড়া সময় মাত্র দুইদিন আছে। দুইদিন পর ভর্তি ক্লোজ করে দেওয়া হবে।

আমার সামনে থাকা মহসিন স্যার ব্যাপার টা কেন জানি এঞ্জয় করতেছিল। আমি মালিহার মুখে বন্ধু কথাটা শুনে কিছুটা খুশি হলাম। অনেক ক্ষণ ভাবনা চিন্তা করার পর রাজি হলাম। এবং বললাম, কিন্তু আমি তোমাকে যখন টাকা ব্যাক দিবো তখন তুমি কিন্তু ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃত জানাবে না।

-ঠিক আছে দেখা যাবে ক্ষণ।

এভাবে সেইদিনই ভর্তি হয়ে গেলাম। কয়েকদিন পরেই ক্লাস শুরু হয়ে গেলো। আমিও নিয়মিত ক্লাস করতে লাগলাম।

মালিহা আর আমি সেই আগের মত আবার ঘুরতে লাগলাম। ও প্রতি সপ্তাহে আমাদের ইউনিভার্সিটি তে চলে আসতো। আমার ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতো। আমার সকল স্যার দের সাথে ওর ভালো খাতির হয়ে গেলো অল্প দিনের মধ্যে। ইউনিভার্সিটি তে সব ছেলে মেয়ে ওকে জানতো। ও আমাকে নিয়ে ঢাকার প্রতিটি স্থানে ঘুরেছে। ঢাকা শহরের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে ও আমাকে নিয়ে যায়নি।

জিয়া উদ্যান, সহরাওয়ারদি উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, লালবাগ, আশুলিয়া, নন্দন পার্ক, পলাশী, পূর্বাচল, আহসান মঞ্জিল, কলাবাগান লেক, হাতিরঝিল, বুড়িগঙ্গা নদীতে, সব জায়গাতে আমাদের পদধুলিতে মুখর ছিল।

ওর ঘন ঘন আসাতে আমার পড়াশোনাতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া ঘটলো। আমি মালিহা কে জানালাম। কোন কাজ হল না। ও আমাকে আরও বলল, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনা। যতক্ষন বরিশালে থাকি ততক্ষণ মনে হয় আমি শ্বাসকষ্টে ভুগছি। তাই তো বারবার ছুতে আসি তোমার কাছে। আমি তোমাকে খুব ভালো বাসি আলি। এই ধরনের অনেক কথা বলতো যা আমি প্রতিরোধ করতাম শুরু থেকেই। আমি ওকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতাম যে আমি তোমার বন্ধু ছাড়া আর কিছুই না।

মালিহা এইটা মানতে নারাজ। ও বলতো, আমি তোমার মন জয় করবই। যেকোনো মুল্যে তোমাকে আমার চাই চাইই।

আমার ভার্সিটিতে ওর অবাধ আসা যাওয়া তে আমার ছোট বড় ভাই বোনেরা আমাকে মালিহার নাম নিয়ে খেপাত। আমি ভীষণ চোটে যেতাম। মালিহা কে বললাম সে গুলো মালিহা শুধু হাসত। যেদিন মালিহা আমাদের ভার্সিটিতে না আসতো সেদিন সবাই বলতো, কিরে আলি আজকে তোর বউ আসেনি? কেউ বলতো, ভাবি আজকে আসেনি মনে হচ্ছে। এমন কি কয়েক জন শিক্ষকেও বলতো ,কি আলি, তোমার বউ আসেনি?

এভাবে সবার আক্রমণ আমার কান ঝালা পাড়া করে দিতো। আমি খুব রেগে যেতাম। মাঝে মাঝে মালিহা কে এসব নিয়ে খুব খুব বকা দিতাম। ইদানিং মালিহা আমাকে ওকে বিয়ে করার জন্য তাগিদ দিতে লাগলো।

-মালিহা বলতো, জানো আমার বাসাতে বিয়ের জন্য বলছে। প্লিজ তুমি আমাকে বিয়ে করো। আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমাকে আরও বলতো আমার নামটা চেইঞ্জ করি না কেন? আলি রহমান কেমন যেন পুরনো নাম মনে হয়। ও সেদিন আমাকে বলেছিল, আজ থেকে তোমার নাম আমি সুপ্ত বলে ডাকবো। সেই থেকে মালিহা আমাকে সুপ্ত বলেই ডাকতো।

আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করতে লাগলো। এমনি আমি ওকে নিয়ে মানুষের সবার টিটকারির মধ্যে আছি। ও আবার তাঁকে আমায় বিয়ে করতে বলে। তুমি পাগল আছো? আমি কি তোমাকে কখনও বলেছি যে আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে কখনও ভালবাসি নাই। তোমাকে আমি অনেক বার নিষেধ করেছি। আমি তোমাকে বলেছি আমি শুধু তোমার বন্ধু ছাড়া আর কিছুই হতে পারবো না। তুম্মি কেন এমন আশা করতেছো। প্লিজ আমাকে জ্বালাতন করো না।

আগের কলেজ হোস্টেল ছেড়ে দিতে হল তাও আবার মালিহার ঘন ঘন হোস্টেলে আসাকে কেন্দ্র করে। হোস্টেল ছেড়ে ম্যাচে উঠলাম। সেই ম্যাচের সকল সদস্য কে মালিহা অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর আয়ত্তে নিয়ে ফেল্ল,যে তাঁরা সবাই আমাকে বলতে লাগলো যে মালিহা মেয়েটা অনেক ভালো, সে তোমাকে অনেক ভালবাসে। এই যুগে এমন মেয়ে সহজে পাওয়া যায়না।

আমার বিরক্তির মাত্রা এতোটা বেড়ে গেলো যে আমি ওর নাম পর্যন্ত সহ্য করতে পারতেছিলাম না। ওকে অনেক খারাপ খারাপ ভাষায় গালি দিয়েও ক্ষান্ত হলাম না। খারাপ চরিত্রের মেয়েও বলতে দ্বিধা বোধ করলাম না। যদিও আমি জানতাম তাঁর মত শুদ্ধ চরিত্রের মেয়ে আমার দেখা আর নায়।

আমি যত ওকে বোঝাতে লাগলাম, যে আমার দ্বারা তোমার সাথে ভালবাসার সম্পর্ক করা সম্ভব না।তত বেশি মালিহা আমাকে ভালবাসার উষ্ণ পরশ দিতে চাইতো। আমি এইগুলো একেবারে মানতে পারতাম না। মালিহা সবার মাঝেই আমাকে জড়িয়ে ধরত।

একবার আমি রিক্সায় করে মেসে ফেরার পথে অ্যাকসিডেন্ট করে পা ভেঙ্গে গিয়ে ছিল। মালিহা কে আমার এক মেসের ছেলে জানিয়েছিল। ও খুব কেদেছিল। সেই রাতেই বাসে করে রওনা দিয়েছিলো। খুব ভোরেই পৌঁছে গেছিলো। আমি পঙ্গু হসপিটালে ছিলাম, মালিহা এসেই আমার বুকে পড়ে গেছিলো। আমি তিনদিন হাসপাতালে ছিলাম, মালিহাও আমার সাথে তিনদিন আমার যত্ন নেওয়ার জন্য ছিল। মালিহা সেই কদিনে খুব কেদেছিল। যেগুলো মালিহা আমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার পড়ে সবার মুখ থেকে শুনেছিলাম একে একে। হাসপাতালে সব নার্স দের সে পরিচয় দিয়েছিলো আমার বউ বলে। আমি যেদিন চলে আসি হাসপাতাল থেকে সেদিন ডাক্তার এবং নার্স সবাই বলেছিল তোমাদের জুটিটা অনেক সুন্দর। আমি সেদিনই ইতস্ত করছিলাম তাঁর ঘাড়ে ভোর করে হাটার জন্য। আমি মালিহা কে বন্ধু বলেই ভাবতাম। তাঁকে নিয়ে ঘর বাধবো এমন ভাবনা আমার কখনও ছিল না। ভালবাসা আর বন্ধুত্ত্ব কে আমি আলাদা করে দেখতাম।

যদিও আমার সব বড় ভাইয়েরা বলতো তাঁকে যেন আমি ভালবাসি। আমি বরাবরই এইটা মানতে নারাজ ছিলাম। আমি তাঁকে বন্ধুর বেশি কখনও কল্পনা করতে পারিনি। কিন্তু সে আমাকে ভালবাসা থেকে কখনো পিছপা হয়নি।

যেদিনের পর থেকে মালিহা আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সেদিন আমি মানিক স্যারের ইলেক্ট্রিক বাউন্স অফ ওয়েব ক্লাস করতেছিলাম। আমাদের পুরো ক্লাসে মানিক স্যার ছিল খুব কড়া। উনি স্কুল এবং কলেজ জীবনে ছাত্র দের যেভাবে শাসন করে সেভাবে সকল কে শাসন করতো। আমরা সবাই উনাকে হাড়ে হাড়ে ভয় করতাম। উনি এখানে নতুন আসছে। আমার এবং মালিহার বিষয়ে পুরো ভার্সিটিতে সবাই জানলেও উনি জানতেন না।

তো আমি ক্লাস করছিলাম, হটাত আমার ফোনে রিং বেজে উঠলো। স্যার কিছুটা রেগে গেলো। আমাকে ফোন রিসিভ করতে বলল, কিন্তু রিসিভ করার আগেই আবার কেটে গেলো, তো আবার ক্লাসে স্যার পড়ানোতে মনোযোগ দিলো। আবার ফোন আসলো, এবার স্যার এসে আমার কাছ থেকে ফোন টা কেড়ে নিলো।

ফোন টা স্যারের কাছে থাকলো, স্যার রিসিভ করার আগেই আবারো কেটে দিলো মালিহা। স্যার করার আগেই আবার কেটে দিলো। স্যার ক্রমেই খুব রেগে যাচ্ছিলো। পুরো ক্লাস যখন আমাকে নিয়ে তামাশা করছিলো, কেউ কেউ বলছিল কিরে আলি তোর বউ ফোন দিয়েছে নাকি?

-তো পরের বার স্যার ফোন ধরল, ওপাশ থেকে, এই সুপ্ত, জানু নিচে আসো, আমি কখন থেকে তোমাকে ফোন দিচ্ছি। আমার খুব বিপদ প্লিজ তুমি তাড়াতাড়ি নিচে আসো।

-তো স্যার ফোন কেটে দিয়ে আমার কাছে এসে অনেক বকাঝকা করলো এবং সেই সাথে ক্লাস থেকে বের করে দিলান। আমার মেজাজ চরমে উঠে গেলো। আমি রাগে গজগজ করতে লাগলাম। এই অপমান কে আমি মানতে পারছিলাম না।

নিচে গিয়ে দেখলাম মালিহা ক্যান্টিনের একপাশে দাড়িয়ে আছে। সেই চঞ্চলতা আজ নেই ওর মাঝে। পাশে একটা ব্যাগ। আমি ওর কাছে গেলাম শুধুমাত্র ওকে বকা দিবো বলে। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই মালিহা আমার বুকে এসে ঝাপিয়ে পড়লো। আমি তাড়াতাড়ি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম, ওকে দুই গালে কষে কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে, ওকে হাত ধরে টানতে টানতে ভার্সিটির বাইরে এনে আরও কয়েকটা থাপ্পড় দিলাম, আর বললাম,

-তুই ভেবেছিস কি? তুই যেভাবে আমাকে ডাকবি আর আমি সেভাবেই আসবো। না কখনো না। তুই কি ভাবিস আমি ওকে ভালবাসবো। তোর মত এমন দুশ্চরিত্র মেয়েকে আমি কখনও ভালবাসবো না। তোর নিজের না হয় মান সম্মান নাই তাই বলে কি আমার মান সম্মান নাই। আর তুই আমাকে সুপ্ত বলে ডাকবি না আমার নিজের একটা সুন্দর নাম আছে যে নাম আমার বাবা মা আকিকা দিয়ে রাখছে। পারলে তুই আমাকে আলি নামে ডাকবি না হয় ডাকবি না। আর আমার সাথে আর কখনও যোগাযোগ করার চেষ্টা করিস না। আমাকে আমার মত থাকতে দে। তোর জন্য আমি কোথাও নিজের স্বতন্ত্রতা নেই। এই ধরনের আরও শখানেক কথা ওকে শুনালাম। ওকে কোন কথা বলার সুযোগ দিলাম না। চলে আসলাম মেসে।

সেদিন থেকে পরপর সাত দিন মালিহা আমাকে ফোন দিয়েছিলো না। আমি মনে মনে কিছুটা খুশিই হয়েছিলাম যে যাক বাবা বাঁচছি। ভুত তাহলে বিদায় হয়েছে!

আমি আবারো মেস চেইঞ্জ করে অন্য মেসে চলে আসলাম। জহুরী মহল্লার মেসে আসলাম। সেখানে আমার ইউনিভার্সিটি তে পড়ুয়া এক বড় ভাইয়ের সহায়তায়। মইনুল ভাই আমার ডিপার্টমেন্টের তিন সেমিস্টার সিনিয়র। উনি আমাকে নিয়ে আসলেন জহুরী মহল্লার মেসে। মেস টা অনেক সুন্দর ছিল। পাশেই মসজিদ ছিল যেটা আমার খুব পছন্দ হল। আমি ভাবলাম এখানে আসলে মালিহা আর আমাকে খুঁজে পাবে না। তাঁর অত্যাচার থেকে আমি রেহায় পাবো। এই মেস টাতে মইনুল ভাই ছাড়াও আরও ছিল, শামিম ভাই, মুস্তাক ভাই, তুহিন ভাই, জাব্বার ভাই এবং মিজান ভাই। সবাই আমার সিনিয়র ছিল। মইনুল ভাইয়ের সাথে আমার ইউনিভার্সিটি থেকেই ভালো একটা সম্পর্ক। মইনুল ভাই জানতো আমার এবং মালিহার মধ্যকার এই ব্যাপার টা। উনার পরামর্শেই চলে আসলাম জহুরী মহল্লা তে।

এখানে একটা ব্যাপার মিনুল ভাইকেও মালিহা খুব ভালো মত চেনে। অনেকবার মইনুল ভাই কে সাথে করে নিয়ে গেছি মালিহার সাথে বেড়ানোর সময়।

এভাবে সাত থেকে আট দিন পার করলাম ভালো মত। কোন ফোন নাই মালিহার। কোন দেখা কড়া নাই। সবাই হয়তো বারবার জিজ্ঞাসা করতেছিল মালিহার খবর কি এতদিন হয়ে গেলো আসেনি কেন। আমি সবাই কে বলে দিয়েছি ওর ব্যাপার নিয়ে আমার সাথে যেন কোন কথা না বলা হয়। মনটা খুব ফুরফুরে লাগছিলো।

উদ্ভাস কোচিং সেন্টারে জব করি প্রায় বছর খানি হবে। সেখান থেকেও চাকরি বদলি করে চলে আসলাম, তাজমহল রোডের ই-হক কোচিং সেন্টারে। যাতে কোথাও গিয়ে মালিহা আমাকে খুঁজে না পায়।

আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী দের উচ্চতর গণিত ক্লাস করাচ্ছিলাম। হটাত করেই মইনুল ভাইয়ের ফোন আসলো। আমি কিছুটা অবাক হলাম। মইনুল ভাই জানে আমি এই সময় কোচিঙে সময় দেই স্টুডেন্ট দের কিন্তু এখন ফোন দেওয়ার মানে কি। আবার ভাবলাম উনি তো বুদ্ধিমান লোক। হয়তো কোন সমস্যা আছে না হলে তো উনি এই সময় ফোন দেবে না। ছাত্র-ছাত্রি দের একটা অংক করতে দিয়ে বাইরে এসে ফোন কল ব্যাক করলাম।

-হ্যা মইনুল ভাই কি ব্যাপার? কোন সমস্যা? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

-না তেমন কোন সমস্যা না। তুমি কি বাসায় আসতে পারবা এখনি? মইনুল ভাই যেন বিস্ময় নিয়ে বলল।

-আপনি তো জানেন আমি এই সময়ে কোচিং করাই। এখন কিভাবে আসবো।

-কোচিং শেষ হতে কয়টা বাজবে? মইনুল ভাই জিজ্ঞাসা করলো।

-সন্ধ্যা তো হয়ে যাবেই?

-না তাঁর আগেই আসো। কাজ আছে। ছুটি নিয়ে নাও।

-ঠিক আছে। দেখছি কি কড়া যায়।

-না তোমাকে আসাই লাগবে। যেভাবে হউক ছুটি নাও।

আমি এসে সেই ক্লাস টা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করে ছাত্র-ছাত্রি দের বল্লাম,আজ আর পড়াবো না। আগামি কাল সকালে এসো। আমার আজ কে একটা সমস্যা হয়েছে। সবাই খুশি হয়ে চলে গেলো। আমি আমাদের চেয়ারম্যান স্যার কে অনেক বলে কয়ে ছুটি নিয়ে বিশ মিনিটের মধ্যেই মেসে ফিরে এসে দেখলাম, কেউ না মেসে। আমি তো ভাবনায় পড়ে গেলাম, তাহলে তো নিশ্চয় কোন অঘটন ঘটেছে। ফোন দিলাম মইনুল ভাইকে,

-কোথায় আপনি, রুমে তো দেখি একটা পাখিও নেই? আপনার কি কোন সমস্যা হয়েছে?

-আরে না কোন সমস্যা হয়নি। তুমি বস আমরা কিছুক্ষণের মধেই চলে আসতেছি।

মইনুল ভাই এর স্বাভাবিক কথা বলে তে আমি একটু চিন্তা মুক্ত হলাম। বসে বসে টিভি দেখতেছিলাম। মিনিট পনেরো হবে তাঁর মধ্যেই দরজায় নক পড়লো। আমি ভাবলাম মইনুল ভাই ফিরে এসেছে।

-না আবারো আমার ভাবনাতে ভুল জবাব আসলো। হাল্কা আকাশি রঙের শাড়ি পড়ে একটা মেয়ে দাড়িয়ে দরজার সামনে। আমি প্রথমে চিনতে পারিনি। পরক্ষনেই চিনতে পারলাম যখন তখন আমি মালিহার বুকের সাথে মিশে গেছি। আমাকে পাগলের মত চুমু খাচ্ছে। ছাড়তে চাচ্ছে না। আমি নিজেকে ওর বাধন মুক্ত করার আপ্রান চেষ্টা করতেছিলাম। কিন্তু কেন যেন সব শক্তি আমি আজ কে হারিয়ে ফেলেছিলাম। দরজা খোলা ছিল বলে আমার অসস্তি লাগছিলো। পাশের বিল্ডিঙের লোকজন তাকিয়ে ছিল যেন কিছু উপভোগ করতেছে স্বচক্ষে। আমি এবার জোর করে ছাড়িয়ে দিলাম মালিহা কে।

-আমি আবারো ওকে সেই বকাঝকা করতে লাগলাম। ও কোন কথা না বলে শুধু আসতে করে বলতো

-প্লিজ সুপ্ত অন্তত আজকের দিনে আমাকে বকাঝকা করো না। কিছুক্ষণ তোমার কাছাকাছি আমাকে থাকতে দাও শুধুমাত্র আজকের এই মহান দিনটাতে।

-কেন, আজকে কি এমন মহান দিন শুনি?

-আজকে আমার জান সুপ্ত মানে আমার আলি আমার ভালবাসার মানুষটি এই পৃথিবীতে এসেছিলো। মানে আজকে ১৭ই ডিসেম্বর। তোমার জন্মদিন।

সেদিন যে ১৭ই ডিসেম্বর ছিল আমি টা একদম ভুলে গেছিলাম। আবার এইদিন যে আমার জন্মদিন ছিল তাও আমি ভুলে গেছিলাম। আসলে সেই মেস থেকে আসার সময় আমার আগের সিমটা চেইঞ্জ করেছিলাম। এই নাম্বার টা আমার কোন বন্ধু দের দেওয়া হয়েছিলো না। কেউ নাম্বার তেমন জানতো না বলে উইশ করে নি বলে আমিও জানতে পারিনি। অন্যবার আমার সব বন্ধু বান্ধবিরা এতো এসএমএস দিতো যে আমি আগের দিন রাত ১১ টার দিকেই জেনে যেতাম। তাছাড়া এই কয়দিনের এমন সব কাণ্ডকারখানা আমাকে এই দিন টার কথা ভুলিয়ে দিয়েছে।

-আমি বললাম, তুই আমাকে মুক্তি দিবি কবে বলতো। তোর জন্য আমার জীবন টা আজ জাহান্নাম হয়ে গেছে। তোর পা ধরি তুই আমাকে তোর এই জ্বালাতন থেকে মুক্তি দে।

-ঠিক আছে জানু আর কখনও কোনদিন আমি তোমার মুখোমুখি হবো না। আসবো না তোমাকে জ্বালাতন করতে। ফোনও করবো না তমাকে।আজকে আমাকে তুমি শুধু সামান্য সময় দাও যেন আমি তোমার জন্মদিন টা শেষ বারের মত পালন করতে পারি। প্লিজ জানু আমাকে এইটুকু সুযোগ দাও।

আমি তখন আর কোন বাধা দিতে পারলাম না। মালিহা দুইটি গিফটের প্যাকেট আমার হাতে দিলো তার আগে খুলল। একটাতে ছিল সুন্দর একটা ডায়েরি সোনালি রঙের। অন্যটাতে একটা কলার ওয়ালা গেঞ্জি ছিল যাতে সবুজের মাঝে সাদা দাগের ছোঁয়া ছিল। আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে অনেক রাগের মধ্যে আমি গিফট টা নিয়েছিলাম না। টান দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম মইনুল ভাইয়ের বিছানার উপর। অন্যটাতে যে ডায়েরি ছিল তার প্রথম অনেকগুলো পৃষ্ঠা মালিহার নিজের হাতের লেখা ছিল। মানে অটোবায়োগ্রাফি বলা যায় আর কি।

এবার আমাকে নিয়ে গেলো আমাকে ভিতরের রুমে যে রুমটা সব সময় অন্ধকার হয়ে থাকে। আমি গিয়ে খাটে বসলাম। কিছু ভাবতে পারছিলাম না কি করবো। মন্নে মনে পস্তাচ্ছিলাম যে কেন মইনুল ভাইয়ের কথা মত ছুটি নিয়ে আসলাম। আবার তো মালিহার অত্যাচার শুরু হয়ে যাবে। এই এলাকা টা একটু খারাপ। ছাত্র লীগের ছেলেরা সবসময় ঘরাঘুরি করছে ওরা যদি দেখে একটা মেয়ে আমাদের এখানে আসা যাওয়া করছে তবে আমার হয়তো এই এলাকাতেই আর থাকতে পারবো না। এসব ভাবতে ছিলাম কিছুটা চোখ বন্ধ করে।

হটাত করেই ঘরে আলো জ্বালাল মালিহা আমার পড়ার টেবিল টার ওপরে সুন্দর একটা কেক সাজানো আছে। আমাকে ডাক দিলো বলল, জান প্লিজ আমার উপরে আজকে অন্তত রাগ করো না, আসো কেক কাটো। এভাবে ও মোমবাতি জালিয়ে আমাকে দিয়ে কেক কাঁটালো । আমাকে ওর নিজের হাতে কেক কেটে খাওয়ায়ে দিলো। আমাকে খাওয়ায়ে দিতে বলল, আমি দিলাম না। ও এবার আমাকে জড়িয়ে ধরল, এক নাগাড়ে চুমুর পর চুমু দিতে লাগলো। আমি একবার নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, স্টপ, স্টপ দিস। আই জাস্ট হেইট দিস অ্যানাটমি।

আবার মালিহা আমার উপর ঝাপিয়ে পড়লো এবার ঘরের বাতি টা নিভিয়ে দিয়ে। আমাকে প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমি এবার নিজেকে আর ছাড়াতে পারছিলাম না। নিজের সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছিলাম তবুও ছাড়াতে পারলাম না। মালিহা আমাকে গরম করে ফেলল তার উষ্ণ কায়িকায়। আমি নিজের মাঝে কেন জানি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেললাম। নিজের মধ্যে কি যে হল আমি ওকে আপন করে নিলাম বুকের মধ্যে। দুজনার মাঝের শুন্যতা হারিয়ে গেলো। মিশে গেলাম তার মাঝে। নিজের মাঝ থেকে কোন কিছুর অব্যাহতি আমাকে আবার সজ্ঞানে ফিরিয়ে আনল। আমি নিজেকে এই অবস্থায় দেখে বিস্মিত হলাম।

আবার নিজেকে একরকম জোর করে ছাড়িয়ে নিলাম। মালিহা আমাকে আরও কিছুক্ষণ চাচ্ছিল যেন তার পাশে থাকি। আবার আমি প্রচণ্ড জেদে তাঁকে থাপ্পড় দিলাম। দুষলাম তাঁকে অনেক। মালিহা অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো। আমার মনে কোন সহানুভুতি উদয় হল না। মনের মধ্যে ভিতি সঞ্চার হচ্ছিলো এই জন্য যে মইনুল ভাইয়েরা যদি এই অবস্থায় দেখলে কতনা খারাপ ভাববে।

আমি বিছানাতে হেলান দিয়ে বারবার ভাবছিলাম, পাগলিটা কখন যাবে? দুজন একেবারে নিশ্চুপ ছিলাম। আমার শরীর টা কেমন যেন দুর্বল লাগছিলো। চোখ বুজে আসছিলো। মালিহা আমাকে অনেক বার ডেকেছিল, আমি উত্তর করতে পারছিলাম না। মালিহা ডেকেই যাচ্ছিলো মনে হল।

ভাবনায় ছেদ পড়লো। চোখ খুলে দেখলাম লঞ্চের টিকিট চেকার। আমার কাছে টিকিট দেখতে চাইলো। আমি সংবিদ ফিরে পেয়ে আমার ডানে তাকিয়ে ব্যাগ টা খুলতে চাইলাম। না কোন কিছুই তো এখানে নাই। না আছে ব্যাগ না আছে আমার ল্যাপটপ। আমার সাথে আনা কোন কিছুই নাই। মোবাইল টাও নাই। আমার সামনে কেবিনে তাকিয়ে দেখলাম সেই মহিলা এবং উনার বাচ্চা যারা আমার রুমে অসুস্থতা দেখিয়ে উঠেছিলো তাঁরা কেউ নেই। আমার যাবতীয় জিনিস পত্র সব নিয়ে গেছে। চিন্তায় এতোটা ডুবে গেছিলাম যে কখন নিয়ে গেছে টের পাইনি।

চেকার কিছু হয়তো বুঝতে পারছিলো সেজন্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য বলল, ঠিক আছে স্যার আমি আবার ঘোরার সময় এসে নিচ্ছি।

আমি ভাবলাম, আমার ব্যাগে আমার কয়েকটা কাপড় চোপড় ছিল, কিছু টাকা পয়সা এবং টিকিট টা আছে ব্যাগে ফ্রন্ট পকেটে। সব থেকে বড় কথা ল্যাপটপ এ আছে আমার যাবতীয় কাজের হিসাব নিকাশ। মহিলা হয়তো আমার ল্যাপটপ টা বেচে হাজার চল্লিশ টাকা পেতে পাড়ে কিন্তু সে তো জানবে না তাঁতে কোন ইনফরম্যাশন আছে।

চেকার আসলে উনাকে বুঝিয়ে বললে উনি বুঝতে পারলেন। তখন আর কিছু বললেন না। আমার পরনে থাকা জিন্স প্যান্ট টাতে অবশ্য আমার ক্রেডিট কার্ড ছিল। আমি কিছুটা আশান্বিত হলাম এই ভেবে যে কার্ড থেকে টাকা তুলে আমার প্রয়োজন মেটাতে পারবো। পটুয়াখালী আসতে এখনো ঘণ্টা তিনেক লাগবে। আবারো ভাবনাতে নিমগ্ন হলাম।

মালিহা সেদিনের পর থেকে আমার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে আর কখনও একটিবারের জন্যও আমাকে ফোন দেয়নি এমন কি আমার কোন বন্ধুদের কেউ ফোন করেনি। আমি ভেবেছিলাম হয়তো কয়েক দিনের পর আমার কাছে আবার মালিহা ফোন দিবে কিন্তু আর কখনও ফোন দেইনি। সেদিন ওর সাথে আমার এভাবে মনস্কামিক মুহুরত টা আমাকে নিজের কাছে অনেকবার প্রশ্নের মুখোমুখি করে ছিল, কোন জবাব পাইনি। আমি মইনুল ভাই এবং অন্যান্য আমার রুম মেট দের সাথে এইটা নিয়ে অনেক বকাঝকা করেছিলাম। মইনুল ভাই জানতো এমন একটা কিছু করেবে।

মইনুল ভাই আমাকে বলেছিল, মেয়েটি অনেক ভালো প্লিজ তুই ওকে ফিরিয়ে দিস না। ওকে বিয়ে করলে তুই জীবনে অনেক সুখি হবি।

-আমি বরাবরি এইটার বিরোধিতা করে এসেছিলাম। সবাই কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলাম যে মালিহার বিষয়ে যেন কোন কথা আর না বলা হয়।

এভাবে মাস তিনেক পার হলে, ইউনিভার্সিটি তে আমার সব ছোট বড় ভাই বোনেরা এবং টিচারেরা মালিহার না আসা বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো, কি ব্যাপার আলি ভাই মালিহা আপু কে দেখছি না তো অনেক দিন হয়ে গেলো। কি ব্যাপার কোন ঝগড়া হয়েছে বুঝি। অমন সুন্দর ভালো একটা মেয়ের সাথে রাগ করে থাকতে হয়না যান গিয়ে রাগ ফুলে তাঁকে একটু সময় দেন। মেয়ে টা আপনার জন্য জীবনে অনেক কিছুই করে গেলো। অন্য কোন মেয়ে এইভাবে আপনার জন্য কিছু করবে না। আপনাকে এতো গভীর ভাবে কেউ ভালবাসবে না।

-একদিন তো আমাদের অ্যাডমিন স্যার সাব্দার মণ্ডল আমাকে অফিসে নিয়ে ডাকল, জিজ্ঞাসা করলো মালিহার ব্যাপারে, কি ব্যাপার আলি, ওই যে মেয়েটা কি যেন নাম, হ্যা মালিহা, ও আর আসেনা। কোন কি সমস্যা?

-আমি অনেক্তা রাগান্বিত হয়ে উত্তর দিয়ে ছিলাম, আসেনা তো আমাকে জিজ্ঞাসা করতেছেন কেন? আমি কিছু জানিনা।

-তুমি জাননা? স্যার অনেকটা অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলো। অহ বুঝতে পারছি রাগ করেছ তার ওপর। আমাদের অনেক স্যারে তোমাকে এইসব নিয়ে রাগাত বলে। ঠিক আছে আমি সবাই কে নিষেধ করে দেবো। আর কখনও তোমাদের ব্যাপারে কিছু কেউ বলবে না।

-স্যার দেখেন প্লিজ আমাকে ওর ব্যাপারে আর কোন কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। ওর বিষয়ে আমার আর জানার কোন আগ্রহ নাই। ওই একটা মেয়ে আমার জীবন টাকে জাহান্নাম করে ফেলেছিল। সে গেছে আমি মুক্তি পেয়েছি। আল্লাহ আমাকে বাচাইছে।

-হায়রে গাধা! যে মেয়েটা তোমার জন্য এতো কিছু করলো আর টাকে কিনা তুমি বলছ তোমার জীবন জাহান্নাম করে ফেলেছিল। তার মুল্য তুমি এইভাবে দিলে। আবার টাকে এইভাবে বলছো ছি ছি। তোমাকে আমার ছাত্র বলতে ঘৃণা হচ্ছে। উপকারের মুল্য তুমি এই ভাবে দিলে মেয়েটাকে? তোমাকে অনেক নীতিবান ছেলে মনে করতাম। স্যার এতোগুলো কথা একসাথে বলে থামলেন।

-মানে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি কিছুই বুঝলাম না?

-আলি তুমি জানো না ওই মালিহা তোমার কত বড় উপকার করেছে। পদে পদে তোমার জন্য নিজেকে ব্যয় করেছে। তোমার কোন জিনিশে তার হাত নাই বলতো। যযখন তুমি কোথাও ভর্তি হতে পারনি তখন তুমি আসার আগেই ওই মেয়েটা নিজে এসে আমার সাথে তোমার ভর্তির বিষয়ে কথা বলে। জানো তোমাকে এতো কম টাকা কেন দেওয়া লাগে আস্লনে কিন্তু কম দেওয়া লাগেনা। ওই বারো লাখ টাকায় তোমার দেওয়া লাগে কিন্তু তুমি সেটা জাননা। আর সেটা দিয়েছিল মালিহা। তুমি জানলে নিবেনা বলে আমি তোমাকে জানায়নি।

তুমি জানো চার মাস আগে যখন ও তোমার বাকি সেমিস্টারের টাকাও ও শোধ করে দিয়ে গেছে। আগের টাকা গুলোও সব একবারে পরিশোধ করে দিয়েছিলো সেদিন। আমাকে অবশ্য ওইদিন বলেছিল যে আর কোন দিন আসা হবে না। আমি তেমন একটা আমলে নেয়নি। আমি জানতাম সে তোমাকে ছেড়ে বেশি দিন থাকতে পারবে না। এইজন্যই তোমাকে বলিনি। তোমার ভর্তি পরীক্ষার কোচিং সেন্টারে ভর্তির ব্যাপারেও তার প্রত্যক্ষ হাত না থাকলে তুমি ভর্তি হতে পারতে না। আমরা তো ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া কাউকে ইঞ্জিনিয়ারে ভর্তি করায় না কিন্তু ওর তোমার প্রতি ভালবাসা কে আমরা শ্রদ্ধা জানিয়ে তোমাকে ভর্তি নিই আমরা।

সত্যি বলছি আলি, আমি তোমার একজন শিক্ষাগুরু হয়ে বলছি তোমাকে সে খুব ভালবাসে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তোমার চোখই খুলল না তার প্রতি। এখন তুমি বলছো সে তোমার জীবন কে জাহান্নাম বানিয়েছে। এইটা ঠিক না।

মালিহা তোমার জন্য তার সরবচ্চ করেছে আর তোমার ভুল ধারণা রয়ে গেছে তার প্রতি যে সে তোমার জীবন পুরো নষ্ট করে দিয়েছে। এটা সত্য যে সে তোমাকে প্রথম থেকেই খুব বেশি ভালবেসে এসেছে। তোমার এতো অবহেলা সত্তেও সে তার অবস্থান পরিস্কার করেছে যে সে তোমাকে ভালবাসে আর তোমাকে ছাড়া কাউকেই আর চাইনি এতে দোষের কি আছে। তুমি তো টাকে বলতে পারতে তোমার জীবনে কেউ থেকে থাকলে। কিন্তু বলনি হয়তো মনের কোথাও তার প্রতি দুরবলতা ছিল। তাছাড়া সে ছাড়া তো তোমার জীবনে আর কেউ আসার সুযোগ পায়নি। বন্ধু বল আর ভালবাসা বল মালিহা তোমার সেই একজন। তার সবসময়ের উপস্থিতি তোমার জীবনে অন্য কোন মেয়েকে আসতে দেয়নি।

আমি তোমার একজন টিচার হয়ে উপদেশ বল আর আদেশ বল আমি বলছি ওকে তোমার জীবনে ফিরিয়ে আনো। মালিহার মত মেয়ে তুমি আর কখনও পাবেনা।

-স্যার এসব কি বলছেন আপনি? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।

-হ্যা হ্যা এইগুলোই সত্য এই গুলো ঠিক। ওর জন্যই তুমি আজ এইখানে দাড়িয়ে রয়েছো। আজ তুমি টাকে বুঝছো না তবে সেদিন বেশি দূরে নেই যেদিন তুমি মালিহার জন্য পস্তাবে।

এতোগুলো কথা বলে স্যার থামলেন, আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না। মাথাটা চক্কর দিতে লাগলো। এই প্রথম মালিহার প্রতি টান অনুভুতি হতে লাগলো। বাসায় চলে আসলাম। আমার বন্ধ কড়া সিম টা চালু করলাম। মালিহার নাম্বার টা স্ক্রিনে এনে দায়েল করলাম। কতবার ফোন করেছেলাম জানিনা, বার বার বন্ধ দেখাচ্ছে। সেইদিন থেকে আমি নিয়মিত ভাবেই মাঝে মাঝে ফোনে কল দিতে লাগলাম না বার বার সেই একই কথা, আপনার ডায়েল কৃত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পড়ে আবার কল করুন। তারপর থেকেই আমি এই সিম টা আর বদলায়নি। কোনদিন বন্ধও করেনি। আমি বিশ্বাস করেছিলাম মালিহা আমার এই নাম্বার টা যেহেতু জানে একদিন না একদিন আমাকে ফোন দিবে অন্তত আমার জন্মদিন ১৭ই ডিসেম্বর তে ফোন করবে। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ বছরে একবারের জন্যও ফোন দেয়নি মালিহা।

মালিহা চলে যাওয়ার পরে মালিহার শুন্যতা আমি বুঝতে পেরেছি প্রতিটি মুহূর্তে। মইনুল ভাই আমাকে তার ব্যাপারে প্রথমে বলার পর আমি যখন নিষেধ করে ছিলাম তার পর থেকে আর কখনও বলেনি। আমার প্রতিটি জন্মদিন গেছে আমার অনেক কষ্টে। প্রতি শুক্রবার আমি এখনো ভাবি হয়তো মালিহা অভিমান ভুলে চলে আসবে কিছু একটা বলবে আমাকে কিন্তু না এভাবেই পার হয়ে গেছে বছর গুলো। যে মেয়েটা আমার চারিপাশ ঘিরে থাকতো সবসময় সেই এখন কিভাবে এতোটা দিন আমাকে না দেখে থাকতে পারছে আমি বুঝতে পারিনা।

মালিহা চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছি আমার কতটা জুড়ে মালিহার অবস্থান ছিল। আমি নিজেও টাকে কতটা ভালবাসতাম। কিন্তু আমার প্রচণ্ড পড়াশোনার চাপ এবং কোচিং করানো এই গুলো কে নিয়ে আমি অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ি যাতে আর কখনও টাকে খোজ করতে পারিনি। তবে যত দিন পার হয়েছে আমার জবনে তার প্রভাব তত বেশি বিস্তার করেছে। মইনুল ভাইয়ের সেই কথাটা কিছুদিন পরেই আমি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম, উনি প্রায় বলতেন দেখো, আলি তোমার একজন ভালো বন্ধুই হতে পারে তোমার ভালো একজন জীবনসঙ্গী।

আমি তখন কথাটা স্বীকার করেছিলাম না, বলেছিলাম, বন্ধু তো বন্ধু সে কখনও জীবন সঙ্গি হতে পারেনা। কিন্তু আজ ছয় বছর পর বুঝতে পেরেছি যে একজন ভালমানের বন্ধুই হতে পারে একজন মানুষের জীবনের সর্বোত্তম সঙ্গি। মালিহা চলে যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছি আমি ওর সদা উপস্থিতির জন্য আমার জীবনে আর কেউ আসতে পারেনি। সেই আমি কাউকে সেই ভাবে গ্রহণও করিনি।

তার ফিরে আসার কথা চিন্তা করে আমি অসংখ্য প্রেমের প্রস্তাব কে ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি মেয়ে বন্ধুদের কে তেমন পাত্তা দেয়নি। প্রতি মুহূর্তে আমি তার জন্য প্রতিক্ষা করেছি। আমার শক্ত বিশ্বাস ছিল যে মালিহা আসবেই। তার প্রতি মুহূর্তের দুষ্টুমির কথা গুলো আমাকে নিরবে খুব কাদায়। তার উষ্ণ অনুভুতি এখন খুব মিস করি। যতই তাঁকে নিয়ে ভেবেছি তার প্রতি আমার দুর্বলতা তত বেড়েছে।

সেদিনের সেই কান্না মাখা মুখটা আজো আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দেই। অনুতপ্ততায় আমাকে কাদায়। সেদিন মালিহা বলেছিল, সুপ্ত আজ তুমি আমাকে সরিয়ে দিচ্ছ তো দাও। আমাকে তোমার এতো বিরক্তি লাগে তো। এমন একদিন আসবে যখন এই আমাকে পাবার জন্য আমাকে খোজার জন্য তুমি মরিয়া হবে। আমার জন্য চোখের জল ফেলবে। তন্নতন্ন করে খুজবে সবখানে কিন্তু পাবে না সেদিন আমাকে তুমি।

সত্যিই তো আজকে তাঁকে আমি পাবার জন্য কতনা উতলা হয়ে উঠেছি। প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে তার কথা মনে পড়ছে। তাঁকে আজ আমার জীবনে ভীষণ প্রয়োজন। তার আশা ছিল আম্মি বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশের বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবো। আমি একে একে সেই পথ সবটাই পাড়ি দিলাম কিন্তু সিমান্তে এসে তোমাকে আমি ভীষণ ভালবেসে ফেললাম। তার সাথে একটি বারের জন্য কথা বলার জন্য আমার মন আনচান করতে লাগলো।

এখন আল্লাহর কাছে আমার একটায় চাওয়া, যেন একটি বারের জন্য হলেও আমি তার দেখা পাই।

আমার ভাবনাতে ছেদ পড়লো আবারো, সেই টিকিট চেকার লোক টি এসে বলল, ভাইইজান, পটুয়াখালী তো এসে গেছে। নাম্বেন না? তাড়াতাড়ি নামেন এখনই আবার বরিশালের উদ্দেশ্যে লঞ্চ ছেড়ে দেবে।

চোখ মেলে তাকালাম, চারিদিকে হাল্কা হাল্কা অন্ধকার বিরাজ করছে। সুবহে সাদিক এখনো দেখা যায়নি। মোবাইল টা হাতড়ালাম। পাচ্ছিলাম না বলে বিরক্ত হলাম। পরক্ষনেই মনে পড়লো সেই বেআক্কেল মহিলার নিরস ব্যবহারের কথা।

লঞ্চ থেকে নেমে খুব খিধে অনুভব করলাম। কিছু একটা খাওয়া দরকার সেই গতকাল থেকেই কিছু খাওয়া নাই। পেটের মধ্যে বুড়বুড়ি দিতেছে। বমি হবে না হয়তো মুখে নালা আসবে কারণ পেটে তো কিছুই যায়নি। পাশেই একটা হোটেল পেয়ে গেলাম সবজি দিয়ে কয়েক প্লেট ভাত সাবাড় করলাম। হোটেল বেয়ারা বারবার বলছিল স্যার মাংস দেই, গরুর মাংস খুব ভালো হবে।

যদিও গরুর মাংস আমার খুব প্রিয় ছিল তবুও পকেটের কথা চিন্তা করে না করে দিলাম। খাওয়া শেষ হতে হতেই ফজরের আজান দিয়ে দিলো। বিল মিটিয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আল্লাহর কাছে অনেক চাওয়ার আছে। উনিই একমাত্র ভরসা আমাকে মালিহার কাছে পৌঁছে দেওয়ার।

মসজিদে নামাজ পড়ে রেস্ট নিলাম। একজন কে জিজ্ঞাসা করলাম এখানে কোথাও ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বুথ আছে কোথায়। উনি আমাকে ঠিকানা বলে দিয়ে চলে গেলো। আমি মসজিদে অনেকক্ষণ রেস্ট নিলাম। আমি জানি পৃথিবীতে একমাত্র নিরাপদ স্থান এই মসজিদ আর মায়ের কোল।

সকাল সাত টার দিকে বুথ খুললে আমি প্রথমে গিয়েই পনেরো হাজার টাকা তুললাম। পটুয়াখালী হাসান মার্কেটের দোতলাতে মোবাইল এর দোকান থেকে অল্প দামের একটা চাইনিজ মোবাইল সেট কিনলাম। পাশের গ্রামীণ ফোনের কাস্টমার কেয়ার থেকে আমার হারিয়ে যাওয়া সিম টা রিপ্লেস করলাম যেটা ওই বেআক্কেল মহিলা চুরি করে নিয়ে গেছে। আমি জানি এই সিম টা আমার সকল বন্ধু বান্ধবি এবং আত্মীয় স্বজনেরা জানে। সব চেয়ে বড় কথা হল এই নাম্বার টা মালিহা জানে। যেজন্য আমি একবারের জন্যও আমি এই সিমটা বন্ধ করিনি এবং হারিয়ে গেলেও তুলে এনেছি সাথে সাথে। ভাবনায় ছিল এই সময় হয়তো মালিহা ফোন করবে। এই আশাটা আমাকে আজো সিমটার ব্যাপারে সচেতন করেছে।

আমার কোন কোন বন্ধুরা আবার শেষের দিকে এসে বলেছে, হয়তো সে তোকে ভুলে গেছে। আর তোকে ভালবাসে না হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে বলে আর তোকে ফোন করে না। আমি তাদের কোন কথা মানতে নারাজ ছিলাম। তীব্র বিশ্বাস করেছিলাম যে মালিহা আসবেই। বিয়ে হলেও অন্তত আমাকে জানাতো।

আমি নতুন মোবাইল টাতে সিমটা চালু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন কাবেরি আপু ফোন দিলো। আমি প্রথমে চিনতে পেরেছিলাম না। এইজন্য আমি ফোন ধরে প্রথমে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হ্যালো কে?

-কিরে কে মানে কি? তুই আমাকে চিনিস না মনে হচ্ছে?

-না মানে চিনি কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছিলো তো তাই। তাছাড়া তোমার নাম্বার তো আমার মুখস্ত নাই।

-তার মানে তুই আমার নাম্বার সেভ করিস নি। আচ্ছা তোর আক্কেল টা কেমন? ফোন বন্ধ করে রেখেছিস কেন? কি ব্যাপার?

-আরে বলনা, আমার তো সব কিছু চুরি হয়ে গেছে? ল্যাপটপ, ব্যাগ, মোবাইল আরও কিছু শার্ট এবং প্যান্ট।

-মানে কি? আর তুই এখন কোথায়? তোর বাসাতে চোর আসলো কোথা থেকে?

-মানে আবার কি। আমি তো গতকাল রাতেই রওনা দিয়েছি মইনুল ভাইকে খোজার জন্য। আজকে হরতাল এছাড়া উনি বলেছিলেন যে মইনুল ভাই ডিভি তে লটারি পেয়েছে। কবে চলে যাবে কে জানে। একদিন মিস হলে যদি উনি চলে যান তবে আমি কি করবো?

এই উদ্দেশ্য নিয়েই রওনা দিয়েছিলাম। আমি আমার কামরাতে বসেছিলাম। হটাত ওই মহিলা অসহায় সেজে নাটক করে আমার এমন একটা বেরসিক অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দেবে কে জানে?

-আমি তো আগেই বলেছিলাম, ছাড় ওইসব পাগলামো। তুই তো কিছুই শুনলি না। এখন তার মুল্য তো দিতে হবে। এই বলে হো হো হো করে হাস্তে লাগলো।

-তুমি এইটাকে পাগলামো বলতেছো আর হো হো করে হাসছো। তুমি আমাকে নিয়ে ফান করতেছো?

-সরি সরি। এখন বল কতদুর এগালি?

-এইতো আমি এখন পটুয়াখালী শহরের মধ্যে। এখান থেকে হিরেরচর গ্রামে যেতে হবে। সেখানেই মইনুল ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি।

-ঠিক আছে, তাহলে ভালো মতো যা, কোন বিপদ হলে বলিস। হয়তো আমি কোন না কোন ভাবে তোর উপকারে আসতেও পারি।

-কাবেরি আপুর সাথে কোথা বলা শেষ করে একটা ট্যাক্সি ডাকলাম। মামা যাইবেন?

-কেউ কেউ বলল না মামা যামু না। তবে একজন নিজে থেকে এসে বললেন মামা উঠেন আমি যামু।

লোকটার চেহারাটা একটু শয়তান টাইপের ছিল। এজন্য আমি সাবধানতা অবলম্বন করলাম। পাশের এক ট্যাক্সি ওয়ালা আমার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমাকে সাহায্য করবে বলে আসলো। উনি আমাকে সেই ঠিকানাতে নিয়ে আসলেন। রাস্তা গুলো ছিল খানা খন্দে ভরা। চারিদিকে ঝপজঙ্গল ভরা। আসার সময় বুঝতে পারলাম, এই গুলোতে দিনের বেলাতেও অনৈতিক কার্যকলাপ হয়। ছিনতাই হয় সবসময়। এইজন্যই কেউ এইদিকে আসতে চাইনা।

যাইহউক অনেক কষ্ট করে আসলাম সেই হিরেরচর গ্রামে। মনে মনে বিরক্তি ভোর করছিলো কি এমন গ্রাম্ম যার নাম আবার হিরেরচর! ট্যাক্সি এসে আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। হিরেরচর গ্রামটা ছিল অনেক বড়। এক গ্রামে ৬ টা ওয়ার্ড।

কয়েকজন কে জিজ্ঞাসা করলাম মইনুল নামে কাউকে চেনে কিনা? বাবার নাম সহ বললাম কিন্তু সবাই একই কোথা বলে যে এই নামে তো অসংখ্য মানুষ আছে কার কোথা বলবো। কেউ কেউ বলে কয় নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দা সেইটা জানতে পারলে বলা যেতো।

আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। এবার কাবেরি আপু ক্কে ফোন দিয়ে ঘটনাটা বললাম, যে গ্রাম টা অনেক বড় চিনতে তো বিশাল সমস্যা হচ্ছে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে এতো দূর এসেও আমাকে শুন্য হাতে ফিরে যেতে হবে।

-ওপাশ থেকে কাবেরি আপু বলল, ঠিক আছে তুই অতো ভেঙ্গে পরিস না, তুই বরং এক কাজ কর ওই হিরের চোর গ্রাম থেকে সোনাডাঙ্গা র্যাাপিড অ্যাকশান ব্যাটেলিয়ন এর ৭ নং পয়েন্ট আছে সেখানে আমার এক কলিগ আছে। সে তোর উপকার করবে, আমি বলে দিচ্ছি। তুই এখনি রওনা দে। তার পোস্টিং যেহেতু ওখানে ও নিশ্চয় খুঁজে বের করতে পারবে।

-আবারো ট্যাক্সি ভাড়া করে চলে আসলাম, সোনাডাঙ্গা র্যা বের অফিসে। সেখানে যাবার পর আবার ফোন দিলাম কাবেরি আপু কে। আমি এমনি পুলিশ দেখলে ভয় পায় তার উপরে উনি আবার র্যাাবের অ্যাকশান অফিসার। আমি কিছুটা ইতস্ত করছিলাম বলে ফোন দিয়ে বললাম, আমি তো এসেছি তুমি ফোন করো।

-কাবেরি আপু বলল, আমি কিছুক্ষণ আগেই ফোন দিয়েছিলাম, তোর কোথা বলেছি। তুই ভিতরে গিয়ে শুধু বল যে অ্যাকশান অফিসার নাজমিন নাহার কে চাই। দেখ সবাই দেখিয়ে দেবে।

-না প্লিজ তুমি আবার ফোন করো আমি বাইরে দাড়িয়ে আছি। ভিতরে যেতে কেমন লাগছে।

-আরে পাগল আমি এইমাত্র ফোন দিলাম।

-না তুমি আবার দাও।

এইভাবে কথা বলার একটি পর্যায়ে খুব সুন্দরি একটি মেয়ে আমার সামনাসামনি এসে দাঁড়ালো। গায়ে র্যািবের পোশাক পরিহিত। দেখতে অনেক সুন্দর। এবার আমার ফোন টা আমার হাত থেকে নিয়ে বলল, হ্যা দোস্ত তুই কোন চিন্তা করিস না, আমি তোর ভাইয়ের সব কাজ করে দিবি, নিজে উপস্থিত থেকে। এবং নিজে থেকেই নাজমিন ফোনটা কেটে দিলো।

-ফোনটা আমাকে দিয়ে বসিয়ে বলল, কি মিঃ আলি রহমান, আপনার সমস্যা আমাকে একটু খুলে বলবেন কি। আর কাকে খোঁজা লাগবে শুনি?

-আমি পুরো সমস্যাটার একটা সারাংশ বললাম। সেইসাথে বললাম, খোঁজা লাগবে দুইজন কে তবে আপাতত আপনি প্রথম জন কে খুঁজে পেতে সাহায্য করুন তাহলেই আমি কৃতজ্ঞ থাকবো। এবার আমি আমার সাথে আনা মইনুল ভাইয়ের ঠিকানাটা দেখালাম।

-নাজমিন আপা কিছুক্ষণ ঠিকানাটা হাতে ধরে কি যেন ভাবলেন। তারপর কি যেন আরও ভেবে আমাকে বললেন, এই মইনুল হাসান কে আমি যতটা সম্ভব মনে হচ্ছে চিনি। ছবি দেখে চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিকানা তো আলাদা দেওয়া আছে।

-আমি এবার বললাম, যে ঠিকানা দেওয়ায় আছে সেইটাই হল আসল ঠিকানা। আমি এই ঠিকানা টা এনেছি উনি যেখানে জব করতেন সেখান থেকে। দুঃখের বিষয় উনি ওখান থেকে ছয়মাস আগে চাকরি ছেড়ে চলে এসেছেন। এজন্যই খুজতে আসা।

-ঠিক আছে চলুন দেখি কি করা যায়। নাজমিন আপা আর আমি রওনা দিলাম।

প্রথমে আমার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী হিরেরচর গ্রামে অনেক অনেক খোঁজাখুঁজি করে। মানুষের মুখে শুনে জানা গেলো আমার দেওয়া মইনুল ভাইয়ের ঠিকানাটি ছিল মইনুল ভাইয়ের নানা-নানির বারির থিকানা।মইনুল ভাইয়ের বাবা এখান টাতে ঘরজামাই থাকতো। মইনুলের বাবা নাকি মারা যাবার পর তাঁরা নাকি ঢাকাতে চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানেনা। আমি ছবি দেখালাম, সবাই চিনতে পারলো, হ্যা হ্যা এই ছবির ছেলেটাই মইনুল।

আমিতো এবার আবারো দোটানা তে পড়ে গেলাম। ভোটার কার্ডে হিরেরচর গ্রাম লেখা অথচ এখানে উনি নাই। কি করবো কিছু মাথায় খেলছিল না। মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো।

নাজমিন আপা কিছু হয়তো বুঝতে পারছিলেন। এইজন্যই কিছুক্ষণ আরাম করার জন্য উনার বাসাতে নিয়ে গেলেন। দুপুরে আমার সাথে কিছু খেতে খেতে বললেন, কিছু মনে না করলে আমি কি জানতে পারি ব্যাপারটা কি?

-আমি এবার উনাকে সব ঘটনা খুলে বললাম, উনি আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন চিন্তা করবেন না আমি সবসময় আপনার পাশে থাকবো। যেকোনো মুল্যে আপনার মইনুল কে খুঁজে বের করবো। দরকার হলে পুরো বাংলাদেশ খুঁজবো। আপনি চিন্তা করবেন না। এখন রেস্ট নিন, বিকালে আমি যে মইনুল কে চেনার কথা আপনাকে বলছিলাম না, তার ওখানে একবার দেখার দরকার। কি বলেন?

-আমি শুধু হ্যা বললাম।

বিকালে নাজমিন আপু সেই মইনুল ভাইয়ের বাড়ি নিয়ে গেলেন। আমি প্রথমে যেতে চাচ্ছিলাম না, পরে উনি বললেন, দেখতে তো আর কোন সমস্যা নাই তাই না?

পরে গিয়ে দেখলাম, উনি যে মইনুল ভাইয়ের কথা বলছিলেন উনি বাসাতে নেই। উনার স্ত্রী আমাদের ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসালো। নাজমিন আপু উনাকে সব খুলে বলল, আমার ছবিটা নিয়ে বলল, দেখেন তো এই ছবিটা কি মইনুল ভাইয়ের কিনা?

উনি দেখে বললেন, আরে হ্যাঁ এইটা তো মারিয়ার বাবার ছবি দেখছি। মারিয়া হল মইনুল ভাইয়ের আড়ায় বছরের মেয়ে। ভিতর থেকে আরও এ্যালবাম বের করে এনে দেখালেন। ভাবি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে কেন জানি চেনা চেনা লাগছে। পরে অ্যালবামের একটি ছবির সাথে আমাকে মিলিয়ে বললেন, দেখেন তো এই ছবিটা আপনার কিনা?

-আমি ছবিটা দেখে অবাক হলাম, হ্যাঁ এই ছবিটা তো আমারই ছবি।

উনি বললেন, আপনার সাথে আরও একজনার ছবি আছে। বলে মালিহার সাথে আমার একটা ছবি ছিল সেইটা দেখাল। এই ছবিটা মইনুল ভাই তার নিজের মোবাইল দিয়ে উঠিয়ে ছিল। জিয়া উদ্যানের লেকের পাশ থেকে ছবিটা উঠানো। আমাকে অবশ্য দেখিয়েছিল কিন্তু আমি তখন এইটা ডিলিট করে দেওয়ার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু আজকে এই ছবিটা আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিচ্ছে।

উনার স্ত্রী আমাকে বলতে লাগলো, আপনিই সেই আলি রহমান, জানেন না আপনার ভাইয়ের মুখে আপনার এবং মালিহার নামে কত কথা যে শুনেছি। শেষের কথা গুলো আমার খুব খারাপ লেগেছিল। যাই হউক এতদিন পরে আপনি কি মনে করে আসলেন তাও আবার সাথে করে পুলিশ নিয়ে। আপানারা বসেন আমি মইনুল কে ফোন দিচ্ছি।

-উনার স্ত্রী ফোন করে আমার কথা বলার সাথে সাথে উনি বললেন, যে উনি এখনি চলে আসছেন। সামান্য অপেক্ষা করতে।

আধাঘণ্টা পরে মইনুল ভাই আসলেন। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কি ব্যাপার ভাইজান, কি অপরাধ করলাম যা আমার বাসায় পুলিশ নিয়ে আসছো। এতদিন পরে কি মনে করে? আর চিনলে কি করে?

-আমি হাসতে হাসতে বললাম, চেনার জন্যই তো পুলিশের সহয়তা নেওয়া। নাজমিন আপা কে মইনুল ভাই আগে থেকেই চিনতেন। তবুও আমার পক্ষ থেকে পরিচয় করিয়ে দিলাম।

-এবার জিজ্ঞাসা করলেন হ্যাঁ বলো আমি কি করতে পারি তোমাদের জন্য?

-আমি খুব হতাশায় ভুগছিলাম, প্রায় কান্না ভরা চোখে বললাম, মইনুল ভাই এখন আমি বুঝতে পারছি, মালিহার ভালবাসার গভিরতা। আমিও এখন তাঁকে অনেক ভালবাসি। আমার জীবনে তাঁকে এখন খুব প্রয়োজন। ওর দেওয়া সেই ডায়েরিটা কি আপনার কাছে আছে? ওকে খুঁজে বের করতে হলে ওইটা এখন আমার খুব প্রয়োজন।

-মইনুল ভাই আমার কাতরতা বুঝতে সমর্থ হলেন। হ্যাঁ আছে। খুব যত্ন করে রেখেছি। তোমাদের প্রেমের কথা তোমার ভাবিকে অনেকবার বলেছি। তোমার ভাবি শুনে খুব আপসোস করে।

এবার মইনুল ভাই ভাবিকে ভিতরে যেখানে ডায়েরিটা রেখেছিল সেখান থেকে নিয়ে আসতে বললেন। ভাবি ডায়েরি দুইটা নিয়ে এসে আমার হাতে দিলো। সেই আগের মতন নতুন হয়েই আছে। বুঝতে পারলাম উনি খুব যত্ন করে রেখেছিলেন। আমি মালিহার দেওয়া ডায়েরিটা নিয়ে উল্টিয়ে পালটিয়ে দেখলাম। কোথাও কোন ঠিকানা লেখা আছে কিনা?

-হ্যাঁ মালিহার নিজের হাতে লেখা ঠিকানা দেওয়া আছে। উনি আমাদের না খাইয়ে ছারলেন না। মইনুল ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি এবং নাজমিন আপু মালিহার বাসার ঠিকানাতে যাবার জন্য রওনা দিলাম বরিশালের উদ্দেশ্যে।

প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে এসে থামলাম বরিশাল শহরে। সেখান থেকে লোকজন কে বলে কানাইপুর আসলাম। কানাইপুর শহর থেকে বেশি একটা দূরে না। এই পথে আসতে আমরা পার হলাম দরিয়াপুর ক্যান্টনমেন্ট।

মালিহার দেওয়া ঠিকানাতে গিয়ে দেখি একটা সুন্দর বাড়ি। আমাদের প্রথমে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না। আবারো নাজমিন আপার প্রফেশনাল পরিচয় দেবার সাথে সাথে উনাকে বরং একটা স্যালুট দিয়ে ঢুকতে দিলেন।

-কিন্তু ভিতরে গিয়ে তেমন কোন দৃশ্য চোখে পড়লো না। বারির মালিক এসে আমাদের কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে বললেন, আপনারা ঠিক জায়গাতেই এসেছেন কিন্তু এখন তো উনারা এখানে থাকেন না। উনার ভাষ্যটা ছিল এমন যে মালিহার বাবা একজন আর্মি অফিসার ছিলেন। এই বাসাটা মালিহার দাদার বাসা। উনারা এখানেই থাকতেন। কিন্তু বছর তিনেক আগে যখন বদলি হউন তখন উনারা এই বাসাটা বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছেন। কোথায় গেছেন জানিনা।

আমার এবার গলা ভারি হয়ে আসলো। খুব কান্না পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো চিৎকার করে কাঁদি। আকাশ বাতাশ পেরিয়ে সেই কান্না যেন পৌছে যায় মালিহার কানে। কিন্তু পাশে নাজমিন আপু আমার দিকে মিটিমিটি তাকাচ্ছিল। বুঝতেছিলাম না উনি এমন লুকোচুরি কেন করতেছেন। হয়তো আমাকে হেয় করতে নাহয় আমার ধৈর্য দেখে। কিন্তু আর তো আমার শক্তি না মনে হচ্ছে। খুব হতাশ হয়ে পড়লাম।

উনি আমাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করতেছেন। উনার বাসায় সেই রাতেই ফিরে আসতে রাত ২ টা বেজে গেলো। আমি চোখের পানি আর রাখতে পারছিলাম না। আমার পাশে খুব ক্লোজ হয়ে বসেছিলেন নাজমিন আপু। উনি আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমার মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে নিলেন। আমাকে উষ্ণতায় ভরাতে চাইলেন মনে হল। কিছুক্ষণ পরে কিছুটা স্বাভাবিক হলাম।

আমাকে বুকের মধ্যে নিয়েই শুরু করলেন নিজের জীবনের দুঃস্বপ্নের কিছু কাহিনী। উনি একটা ছেলে কে ভালবাসতেন। ভালবাসার রঙ্গিন জীবনে থাকা সময়টা তিনি অনেক রোমান্স নিয়ে পার করেছেন। শরীর মন সবকিছুই তিনি তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু ছেলেটি অস্ট্রেলিয়া চলে যাবার কয়েকমাস পরে আর নাকি কোন যোগাযোগ করেনি। আজো তার আশায় তিনি বসে থাকেন। হয়তো কোন দিন ফিরে আসবে।

আমাকে সান্ত্বনা হিসাবে বললেন, এতো টা বাধা অতিক্রম করে যখন এসেছো নিশ্চয় তুমি নিরাশ হবে না। আশা রাখো।

তারপর রাতের খবার দিয়ে আরও কিছুক্ষণ আমার সাথে কথা বললেন। যখন গুড নাইট জানিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো, আমাকে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। আমার একদম ঘুম আসছিলো না। মালিহার দেওয়া ডায়েরিটা বের করে এই প্রথমবারের মত পড়তে লাগলাম। আগে অবশ্য যখন ডায়েরিটা মালিহা আমাকে দিয়েছিলো তখন বন্ধুরা ওইটা নিয়ে মজা করার একটা পর্যায়ে ডায়েরির লেখা গুলো উচ্চস্বরে পড়েপড়ে আমাকে শুনাতো। আমি খুব রাগ করতাম কিন্তু এখন এই ডায়েরিটা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলাম।

-ডায়েরিটা কে আজ খুব আপন মনে হচ্ছিলো। কত চড়ায় উতরায় পার করে এই ডায়েরিটা আমি হাতে পেলাম। প্রথম থেকে তার লেখা অটো বায়গ্রাফি টা পড়তে শুরু করালাম। শেষের দিকে তার অনার্স করছিলো যে কলেজে সেই কলেজের নাম আসলো। বরিশাল বিএম কলেজ। অর্থনীতিতে অনার্স করছিলো।

-মনের মধ্যে একটু ভাবনার ঝিলিক উঠে আসলো। তিনবছর আগে যদি মালিহার বাবা বদলি হয়ে যায় তবে ওই কলেজে তো মালিহার বাবার বদলি হবার সম্পূর্ণ ইনফরম্যাশন থাকার কথা।

পরেরদিন নাজমিন আপার সাথে আলোচনা করে বিএম কলেজে গেলাম। না কোন তথ্য মিললো না। আবারো হতাশায় ভোর করলো। নাজমিন আপা ডায়েরিটা পড়তে ছিল উনি বলল, এখানে তো ওর স্কুল এবং কলেজের নামও দেওয়া আছে। এইজে স্কুলের নাম বরিশাল চন্দনা-মহন স্কুল এবং কলেজ হচ্ছে প্রগতি কলেজ। এইখানে একবার খোঁজ নিলে পাওয়া যেতে পারে হয়তো কোন ইনফরম্যাশন।

আমি নাজমিন আপা কে বললাম, যখন অনার্স পরতেছিল বিএম কলেজে তখন ওর বাবা বদলি হয়েছে। ওরা কি করে জানবে? মালিহা কে আর পাওয়া সম্ভব না মনে হচ্ছে।

-কেন কলেজে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে ঠিকানা দিতে পারবে না যে কোথায় ওর বাবা বদলি হয়েছে?

-পারবে না। কারণ যখন এই স্কুল এবং কলেজে মালিহা পড়তো তখন ওর বাবা এখানেই ছিল। এমন কি এইচএসসি পাশ করার পর আরও দুবছর এখানে ছিল, তাহলে ওরা কি করে জানবে?

-নাজমিন আপু এবার বলল, আচ্ছা দেখেন তো ওর বাবার নাম লেখা আছে কিনা?

-আমি ডায়েরিটা আবার ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম না কোথাও ওর বাবার নাম লেখা নাই।

-তবে আপনি কানাইপুর গিয়ে লোকটাকে যে বললেন, মালিহার বাবার নাম শরিফ চৌধুরী? লোকটাও এক নামেই চিনে ফেলল।

-মালিহা একবার আমাকে বলেছিল, যে তুমি এসে যদি আমার বাবার নাম বল যে শরিফ চৌধুরির বাসা কোনটা? সবাই তোমাকে সাথে সাথে দেখিয়ে দেবে। কিন্তু নামটা কেন লিখেনি আমি বুঝতে পারতেছি না। আমার মনে হয় চাকরি ক্ষেত্রে অন্য নাম থাকতে পারে।

-এবার নাজমিন আপা বিজ্ঞজনের মত বলল, তাহলে বরং আমাদের কে একবার মালিহার ইন্টার লাইফের কলেজে খোজ নেওয়া দরকার। তাহলে হয়তো ওর বাবা মায়ের পুরো নাম পাওয়া যেতে পারে। আর একবার বাবার নাম জানতে পারলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রালয় থেকে মালিহার বাবার বরতমান পোস্টিং কোথায় তাও জানতে পারবো।

-আমিও সম্মতি দিলাম, দুজনা সাথে সাথেই বের হয়ে গেলাম ওর ইন্টার লাইফের কলেজ প্রগতি কলেজে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। এখানে এসে একেবারে বোকার মত হয়ে গেলাম কারণ বাবার নাম না জানলে তাঁরা কিভাবে মালিহা কে চিনবে। আমি তারপরের শরিফ চৌধুরী বললাম, টি থেকে চারশো মেয়ের নাম আসলো যাদের প্রত্যেকের নাম মালিহা। না আবার ব্যর্থ হলাম।

এবার আসা একেবারেই ছেড়ে দিলাম যে না আর সম্ভব না। মালিহা হয়তো ভুল ঠিকানা দিয়েছিলো। আর না হয় আমরা সথিক সময়ে আসতে পারিনি। এতো বছর পর এসে কোন একটা মানুষের খোজ করা পাগলামো ছাড়া আর কিছুই না।

ফিরে আসলাম নাজমিন আপুর বাসায়। খুব হতাশ হয়ে পরছিলাম। কোন কিছুই মাথায় ধরছিল না। পরপর দুইদিন ঘুমালাম এখানেই। নাজমিন আপা আমার জন্য অনেক করেছেন। আমি উনাকে ধন্যবাদ জানালাম। উনি বলছিলেন যদি তোমার মালিহা কে খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত করতে পারতাম তবে হয়তো কিছু করা হতো। কিন্তু পারলাম না। দুজনেই ব্যর্থ হলাম।

সেদিন রাতে আমি খুব কাদতেছিলাম। মালিহার শেষের দিন কার কথা গুলো আমাকে খুব করে পোড়াচ্ছিল। আমি নাজমিন আপুর সাথে এইগুলো শেয়ার করতেছিলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। যখন ঘুম ভাঙল তখন আমি নিজেকে নাজমিন আমার শরিরের মাঝে মিশে থাকা অবস্থায় আবিস্কার করলাম। কোন কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম, উনি আমাকে বলতে দিলেন না। শুধু বললেন, প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না, আমিও জলছি, রাতের নিস্তব্ধতা এবং রাতের আধার ছাড়া কেউ টের পাবে না। তোমার চোখের দিকে যেদিন আমি তাকিয়েছি সেদিনই আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে স্বর্গ তাড়িত করোনা। প্লিজ আপন বাহু বন্ধনে আজকের রাত টুকু আমাকে জ্বালা থেকে মুক্ত করো।

ততক্ষণে নারী উষ্ণতায় আমি কাতর হয়ে গেলে আমি পুরুষত্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বখতিয়ারের ঘোরার লাগামহীন গতি বাড়তে থাকলো। জমানো কিছু ধন উগরে পড়লো নিজের কায়া থেকে। প্রশান্তির বাতাস যেন খেলে গেলো দোলাচলে।

পরেরদিন সকাল বেলাতে বিদায়ের বানি নাজমিন কে আমি দেইনি, তার পিপাসিত চোখের দিকে আমি আর চোখ মেলতে চাইনি বলে চলে এসেছিলাম ভোরের শিশির মাথায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে। তখনও আমি নিরাশার জলে ডুবি নাই যে মালিহাকে আমি আর কখনই পাবো না। আশা আরও সুদৃঢ় হয়েছে।

ঢাকাতে এসেছিলাম আরেকটি আশার বানি সঞ্চারণে। সে হচ্ছে মালিহার সাথে মাঝে মাঝে আসতো সেই ছোট মেয়েটা নাম আকলিমা স্বর্ণা। মেয়েটি এসএসসি তে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিল। আমার কাছে আমার সাথে উঠা একটা ছবি তখনও ছিল। এর কথা একেবারে ভুলেই গেছিলাম। আমার এখন বিশ্বাস আরও দৃঢ় হল এইজন্য যে এই মেয়ে তো মালিহা দের আত্মিয়া হয় তবে নিশ্চয় কোন না কোন তথ্য পেতে পারি। কিন্তু দুঃখের বিষয় মেয়েটা সম্পর্কে আমি বেশি কিছু তথ্য জানিনা। তবে আমি একবার স্বর্ণা দের কলেজ ভিকারুন্নেসা তে গিয়েছিলাম। ওখানকার প্রিঞ্চিপাল ম্যাডামের সাথে আমার একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল আমার কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা নিয়ে। আবার আশা জাগল।

কিন্তু গিয়ে আমি যখন মেয়েটির ছবি দেখালাম কেউ তেমন একটা চিনতে পারলো না। এবং সেই প্রিন্সিপাল এখন আর নেই বদলে গেছে।

সেজন্য আমি বুদ্ধি করলাম, যেহেতু আগের প্রিন্সিপালের সাথে আবার একটা ভাব ছিল তাই উনি আমার উপকার করতে পারবেন। তাছাড়া উনি আকলিমা স্বর্ণা এবং আমাকে ভালভাবেই চেনেন। স্কুল থেকে সেই ম্যাডামের ঠিকানা নিয়ে গেলাম উনার বাসায়। উনি বাসাতেই ছিল, আমি গিয়ে পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথে চিনতে পারলেন।

আমার সমস্যার কথা বললাম, উনি আমাকে আবার ভিকারুন্নেসা স্কুল এবং কলেজে নিয়ে গিয়ে অনেক কাগজ পত্র ঘেঁটে ঘেঁটে আকলিমা স্বর্ণার বাসার ঠিকানা আমাকে বের করে দিলেন, সেই সাথে স্বর্ণা বাবা ব্যবসা করতেন তার ঠিকানাও দিলেন।

আমি ম্যাডামের দেওয়া ইনফরম্যাশন দেখে আকলিমা স্বর্ণা দের বাসার ফ্ল্যাট টিতে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম, উনারা ওখানে থাকেন না। যারা এখন থাকেন তারাও জানেন না, আমি এবার আর হতাশ না হয়ে স্বর্ণার বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিলে দেখা মিলল, স্বর্ণার বাবার কিন্তু উনি আমাকে চিনতে পারেন নি। আর চিনবেনই বা কি করে আমি তো আগে কখনও উনার সাথে পরিচিত ছিলাম না। উনি আমাকে বসিয়ে রেখে আকলিমা স্বর্ণা কে ফোন করলেন। আকলিমা এখন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসিতে বিএসসি করতেছে। ওর এখন ৭ম সেমিস্টার চলতেছে।

স্বর্ণা আসলে ওর বাবা ওকে বলল, দেখো তো মামুনি তুমি এই ছেলেটাকে চিনো কিনা? আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বলল।

স্বর্ণা ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, না আব্বু আমি তো চিনতে পারতেছি না। কে উনি?

এবার উনার বাবা বললেন, উনি বলছেন তোমাকে নাকি চেনেন। এবং তোমাকে নাকি ওর বিশেষ একটা প্রয়োজন।

আমি এবার বললাম, তুমি স্বর্ণা না। আমাকে চিনতে পারছো না, আমি তোমার আলি ভাই। ওই যে তোমাদের এসএসসি সংবর্ধনাতে এসেছিলাম। তুমি গোল্ডেন এ প্লাস পাইছিলে।

-আরে হ্যাঁ হ্যাঁ আমি এখন আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি তো অনেক চ্যাঞ্জ হয়ে গেছেন। আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়ে গেছেন। বলেন কি খবর? আমাকে আপনার এতো প্রয়োজন হল কি করে? কি করতে পারি আপনার জন্য?

-না মানে বিষয়টা একটু জটিল যদি তুমি আমাকে একটু একা একা সময় দাও তাহলে সব খুলে বলতে পারি?

-সমস্যা নাই বাবা আমার বন্ধুর মত। আমি যেকোনো কথা বাবার সাথে শেয়ার করি। এবার দেখলাম ওর বাবাও আমাকে অনুরধ করলো যে বল, কোন সমস্যা নাই, পারলে আমি নিজে থেকে তোমাকে সহজগিতা করবো।

এবার আমি বললাম, ওই যে মালিহা আসতো না তোমার সাথে। তুমি একবার গিয়েছিলা তার সাথে জিয়া উদ্যানে। যেদিন মালিহা প্রথম আমার সাথে দেখা করে। মনে আছে/

-হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে বলুন, তার কি হয়েছে? আপনি তো তাঁকে সবসময় এড়িয়ে গেছেন। এখন তার খোঁজ কেন করতেছেন? কোন কি সমস্যা?

-না মানে তুমি কি তার সম্পূর্ণ ঠিকানা জানো? মানে মালিহা তোমাদের যদি আত্মীয় হয় তবে তো তুমি তাদের বিষয়ে জানবে। গত কয়েকটি মাস থেকে আমি তাঁকে খুব করে খুজছি পাচ্ছে না। আমি তার খোঁজে বরিশাল গিয়েছিলাম, তার বাসার ঠিকানায় কিন্তু ওখানে এখন অন্যজনারা থাকেন। আর মুল কথা হচ্ছে ও যে ডায়েরিটা আমাকে দিয়েছিলো টাতে ওর জীবনী লেখা আছে কিন্তু বাবা মায়ের নাম জানা নেয় বলে আমরা খুঁজে পায়নি। ওখান থেকে জেনে এসেছি উনারা বদলি হয়েছে। কোথায় বদলি হয়েছে তাও জানেনা। এইজন্যই তোমার খোঁজে এখানে আসা।

-বাব্বা এতো ভালবাসা তার ওপরে। আপনি আমার বাবার এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পাইলেন কথা থেকে?

-আমি তোমার স্কুলে গিয়েছিলাম, সেখানকার প্রিন্সিপাল আমাকে তোমার বাসার এবং তোমার বাবার এই ঠিকানা দিয়েছিলেন। বাসাতে আগে খোঁজ নিয়ে ছিলাম না পেয়ে এখানে এসে অনেক কষ্টে ম্যানেজ করলাম।

-কিন্তু আমি তো মালিহা আপুর বিষয়ে বেশি কিছু জানিনা। উনি আমাদের আত্মীয় ছিলেন না। আমরা আগে যে বাসাতে থাকতাম সেই বাসার পাশের ফ্ল্যাটে মালিহার আপুর এক চাচাতো বোন দুলাভাই থাকতো। সেখানে ও আসতো এবং আমার সাথে কথ বলতে বলতে ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে যায় এজন্য একবার আপুর সাথে আপনার ওখানে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

কিন্তু ওর বোন দুলাভাই কানাডা তে চলে যাওয়ার পরে আর মালিহা কখনও আসেনি। আমার সাথেও দেখা আর হয়নি।

-তুমি কি ওর বাবা মায়ের নাম জানো কি? এইটুকু জানলেও হবে।

-তাতো জানিনা। তবে মালিহা আপু আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল, আমার জন্মদিনে একটা গিফট পাঠিয়েছিলো। সেইটাতে মনে হয় মালিহা আপুর বাবার নাম লেখা আছে।

-এবার আমি খুব কাতর ভাবেই বললাম, প্লিজ তুমি সেই চিঠি টা থেকে নাম ঠিকানা টা জেনে আমাকে জানাও।

-স্বর্ণা এবার আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল। আমার শরীর পুরো থামে ভিজে গেছে। এসি চলতেছে তবুও আমার এমন অবস্থা দেখে ও কিছুটা অবাক হল। ঠিক আছে চলেন আমাদের বাসায় আমি আপনাকে সেইটা খুঁজে বের করে দিবো।

-এবার স্বর্ণা ওর বাবার গাড়িটা চেয়ে নিয়ে আমাকে গাড়িতে করে ওর বাড়ির দিকে রওনা দিলো। আসার পথে অনেক কথা হল, আমি এখন কি করতেছি সব জানলো। আমাকেও ওর ব্যাপারে অনেক কিছু জানালো। শেষে বলল, আমার বিশ্বাসই ছিল না যে আবার আপনার সাথে আমার দেখা হবে।

-আমিও এবার ভালো করে দেখলাম, সেই ছোট্ট স্বর্ণা মেয়েটা আজ কত বড় হয়ে গেছে। অনেক সুন্দর হয়ে গেছে। যৌবনের উজ্জ্বল অঙ্গ গুলো আজ যেন সব ডাগর ডাগর হয়ে গেছে। সুউচ্চ স্তনদেশ সবাই কে আকর্ষণ করতে সক্ষম।

আমাকে হটাতই জিজ্ঞাসা করলো, আগে আপনি আপু কে এতো অবহেলা করতেন সেই আপনি আজ আপুকে পাবার জন্য এতো কষ্ট দিচ্ছেন নিজেকে?

আমি বললাম, মালিহা চলে যাওয়ার পর পরই বুঝেছি ও আমার কতটা স্থান জুড়ে ছিল। আমার বিবেকের তাড়নায় তাঁকে আমি খুজতেছি। আসলে বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপাচাপি করতেছে। তারাও বলেছে আমার যদি কোন পছন্দ থাকে তবে তার সাথেই বিয়ে দিতে রাজি আছে, কিন্তু বিয়ে আমাকে করায় লাগবে। এজন্য আমি অনেক অনেক ভেবে দেখলাম, আমার জীবনে মালিহার সর্বদা উপস্থিতি অন্য কাউকে আমার জীবনে আসতে দেইনি।

-স্বর্ণা এবার কিছুটা হাসি দিয়ে বলল, আচ্ছা ভাইয়া যদি আপনি তাঁকে না পান। মানে গিয়ে যদি দেখেন, যে মালিহা আপুর বিয়ে হয়ে গেছে অন্য কারো সাথে তখন কি করবেন?

-আরে পাগলি আমাকে তো এই বিষয়টাই জানতে হবে। এইটা না জেনে তো আমি নিজেও কাউকে আমার জীবনে নিতে পারছি না। যখনি কাউকে আপন করে ভাবি তখনি মালিহার মুখটা আমার সামনে ভেসে আসে।

-আচ্ছা ভাইয়া আপনার ফোন নাম্বার টা আমাকে দিবেন? স্বর্ণা প্রত্যাশিত চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো।

-আমি না করতে পারিনি। বাসাতে নিয়ে আসার পর আমাকে টাণ্ডা আইসক্রিম খাওয়ালো। নিজের ঘরের মধ্যে গিয়ে অনেকক্ষণ খুঁজে খুঁজে বের করে আনলো মালিহার পাঠানো চিঠির খামটি। আমার হাতে দিয়ে বল্ল,এই নিন আপনার প্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষিত মালিহা আপুর ঠিকানা এখানে লেখা আছে?

-আমি হাতে নিয়ে দেখলাম, খামটাতে স্পষ্ট লেখা আছে, প্রেরকের জায়গায় মালিহার নাম ঠিকানা। মোছাঃ ফাইরুজ মালিহা চৌধুরী। পিতাঃ মোঃ সৈয়দ শরিফুদ্দিন মাহমুদ হাসান চৌধুরী। পোস্টঃ কানাইপুর থানা ও জেলাঃ বরিশাল।

আমি বললাম, এই ঠিকানাতে আমি গিয়ে খোঁজ নিয়ে ছিলাম কিন্তু ওখানে মালিহার বাবা কে শুধু শরিফ চৌধুরী বলেই চেনে। ওরা বলেছে মালিহার বাবা বদলি হয়ে গেছে। কিন্তু ওর বাবার পুরো না জানার জন্য আর এগুতে পারনি। এখন আমি যেকোনো মুল্যে বের করে আনবো।

-চলে আসবো এই সময় স্বর্ণা বলল, ভাইয়া মাঝে মাঝে আইসেন।

-আমি বললাম, ইয়ে মানে আনটি কে দেখছি না তো। আনটি কি বাইরে গেছেন?

-এবার দেখলাম স্বর্ণা চুপ করে আছেন। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আবারো জিজ্ঞাসা করতে যাবো এমন সময় স্বর্ণার বাবা এসে গেলেন। উনি স্বর্ণা বললেন, মামুনি তোমার এই ভাইয়াটাকে কিছু নাস্তা খাইয়েছো?

-এবার স্বর্ণা কিছুই না বলে কেদে ফেলল, আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।

উনি আমাকে বললেন, বাবা তুমি কি স্বর্ণাকে ওর মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছো?

-আমি বললাম হ্যাঁ সেটাই তো জিজ্ঞাসা করতেই কেদে ফেলল, কি হয়েছে।

-উনি এবার আমাকে বললেন, বাবা ওর মা ওর জন্মের সময় মারা গেছেন। সেই থেকে ওর ফুফুর কাছেই থাকতো, চার বছর পরে ওর ফুফুও মারা যায়। আমার মেয়েটি অনেক কষ্টে পেয়ে পেয়ে মানুষ হয়েছে। যাক গে বাবা তোমার কাজ হয়েছে।

-আঙ্কেল আমি দুঃখিত কিছু মনে করবেন না। আমি না জেনে বলে ফেলেছি। স্বর্ণা কেও বললাম, স্বর্ণা কেঁদো না। আমাকে ক্ষমা করো।

-উনি এবার বলল, না না বাবা। এটা কোন ব্যাপার না। তাছাড়া তুমি তো না জেনেই বলেছো।

আমি এবার স্বর্ণা এবং ওর বাবার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে চলে আসলাম, আমার ফ্ল্যাটে। বিকেল বেলা কাবেরি আপু কে ফোন দিলাম। সব ঘটনা খুলে বললাম।

-কাবেরি আপু বলল, তুই চিন্তা করিস না আমি খোঁজ নিয়ে বের করবো উনার বর্তমান পোস্টিং কোথায়?

সন্ধ্যার দিকে কাবেরি আপু আমাকে ফোন করে জানালো। আলি আমি সব তথ্য ম্যানেজ করে ফেলেছি। মালিহার বাবা মানে শরিফুদ্দিন মাহমুদ চৌধুরী এখন দিনাজপুর জেলার খোলাহাটি ক্যান্টনমেন্টে ওয়ারেন্ট অফিসার পদে কর্মরত আছেন। উনি আমার সাথে যাবার ইচ্ছা পোষণ করলেন।

আমি প্রথমে না করলেও পরে ভেবে দেখলাম, যদি কোন প্রবেশে বাধা আসে সেই ক্ষেত্রে কাবেরি আপু আমার অনেক বড় অনুদায়কের ভুমিকাতে আসতে পারেন। যেমন টি ঘটেছিলো সাভার ইপিজেডে প্রবেশের সময়।

পরেরদিন আমি এবং কাবেরি আপু দুজনাই রওনা দিলাম দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে। এই দিন কাবেরি আপু সুন্দর একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ছিলেন। দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। আমি তো বলেই ফেললাম, আপনাকে তো আজ নায়িকার মত লাগতেছে। কাবেরি আপু একটু হাল্কা করে হাসলেন।

-চল তোর বউকে আজ একেবারে বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে আসবো। তোর বাসাতে বলে দিয়েছি যে আলির বউ পেয়ে গেছি। তোর বোন কে বলেছি তুই বেশি চিন্তা করিস না, আলি কে আর আলির বউ কে একসাথে নিয়েই বাড়ি ফিরবো।

-আমি বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ হয়েছে হয়েছে। এখন আপনার কথা বলেন তো। আমার মনের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করতেছিল যে একবারের জন্য হলেও তো আমি মালিহা কে দেখতে পারবো সেটা তাঁকে আমি যে অবস্থাতেই পায়না কেন? এজন্য আমার মুখে হাসি ফুতে ছিল। কাবেরি আপা আমার পাশাপাশি খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে বসে ছিল। আমাকে নিয়ে আপু বারবারে ফাজলামো ইয়ার্কি করতেছিলো। সারা পথ কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলাম। পথ যেন শেষ হতেই চাইছিল না।

আমরা যখন পার্বতী পুর পৌছালাম তখন রাত ৯ টা সাড়ে ৯ টা বাজে আর কি। কাবেরি আপু আমাকে বলল, আলি এখন তো অনেক রাত হয়ে গেছে। এই খান থেকে খোলাহাটি ক্যান্টেনমেন্ট যেতে আরও দেড় ঘণ্টা অথবা দুই ঘণ্টা লাগবে। তো আজকে গিয়ে ওইভাবে খোঁজ নেওয়া যাবে না। বরং আমরা আগামী কাল সকাল সকাল গিয়ে খোঁজ নিলে ভালো হবে।

-কিন্তু আমরা থাকবো কোথায়? আমি প্রশ্ন করলাম।

-দেখি এখানে কোথাও আবাসিক হোটেল মোটেল আছে কিনা সেখানেই আমাদের থাকতে হবে।

-ঠিক আছে চল দেখি। আমরা অনেক লোক জন কে ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করার এক পর্যায়ে হোটেল পেলাম। হোটেলের নাম হল, হোটেল শাহজাহান। আমি এবং কাবেরি আপু দুজনা মিলে একটা ডাবল ব্যাডের রুম ভাড়া করলাম।

সারারাত আপুর সাথে আমি কথা বলছিলাম। আপুও বলছিল তার জীবনের কথা। আমার ভালবাসার প্রসংশা করছিলো। বারবার বলছিল তোর মত কেউ যদি এতো বেশি আমাকে ভালোবাসতো তাহলে আমি নিজের জীবন তার জন্য উৎসর্গ করতাম। একপর্যায়ে আমাকে নাজমিন আপার কথা জিজ্ঞাসা করলো।

-হ্যারে আমার দোস্ত নাজমিন কে তোর কেমন লাগলো?

-হ্যাঁ খুব ভালো লেগেছে। উনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছে। আমার সাথে সব জায়গাতে উনার ডিউটি ফেলে গ্যাছে। আমাকে থাকার জায়গা দিয়েছে। ভালো ভালো খাবার দিয়েছে।

-বাব্বা এতো প্রসংশা করতেছিস নাজমিনের নামে। ব্যাপার কি। আর কিছু দেয়নি? আমাকে চমকে দিয়ে এই প্রশ্নটা কাবেরি আপু করে ফেলল।

-আমি এড়িয়ে যেতে চাইলাম। না আবার কি করবে।

-আমি কিন্তু সব কিছু জানি। নাজমিন আমাকে সব কিছু বলেছে।

-আমি তো মনে হল কারেন্টের শক খেলাম। বলেছে মানে কি বলেছে?

-ওই যে রাতে তুই যা করেছিস তাই।

-আমি আর কোন কথা বলতে পারলাম না। দেখো আপু আমার কোন দোষ নাই। আমি ইচ্ছা করে করিনি।

-আমি তাও জানি। কাবেরি আপু বলল।

তাহলে তো হয়েই গেলো।

-জানিস আমার পরামর্শেই নাজমিন এমন করেছে তোর সাথে। জানিস তো এই পেশায় আসার পর আমি কোন ছেলে কে আপন করতে পারিনি। যখন কেউ শোনে যে আমি র্যারবের চাকরি করি তখন কেন যেন ভয় করে, আমাদের সাথে আর সম্পর্ক করতে চাইনা। কিন্তু আমরা প্রত্যহ এইসব কেস নিয়া হ্যান্ডেল করি।

-তুমি ঠিক কোথায় বলেছে। র্যাবব কথা শুনলে কেন যেন মানুষের মনে একটা ভিতি কাজ করে।

-এইজন্যই তো আজো একা। কোন সঙ্গী পেলাম না জীবনে। আচ্ছা বলতো আমার চেহারা কি খুবই খারাপ।

-কি বলছো? তোমার চেহারা খারাপ হবে কেন? এতো সুন্দর চেহারা কোন মেয়ের আছে দেখাও তো একটা।

-আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বলছিস।

- না আপু সত্যি তুমি সুন্দর।

সেই রাতে আমি এবং আপু দুজনাই ঘুমায় নি সারা রাত আপু আমার আর মালিহার কাহিনী শুনেছিল। বরিশাল যাবার পথে কি ঘটেছিল, সেই কথা শুনেছিল। আমরা কথা বলতে বলতে পুরো রাত পার করে দিয়েছিলাম।

-পরেরদিন টা ছিল ২৩ শে এপ্রিল। মালিহার জন্মদিন। আমি এই দিনটার কথা মনে রেখেছি সবসময়। মনে পরে অতীতের সেই কথা গুলো। একবার ২৩ শে এপ্রিল এ আমি ওকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম না বলে আমার কোচিং সেন্টারে চলে গিয়ে আমার স্টুডেন্টস দের সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আজ কে আমার জন্মদিন তুমি কেন ভুলে গেলে?

আমি তখন বলেছিলাম, তোমার জন্মদিন মনে রেখে আমি কি করবো। আমার তো কাজ নেই যে তোমার জন্মদিন মনে রেখে আমার পড়া মাথা থেকে মুছে ফেলি।

-সেদিনও মালিহা বলেছিল, এমন একদিন আসবে যেদিন আমার জন্মদিনের শুভেচ্চছা জানাতে খুঁজে খুঁজে আমার বাসাতে এসে হাজির হবে।

-আমি তাঁকে নিরাশ করে বলেছিলাম, আলির জীবনে সেইদিনটা কখনও আসবে না। তুমি অতো আশা করো না।

কিন্তু আজকে মালিহার কথা গুলো যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। তার জন্য আমি দিশেহারা হয়ে কত জায়গায় কত বাধা পেরিয়ে এসেছি। আবার আজকে যখন তার খোঁজ করে পেলাম তাও আবার তার জন্মদিন আজকে। মন্নে মনে এক্সাইটেট হচ্ছিলাম এই ভেবে যে প্রায় ছয় বছর পরে দেখবো মালিহা কে। মালিহা নিশ্চয় আমাকে দেখে সাথে সাথে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরবে। আগে মাত্র একদিন যদি আমি ওর ফোন না ধরতাম, পরের দিন আমার কলেজ অথবা আমার মেসে চলে আসতো। হাজার টা প্রশ্নে আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলত যে কেন আমি ফোন ধরিনি। কেন কথা বলিনি। সাথে সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিতো। আমার সাথে যখন ঝগড়া করতো আমার কলেজের বন্ধুরা এইগুলা দেখে খুব মজা পেতো।

মাঝে মাঝে কোন কোন বন্ধু তো বলেই ফেলতো, দোস্ত আলি আমাদের সাথে প্রেম করতে বল না আমি সবসময় ফোন ধরবো। সব সময় তার সাথে ঘুরবো। যা বলবে তাই করবো। এতো সুন্দর পরির মত মেয়ের ভালবাসা পেলে যে কেউ তার জীবনও বাজি রাখতে পারে।

-এসব কথা শুনার পর মালিহা আবার আমার বন্ধদের অনেক বকা দিতো। আমার সব বন্ধু গুলো কে কিভাবে যেন তার মান্য করে ফেলেছিল। আমার বন্ধুরা আমাকে বলতো ব্যাটা তোর কোন চোখ নাই। তুই আসলে চোখ থাকিতেও অন্ধ। আজ বন্ধুদের কথা গুলো খুব মনে পড়তেছে।

-জানিনা আমাকে দেখে হয়তো মালিহা আগের মতই করবে। তবে এবার আমার পুরো সম্মতি থাকবে তার আলিঙ্গনে। তার উষ্ণতা আমি আজো অনুভব করি। তার ঠোঁটের সাথে আমার ঠোঁট মিলাতে আমি আজ তৈরি। তাঁকে ফিরাবো এখন আর আমি। সারা জবনের জন্য আমি তাঁকে চাইবো। যত বাধা আসুক আমি সেগুলোকে জয় করতে চাইবো। এখন আমিই ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমি খুশিই হবো। এতো কিছু ভাবছিলাম আমি এক মনে।

-কাবেরি আপু এসে বলল, কি যাবি না? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। এগারো টা বেজে গেলে আবার সমস্যা হতে পারে।

-আমি কোন কথা না বলেই রেডি হয়ে আপু কে অনুস্মরণ করে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম মালিহা কে আমি কি বলবো। এইসব ভাবনা গুলো আমার মাঝে জড়ো হচ্ছিলো। পথে আপা কে বললাম, আপা আজকে মালিহার জন্মদিন। চল কিছু গিফট কিনে নিয়ে যায়। আমার জন্মদিনে মেয়েটি আমাকে কত কিছুই না গিফট করেছে, কিন্তু আমি তাঁকে তিরস্কার ছাড়া কোন কিছুই দেইনি।

-মালিহার জন্য কয়েকটি গিফট কিনলাম, একটা সুন্দর দেখে ক্র্যাচ কিনলাম, একটা গ্লোব কিনলাম। একটা ডায়েরি কিনলাম। আরেকটা শাড়ির দোকান থেকে হাল্কা আকাশি রঙের শাড়ি কিনলাম। আকাশি রঙের শারিতে মালিহা কে যেন আকাশের পরীদের মত মনে হয়। একবার পহেলা বৈশাখে মালিহা এমন একটা শাড়ি পরে আমার সাথে ঘোরার জন্য বাইনা ধরেছিল। আমি সেদিন তাঁকে সময় দেয়নি। সেদিন আরও অনেক অপমান করেছিলাম এইভাবে আমার সামনে আসার জন্য। কারণ সেদিন আমি আমার বন্ধুদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্তরে জেমস এর গানের কনসার্টে গিয়েছিলাম। হটাত তার আগমন কে আমি উটকো ঝামেলা বলেছিলাম।

সেদিন মালিহা খুব কেদেছিল। সন্ধ্যার দিকে যখন আমি তাঁকে বাসে উঠিয়ে গিয়েছিলাম তখন একবার শুধু সরি বলেছিলাম, তাতেই মালিহা সব অভিমান ভুলে আমাকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা দিয়েছিলো। আজকে তার বাবা মার সামনে গিয়ে বলবো, এই শাড়ি পরে আমার সাথে যেন ঘোরে।

ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে কাবেরি আপু ইনফরম্যাশন নেবার জন্য চারজিং পয়েন্ট এ গিয়ে মালিহা বাবার নাম বলার সাথে সাথে উনারা বলে দিলো যে, হ্যাঁ উনি যমুনা কোয়ার্টারে থাকেন। ফ্ল্যাট নম্বর হল, ৩২৮। চারজিং পয়েন্ট থেকে আরও বিশ মিনিট হাটার পর এসে যমুনা কোয়ার্টারে পউছালাম। ৩২৮ নং ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিং বেল বাজানোতে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেন মালিহার আম্মা।

-আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। আঙ্গুল তুলে কি যেন মনে করার চেষ্টা করলেন। তারপরে মুখে আস্তে আস্তে বললেন, তোমাকে যেন চেন চেনা লাগছে। এবার পুরদমে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেই ফেলল, তুমি আলি রহমান না?

-জী আনটি। আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমিই আলি।

-এসো বাবা ভিতরে আসো।

-আমরা ভিতরে যাবার পর বাসা টা সুন্দর করে দেখলাম। খুব ছিমছাম করে সাজিয়ে রেখেছেন সবকিছু। ড্রয়িং রুমের পশ্চিম পাশের দেওয়ালে মালিহার সুন্দর একটি ছবি দেখলাম। ছবিটার দিকে তাকিয়েই কেমন যেন আপন মনে হচ্ছিলো। সারাজীবন ধরে দেখতে ইচ্ছে করতেছিল।

কিছুক্ষণ পরে উনি একটি মেয়েকে সাথে করে আমার সামনে নিয়ে আসলেন। মেয়েটার বয়স পাঁচ বছর কিংবা সাড়ে পাঁচ বছর হবে হয়তো। দেখতে খুব সুন্দর। এই বয়সেই মাথার চুল বড় বড়। চুল গুলো হাল্কা সোনালি রঙের ফ্যাকাশে। আমার মাথার চুল অমন ফ্যাকাশে। ঠিক আমার চুলের মতই মনে হচ্ছে। চেহারার গাড়ুন মালিহার মত লাগছে। খুব ফর্সা। চুল গুলো ফুল করে ফুতিয়ে রেখেছে বলে আরও বেশি সুন্দর লাগছে। দেখে খুব আপন আপন লাগছে। মনে হচ্ছে যেন মেয়েটার সাথে আমার রক্তের কোন সম্পর্ক আছে। কেন এমন লাগছে বুঝতে পারলাম না।

-এতক্ষনে বুঝে গেছি মেয়েটা মালিহার মেয়ে। তারপরেও জিজ্ঞাসা করলাম এইটা কি মালিহার মেয়ে আনটি? কি নাম?

-আনটি কিছুটা চিন্তিত স্বরে বলল। হ্যাঁ। ওর নাম হল, তৌহিদা আলি।

-আমি বললাম, বা অনেক সুন্দর নাম তো। মেয়েটা আনটি কে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করলো, নানু উনারা কারা? কিসের জন্য এসেছেন?

-আনটি বলল, তৌহিদা মামনি ভিতরে যাও তোমার নানু কে ফোন করো। বল যে আলি রহমান এসেছেন ঢাকা থেকে। পরে বলতেছি উনারা কে। তবে উনিই তোমার একমাত্র আপনজন এই পৃথিবীতে।

তারপর আমাদের বসিয়ে রেখে আনটি ভিতরে গেলো, বলল বাবা তোমরা বস আমি তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসি।

আনটি চলে গেলে কাবেরি আপু আমাকে বলতে লাগলো, আমি বলেছিলাম না যে মালিহার বিয়ে হয়ে গেছে। এইজন্যই তোর সাথে আর যোগাযোগ করিনি। এখন দেখলি তো।

-আপু চুপ করো তো। আমি অন্য চিন্তা করতেছি। জানো তৌহিদা কে দেখে আমার কেমন যেন খুব আপন আপন লাগছে। এমন কেন লাগছে বুঝতে পারতেছি না। মনে হচ্ছে মেয়েটির সাথে আমার হাজার বছরের সম্পর্ক।

-তুই মালিহা কে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছিস তো তাই এমন মনে হচ্ছে। যাইহউক কিন্তু তোর মালিহা কে তো এখন পর্যন্ত দেখতেছি না। সে কি বাইরে গেছে। নাকি শশুর বাড়ি থাকে আর তার মেয়ে এখনে নানার বাড়ি থাকে।

কিছুক্ষণ পর আংকেল চলে আসলেন। আমাকে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছি। কিভাবে এতো খোঁজ পেলে আমরা এখানে থাকি। আমি সব বাধা বিপত্তির কথা খুলে বললাম। উনারা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল আমার কথা গুলো। একপর্যায়ে দেখলাম আনটির চোখে পানি চলে এসেছে।

আমি বললাম, আনটি মালিহার ব্যাপারে কিছু কি জানতে পারি? মানে মালিহার স্বামির বাড়িতে থাকে আর ওর স্বামি কি করেন।

এবার আনটি এবং আঙ্কেল দুজনাই একটু চুপ হয়ে গেলো সাথে সাথে মুখটাও যেন ভারি হয়ে গেলো। পাশ থেকেই তৌহিদা বলে বসলো, আমার আম্মু তো মারা গেছে। আমার আম্মু ওই আকাশের তাঁরা হয়ে গেছে।

-আমি এবার খুব বিচলিত হয়ে গেলাম, চোখ দিয়ে বলে হল ফিনকি দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তেছে। মনে হচ্ছিলো চিৎকার দিয়ে কাঁদি আর বলি না তা কখনই হতে পারেনা। মালিহা মরতে পারেনা। আমি সোফাতে বসে পড়লাম।

-আনটি ব্যাপার টি বুঝতে পেরেছিল, আমার পাশে এসে আমার মাথাই হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, দেখো বাবা এই কথাটাই সত্য, যে কথা আমরা তোমাকে বলতে কুণ্ঠিত হচ্ছিলাম সেটা হচ্ছে মালিহা আর এই পৃথিবীতে নেই।

-আমার গলাটা লেগে আসছিলো, কোন কথাই মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলো না, তবুও বললাম, কেন, কিভাবে সে এতো তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে চলে গেলো।

-আঙ্কেল এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার শুরু থেকেই বলল, মালিহা তোমাকে তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। আমরা সবাই জানতাম। তাঁকে সাপোর্ট করেছিলাম, তার ভালবাসাতে। আমরা মালিহার বন্ধুর মত ছিলাম। আমরা মাঝে চেয়েছিলাম তোমার সাথে কথা বলবো। প্রয়জনে তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মালিহা আমাদের কে নিষেধ করেছিলো, যে না এখন এসব বলার দরকার নাই।

-তুমি নাকি তাঁকে বন্ধুর মত ভালবাসতে। কিন্তু সে তোমার প্রতি দিন দিন অনেক দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলো। আমরা তাঁকে বলেছিলাম যে জোর করে কি ভালবাসা হয়, এজন্য অন্য জায়গায় তার বিয়ের জন্য কথা বলা হচ্ছিলো। সে এইগুলো মেনে নিতে পারেনি।

-পরে যেদিন আসলো তার কিছুদিন পরে তার শারীরিক অনেক পরিবর্তন হচ্ছিল, আমরা জিজ্ঞাসা করলে তখন বলেছিল যে সে তোমার সাথে মিলামেশা করেছে যার ফলে তার মধ্যে তৌহিদা দিন দিন বড় হচ্ছিলো। আমরা চেয়েছিলাম, তোমাকে ডেকে বিষয়টা মীমাংসা করি, কিন্তু মালিহা আমার পায়ে ধরে কয়েছিল আমাকে যেন জানানো না হয়। মালিহা তোমাকে চেয়েছিল পায় নাই বলে তোমার সন্তান কে তার মাঝে ধারণ করেছিলো জোর করে। এইজন্য সে অনেক অপমান সহ্য করেছিলো সবার কাছে। আমরাও অনেক অপমান সহ্য করে যখন হাপিয়ে উঠেছিলাম। বাবা হিসাবে চেয়েছিলাম যে আমার মেয়ে কে যেন কেউ খারাপ না বলে এজন্য তৌহিদার একজন পরিচিতির জন্যই ওকে জোর করেছিলাম বিয়ে দেবার জন্য কিন্তু মেয়েটা আমাদের কে দোষী করে চলে গেলো না ফেরার দেশে। তার চলে যাবার প সকালে যখন তার বিয়ের আয়োজন করেছিলো তখন তাঁকে আমরা সেই অবস্তায় পায়। প্রচণ্ড রাগ হয়েছিলো তোমার ওপরে। কিন্তু মেয়ে আমার তার জীবনী তে লিখে গেছিলো যে বাবা মায়ের পর আমি আলি কে সব থেকে বেশি ভালবাসি। আমাকে অনুরধ করেছিলো যে বিন্দু মাত্র যদি তার প্রতি ভালবাসা থাকে তবে যেন আমার কোন ক্ষতি না করে। তার বিশ্বাস ছিল যে তুমি একদিন আসবে। সেদিন যদি সে না থাকে তবেও যেন তোমার সাথে আমরা ভালো ব্যবহার করি, না হলে তার আত্মা ভীষণ কষ্ট পাবে।

এই পর্যন্ত বলে আঙ্কেল রুমের মধ্যে ঢুকে গেলো। কিছুক্ষণ পর এসে একটা ডায়েরি আমার হাতে ধরিয়ে দিলো, বাবা এইটা তোমার। মালিহা এটা তোমাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে। আর বাবা তৌহিদা হচ্ছে তোমার রক্ত। ও তোমার মেয়ে। তুমি ওকে ফিরিয়ে দিও না। মালিহা তোমাকে দীর্ঘ চিঠিতে লিখে গেছে, যে তোমার ভালবাসা না পেলেই আমি স্বারথক এজন্য যে সে তোমার সন্তানের মা হতে পেরেছে।

-আমার চোখ দিয়ে অশ্রু অনবরত বইছিল। কণ্ঠ ভারি হয়ে আসছিলো। একটা কথারও জবাব দিতে পারছিলাম না। শুধু দৌড়ে গিয়ে তৌহিদা দুগালে কয়েকটা চুমু খেলাম। তাঁকে আমার কেন আপন মনে হচ্ছিল সেটা এখন অনুধাবন করতে পারতেছিলাম। আনটি তৌহিদা কে উনার দিকে ঘুরিয়ে বলল, মামুনি এই হলো তোমার পাপা। যাও উনার বুকে যাও। তুমি বলতে না যে তোমার বাবা কবে আসবে। আজকে এসেছে। যাও তার বুকে যাও।

আমি তৌহিদা বুকে নিয়ে দুঃখ টাকে চাপা দিতে চাইলাম। শুধু আমার মুখ দিয়ে বাইর হল আজ যখন আমি মালিহা কে খুঁজে পেলাম কিন্তু টাকে পেলাম। তোমাকে কত না জায়গায় খুজেছি?

কয়েকদিন থাকার অনুরধ করলো আমাকে আঙ্কেল আনটি। আমি বললাম, এখানে থাকলে মালিহার সৃতি আমাকে সারাক্ষণ পীড়া দেবে আমি থাকবো না। আর আমি তৌহিদা কে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই।

-আনটি এবং আঙ্কেল কিছুক্ষণ ভেবে বলল, বাবা তোমার মেয়ে তুমি নিয়ে যাও কোন সমস্যা নেই, কিন্তু ওকে ভালবাসা দিয়ে রেখে, আঙ্কেল বলল, বাবা তুমি তো বিয়ে করনি, এই তৌহিদা তোমার জীবনে অনেক বাধা হতে পারে সে বরং আমাদের সাথেই থাক টাতে বরং তোমার ব্যক্তিগত জীবনে লাভ হবে। তৌহিদার কথা শুনলে কেউ টাকে মানবে না। তুমি মাঝে মাঝে দেখে যেও তাতেই আমরা খুশি। আমরা চাইনা তোমার জীবনে ওকে নিয়ে বাধা আসুক। তুমি যে ওকে এক বাক্যে স্বীকার করেছো তাতেই আমরা খুশি।

-আমি বললাম, না আনটি আমি মালিহা কে আমার ভালবাসা থেকে দূরে রেখে বড় ভুল করেছিলাম জীবনে। আজ আর সেই ভুল করবো না আমার মেয়ে কে আমার ভালবাসা থেকে দূরে রেখে। আমার যত ক্ষতি হউক না কেন আমি তৌহিদা কে আমার সাথেই রাখবো। আপনারা প্লিজ না করেন না।

এবার আনটি আঙ্কেল বলল, বাবা এখন বুঝতে পেরেছে তোমার ব্যক্তিত্ব কত বড়। আমার আজ কোন ক্ষোভ নেই তোমার ওপর। বরং আজ আমার গর্ব হচ্ছে যে তুমি আমার জামাই। যাও বাবা নিয়ে যাও। তোমার আদর্শে ওকে বড় করো। ও সারাক্ষণ বলে যে কবে ওর বাবা আসবে ঢাকা থেকে। তোমার আনটি বলতো আসবে। একদিন না একদিন আসবেই।

তৌহিদা কে সাথে আমি এবং কাবেরি আপা বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। তৌহিদা আমাকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে, আমার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। একের পর এক উতভট কথা জিজ্ঞাসা করেই যাচ্ছে। আমি টাকে পেয়ে যেন অনেক কিছুর সমাধান পেয়ে গেছি।

-কাবেরি আপা ট্রেনের টিকিট কাটতে গেলো। কিন্তু না বিএনপি হরতাল দিয়েছে। বিএনপির এক নেতা ইলিয়াস আলি কে কারা যেন ঘুম করে দিয়েছে রাজধানী থেকে। আজ পনেরো দিন পার হয়ে গেলেও সরকার কোন পদখেপ নেই নি এই প্রশ্নে সকাল সন্ধ্যা হরতাল চলছে। কিন্তু ট্রেন চলবে তবে আজকের টিকিট সব বুক হয়ে গেছে। এজন্য কাবেরি আপা নিরুপায় হয়ে পরেরদিন সকাল সাড়ে এগারোটার টিকিট কিনল। মানে সেইদিন টা আমাদের হোটেলে থাকতে হবে।

আবার সেই হোটেলে গিয়ে দুইটা রুম ভাড়া করলো রাত টা থাকার জন্য। বাইরে থেকে খাবার এনে খেলাম, আমি কাবেরি আপু আর আমার মেয়ে তৌহিদা। পরে আমি আর তৌহিদা একটা রুমে থাকার জন্য গেলাম, পরেরটা কাবেরি আপু একা একা থাকার জন্য। তবে অনেক রাত পর্যন্ত আমার মেয়েটা বিভিন্ন রকম কথা দিয়ে আমাদের কে মাতিয়ে রাখল। তার প্রতিটা প্রশ্ন ছিল যথেষ্ট ভাবনার বিষয়। এক সময় সে ঘুমিয়ে গেলো। কিন্তু আমার চোখে তখনও ঘুম ছিল না।

অনেকের দিন গুলি আমার মাথাতে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মালিহার ডায়েরিটা নিলাম। প্রথম পেজটা খুলে পড়তে শুরু করলাম। মালিহা সুন্দর করে তার সাথে পরিচয়ের দিন থেকে শুরু করে কবে কোথায় গিয়েছিলাম, আমার সাথে সে কি কি করেছে, সব কিছু লিখেছে। মনোযোগ যেন সরতে ছিলনা, এক নাগাড়ে পড়েই যাচ্ছিলাম তার আর আমার অতীতের কাটানো দিন গুলো। শেষের দিকটাতে যে আমি টাকে অবেহেলা করেছি সেইটা সে হুবহু তুলে ধরেছে।

তার কষ্টের অন্তিত মুহূর্তের কথা গুলো এতো আবেগ মিশ্রিত ভাবে লিখেছে যে আমার চোখের জল টাতে হার মানতে বাধ্য। আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর তার কষ্টের মাত্রা টা আমাকে ভীষণ অপরাধি করে তুলছে। আমার সাথে কাটানো শেষ দিনটার কথা লিখতে সে ভুলে নি। মালিহা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে আমাকে না পেলেও আমার সাথে সে একবারের জন্য হলেও মিলিত হবে আর আমার সন্তান কে সে ধারণ করবে। এতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সে বারবার ভেবেছে কিন্তু আমি যে তার মনপ্রান জুড়ে ছিলাম সেটা সে ভুল্বে কি করে? কোন রকম দন্দ ছাড়ায় সে আমার সাথে মিলিত হবার নিমিতেই গেছিলো শেশবারের মত আমার মুখোমুখি। আমার অসম্মতি সত্তেও সেদিন সে আমার ভালবাসা আদায় করে নিয়ে ছিল। সেদিনের পর থেকে আর আমার মুখোমুখি হয়নি। তবে সেই সময়ে তার উর্বরতা তার মাঝে আমার তৌহিদা কে ধিরে ধিরে বড় করে তলে। যখন সে তৌহিদার অস্তিত্ব টের পাই তখন সে ভীষণ খুশি হয়। তার শেষ স্বপ্ন টা অবশেষে পূরণ হলো।

অবশ্য এই জন্য টাকে অত্যাধিক অপমান সহ্য করতে হয়েছিলো। আমি নিজে তাঁকে প্রচণ্ড রকম খারাপ কথা বলেছিলাম। তার বাবা মা প্রথমে তাঁকে অনেক বকাঝকা করেছিলো সেইসাথে মার খেতেই হয়েছিলো। কিন্তু মালিহা এক সময় তার বাবা মাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলো আমার প্রতি দুর্বলতার পরিমাণ। এবং মালিহার অনুরধে উনি আর আমার সাথে দেখা করেন নি।

কিন্তু উনি মালিহার জন্য একটা সুন্দর ছেলে ঠিক করেন। ছেলেটি সব কিছু জানার পরেও বিয়ে করতে রাজি ছিল। মালিহা আমাকে ছাড়া আর কাউকেই কখনো ভাবতে পারেনি বলে আত্মাহুতি দিয়েছে।

এই পর্যন্ত পড়ার পর আমি একটু শব্দ করে কেদে ফেলি। নিজেকে খুব অপরাধি অপরাধি লাগে। আমার এমন কান্নার আওয়াজ টা কাবেরি আপা হয়তো শুনে ফেলেছিল। উনি আমার ঘরে আসলেন, কি ব্যাপার কি হয়েছে রে আলি। কোন সমস্যা?

-কয় নাতো কোন সমস্যা নেই।

-তবে কাদছিস কেন?

-এমনি।

-ও বুঝেছি মালিহার কথা মনে পড়েছে?

-হ্যাঁ তাঁকে খুব মনে পড়েছে। মনে মনে কত আশা নিয়ে আসলাম। কিন্তু আমি এসে কি দেখলাম। জীবনে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।

-শোন অতকিছু ভাব্বার কোন কারণ নেই। তুই যখন ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিস, তোর ভালোর জন্যই হয়তো দিয়েছিলি। তোর স্থানে যে কেউ থাকলে একাজ করতো। এই কথা গুলো বলে উনি আমাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলেন। আর বিভিন্ন রকম কথা বলতে লাগলেন আর আমার মাথার চুল গুলো নাড়তে লাগলেন। আমার খুব ভালো লগতেছিল।

এবার উনি আচমকা উঠে পড়লেন। বললেন তুই ঘুমিয়ে পড় আর কোন চিন্তা করিস না।

উনি উনার রুমে চলে গেলেন। আমি ঘুমাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। তৌহিদার মুখের দিকে তাকালাম। কি সুন্দর হয়েছে আমার মেয়েটা। ঠিক একেবারে ওর মায়ের মতই সুন্দর হয়েছে। নিষ্পাপ চেহারা। ঘুমানোর ধরণ টা খানিকটা আমার মত। অর্ধ চক্ষু খোলা আছে। আমি ঘুমালে সবাই বলে আমি নাকি তাকিয়ে থাকি এমনার কি।

হোটেলের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। যেন মনে হচ্ছে পূর্ণিমা রাত। আসলেই তো আজ পূর্ণিমা রাতই তো। আকাশের চাঁদটা তখন সামান্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। আশেপাশে কোন শব্দ নেই। আসলে আমাদের হোটেলটা একটু মাঠের ভিতরে। কতক্ষন দাঁড়িয়েছিলাম জানিনা। হটাত মালিহার হাত আমাকে কাধে স্পর্শ করলো। আমি অবাক ভাবে কিছুক্ষণ চেয়েছিলাম। আমার আনা নীল রঙের শাড়িটা ম্যাচিং ব্লাউজ দিয়ে পড়েছে। সাক্ষাত পূর্ণিমা রাতের পরী মনে হচ্ছে।

-কি দেখো এমন ভাবে?

-দেখছি তুমি কতসুন্দর।

-সত্যিই আমি কি সুন্দর? তাহলে এতদিন একবারও কেন আমাকে কাছে ডাকো নি?

-তুমি আমাকে আবার পুরনো কথা বলে লজ্জা দিচ্ছ। প্লিজ আমাকে আর ওই কথা বলনা।

-ঠিক আছে এখন রুমে চল। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস। আমি দৃষ্টি ভ্রমের মত হেঁটে গেলাম কাবেরি আপার রুমে। তখনও বুঝিনি আমি যে এ মালিহা নই। আসলে মস্তিস্কে সারাক্ষণ মালিহা কে নিয়ে চিন্তা করেছি। তার জন্য কিনে আনা শাড়িটা যখন কাবেরি আপা গায়ে জড়িয়েছে তখন আমার মস্তিস্ক আমাকে এই জন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিতে কাবেরি কে আমার সামনে মালিহার মত করে উপস্থিত করেছে।

আমার এই ভুল টাকে আমি শুদ্রিয়ে নিতে অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম। কাবেরি আপার অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষিত কামচাহিদার মুলে যে আমি ছিলাম টা বুঝতে পারিনি। আমার যখন ঘুম ভাংগে তখন আমি নিজেকে আবিস্কার করি কাবেরির বাহ বলয়ে। উনার শরীরে কোন কাপড় ছিলনা। পড়ে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার শরীরেও কোন বস্ত্র নাই। ওর স্তন জোড়াতে আমার মাথার আংশিক পরিমাণ রাখা। কাবেরি খুব ত্রিপ্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছে।

আমি তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম কাবেরি উথার আগেই। ফ্রেশ হয়ে আমার মেয়ের রুমে গেলাম। তখনও তৌহিদা ঘুমাচ্ছে। আমি নাস্তা আনার জন্য বাইর হয়েছি। অমনি আমার সামনে দাঁড়ালো কাবেরি আপা।

-কেমন মজা লাগলো? আসলে তুমি একজন সুপুরুষ। আমার বান্ধবি নাজমিন যখন বলেছিল আমি বিশ্বাস করেছিলাম না। গতরাতের পর বুঝলাম তোমার পুরুষত্ব অনেক বেশি।

-বাজে কথা বাদ দেন। আমি এই বিষয়ে আপনার সাথে এখন কোন কথা বলতে পারছি না। আমার মেজাজ খুব খারাপ।

-কেন মেজাজ খারাপ কেন? তুমি কি মজা পাওনি?

-আপনার মাথায় কি শুধু এই গুলা ছাড়া আর কিছু নাই? আমি নাস্তা আনতে যাচ্ছি, আপনি একটু রুমে থাকেন।

-এই আলি শোন আমিও যাবো তোর সাথে। আসলে তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলাম। অনেকক্ষণ কোন কথা হলনা আমাদের মাঝে। আমিই আগে শুরু করলাম।

-আপনি এইকাজ টা কি ঠিক করলেন? আমি আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করলাম। আজ থেকে আমি আপনাকে আর আপনার বান্ধবিকে খুব ঘৃণা করবো। আপনারা যুক্তি করে এমন করেছেন।

-আমাকে থামিয়ে দিয়ে কাবেরি বলল, আমি কি একাই দোষ করেছি। তুই কোন দোষ করিস নি? তুইই তো আগে আমাকে জড়িয়ে নিলি বুকের মধ্যে। আমার আগুনের মত তপ্ত বুক আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠলো তারপরে আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। এতে আমার কি দোষ?

-ঠিক আছে আর কিছু বলা লাগবে না।

-তুই চিন্তা করিস না আমার পিল খাওয়া আছে। কোন বাচ্চা তোকে উপহার দিবনা। এইটা নিশ্চিত থাক।

-আপনি কিন্ত্রু মালিহা কে নিয়ে ঠাট্টা করতেছেন। এটা ঠিক না। আমি তাঁকে খুব ভালো বাসতাম। আজীবন বাসবো।

রুমে ফিরে গিয়ে তৌহিদাকে উঠিয়ে ব্রাশ করিয়ে নাস্তা খাওয়ালাম। তখন আমি আমার মেয়ের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছি এমন সময় কাবেরি বলল, শোন আমার না যাওয়া হবে না, এখানে একটা অপারেশনের জন্য আমাকে থাকতে হবে তুই আর তোর মেয়ে ঢাকাতে ফিরে যা। হ্যাঁ ভালো কথা তোর আপু ফোন দিয়েছিলো তোকে বাসায় যেতে বলেছিল।

আমি মনে মনে খুবই খুশি হলাম। যথাসময়ে আমি আর তৌহিদা ট্রেনে উঠে চলে এলাম। মাঝপথে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসলো। এদিকে তৌহিদা আমার কোলের উপর ঘুমিয়ে পড়লো। নাম্বার টি থেকে বারবার ফোন আসতে থাকলো। আমি বারবার ফোন কেটে দিলাম। কিছুক্ষণ পর আবারো ফোন আসলো, আমি এবার রিসিভ করলাম।

-হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।

-ওয়ালাইকুম আসসালাম।

-কে বলছেন? কাকে চাচ্ছেন?

-আলি ভাইয়া কেমন আছেন? আমি স্বর্ণা বলছিলাম। আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?

-একটু মনে করিয়ে দিলে ভালো হতো।

-ওই যে তিন চার দিন আগে মালিহা আপু কে খুজতে আমাদের বাসায় এসেছিলেন...

-আমি স্বর্ণা কে থামিয়ে দিয়ে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। টা কেমন আছো তুমি?

-আমার কথা বাদ দেন তো। আপনার খবর কি? মালিহা আপু কে কি খুঁজে পেয়েছেন?

আমি সব ঘটনা খুলে বললাম, তৌহিদার কথা বললাম।

এটা শুনে স্বর্ণা খুব উতসাহি হয়ে বলল, ভাইয়া আপনি কি ঢাকাতে আসবেন নাকি মেহেরপুর যাবেন।

-কেন বলতো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

-না মানে তৌহিদা কে খুব্ব দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি মনে মনে খুব আশা করেছিলাম হয়তো আপনি মালিহা আপু কে খুঁজে পাবেন। আমি আবার অনেক দিন পড়ে আপনাদের দুজন কে একসাথে দেখবো। ঢাকাতে তো আপনাকে আর মালিহা আপু কে অসংখ্য বার দেখেছি কিন্তু দুংখের বিষয় তখন আপনার মাঝে কোন প্রেম ছিল না। মালিহা আপু আপনাকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতো।

-আমি বললাম, চুপ করো স্বর্ণা। অতীতের কথা আমাকে খুব কাদায়। প্লিজ অইগুলা আর আমি মনে করতে চাইনা।

-আচ্ছা চুপ করলাম, এখন্ন এক কাজ করেন আপনি সোজা ঢাকাতে আসেন।

-আরে বাবা আমিতো ঢাকাতে আসতেছি। এই বলে কেটে দিলাম।

ঢাকাতে তৌহিদা কে আমি একটা বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম। ওর জন্মদিন টা সামনে ৩ই মে। ২মে স্বর্ণা কে ফোন দিলাম, কি ব্যপার আমার মেয়ে দেখতে তো আর এলেনা। শোন আগামী কাল ৩ মে তৌহিদার ষষ্ঠ জন্মদিন তুমি সকাল সকাল চলে আসবে, তৌহিদা তোমাকে দেখতে চেয়েছে।

পরদিন সকাল সকাল সবাই আসলেও স্বর্ণা আসলো বিকেল বেলা, যখন সবাই চলে গিয়েছে তখন আসলো স্বর্ণা। তৌহিদার জন্য একটা পাণ্ডা এনেছিল এবং অনেক ধরনের চকলেট এনেছিল। তৌহিদার বুড়িগঙ্গা নদী দেখার খুব শখ ছিল। স্বর্ণাও বারবার বলছিল আলি ভাই চলেন বুরিগঙ্গার তিরে যাই, আপনার মন খারাপ না? একেবারে মন ভালো হয়ে যাবে।

তিন জনায় একসাথে চলে আসলাম বুরিগঙ্গার তীরে দুজনে হাতছিলাম পাশাপাশি। মাঝখানে আমার সবচেয়ে ভালবাসার মানুষটির স্মিতি চিহ্ন তৌহিদা। ওর দুটি হাত আমার আর স্বর্ণার মাঝে একটা বন্ধন সৃষ্টি করেছে।

একবার সামান্য সময়ের জন্য তৌহিদা আমাদের দুজনের হাত ছেড়ে সামনে সামনে দৌড়াতে লাগলো। বুঝলাম তৌহিদার জায়গাটা খুব পছন্দ হয়েছে। মালিহার নিজেরও এই বুরিগঙ্গার তীর সবচেয়ে প্রিয় ছিল। আমাকে নিয়ে যে কতবার এসেছে তার ইয়াত্তা নাই।

হটাত করেই স্বর্ণা আমার হাতটা ধরে ফেলল, আমি প্রথমে মৃদু ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু স্বর্ণা অনেকটা শক্ত করে ধ্রে বসলো। আমার নিজের মাঝেও একটা ভাললাগা কাজ করছে। দুজনা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এসে গেছি। কিন্তু হাত যেন ছাড়তে ইচ্ছা করছে না, মনে হচ্ছে এভাবে অনন্তকাল শুধু হাটি আর হাটি।

বিষয়: সাহিত্য

৭৪৬২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

203158
০৬ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১০:১০
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম, জাজাকাল্লাহুল খাইরান, অনেক সুন্দর পোস্ট। লেখাটি অনেক বড় পর্ব আকারে দিলে ভাল হত।
203326
০৬ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৪
হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে লিখেছেন : বড় পোষ্ট তারপরো জাজাকাল্লা খাইরান.. অনেক ভালো লাগলো পড়ে

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File