দ্য ট্যাট্টুড ম্যান

লিখেছেন লিখেছেন শারিন সফি অদ্রিতা ০১ জানুয়ারি, ২০১৮, ১০:২২:৪৮ রাত

ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি পৌনে চারটা বাজে। হাদিস ক্লাস শুরু চারটা থেকে। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। যা সামনে পেলাম গায়ে সেটা জড়িয়ে, কোনমতে হিজাব পেঁচিয়ে গাড়ির চাবিটা নিয়ে দিলাম দৌড়। দেরি করে গেলে মসজিদের সামনে পার্কিং পেতে ঝামেলা! পৌঁছে, গাড়ি পার্ক করে দেখি সিস্টার রিদানাহ্‌ চলে এসেছেন। সবাই উনাকে গোল করে বসে আছেন। সিস্টার রিদানাহ্‌ আমাদের হাদিস পড়ান। আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে বললেন, “আহলান ওয়া সাহলান শারিন!” আমিও হেসে সালাম দিয়ে বসে পড়লাম, যাক ক্লাস এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি তাহলে। সিস্টার রিদানাহ্‌ আমাদেরকে উনার কাজের গল্প শোনাচ্ছিলেন। উনি একটা ট্যাক্স কালেক্টর অফিসে কাজ করেন। সেখানে বিভিন্ন কিসিমের মানুষ আসে-যায়! কেউ ভদ্র, কেউ উগ্র, কারো এত টাকা যে রাতে ঘুমাতে পারেনা, আবার কারো গ্যাস ভরার টাকাটাও ব্যাঙ্ক থেকে লোন করে নেওয়া! তেমনি এক ক্লাইন্ট এর গল্প বলছিলেন আমাদেরকে। এক মধ্যবয়স্ক লোকের কথা। তাকে দেখলে দুবার চোখ ফেরানো লাগে এমন। সারা শরীর তার ট্যাটু দিয়ে ভর্তি, হাতের এক কোষ জায়গাও বুঝি খালি নেই। কানে দুল, নাক ফোঁড়া, ভ্রু-র ফাঁকেও ফুটো করে অলংকার গোঁজা। “দেখলেই মনে হয় উল্টা দিক ধরে দৌড়ে পালাই” – বলে হাসলেন সিস্টার, “কিন্তু সে যখন আমাকে তার কাহিনীটা বলা শুরু করলো, আমার হাত-পায়ের লোম সব খাঁড়া হয়ে গেল”।

তো কাহিনী হচ্ছে, সিস্টারের এই ক্লাইন্ট একদিন ক্লাব থেকে ড্রিঙ্ক করে আসতে আসতে ডাস্টবিনে একটা ছোট্ট ঝুড়ি খুঁজে পায়। সুবহানআল্লাহ্‌ ঝুড়ি খুলে দেখে একটা ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা! কি সুন্দর লাল গাল বেয়ে হাসি ঝড়ে পরছে! আশেপাশে আর একটা মানুষও নেই, কোন চিঠি, ঠিকানা-পত্র কিচ্ছু নেই। বুঝতে বাকি রইলো না; না জানি কোন দুই অভাগার পাপের ফল ভুগছে এই বাচ্চাটা। বাচ্চাটা লোকটার আঙ্গুল ধরে খুব করে একটা হাসি দিলো। যতই পাগলাটে সে হোক না কেন, এভাবে একটা ফুটফুটে জানকে রাস্তার মাঝে ডাস্টবিনে তো ছেড়ে যেতে পারে না। সে বাচ্চাটাকে বাসায় নিয়ে আসলো! সে তখনো জানতো না যে এই বাচ্চা তার দুনিয়া পাল্টে দিবে। তার নিজের জীবন টাই যেখানে বিশাল এক মেস- জঞ্জাল! একা একা থাকে, ড্রিঙ্ক করে, কোনমতে খায় তো খায় না, এই জব আছে তো জব নেই। নিজেকেই টেক-কেয়ার করতে পারেনা, সেখানে একটা বাচ্চাকে কিভাবে টেক-কেয়ার করবে সে!! সবার আগে লোকটা আরেক শহর থেকে তার আম্মুকে ডেকে নিয়ে আসলো বেবির জন্যে। কিভাবে বাচ্চাটাকে সে এত ভালোবেসে ফেললো। আস্তে আস্তে মার কাছ থেকে ডাইপার চেঞ্জের আর লোলাবাইয়ের ট্রেইনিং নিতে লাগলো।

এখন সে কোর্ট থেকে কোর্টে দৌড়ে বেড়াচ্ছে বেবিকে Adopt করে Legal Guardian হবার পারমিশানের জন্যে। তার তো যে অবস্থা; কোর্ট এত সহজে তাকে Guradian হবার পারমিশান দিবে না। সে নিজেকে Change করার যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভবঘুড়ের মতন ড্রিঙ্কিং আর ক্লাবিং ছেড়ে দিচ্ছে। চুল-টুল কেটে, কোট টাই পড়ে ভালো ভালো জবের Interview দিচ্ছে। কোর্টে তাকে Parent হিসেবে Competent দেখানোর জন্যে যা যা করা লাগবে, সে যথাসাধ্য করে যাচ্ছে। মিনিমাম ইনকাম দেখাতে ট্য্যক্সের ডকুমেন্ট লাগবে, তাই আজকে ট্যাক্স কালেক্টর অফিসে হাজিরা দিতেও চলে আসছে। এত ঝামেলা করে, এতকিছু করছে সে- কিসের জন্যে? একটা বেবির জন্যে, যাকে কিনা সে চিনেনা, জানেনা, কোনদিন দেখেওনি আগে! সে কিন্তু চাইলে একটা Orphanage এ দিয়ে আসতে পারতো বেবিটাকে। সুবহানআল্লাহ্‌ এত ভালোবাসা আর এত মায়া এই মানুষটার মধ্যে যে আছে, তাকে প্রথম দেখেই সেটা কে বুঝবে!

সিস্টার রিদানাহ্‌ বলে যেতে লাগলেন, এই মানুষটাকে প্রথম দেখেই আমার কেমন নাক সিঁটকানো ভাব চলে আসছিল, অথচ তার কাহিনী শুনে তার প্রতি আসে সেরকম রেসপেক্ট !! সিরিয়াসলি আমরা বাইরে থেকে কাউকে দেখেই এত কুইকলি একটা জাজমেন্ট করে ফেলি যে এটা Almost একটা sickness এর মত হয়ে গেছে! অথচ আমরা কিছুই জানিনা কার লাইফে কি হচ্ছে না হচ্ছে, অথচ জাজমেন্ট পাস্‌ করতে আমাদের কোন দেরি নেই।

“ডু নট জাজ মি” বলে হাসতে হাসতে এমন জাজমেন্টাল কমেন্ট করে ফেলি যে, যাকে বলছি তার কত খারাপ লাগছে, একবারো ভাবিনা। কেউ নামাজ পড়ছে না, ধর্ম-কর্ম করছে না আর আমি হিজাব করি-নামাজ পড়ি দেখি আমি ভাবি, আমি তার থেকে খুব ভালো। অথচ, আমি কি জানি হিজাব না পরা নামাজ না পড়া মানুষটা বন্ধ দরজার পিছনে কি কি ভালো কাজ করে যাচ্ছে আল্লাহর জন্যে? তোমাকে দেখিয়ে তো সবাই সবার ভালো কাজ করবেনা। তার ভালো ব্যবহারের নেকী হয়তো আল্লাহ্‌র কাছে তোমার ট্রেনের গতিতে পরা নামাজের থেকে বেশি ভারী, তুমি তো সেটা জানো না!” সিস্টার রিদানাহ্‌ একটু থামলেন, তারপর বললেন, “আবার ভেবো না আমি বলছি, নামাজ না পড়ে, হিজাব না পড়ে, ট্যাট্টু লাগিয়ে সবাই অনেক ভালো হয়ে যাচ্ছে, সেটা অবশ্যই না, আল্লাহকে চিনা মাস্ট, নামাজ মাস্ট! কিন্তু সেটা তো আল্লাহ এবং তার মধ্যের ব্যপার, তুমি-আমি কেন তাকে বাজে ভাবে জাজ করে তাকে আরো ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি?

আমাদের মহানবী(সাঃ) সবার মধ্যে সবচেয়ে বেস্ট কোয়ালিটিটা দেখতেন এবং সেভাবেই তাদের ভালোটাকে আরো ভালো করার ট্রেইনিং দিতেন। সাহাবীরা যদি দেখতেন কারো দাড়ি থেকে মদের ফোঁটা বেয়ে বেয়ে পড়ছে, তাহলে ভাবতেন যে ঝগড়া করতে গিয়ে হয়তো কেউ তার মুখে মদ ছুঁড়ে মেরেছে, এটা প্রথমেই ভাবতেন না যে সে মদ খেয়ে টাল হয়ে এসেছে! মুসলিমরা ভাই ভাই একজন, আরেকজনের জন্যে সমানে Excuse বের করতেন যে, আচ্ছা সে আমার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করলো কেন? মেইবি বাসায় বৌয়ের সাথে ঝগড়া করে এসেছে, কে জানে মেইবি তার মা হস্পিটালে অসুস্থ, তাই আজকে তার মুড অফ, তাই চিল্লাচ্ছে, থাক আমি এটা ভুলে যাই, লেট ইট গো! সাহাবীদের সুন্দর চিন্তা আর কোমল আচরণ দেখেই মানুষজন মদ খাওয়া, ধাপ্পাবাজি সব বাদ দিয়ে তাদের সাথে ইসলাম গ্রহণ করতেন! Their characters preach louder than their words. আর আমরা কি করি? অজুহাত বের করা তো দূরে থাক, একটা ভুল দেখলেই আর তাকে আমাদের সহ্য হয়না। এক গাদা পরনিন্দা করে, রেডিও বাংলাদেশে ছড়িয়ে, কথা শুনিয়ে শুধু শুধু Negative Vibes ছড়ানো! কি দরকার ভাই? দুই দিনের দুনিয়া, এই আছি তো এই নেই, সবাই মিলেমিশে থাকলে ক্ষতি কিসের?

সবাইকে সবার জায়গা থেকে accept করে চলবে। সবাই তোমার মত চিন্তা করবেনা, সবাই হয়তো তোমার সাথে একমত হবে না, তাই বলে সবাই খারাপ হয়ে যায় না। মহানবী(সাঃ) এর সাহাবীদের মতন সবার ভালোটাতে ফোকাস করবে, এবং খারাপটার জন্যে হিকমাহ্‌ সহ বুঝিয়ে বলবে। সে বুঝলে আলহামদুলিল্লাহ্‌, না বুঝলে আল্লাহ্‌র কাছে তার জন্যে দুয়া করবে। এই তো আর কি। এত রাগারাগি, ঝগড়া-ঝাটি করে কি হাসিল হল? আল্লাহ্‌ তা’আলার সামনে তো একদিন সবাইকেই দাঁড়াতে হবে এবং সমস্ত ঝগড়া-ঝাটি আর গীবতের হিসাব দিতে হবে, তখন কি বলবো আমরা আল্লাহ্‌কে, যে নিজের ইগোর জন্যে সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম?”

আহ্‌!! সিস্টার রিদানার কথাগুলি আমার কাছে ম্যাজিকের মত লাগে। কিভাবে এক ঘন্টা পাড় হয়ে গেল টের-ই পেলাম না! যাক শারিন, ভাগ্যিস ঘুমটা ভাংসিল, নাহলে এমন একটা জেম মিস্‌ হয়ে যেত আলহামদুলিল্লাহ্‌! Happy

লোকটা নাকি মাঝে মাঝেই এসে সিস্টার রিদানাকে খুব আনন্দে তার বেবি গার্লের ছবি দেখায়। দুয়া করি আল্লাহ যেন তাকে কোর্টে সাক্‌সেস দেন এবং তাকে এবং আমাদের সবাইকে আলটিমেট হিদায়াত দেন! আমিন Happy

বিষয়: বিবিধ

৯০৯ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384633
০৩ জানুয়ারি ২০১৮ রাত ০২:০২
মনসুর আহামেদ লিখেছেন : চমৎকার আপু। আমেরিকার প্রায় স্টেটে
ল রয়েছে। বাচ্চা যেখানে সেখানে রেখে আসার অধিকার নেই। একমাএ Hospital,
Fire service station ছাড়া, এখানের সবাই তো এই কর্ম কান্ডে জড়িত।
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সকাল ০৭:২৯
317324
শারিন সফি অদ্রিতা লিখেছেন : জ্বী ভাইয়া অনেক দুঃখ জনক! সময় নিয়ে লিখাটি পড়ার জন্যে এবং কমেন্ট করার জন্যে ধন্যবাদ। জাঝাকাল্লাহু খইর। Good Luck
384636
০৩ জানুয়ারি ২০১৮ রাত ০৯:১৪
সত্যলিখন লিখেছেন : নাতি অনেক মূল্যবান ও শিক্ষনীয় পোস্ট।
তবে ব্লগে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ চলছে কেন? জ্ঞানী ব্লগারদের দেখা যাচ্ছে না।
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সকাল ০৭:৩০
317325
শারিন সফি অদ্রিতা লিখেছেন : সেটাই ভাইয়া! ব্লগে যাদের লিখার জন্যে দিন গুনে অপেক্ষা করতাম, সবাই কোথায় হারিয়ে গেলো কে জানে। হালিমা আপু, রেহনুমা আপু সহ, মিশু - ওদের সবাইকে অনেক মিস্‌ করি। আপনার যদি দেখা হয়, আমার সালাম দিবেন!
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সকাল ০৭:৩১
317326
শারিন সফি অদ্রিতা লিখেছেন : প্লাস্‌ ব্লগের মডারেটর এর ও কোন খবর নেই। লাস্ট কবে তিনি নির্বাচিত পোস্টে ভালো কোন পোস্ট দিয়েছেন, কোন ঠিক নাই!
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সকাল ০৭:৩২
317327
শারিন সফি অদ্রিতা লিখেছেন : দুয়া করছি আল্লাহ সুবহানুতা'আলা যেন ব্লগের দুর্ভিক্ষ শিঘ্রী দূর করে দেন! আমিন

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File