হিজাব ৭: আপু আমি আর হিজাব পড়তে চাই না, আমার চুল মিস করি অনেক"
লিখেছেন লিখেছেন শারিন সফি অদ্রিতা ০৯ মার্চ, ২০১৮, ১২:৫৭:৪৭ দুপুর
“আপু আমি আর হিজাব পড়তে চাই না। আমি আমার চুল দেখানো অনেক মিস্ করি!” :(
কথাগুলো আমার ১২ বছরের স্টুডেন্ট মারইয়ামের! মারইয়াম আমার বেস্ট স্টুডেন্টদের মধ্যে একজন। কুরআন ক্লাসে সবার আগে হাত তুলে সব প্রশ্নের জবাব দিবে সে! এই তো সেদিন-ই হিজাব পড়ে আমাকে ছবি তুলে পাঠালো যে, সে কালকে থেকে হিজাব পরে স্কুলে যাবে, চোখে মুখে কি খুশি মেয়েটার! পরদিন স্কুলে গিয়েই ঘটলো কান্ড! সম্ভবত ওর ফ্রেন্ড্স এন্ড ক্লাসমেইটরা উল্টা-পাল্টা কিছু বলেছে। বাসায় এসে তার চিৎকার, সে আর কোনদিন হিজাব পড়বে না! চিন্তিত মারইয়ামের আম্মু আমাকে ফোন দিয়ে সব বললেন। আমি বললাম, আন্টি! আমেরিকান বাচ্চারা হিজাব দেখে মারইয়ামকে কিছু বলেছে দেখে ও এমন রিএক্ট করছে। প্রথম প্রথম স্কুলে হিজাব পড়লে এরকম হয়। আপনি মারইয়ামকে কোন বকা দিবেন না। আমি দেখছি কি করা যায়!”
আমি লেকচার শেষ করে ক্লাস থেকে বের হয়েই মারইয়াম কে মেসেজ দিলাম। সাথে সাথেই সে রিপ্লাই ব্যাক করলো,
“সিস্টার শারিন, আমি sad, আমাকে help করো!”
আহারে পিচ্চি টা! খুলে খুলে সে আমাকে সব বললো। প্রথমে বললো, কে নাকি ওকে বলেছে হিজাব পড়লে মারইয়ামকে দেখতে অনেক কুৎসিত লাগে। ক্লাসের কিছু ছেলে-পিলে এরকম হিজাব আর মুসলিমদের নিয়ে ওকে উল্টা-পাল্টা শুনিয়েছে। পরে বললো, কয়দিন আগেই নাকি সে চুলের বেনী করা শিখেছে, আর এখন এভাবে হিজাব করতে গেলে সে তার চুলগুলিকে অনেক মিস্ করে! শেষ পর্যন্ত বললো, “সিস্টার শারিন, আল্লাহ্ কেন আমার সাথে এমন করছেন?”
আমি মন দিয়ে সব শুনলাম। তারপর আমি আস্তে আস্তে বলা শুরু করলাম, “ওয়েল আপু প্রথমত, হিজাব পড়লে তোমাকে মোটেও কুৎসিত লাগে না। যে এটা বলেছে, সে শুধু তোমাকে রাগানোর জন্যে এটা বলেছে। তোমার চেহারা যা ছিল তাই আছে, জাস্ট তার চারপাশে একটা কাপড়ের লাইন, এজন্যে তোমার চেহারার সৌন্দর্য্যের কোন চেঞ্জ হয়নি। প্রথম প্রথম হিজাব শুরু করছো দেখে এমন weird লাগছে, করতে করতে দেখবে তোমার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে আর কোন প্রবলেম হবে না ইনশাআল্লাহ্। দ্বিতীয়ত, তোমার চুল মিস্ করাটা একেবারে নর্মাল! It’s okay to miss your hair! আমি নিজেও প্রায়-ই আমার চুল মিস্ করি। এটা কোন ব্যপার না মারইয়াম, তুমি এই ছোট বয়সেই দেশের বাইরে থেকেও নিজে থেকে হিজাব শুরু করেছো - তার মানে তুমি সাহসী মেয়ে যে আল্লাহকে ভালোবাসে!
বড় করে একটা নিঃশ্বাস নেও এন্ড নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখো, তুমি কার জন্যে এবং কিসের জন্যে হিজাব করাটা শুরু করেছিলে? তুমি যার জন্যে এটা শুরু করেছিলে, তার কাছে দুয়া করে চাও সে যেন তোমার জন্যে এটা সহজ করে দেন এবং এটা ধরে রাখার তাওফিক দেন। তুমি আল্লাহর জন্যে কিছু করতে গেলে, আল্লাহ তোমাকে পরখ করে দেখবেন তুমি তোমার কাজে কতটা আন্তরিক! এটাই তো আল্লাহর কাছে তোমাকে একটা ভালো মুসলিম হিসেবে প্রমাণ করার সময়, তোমার নেকীর পাল্লা আরো ভারী করে নেওয়ার চান্স! এখন মোটেও হতাশ হয়ে যাবার সময় না। তোমাকে অনেকে হয়তো অনেকরকম কথা বলবে যেটা তোমার শুনতে ভালো লাগবে না, তার জন্যে কি তুমি তোমার নেক কাজ করা ছেড়ে দিবে আপু? শুনো আপি, স্ট্রাগল ছাড়া আমরা লাইফে কেউ grow করতে পারতাম না, mature হতে পারতাম না। আল্লাহ্ তোমাকে এই স্ট্রাগলের মাধ্যমে আরো স্ট্রং বানাচ্ছেন, যেটা তোমার সামনে গিয়ে লাইফের প্রতিটা ক্ষেত্রে কাজে আসবে। আর আপু সবচেয়ে বড় কথা, তুমি যদি হিজাব ছেড়ে দাও, তাতে আল্লাহর কিন্তু কিচ্ছু হবে না! মনে আছে আমরা ক্লাসে কি পড়েছিলাম? আল্লাহ সুবহানুতা’আলা স্বয়ং-সম্পূর্ণ, দুনিয়ার সবাই মিলে আল্লাহর ইবাদাত ছেড়ে দিলেও আল্লাহ্র রাজত্য থেকে কিচ্ছু কমে যাবে না। বরং আমাদের নিজেদেরই ক্ষতি হবে। তুমি পদে পদে নিজের সৌন্দর্য্য নিয়ে হীনমণ্যতায় ভুগবে। একগাদা মেকআপ নিয়ে বের হয়েও মানুষকে খুশি করতে পারবেনা! মানুষকে খুশি করা কঠিন, আল্লাহ কে খুশি করা সহজ। যাতে তোমার ফ্রেন্ডসরা তোমাকে মেনে নেয়, সেজন্যে যাদের খুশির জন্যে তুমি হিজাব ছেড়ে দিতে চাচ্ছো, তারা তোমার জন্যে কি কি করেছে আপু? তোমাকে কি কি দিয়েছে ? তারা কি কিয়ামতের দিন তোমাকে সাহায্য করতে আসবে?এবার ভাবো এই লাইফে আল্লাহ তোমাকে কি কি দিয়েছেন? তুমি তো স্মার্ট মেয়ে, কার জন্যে কোনটা ছেড়ে দেয়াটা বেটার সেটা আমি তোমাকেই ডিসাইড করতে দিলাম। তুমি হিজাব ছেড়ে দিতে চাইলে আমরা কেউ তোমাকে জোর করে হিজাব পড়িয়ে রাখতে পারবো না। ফাইনাল ডিসিশান তোমার। তুমি যেটা তোমার নিজের জন্যে ভালো হবে বলে মনে করো, সেটাই করো আপু।”
শুধু বারো বছরের মারইয়াম না, বাইশ বছরের বড় বড় মেয়ে গুলি থেকে শুরু করে চল্লিশ বছরের আন্টিদের মধ্যেও প্রায় সেইম মেন্টালিটি। আমার স্টাডি করতে গিয়ে এরকম আরো কিছু আপুর সাথে আমার কথা হয়। সবার সেইম প্রবলেম। হিজাব পড়লে চারপাশের কে কি ভাববে, তাদেরকে দেখতে কেমন দেখাবে – এটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে মাথা খারাপ অবস্থা! সুবহানআল্লাহ্ মানুষ আমাদের নিয়ে কি ভাবলো সেটার উপর ডিপেন্ড করে আমরা আমাদের values, ধর্ম, নেককাজ – সবকিছু ছেড়ে দিতে প্রস্তুত! অথচ আল্লাহ্ আমাদের কাজ-কর্ম গুলি নিয়ে কি ভাবলো, আমাদের নিজেদের ঈমানের কতটা ক্ষতি হলো - সেটা আমাদের চিন্তার রাডারের বাইরে।
যাহোক, টানা তিন দিন ধরে মারইয়াম কে কাউন্সিল করার পর ফাইনালি মারইয়ামের আম্মুর মেসেজ আসলো!! আলহামদুলিল্লাহ্ আল্লাহর রহমতে মারইয়াম এখন স্কুলে রেগুলার হিজাব পড়ে যাচ্ছে। কেউ উল্টা-পাল্টা কিছু বললে মারইয়াম একটু আপসেট হয়, কিন্তু হিজাব সে ছাড়বে না। একটু পরে মারইয়ামের মেসেজ আসলো, “Thank you sister Sharin!” মারইয়ামদের বাসায় আমার দাওয়াত!
বিষয়: বিবিধ
১০৫২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন