অসাধারণ ভালোবাসার এক মর্মস্পর্শী সত্য গল্প!
লিখেছেন লিখেছেন হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে ২৫ এপ্রিল, ২০১৪, ০৭:৩৬:২১ সন্ধ্যা
নিকোলাস জেমস ভয়েইচিচের জন্ম ১৯৮২ সালের ৪ ডিসেম্বর। নতুন সন্তানের আগমনে সব বাবা-মা’ই আনন্দে উদ্বেলিত হন। কিন্তু এক্ষেত্রে নেমে এলো ভয়াবহ শোকের ছায়া। কারণ কি? শিশুটির যে হাত-পা কিছুই নেই। শুধু দেহটি আছে। বিমর্ষ বাবা-মা বরিস ও ডিউসকা চিন্তিত হয়ে গেলেন কীভাবে tetra-amelia syndrome নামে বিরল রোগে আক্রান্ত এ ছেলেটিকে মানুষ করবেন। কিন্তু শত হোক সন্তান তো। বাবা-মায়ের ভালোবাসায় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে জন্ম নেয়া নিক (নিকোলাসের সংক্ষিপ্ত রূপ) বেড়ে উঠতে থাকেন।
কিন্তু যা হয়, সমাজ তাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে চাইলো না। শুধু তাই নয় ভিক্টোরিয়া রাজ্যের তখনকার একটি আইনের কারণে নিকের বাবা-মা তাকে মূল ধারার কোনো স্কুলে ভর্তি করাতে পারছিলেন না, যদিও তারা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। পরে আইনে পরিবর্তন হলে নিককে স্কুলে ভর্তি করানো হয় কিন্তু সেখানে তিনি অন্য সুস্থ ও স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের দ্বারা প্রায়ই উত্ত্যক্ত হতেন। এতসব প্রতিকূলতা ছোট্ট শিশু নিকের মনে খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তিনি ৮ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ও ব্যর্থ হন। ১০ বছর বয়সে তিনি আবারো নিজেকে বাথটাবের ভেতর চুবিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাবা-মা ও ভাই-বোনের অকৃত্রিম ভালোবাসার কাছে আশেপাশে মানুষের ঘৃণা ও জীবনের সব প্রতিকূলতা পরাজিত হয়। ছোট নিক মনে-প্রাণে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন যেন তিনি দৈববলে নিজের দেহে হাত-পা সৃষ্টি করে দেন। অভিমানভরে বলতেন, “তুমি যদি আমার অনুরোধ না শোনো, তবে আর কখনো আমি তোমার সাহায্য প্রার্থনা করবো না।“ নিকের ধারণা আমূল পরিবর্তন হলো, যখন তার মা তাকে একটি পত্রিকা এনে সেটার একটি খবর পড়তে দিলেন। এটা ছিল ভয়াবহভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা। তখন নিক বুঝতে বলেন, পৃথিবীতে শুধু তিনি একা নন, আরো অনেকেই তাদের নিজেদের জীবনে অনেক সমস্যা নিয়ে বেঁচে আছেন, এগিয়ে চলেছেন। এরপরেই তিনি নিজের জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করতে শুরু করেন। তার জীবন বদলে যেতে শুরু করে। কুইন্সল্যান্ডের Runcorn State High School এ তিনি ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হন ও সেই সময় থেকে নিজের বন্ধুদেরকে নিয়ে বিভিন্ন দাতব্য কাজ শুরু করেন। ২১ বছর বয়সে তিনি গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব কমার্স ডিগ্রি ও পরে ‘ডাবল মেজর ইন একাউন্টেসি এন্ড ফিনান্সিয়াল প্ল্যানিং’ এর উপর ডিগ্রি লাভ করেন। নিক তার বাম পায়ের মত অংশে থাকা ছোট দুই আঙ্গুল দিয়ে কলম দিয়ে লেখালেখি করেন। এছাড়া তিনি heels and toes পদ্ধতিতে কম্পিউটার ব্যবহার করেন, মিনিটে টাইপ করেন ৪৫ টি শব্দ। তিনি নিজেই পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেতে পারেন, টেনিস বল ছুঁড়ে মারতে পারেন, নিজেই নিজের চুল আঁচড়ান ও দাঁত ব্রাশ করেন, শেভ করেন। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, নিক গলফ খেলেন, সাঁতার কাটেন, এমনকি স্কাই-ডাইভিং করার মত রেকর্ডও আছে তার! এভাবেই নিক কিশোর থেকে তরুণে পরিণত হন। কিন্তু তিনি কখনো ভাবেন নি তার জীবনে কোন ‘রাজকন্যা’(তার মতে) আসবে। যত যোগ্যতাই থাকুক, হাত-পা নেই-এরকম একজন মানুষকে কোন মেয়ে সজ্ঞানে ভালবাসবে, জীবনসঙ্গী হবে? কিন্তু নিকের সাথে একদিন কেনি মিয়াহারা নামে এক তরুণীর দেখা হলো। এবং অত্যন্ত অদ্ভুতভাবে প্রথম দেখাতেই দুজনেরই একজনের আরেকজনের ভালো লেগে গেল। বাকিটুকু কেনির মুখ থেকেই শোনা যাক, “আমি নিককে ভালোবাসি, সে যেরকমই হোক না কেন। ২০০৮ সালে আমাদের দেখা হয়। আমি মনে করি সে-ই আমার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। যখন সে আমার পাশে থাকে আমি অনুভব করি, তাকে বিয়ে করে আমি ভুল করি নি। তার ব্যক্তিত্ব আর রসবোধ আমাকে সব সময় মুগ্ধ করে রাখে।
বিয়ের দিনের বেশ আবেগঘন ঘটনা এখনো কেনির মনে আছে। বিয়েতে বর কনেকে হাতে রিং পরিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু নিকের তো হাত নেই,সবাই বললো, “নিক কিভাবে রিং পরিয়ে দিবে? “ নিক কেনিকে বললেন, “আমি কি তোমার হাতে চুমু খেতে পারি? “ কেনি তার হাত এগিয়ে দেন ও কিছুক্ষণ পর অনুভব করেন নিক তার হাতের আঙ্গুল নিজের মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এরপর নিক মুখ খুলে ফেললে কেনি দেখেন তার আঙ্গুলে মুখ দিয়ে রিং পরিয়ে দিয়েছেন নিক! আবেগে ঝর ঝর করে কেঁদে দেন কেনি। নিক ছল ছল চোখে বলেন, “ কেনি তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? কাটাতে পারবে সারা জীবন আমার সাথে?” কেনি তখনো অঝোরে কেঁদেই চলেছিলেন! নিক ও কেনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বাস করছেন। নিক ৫ টি মহাদেশ ঘুরেছেন, ৪৪ টি দেশে ৩ মিলিয়ন মানুষের সামনে নিজের জীবনের এগিয়ে চলার সত্য গল্প বলে বহু মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। বের করেছেন একাধিক বই, ডিভিডি। অভিনয় করেছেন The Butterfly Circus নামে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রেও, যেটা পেয়েছে অনেকগুলো পুরস্কার। অনেকে হয়তো বলতে পারেন, একটি দীর্ঘস্থায়ী ভালোবাসাময় সম্পর্কের জন্য শারীরিক ভালোবাসা প্রধান ভূমিকা পালন করে। সেখানে নিক ও কেনির ভালোবাসা কতদিন টিকে থাকবে? কেনি বলেন, “আমাদের এটা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। আমরা দু’জন দুজনকে ভালোবাসি। আমাদের নিজেদের মাঝে বোঝাপড়া চমৎকার।“ আর সবচেয়ে আনন্দের কথাটি হচ্ছে, ২০১৩ সালে কেনি ও নিক দম্পতির ঘর আলো করে পৃথিবীতে আসে একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান! শেষ করা যাক নিকের একটি বক্তব্য প্রদান অনুষ্ঠানের ঘটনা দিয়ে। নিক যখন কথা বলছিলেন, উপস্থিত মেয়েরা কেঁদে দিয়েছিলেন, ছেলেরা চেষ্টা করছিলেন চোখের পানি ধরে রাখতে। হঠাৎ একটি মেয়ে উঠে দাঁড়ালো, বললো,” নিক, আমি কি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি। আপনার বক্তব্য বিঘ্ন ঘটানোর জন্য ক্ষমা চাইছি।“ নিক অনুমতি দিলে মেয়েটি স্টেজে এসে নিককে জড়িয়ে ধরেন, কানে কানে বলেন, “ধন্যবাদ নিক, অনেক অনেক ধন্যবাদ। এর আগে কেউই আমাকে বলে নি যে তারা আমাকে ভালোবাসে। কেউ আমাকে বোঝায় নি যে আমি দেখতে যেমন সেভাবেই আমি সুন্দর।“ নিকের খুব ছোট একটা কথা সবার জন্য, “Dream big my friend and never give up. We all make mistakes, but none of us are mistakes.“
ফেবু
বিষয়: বিবিধ
১৭৬৪ বার পঠিত, ২৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন