নামাজে মন ফেরানো - ৩
লিখেছেন লিখেছেন শারিন সফি অদ্রিতা ১৪ নভেম্বর, ২০১৯, ০৫:৫৯:৪৩ সকাল
আমার ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারের ঘটনা। মসজিদ সোসাইটির একজন বয়স্ক আন্টি অনুরোধ করলেন, আমি যেন মসজিদে বাচ্চাদের কুরআনের একটা ক্লাস নেই। সওয়াবের লোভেই হোক, বা আন্টি আমার খুব প্রিয় বলেই হোক - আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। কুরআনের প্রথম সূরা হিসেবে ফাতিহা দিয়েই ক্লাস শুরু হবে।
স্টুডেন্টদের জন্যে লেসান প্লানিং করার সময় আমার টনক নড়লো, আমি তো আসলে "সূরা ফাতিহা" সম্পর্কে অত ভালোভাবে জানি না! আবছা ভাবে এর বাংলা ট্রান্সলেশান হয়তো দুই একবার পড়েছি, এর বেশি না। সূরা ফাতিহা কমপক্ষে দৈনিক ১৭ বার করে পড়ি, অথচ এটার অর্থ ভালোভাবে জানিনা। নিজের কাছে ভীষণ লজ্জা লাগলো! আমি অন্যদের কি ক্লাস নিবো? আমার নিজের আগে শিখতে হবে! সূরা ফাতিহার উপর একটা কোর্স শুরু করলাম। সেই কোর্সের মাধ্যমে সূরা ফাতিহাকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম।
১. আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আ'লামিন:
আল্লাহ এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদের সাথে আল্লাহর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। তিনি আমাদের রব, প্রভু, মনিব। আরবি "রব" শব্দটার মানে এমন কেউ যে টুয়েন্টি-ফোর-সেভেন আমাদের দেখ-ভাল করে যাচ্ছেন। সারাটাক্ষণ আমাদের খেয়াল রাখছেন। আমাদের প্রত্যেকটা হার্ট-বিট সুপারভাইজ করে যাচ্ছেন। আমাদেরকে খাওয়াচ্ছেন, পড়াচ্ছেন। নানারকমের রোগ-বালাই থেকে আমাদেরকে সুস্থ রাখছেন। আমাদের অনুরোধ শুনছেন। আমাদেরকে সবার চেয়ে বেশি ভালোবেসে যাচ্ছেন - এই সবই "রব" শব্দটার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ আমাদের প্রভু মানে আমরা তাঁর গোলাম। আমরা আল্লাহর সম্পত্তি। আমাদের হাত-পা-মুখ সবকিছুই আল্লাহর। খুব সীমিত সময়ের জন্যে আল্লাহ আমাদেরকে আমানত হিসেবে কিছু জিনিসের কন্ট্রোল দিয়েছেন। কিয়ামতের দিন আমাদের হাত -পায়ের উপর আমাদের কোনো কন্ট্রোল থাকবে না, আমাদের নিজেদের হাতগুলি আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে। নিজেদের শরীরের উপরেই যেখানে আমাদের চূড়ান্তভাবে কোনো কন্ট্রোল নেই, সেখানে আমরা খুশি খুশি এই আয়াতের মাধ্যমে নিজেদের দাসত্ব আল্লাহর কাছে স্বীকার করি।
নিজেকে গোলাম ভাবতে অনেকের কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। কারণ মানুষ স্বভাবতই স্বাধীন থাকতে পছন্দ করে। তাছাড়া, প্রভু এবং গোলামের সম্পর্কে যেটা সাধারণত দেখা যায় যে, এক পর্যায়ে গিয়ে প্রভু তার দাসের উপর ক্ষমতার জোর খাটানো শুরু করে এবং সেটা অত্যাচারের পর্যায়ে নিয়ে যায়। কিন্তু, আল্লাহ এখানে বলছেন যে, তিনি অন্যরকমের প্রভু। তিনি এমন প্রভু যে তাঁর গোলামের সাথে কখনো অন্যায় করে না। তিনি তার বান্দাকে ধরে-বেঁধে রাখেন না, বরং বান্দাদেরকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্বাধীন ইচ্ছা (free will) দিয়ে থাকেন। এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে কিভাবে চ্যানেল করে হিদায়াতের পথে থাকতে হবে সেটার কমপ্লিট ইন্সট্রাকশনও দিয়ে দিয়েছেন। আমরা দাসেরা তাই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করতে থাকি।
তিনি এমন একজন রব, যার জন্যে "হামদ" নির্ধারিত! আরবি "হামদ" শব্দটা প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা দুইটাই ইঙ্গিত করে। কারণ, কেউ যখন মন থেকে প্রশংসা করে কাউকে ধন্যবাদ দেয়, তার কৃতজ্ঞতা হয় নির্ভেজাল। আমরা সূরা ফাতিহাতে নির্ভেজাল ভাবে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। এখানে আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এই আয়াতের বিশ্লেষণে বুঝা যায়, সর্বক্ষণ কেউ না কেউ আল্লাহর প্রশংসা করে যাচ্ছে। গাছ-গাছালি, পাখি, ফেরেশতা ইত্যাদি - তারা সবাই আল্লাহর গুণগান করতে ব্যস্ত! এটার তাৎপর্য হচ্ছে, আমাদের প্রশংসার আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। দুনিয়ার সব মানুষ মিলে আল্লাহর প্রশংসা ছেড়ে দিলেও আল্লাহর রাজ্য থেকে একটা কিছু কমে যাবে না। আবার দুনিয়ার সমস্ত মানুষ মিলে আল্লাহর প্রশংসা করতে ঝাঁপিয়ে পড়লেও সেটার ফলে আল্লাহর মহিমা এতটুকু বেড়ে যাবে না। আমরা "আলহামদুলিল্লাহ" বলি বা না বলি, আল্লাহ সবসময় প্রশংসিত! আমাদের "আলহামদুলিল্লাহ" না বললে আল্লাহর কোনো ক্ষতি নেই, আর বললে সেটাতে আল্লাহর কোনো লাভ নেই। বরং লাভটা হয় আমাদের। এই লাভটা যে কত বড় সেটা সবসময় হয়তো বুঝতে পারিনা। কিন্তু যখন একজন মাকে দেখি তার বুকের ধন সন্তানকে কবর দিয়ে ফেরত এসে বলছে "আলহামদুলিল্লাহ! আমার ছেলে এখন জান্নাতে খেলছে"; একজন ভাইকে দেখি চাকরি হারিয়ে বলছে, "আলহামদুলিল্লাহ! আরো অনেক কিছুই তো হারাতে পারতাম", একজন বোনকে দেখি বিছানায় প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায় বলছে, "আলহামদুলিল্লাহ! এই কষ্টের মাধ্যমে আল্লাহ আমার গুনাহ্গুলি মাফ করে দিচ্ছেন" - তখন গিয়ে আমি "আলহামদুলিল্লাহ"-র মর্ম বুঝি! আমরা যতবার নামাজে এই আয়াত পড়ছি, ততবার আমরা নতুন করে পজিটিভ হতে শিখছি। শত কষ্টের মধ্যে থেকেও "আলহামদুলিল্লাহ" বলতে পারার চেয়ে পাওয়ারফুল আর কিছু নেই. দিনের মধ্যে পাঁচবার করে নামাজে আমরা সেটারই প্র্যাক্টিস করছি।
"আ'লামিন" মানে ''সকল সৃষ্টি জগতের (পালনকর্তা)". মানে, আল্লাহ তা'য়ালা জাতি, ধর্ম, বর্ণ - নির্বিশেষে সবার জন্যে সমানভাবে available! সুবহানাল্লাহ, ভালো নেটওয়ার্ক না থাকলে চাকরি পাওয়া যায়না। ভালো রেকমেন্ডেশান লেটার না থাকলে এডমিশন পাওয়া যায়না! কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহ কোনো স্পেশাল গ্ৰুপ বা ক্যাটাগরির মানুষের জন্যে না. ধনী বা গরিব, কালো বা সাদা - আল্লাহ সবার জন্যে নিজের অনুগ্রহ বিলিয়ে দিচ্ছেন! তিনি যে "রাব্বুল আলামিন"!
এক লাইনে এই আয়াতের অনুবাদ হয় - "যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।" কিন্তু একটু সময় নিয়ে ব্যাখ্যাসহ বুঝে পড়লে, প্রতিটা শব্দ অন্তরের ভিতরে গিয়ে নাড়া দেয়!
"আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন" আমাদেরকে প্রতিবার রিমাইন্ডার দিচ্ছে যে, আমার এমন একজন সীমাহীন প্রশংসার যোগ্য রব আছে যিনি সারাক্ষন আমার যত্ন নিতে ব্যস্ত, আমার যত ঝামেলা-কষ্ট - সবকিছু তিনি সমাধান করে দিতে পারেন এবং তিনি আমাদের কারো মধ্যে ভেদাভেদ করেন না.
(চলবে )
বিষয়: বিবিধ
৯৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন