এপ্রিল ফুল দিবস : ভিত্তিহীন উদ্ভাবন ও মুসলিমদের বোকামি।
লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নচারী কিশোর ০২ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:৫১:৫৭ সকাল
সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহ তাআলার যিনি ঘোষণা করেছেন সত্য সমাগত আর মিথ্যা দূরীভূত । দরূদ ও সালাম সেই সংবাদবাহকের প্রুতি যিনি দিশেহারা জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম উম্মাহকে এমন অবস্থায় ফেলে যাননি যে তাঁর অনুপস্থিতিতে মুসলিমরা গুঁজবে পরে বোকামি করে যাবে। বরং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মুসলিমরা সর্বদিক থেকে কাফেরদের উপর অগ্রগামী। কিন্তু বর্তমানে বহুল প্রচলিত এপ্রিল ফুল এর ঘটনা এলে তাদেরকে সবচেয়ে বোকা আর অসহায় মনে হয় যা কাফেরদের হাসির খোরাক ছাড়া কিছুই নয়।
কথিত আছে, ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল অ্যারাগোন রাজ্যের রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং ক্যাস্টিলের রানী ইসাবেলা স্পেন দখল করার পর ৭ লক্ষেরও বেশী মুসলিমদের কেউ বলে মসজিদে কেউ বলে জাহাজে আশ্রয় নিলে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল এবং এই প্রতারণা ও বিজয় কে উদযাপন করার জন্য এপ্রিল ফুল দিবস পালন করা হয় । এই ঘটনাটি ন্যূনতম ঈমানের একজন মুসলিমের জন্য এতটা মর্মস্পর্শী যে সে শোনামাত্রই তা পোষ্টারিং , মেইলিং, ফেস বুক বা যে কোন ভাবেই হোক না কেন অপর জন কে না পালন করার জন্য সতর্ক করে। তাঁর এই আবেগ সত্য ও অন্যকে প্রতারণা না করার পরামর্শটাও সুন্দর। কেননা ইসলামে মিথ্যা বলে ধোঁকাবাজি নিষিদ্ধ। কিন্তু ইতিহাস না জেনে একটা প্রচলিত মিথ্যা কাহিনী দিয়ে এই আবেগ প্রচারণার মাধ্যমে তারা নিজেরাই যেন বোকা না সাজে এইটাও খেয়াল রাখা উচিত। উড়ো সংবাদ নাকি বাতাসের আগেও ছড়িয়ে পড়ে, তাই তাঁদের কোনোকিছু প্রচারের আগে যাচাই করা দরকার। এই সম্পর্কে সূরা হুজরাতে ও সতর্ক করে বলা হয়েছে যে এতে পরবর্তীতে নিজেরাই লজ্জিত যেন না হয়। অবশ্য প্রেক্ষাপট আলাদা থাকলেও মুসলিমদের কুরানের আলোকে সব খবর যাচাই করে গ্রহণ ও প্রচার করা উচিত।
যাই হোক, এপ্রিল ফুল এর ইতিহাস কি, কেন তারা পালন করে, এর সাথে স্পেন ট্রাজেডি এর কোন সম্পর্ক আছে কিনা, প্রচলিত কাহিনী কতটুকু সত্য তা জেনে নেওয়া যাক
এপ্রিল ফুল এর ইতিহাস:
এপ্রিল ফুল দিবস মূলত প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য থেকে নববর্ষ উদযাপনের সাথে সম্পৃক্ত। তখন সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নামে প্রচলিত জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এপ্রিল মাসের এক তারিখ থেকে গণনা করা হত। নতুন বছরকে স্বাগতম ও পুরাতনকে বিদায় দেওয়ার জন্য মার্চের ২৫ তারিখ থেকে সপ্তাহব্যাপী ভোজ উৎসবের আয়োজন করা হত যা ১ এপ্রিল শেষ হত। কিন্তু ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরি কর্তৃক ১৫৮২ সালে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ঘোষণার কারনে নববর্ষ ১ এপ্রিলের স্থলে ১ জানুয়ারী থেকে শুরু হয়। তখন রাশিয়ান অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা সহ অনেকেই ধর্মীয় উদ্দেশে এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারেনি এবং জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারেই তাঁদের বড়দিন এবং ইস্তার উৎসব উদযাপন করতে থাকে।
আমেরিকার তামাক শিল্প বিশেষজ্ঞ ও পত্রিকার কলামিস্ট জেরি উইলসন লিখেছেন,
"Others, the more obstinate crowd, refused to accept the new calendar and continued to celebrate the New Year on April 1. These backward folk were labeled as 'fools' by the general populace. They were subject to some ridicule, and were often sent on 'fools errands' or were made the butt of other practical jokes"
" নিজেদের মতের উপর দৃঢ় একদল মানুষ তখন নব্য দিনপঞ্জি প্রত্যাখ্যান করে এবং ১ এপ্রিলেই নববর্ষ উদযাপন চালু রাখে। এই সব অনগ্রসর অথবা অনিচ্ছুক লোকজনকে সাধারণ মানুষ বোকা নামে ডাকা শুরু করল । তারা তখন উপহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়াল এবং তাদেরকে বোকাদের বার্তাবাহক হিসেবে পাঠানো হত অথবা হাস্যরসের পাত্র বানানো হত।"
পরবর্তীতে এটা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ইরান, পোল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, ফ্রান্স সহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন, ইরানে নওরোজ উপলক্ষে ৫৩৬ খ্রিস্টপূর্ব থেকেই ঐতিহ্য হিসেবে তারা ১৩ তম দিন হিসেবে ১ এপ্রিল কে 'সিযদাহ বেদার' নামে এই রকম হাসি ঠাট্টা করে থাকে। ফ্রান্সে এইটা এপ্রিল ফিশ নামে পরিচিত।
স্পেনে মুসলিমদের গৌরবময় ইতিহাস ও পতন :
ইসলামের সুমহান সৌন্দর্য্য বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল রাসুল (সঃ) এর সময় থেকেই। কালের পরিক্রমায় সে আলো আছড়ে পড়ে ইউরোপের মাটিতেও। উমাইয়া সালতানাতের বীর সেনাপতি তারেক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে স্পেনের মাটিতে ইসলামের পতাকা উড়তে শুরু করে অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে। ১৪৯২ সালের আগ পর্যন্ত প্রায় আটশত বছর ধরে স্পেনে মুসলমানদের স্বর্ণযুগ ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, চিকিৎসা, রাজনীতি, স্থাপত্য, শিল্প ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সে সময়কালে স্পেনই ছিল একমাত্র স্পেনের উদাহরণ। মুসলমানদের এমন উন্নতি খৃষ্টানরা মোটেও পছন্দ করলো না। মুসলমানদের অভ্যন্তরে বিভেদ সৃষ্টি করে সাজানো বাগানকে তছনছ করার জন্য খৃষ্টানরা উঠে পড়ে লাগলো। মুসলিম রাজ্য বিভক্ত হতে লাগলো এবং শাসকরা খ্রিষ্টানদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ নিয়োগ শুরু করল। তারা পরস্পরে যুদ্ধ বিগ্রহে জড়িয়ে পড়ে নিজেদেরই হত্যা করতে লাগলো।
যখন খ্রিষ্টানরা তাদের প্রথম আক্রমণ করেছিল তারা মরক্কের সুলতানের কাছে সাহায্যের আবেদন করলে তিনি তাদেরকে পরস্পরে যুদ্ধ থেকে বিরত হয়ে এক শাসকের অধিনে ইসলামি হুকুমাতের দিকে ফিরে যাবার আহ্বান জানান। কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত না করে নিজেদের স্বার্থ বজায় রেখে পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে । এই সুযোগে রোমান খ্রিষ্টানরা নিজেদের শক্তিশালী করে আক্রমণ করা শুরু করলে মরক্কের সুলতান তাদের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করলেন। এতে একের পর এক মুসলিম রাজ্য খ্রিষ্টানদের হাতে চলে যেতে থাকে। সবশেষে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ২ রা জানুয়ারি ইসলামের দুর্গ খ্যাত গ্রানাডার তৎকালীন মুসলিম শাসক আবু আব্দুল্লাহ (পাশ্চাত্যে তাকে ববডিল নামে ডাকা হয়) রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং রানি ইসাবেলার সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে পরাজয় স্বীকার করে মুসলিমদের ভাগ্যে দুর্দিন বয়ে নিয়ে আসে ।
গ্রানাডার যুদ্ধ
Click this link
এখানে ১৪৯২ সালের ২ রা জানুয়ারি তারিখটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে ১ এপ্রিলের বোকা বানানোর ঘটনা কোথা হতে আসল? তবে এটা সত্য যে, এই চুক্তির পর মুসলিমরা সেখানে বসবাস করার অধিকার পেলেও তাদের উপর নির্যাতন এর পাহাড় নেমে আসে। এই সময়ের কয়েক দশক পরে আলজেরিয়ায় জন্ম নেয়া বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে মোহাম্মদ আল মাকারি (১৫৭৮-১৬৩২) স্পেনে মুসলমানদের আগমন, শাসন এবং পতন নিয়ে রচনা করেন The history of the Mohammedan Dynasties in Spain (extracted from the Nafhu-t-Tib Min Ghosni-l-Andalusi-r-Rattib. Volume 2) (মূল আরবি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ) ‘দ্য হিস্ট্রি অব দ্য মোহাম্মাদান ডাইনেস্টি ইন স্পেন’ Click this link। এ গ্রন্থে তিনি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ধারাবাহিক বর্ণনায় স্পেনে মুসলমানদের পরাজয়ের বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু কোথাও তিনি এপ্রিল ফুল জাতীয় কোনো ঘটনার কথা উল্লেখ করেননি। এছাড়াও বিশিষ্ট মুসলিম ইতিহাসবিদ এস. এম. ইমামুদ্দিন রচিত A political history of Muslim Spain গ্রন্থেও আলোচিত এপ্রিল ফুল জাতীয় কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই।
তাহলে এপ্রিল ফুল এর ঘটনা মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়ল কেন? এটা হতে পারে মুসলিমদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ইহুদিদের কোন চক্রান্ত। কেননা ক্ষমতায় আরোহণের পর ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলা ৩১ মার্চ তাদের দেশান্তর অথবা হত্যা করার আদেশ জারি করে। Click this link
এটা তাদের যন্ত্রণা যে ১ এপ্রিল তাদের কাছে বেদনাবহ যা কূটকৌশলে মুসলিম সমাজে ছড়াতে পারে। কিন্তু মুসলিমরা তো আবেগ কে মিথ্যা দিয়ে জাগাতে পারে না। স্পেনের পরাজয় মুসলিমের করুন ইতিহাস তাই বলে ইহুদিদের মত মিথ্যাচার দিয়ে তা হাস্যকর করে তোলাও কাফেরদের একটা উদ্দেশ্য হতে পারে। স্পেন পরাজয়ের পর তাদের উপর যে নির্যাতনের খড়গহস্ত নেমে এসেছিল তা মসজিদে পুড়িয়ে মারার চেয়ে কম মর্মান্তিক না। বিস্তারিত জানতে রেফারেন্সে দেওয়া ইতিহাসের বই ও আর্টিকেলগুলো পড়তে পারেন।
১। Click this link
২।Click this link
৩। Click this link
৪। Click this link
৫। Click this link
৬।Click this link
৭। Click this link
(সংক্ষেপিত)
বিষয়: বিবিধ
১৯১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন